বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে আমরা প্রচুর অপবিজ্ঞান আর ছদ্মবিজ্ঞানকে সরিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছি। অপবিজ্ঞান আর ছদ্মবিজ্ঞান সব সময়ই ছিল- এবং থাকবে। মানবকেন্দ্রিক আর ধর্মীয় কারণে আমরা অনেক সময় স্বচ্ছ এবং শুদ্ধ বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে ফেলি। আর সেটার প্রভাব অনেক বিস্তৃত। এই লেখায় চেষ্টা করবো প্রচলিত কিছু অপবিজ্ঞান আর ছদ্মবিজ্ঞানে কথা তুলে ধরতে চেষ্টা করবো।
Creationism বা Young Earth Creationism- আইরিশ আর্চ বিশপ জেমস আশার ৫০০/৬০০ বছর আগে বাইবেলে বর্ণিত “begets” বা মানুষের জন্মসাল হিসাব করে বলেন পৃথিবীর (সাথে মহাবিশ্বেরও, কারণ বাইবেলের গড পৃথিবী আর মহাবিশ্ব একই দিনে সৃষ্টি করার কথা বলা আছে) বয়স ৬,০০০ বছরের বেশী না। বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে আমরা জেনেছি এই ধারনা পোষণ করা আমেরিকার আয়তন ১৭ ফিট বলা একই মাপের ভুল। তবে এখনো মানুষ এটা বিশ্বাস করেন- কারণ তাদের পূর্বধারণকৃত চিন্তা তাদের বিকল্প (আর আসল) সংখ্যাটা জানতে দেয় না । But that’s not the funny part.
কেন হ্যাম, অস্ট্রেলিয়ান আমেরিকান সৃষ্টিতত্ত্ববিদ যিনি সেই বিশ্বাসীদের মধ্যে একজন, তিনি বিশ্বের প্রথম সৃষ্টিতত্ত্ব জাদুঘর বানিয়েছেন কেন্টাকীতে- যেখানে তিনি ডাইনোসরদেরও রেখেছেন। কারণ বৈজ্ঞানিক সত্য তিনি অস্বীকার করতে পারেন না- ডাইনোসরের ফসিল পাওয়া যাওয়াটা বৈজ্ঞানিক সত্য। আর তিনি মনে করেন- যেহেতু বাইবেলে বলা আছে মহাবিশ্বের বয়স ৬,০০০ বছর আর যেহেতু ডাইনোসররা ছিল (যদিও ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে) সেহেতু ডাইনোসররা নিশ্চয়, কোনো একসময় মানুষের সাথে বেঁচে ছিল! But that’s not the funny part.
তাঁর জাদুঘরের প্রদর্শনীতে থাকা ডাইনোসরের গায়ে তিনি saddle বসিয়ে দিয়েছেন- কারণ- obviously সর্ববৃহৎ আর হিংস্র সরীসৃপরা পৃথিবীতে আমাদের সাথে থাকবে আর আমরা তাদের পিঠে চড়ে বেথেলহেম আর নাজারেথের বাজার থেকে সবজি কিনতে যাবো না, সেটা কিভাবে হয়! But that’s not the funny part.
দুঃখিত, ছবিটি ভুল, আসল ছবি হচ্ছে এটি-
কেন হ্যাম সহ অন্য সৃষ্টিতত্ত্ববিদদের অকাট্য যুক্তি- “অবশ্যই ডাইনোসররা আমাদের সাথে বেঁচে ছিল – না হলে প্রায় প্রতিটা সংস্কৃতিতে ড্রাগনের উপস্থিতি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?”। ফসিল বিজ্ঞানীরা যদিও এখনো কোনো ড্রাগনের ফসিল পান নি, তবুও- অসাধারণ এই যুক্তির জবাবে উড়ুক্কু ঘোড়া পেগাসাস, অর্ধষাঁড়-অর্ধমানব মিনোটর (Minotaur), আর ঘোড়া মানব সেন্টরের (Centaur) ফসিল পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। But that’s not the funny part!
কেন হ্যাম মনে করেন বিগ ব্যাং ১৩.৭২ বিলিয়ন বছর আগে হয়েছে কিনা সেটা প্রশ্নবিদ্ধ কারণ বর্তমানের কোনো বিজ্ঞানী বিগ ব্যাং ঘটতে দেখেননি! তবে…তবে…তবে… তিনি জানেন, ফ্যাক্ট হিসেবে- মানুষ ডাইনোসরের পিঠে চড়ে বেড়াতো। কারণ? বাইবেল! অথচ বাইবেলে বহু দানব রাক্ষসের কথা থাকলেও ডাইনোসরের কথা নেই। আয়রনি আর কাকে বলে!
Ancient Aliens- “এলিয়েনরা আমাদের পৃথিবীতে অতীতে এসেছিল আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছিল, এখনও আসে তবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে না।”
আমাদের বিজ্ঞান সম্পর্কে যতদুর প্রমাণলব্ধ ধারণা হয়েছে তা থেকে আমরা বলতে পারি আমাদের আশেপাশে অন্য কোনো গ্রহে আমাদের মত প্রাণ নাই। তারপরও কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন আমাদের প্রজাতি (শুধু মানুষ) এসেছে অন্য কোন গ্রহ থেকে। উনারা মনে করেন সেটা মঙ্গল গ্রহ হতে পারে।
প্রমাণ?
-“এর প্রমাণ হচ্ছে বৃদ্ধ বয়সে বাতের সমস্যা!”
কিভাবে?
-“কারণ আমাদের জন্ম গ্রহের ম্যাধ্যাকর্ষণ বল পৃথিবী ম্যাধ্যাকর্ষণের চেয়ে ভিন্ন।”
তাহলে বাতের সমস্যা জন্মের পর পর কেন হয় না?
-“কারণ বাতের তথ্যটা জেনেটিক- বার্ধক্যে কাজ করার জন্য তৈরি।”
এসব কথার উত্তরে, খুব ভাব নিয়ে- “ও, আচ্ছা” বলা ছাড়া আর কোনো শব্দগুচ্ছ আছে বলে আমার মনে হয় না।
Ancient Alienদের আরেকটি ভাগ আছে- যারা মনে করে মিশরের পিরামিড বানাতে এলিয়েনরা সাহায্য করেছিল।
কারণ? কারণ তারা জটিলতা এড়িয়ে রহস্যাবৃত উত্তর বেশী পছন্দ করেন। এই ভাবনা কিছু চিন্তার জন্ম দেয়- যেমন-
১) খুফুর পিরামিড বানাতে ২০,০০০ শ্রমিক ২ যুগ কাজ করেছিলেন- বলে গ্রীকরা নথিবদ্ধ করে রাখে। তারা কি এলিয়েনদের কথা জানতো না?
২) অতি উন্নত সভ্যতার (৪,৫০০ বছর আগে যেহেতু তারা আন্তঃনক্ষত্র যাত্রা করতে সক্ষম ছিল) কিছু প্রাণীর সহায়তায়ও পিরামিড বানাতে ২০,০০০ শ্রমিক আর ২ যুগ সময় কেন লাগবে?
৩) যদি এলিয়েন ছাড়া অন্য কোনো ভাবে পিরামিড বানানো অসম্ভব হয়ে থাকে- তবে কেনো পিরামিড বানানোর পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম খুফুকে অত্যাচারী শাসক হিসেবে জানতো?
৪) ২ যুগ আমাদের মাঝে থাকা এলিয়েনদের কোন ট্রেইস পাওয়া যায় না কেনো?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে তারা বলেন- “এটা এমনভাবে করা হয়েছে যেন কোন প্রমাণ না পাওয়া যায়।”
এনসিয়েন্ট এলিয়েনবাদীরা এমনই দূরে চলে গিয়েছেন যে তারা চাঁদে এলিয়েন থেকে শুরু করে মঙ্গলে পিরামিড-মহিলা হয়ে বুদ্ধের প্রতিমা পর্যন্ত দেখে ফেলেছেন!
Astrology- যদি ভ্রান্ত ধারণার কোনো প্রতিযোগিতা করা হয়- এস্ট্রলজি বা জ্যোতিষবিদ্যা নিঃসন্দেহে প্রথম তিনের মধ্যে থাকবে। এস্ট্রলজির কেন্দ্রীয় ধারণা হচ্ছে মহাশূন্যের নক্ষত্রগুলোর মাঝে কিছু নকশা আছে যেগুলো কিছু ছবি বানায়- যেমন সিংহ, মেষ, বৃষ, কাকড়া, মাছ ইত্যাদি। সেই নক্ষত্রপুঞ্জের প্রভাবে মানুষের জীবন প্রভাবিত হয়।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যখন আপনি জানবেন আকাশের সিংহ মাছ বৃষরা আসলে পরস্পর থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তারা, আর এসব ত্রিমাত্রিক জগতের বস্তুকে দুই মাত্রায় বন্দী করে আঁকা ছবিগুলো আমরা দেখছি।
এস্ট্রলজিকে চ্যালেন্জ করে অনেক কাজ করা হয়েছে- মহান শিক্ষক কার্ল সেগান থেকে শুরু করে কুসংস্কার হন্তা যোদ্ধা রিচার্ড ডকিন্স হয়ে মানুষকে প্রতারিত করা যাদুকর থেকে যাদুকরদের মানুষকে বোকা বানানোর পদ্ধতি ফাঁস করা জেমস “দ্যা এম্যাজিং” রান্ডি এস্ট্রলজিকে চ্যালেন্জ করেছেন এবং প্রমাণসহ দেখিয়েছেন এটা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই না। (I will highly recommend An Honest Liar to everyone.)
রান্ডী একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে গিয়ে সবার ঐদিনের রাশিফল লেখা একটি কাগজ দেন- রাশিফলের মিলে যাওয়ার ভিত্তিতে তাতে ১ থেকে ১০ এর মধ্যে নাম্বার দিতে বলেন। প্রায় সকলেই রাশিফলের সাথে ঐদিনের মিল পেয়েছিলেন। পরে ছাত্ররা মিলিয়ে দেখলেন সবাইকে একই লেখা সম্বলিত কাগজ দেয়া হয়েছিল। তাদের রাশি অনুযায়ী সে লেখা অন্য রাশির সাথে মিলার কথা না, তবু সবাই নিজের জীবনের সাথে মিল খুঁজে পেয়েছিলেন সেই রাশিফলে!
রিচার্ড ডকিন্স একধাপ এগিয়ে The Observer পত্রিকার astrologer Neil Spencerকে এস্ট্রলজির কার্যকারিতার ব্যাপারে চ্যালেন্জ করে বসেন। Spencer খুব কষ্টে সেই চ্যালেন্জ থেকে বের হয়ে আসেন। ডকিন্স মনে করেন- যদি জন্মস্থান বিবেচনায় মানুষের চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করা- যেমন- আফ্রিকানরা দাস, জার্মানরা অসভ্য, ভারতীয়রা ওঝা, এগুলো বর্ণবাদী আচরণ, জন্মকালের বিবেচনায় মানুষের চরিত্রের stereotype করাও বর্ণবাদী আচরণ।
সেগান জানতে চান- কিভাবে কোনো গ্রহ বা নক্ষত্র কারো জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে? ধরুন মঙ্গলের গ্রাভিটি পৃথিবীতে প্রভাব ফেলতে পারে, বৃহস্পতি আর বুধের গ্রাভিটি কক্ষপথে হালকা পরিবর্তন ঘটায় যা বরফযুগের কারণ হয়। কিন্তু সেটা পুরো পৃথিবীতে হয়। গ্রাভিটি ব্যক্তিগত বল না, মহাজাগতিক বল।
এখানে special pleading হেত্বাভাস আছে, হয় আপনি এস্ট্রলজিতে বিশ্বাস করেন আর না হয় এস্ট্রলজি বোঝেন না। আপাতদৃষ্টে- রাশিগনকদের উত্তর দেয়ার অপারগতা থেকে বোঝা যায় তারা নিজেও এস্ট্রলজি কিভাবে কাজ করে সেটা বোঝেন না।
মজার ব্যাপার হচ্ছে টলেমির সময়ে এস্ট্রলজির “উদ্ভাবনের” পরে আমরা টলেমির মহাবিশ্বের মডেল আর স্থির মহাবিশ্বের মডেল ভুল প্রমাণিত করতে পেরেছি- তবে এস্ট্রলজি এখনো তেলাপোকার মত টিকে আছে মানুষের অপজ্ঞানে।
Faith Healing- পশ্চিমে টেলিভান্জেলিস্ট বলে একটা গ্রুপ আছে যারা টেলিভিশন প্রোগ্রাম করে ধর্ম প্রচার করেন, তাদের একটা অংশ হচ্ছে এই ফেইথ হিলার বা বিশ্বাস প্রতিকারকরা।
তারা মানুষকে বলতে চান, বিশ্বাসের জোরে ক্যান্সার-আলসার-রক্তচাপ-এইডস ইত্যাদি রোগের প্রতিকার সম্ভব। “Let Jesus enter your body to let diseases go away.” টাইপ স্লোগান নিয়ে তারা মানুষকে বোকা বানান।
অপবিজ্ঞানরোধী মানুষের নাম আসলে কার্ল সেগানের পরের অবস্থানে থাকবেন ম্যাজিশিয়ান জেমস “দ্যা এম্যাজিং” রান্ডী। অপবিজ্ঞানবিরোধী তাঁর মুভি “দ্যা অনেস্ট লায়ার” অনেকগুলো অপবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা করেন এবং ভুল প্রমাণ করেন।
১৯৮৬ সালে ফেইথ হিলার Peter Popoff এর অনুষ্ঠানে Popoff যখন দৈবিকভাবে দর্শকদের অসুস্থতার কথা বলতে থাকেন তখন সবাই বিমোহিত হলেও ছদ্মবেশে থাকা রান্ডী জানতেন এখানে কোন না কোন চাল আছেই। পরের অনুষ্ঠানে তিনি রেডিও প্রযুক্তি ব্যবহার করে জানতে পারলেন Popoff নিজস্ব রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে তার স্ত্রীর কাছ থেকে তথ্য পাচ্ছিলেন যে তথ্য দর্শকরা আগে ফর্মে লিখে রেখে ঢুকেছিলেন। তার স্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য Popoff এর কানে লুকানো হেডফোনের মাধ্যমে শুনে-বলে সবাইকে চমকে দিচ্ছিলেন। রান্ডী এই তথ্য ফাঁস করার পর Popoff দেউলিয়া হয়ে যান। আর এজন্য Popoff এর ভক্তরা রান্ডীকে ঘৃণা করতে শুরু করলেন- যেন তারা বোকা বনে থাকতে মজা পাচ্ছিলেন!
আজ এ পর্যন্তই পরবর্তীতে নতুন কিছু অপবিজ্ঞান নিয়ে হাজির হবো।
অনেক কিছু জানলাম,
কিন্তু হিস্ট্রি চ্যানেলে এ্যানসেন্ট এলিয়েনের উপর অনুষ্টান দেখানো হয়, যেটা ভ্রান্ত, তারপরো দেখানো হয়, খারাপ লাগে কিন্তু কিছুই করার থাকে না কারণ,
আবার ডিসকবারি চ্যানেলে দ্যা হন্টিক নামে একটি ভৌতিক নাটক দেখানো হয়, যেটা অলৌকিক ভূত, আত্মা, অশরীর নির্বর,
কিন্তু এই টিভি চ্যানেলে তো যোক্তিক বিজ্ঞান ভিত্তক, তারপরো কিভাবে এসব আজগুবি বিষয় প্রচার করে বুঝিনা!
তাই আপনার এই পোস্টের ধারাবাহিকতা চায়ছি,
ধন্যবাদ লেখককে
ধন্যবাদ চন্ডাল। জ্বি ইচ্ছা রয়েছে আরেকটা পর্ব করার। বিজ্ঞানের সাথে থাকুন। 🙂 শুভ কামনা।