জীবাণুর সাথে লড়াই করার কথা লুই পাস্তরের* (Louis Pasteur এর) মাথায় কী করে এলো বলছি।
* নামটার উচ্চারণ আসলে পাস্তঘ্র-এর কাছাকাছি, ভদ্রলোক ফ্রেঞ্চ ছিলেন কিনা। তাই, নিচে যতবারই পাস্তর লিখবো, ততবারই নিজ গুণে সেটাকে পাস্তঘ্র পড়ে নেবেন।
তখন এক ব্যাটা হাতুড়ে ডাক্তার রটিয়ে বেড়াচ্ছিলো যে এনথ্রাক্স রোগের চিকিৎসা নাকি সে বের করেছে। পাস্তর জানতেন এ রোগের আসল কারণ এক রকম ক্ষুদে জীবাণু। সেই ব্যাটা হাতুড়ে ডাক্তার ক্ষুদে জীবাণু এর কোন খবর এ জানেনা, চিকিৎসা করবে কী! তবু পাস্তর ভাবলেন দেখেই আশা যাক না লোকটার ব্যর্থ চেষ্টা। দেখতে গিয়ে তো পাস্তরের চক্ষু স্থির! এক্কেবারে বীভৎস ব্যাপার! লোকটা করে কী, অসুস্থ গরুর গা থেকে খানিকটা দূষিত রক্ত বের করে দেয়! তারপর বেচারার চামড়া ফুটো করে খানিক তার্পিন তেল ঢালে ,তারপর অতি দুর্গন্ধ যুক্ত এক মলম গরুটার গায়ে এক ইঞ্চি পুরু করে মাখিয়ে তার উপর চট ঢাকা দিয়ে ফেলে রাখে।
পাস্তর স্পষ্টই বুঝলেন এমন চিকিৎসা সত্ত্বেও যে গরু প্রাণে বাঁচে তার কপালের জোর অসামান্য। ডাক্তারের চোখে আঙ্গুল দিয়ে কথাটা দেখিয়ে দেয়ার জন্য তিনি জোগাড় করলেন গোটা চারেক গরু। তাঁর সঙ্গেই শিশির ভেতরে ছিল এনথ্রাক্স এর জীবাণু। সেই জীবাণু ফুঁড়ে দিলেন গরু গুলোর গায়ে। পরের দিন দেখা গেল চারটে গরু ধুঁকছে। তাদের শরীরে এনথ্রাক্স এর লক্ষণ। তখন পাস্তর বললেন, “ওহে ধন্বন্তরী ডাক্তার, এর মধ্যে দুটো গরুর উপর তোমার কেরামতি দেখাও দেখি” বাকি দুটোকে ছেড়ে দাও নিয়তির হাতে। দেখা গেল নিয়তির হাতে ছাড়া দুটো গরুর মধ্যে একটি বাঁচলো, একটি মরলো। আর ডাক্তারের হাতে ছাড়া দুটো গরুর মধ্যে একটি বাঁচলো, একটি মরলো। পাস্তর বললেন “বুঝেছো ব্যাপার? এ রোগ হলে যে গরু অক্কা পায় তাঁর প্রমাণ নেই। কেউ বাঁচে, কেউ মরে।। কিন্তু যেগুলো বাঁচে স্রেফ কপালের জোরে। সেগুলোর জন্য তোমার হাত-যশ নেই। তারা বাঁচে স্রেফ কপালের জোরে।এই দেখে হাতুড়ে ডাক্তারের ঘাড় হেঁট, মুখ দিয়ে কথা বের হয় না।
“কিন্তু যে গরু বেঁচে গেলো সে দুটোকে নিয়ে কী করা যায়? তিনি ভাবলেন দেখাই যাক না পরীক্ষা করে। শহরে নিজের ল্যাবরেটরি থেকে আনিয়ে নিলেন এনথ্রাক্স এর সবচেয়ে কড়া জীবাণু। আর প্রচুর পরিমাণে ফুঁড়ে দিলেন এই জীবাণু গরু দুটোর গায়ে। এত তীব্র সে জীবাণু এতখানি করে ফুঁড়ে দিলেন যে দুনিয়ার সবচাইতে শক্তিশালী গরুদের পক্ষে তা হজম করা কঠিন হয়ে যেত। কিন্তু দেখা গেল গরু দুটি নির্বিকার, মরবার নামটি পর্যন্ত নেই উল্টা হাম্বা হাম্বা করছে! ব্যাপার কী!
পাস্তর ভাবতে শুরু করলেন। ভাবতে ভাবতে তাঁর মনে হল, এমন তো হতেই পারে যে যে জন্তুর একবার এ রোগ হয়েছে তার দ্বিতীয় বার এ রোগ হওয়ার সম্ভবনা নেই। প্রথমবার রোগ হওয়ার পর যে জীবাণু ঢুকেছিল সেগুলোই ভিতরে পোষ মেনে যায়। তাই দ্বিতীয়বার জীবাণুরা আক্রমণ করলে তারা এমন বন্দোবস্ত করে রাখে যাতে নতুন জীবাণু তাদের কে পরাজিত করতে না পারে।তাই যদি সত্যি হয় তাহলে পাস্তর ভাবতে লাগলেন এ জীবাণুদের সাথে যুদ্ধ করার একটি উপায় বের করা যাবে। একবার যদি কারো গায়ে অল্প একটু জীবাণু ফুঁড়ে দেয়া যায়, তাহলে হয়তো প্রথমে তার জন্য তার একটু অসুখ করতে পারে, কিন্তু পরে এই জাতের জীবাণু তাকে পরে আর কাবু করতে পারবে না।
অবশ্য বিজ্ঞানের কোনো আবিষ্কার রাতারাতি করা যায় না। বহুদিন ধরে, বহু পরিশ্রম করে, অনেক মাথা খাটিয়ে, অনেক পরীক্ষা করে, তবেই আবিষ্কার করা সম্ভব। পাস্তরকেও তাই করতে হয়েছিল। তখন তিনি বুক ফুলিয়ে প্রচার করলেন তিনি এনথ্রাক্স এর টিকা বের করেছেন । এই টিকা একবার গরু ছাগলের শরীরে ফুঁড়ে দিলে আর কখনই এনথ্রাক্স হবেনা। কিন্তু মানুষ এত সহজে তাঁর কথা মানতে চাইলো না।
চার দিকে একেবারে হইচই পড়ে গেল। পাস্তর নাকি সবাইকে এমন এক ভেল্কি দেখাবেন যা আগে মানুষ কখনই দেখেনি। দুটো তাঁবু ফেলা হল। প্রত্যেক তাঁবুতে একদম করে গরু ছাগল। চারিদিকে অজস্র মানুষের কৌতূহলী চোখ। পাস্তর তাঁর দলবল আর সাজ সরঞ্জাম নিয়ে ঢুকলেন প্রথম তাঁবুতে। সে তাঁবুর প্রত্যেকটা জানোয়ার এর গায়ে ইঞ্জেকশান দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন এনথ্রাক্স এর দুর্বল, পুরনো, পোষমানা জীবাণু। এই জানোয়ার গুলোকে আলাদা করার জন্য প্রত্যেকের কানে ফুঁটা করে দিলেন। দ্বিতীয় তাঁবুর জানোয়ার গুলোকে কিছুই করা হলনা।তারপর ১২ দিন কেটে গেল। ইতোমধ্যে প্রথম তাঁবুর জানোয়ার গুলোর সামান্য রোগ দেখা দিল, মারাত্মক কিছু নয়। এর পর পাস্তর আবার প্রথম তাঁবুর জানোয়ার গুলোকে দ্বিতীয় দফা ইঞ্জেকশান দিলেন। এবার দিলেন আগের বারের চেয়ে একটু কড়া জীবাণু। কিন্তু এবার আর তাদের কিছুই হলো না।
তারপর এল চরম পরীক্ষার দিন। পাস্তরের সাঙ্গপাঙ্গ দের তো ভয়ে বুক ধরফর করছে। যদি সফল না হয় পরীক্ষা? পাস্তরের চেহারাও গম্ভীর। জীবনে মনে হয় এত গম্ভীর কোনদিন হননি। যাই হোক একেবারে দুর্ধর্ষ জীবাণুর বোতল হাতে করে তাঁরা ঢুকলেন এবং দুটি তাঁবুর সবগুলো গরুর গায়ে সেই মারাত্মক জীবাণু ফুঁড়ে দিলেন।
এর পর কাটল তিন দিন। ফ্রান্সের অনেক গণ্যমান্য লোকের ভিড়। খবরের কাগজের লোকজন ঘন ঘন ঘুরছে। দুপর ২টা নাগাদপাস্তর তাঁর দলবল নিয়ে ছুটলেন তাঁবুর দিকে। প্রথম তাঁবু খোলা হল। একটা জানোয়ার এর ও রোগের কোন লক্ষণ নেই। দিব্যি প্রাণের ফুর্তিতে ফোঁৎ ফোঁৎ করছে। দ্বিতীয় তাঁবু খোলা হল। মাত্র ২-১ টা জানোয়ার একটু আধটু ধুঁকছে। বাকিগুলোর মৃতদেহ মাটিতে। প্রথম তাঁবুর জানোয়ার বাঁচল কেমন করে? নিশ্চয় আগে দুর্বল জীবাণু ঢুকানো হয়েছিল তাই।
লুই পাস্তর! লোকটা কি জাদুকর? লুই পাস্তর! সমস্ত দেশজুড়ে হুলুস্থুল পড়ে গেল।
[ক্ষুদে শয়তানের রাজত্ব – দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় থেকে সংগৃহীত]
[…] জন্য লুই পাস্তুর কী করেছিলেন, সেই কাহিনীও পড়তে পারেন বিজ্ঞানযাত্রার […]