একজন মাকসুদুল আলম ও একটি গর্ব!

b3ac678f5f8893939a9889124f6dbdaa-34.0

ভূমিকা

ড. মাকসুদুল আলম, বাংলাদেশের ইতিহাসে গর্বের এক নাম। জীববিজ্ঞানের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যিনি তাঁর গবেষণা ও আবিষ্কার দিয়ে কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। তিনটি উদ্ভিদ ও ছত্রাকের জিনোম সিকুয়েন্সিং করে যিনি স্থান নিয়েছেন সেরা সেরা কিছু বিজ্ঞানীর তালিকায়!

জিনোম সিকুয়েন্সিং নিয়ে কিছু কথা

এই জিনোম রহস্য উন্মোচন বা জিনোম সিকুয়েন্সিং সম্বন্ধে অনেকেরই হয়তো ধারণা আছে। একটু সহজ করে বলার চেষ্টা করি। যে কোন জীবের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল কার্যক্রমই নিয়ন্ত্রিত হয় তার জিনোম বা কিছু ক্রোমোজোম বা অনেক অনেক অনেক জিনের দ্বারা। জিনগুলি তৈরি DNA দ্বারা, আর DNA তৈরি নিউক্লিওটাইড দ্বারা। এই নিউক্লিওটাইডের বেস আবার চার ধরনের। এডেনিন (A), গুয়ানিন (G), সাইটোসিন (C) ও থাইমিন (T)। আসলে জীবের ক্রোমোজোমে এই চারটি বেসই ঘুরে ফিরে নানা কম্বিনেশনে আছে, এবং এদের কম্বিনেশন ও বিন্যাসের উপরেই নির্ভর করছে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ। তাই কোনো জীবের এই জিনোম ডিকোড বা ATGC এর পারস্পরিক বিন্যাসটা আবিষ্কার করা মানেই সেই জীবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলির অবস্থান ও ফাংশন সম্বন্ধে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া। যেমন মানুষের জিনোম ডিকোডিং করে ইতিমধ্যে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন জিনের অবস্থান জানা গেছে, এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানেও তার ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং পাটের জিনোম ডিকোডিং বা জিন সিকুয়েন্সিং হওয়া মানে আমরা এখন পাট সম্বন্ধে অনেক কিছু জানি বা এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলোর সম্বন্ধেও জানি। এটা অবশ্যই একটা বড়সড় অর্জন। অর্থাৎ, সিকুয়েন্সিং করা হয়েছে মানে পাটের জিনগুলির বিন্যাস ও অবস্থানের ব্যাপারে জানা গেছে। এদের কার্যকলাপ বা দায়িত্ব-কর্তব্য জানা গেছে। যারা এই বিষয়ে পড়াশোনা করছেন, তারা বেশ ভালভাবে বুঝবেন এই কাজের গুরুত্ব কতটুকু। আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের জৈবিক কার্যক্রমের অন্তর্নিহিত নিয়ন্ত্রকগুলি বের করার সুযোগ দিয়েছে, কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রকগুলি বের করা এখনো শেষ হয়নি, সেটাও করতে আরো অনেক সময় লাগবে। ডঃ মাকসুদুল আলম তিনটা উদ্ভিদের জিন সিকুয়েন্সিং করেছেন। তাঁর এই অর্জন সত্যিই বিশাল কিছু!

জন্ম ও ক্ষুদে বিজ্ঞানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ

ড. মাকসুদুল আলমের জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর, ফরিদপুরে। বেড়ে ওঠা পিলখানায়। ছোট ভাই মাহবুবুল আলম ও বন্ধু জোনায়েদ শফিকের সঙ্গে তরুণ মাকসুদুল আলম গড়ে তুলেছিলেন ‘অনুসন্ধানী বিজ্ঞান ক্লাব’। ক্লাবের কার্যালয় ছিল লালবাগের ২৩ নম্বর গৌরসুন্দর রায় লেনে, তাঁদের বাসার ছাদে। ক্লাবের সভা বসলে খুদে বিজ্ঞানীদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন তাঁর মা। ক্লাবের কাজ বলতে ছিল গাছ পর্যবেক্ষণ, গাছের চারা লাগানো ও পাতা সংগ্রহ করা। গাছের পাতা অ্যালবামে সাজিয়ে বই দেখে দেখে বের করতেন গাছগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম। বিজ্ঞানের বৃহত্তর জগতের আহ্বান  এভাবেই পৌঁছায় মাকসুদুল আলমের কাছে।

শিক্ষাজীবন ও বড় বিজ্ঞানী হয়ে ওঠা

গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে স্বাধীনতার পর মাকসুদুল আলম পাড়ি দেন রাশিয়ার মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। পুরান ঢাকার গলি থেকে প্রবেশ করেন জ্ঞানের মহাসড়কে। রপ্ত করতে থাকেন প্রাণরহস্যের দরজা খোলার জাদুমন্ত্র। শৈশবে তাঁর মন আবিষ্ট করে রেখেছিল গাছ, অন্য কিছুতে কী করে মন বসে? প্রাণের অজানা তথ্য উদ্ধারকেই তিনি বেছে নেন গবেষণার বিষয় হিসেবে।  তিনি ১৯৭৯ সালে রাশিয়ার মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে এমএস ডিগ্রী লাভ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে মাইক্রোবায়োলজিতে পিএইচডি লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট বায়োকেমিস্ট্রিতে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। উচ্চশিক্ষা শেষে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯৭ সালে আবিষ্কার করেন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া হেলো ব্যাকটেরিয়ামের জীবনরহস্য। সেই থেকে শুরু। তাঁর নামের সঙ্গে একের পর এক নিয়মিত যুক্ত হতে থাকে নানা প্রাণরহস্য উন্মোচনের কৃতিত্ব। তিনি  ২০১০ সালে পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করে দেশে-বিদেশে সাড়া ফেলে দেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে পেঁপে, মালয়েশিয়ার হয়ে রাবার   ও বাংলাদেশের হয়ে পাট ও ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করেন।

পেঁপে,রাবার,পাট ও ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন

বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম-এর নেতৃ্ত্বে বিজ্ঞানীদের দলটি “ম্যাক্রোফমিনা ফাসিওলিনা” নামক ছত্রাক নিয়ে গবেষণা করেন। এ ছত্রাকটি উদ্ভিদের  বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি করে থাকে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য রোগ হলো ব্লাইট। এই ছত্রাকের আক্রমণের ফলে উদ্ভিদের আক্রান্ত অংশ শুষ্ক ও বিবর্ণ হয়ে যায়| এই রোগে আক্রান্ত উদ্ভিদের শিকড় পঁচে যায় বা ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। পাটসহ প্রায় ৫০০ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বিকাশকে এই ছত্রাক বাধা প্রদান করে।

তাঁর গবেষণার ছত্রাকটির পরিচয়ঃ-

• Kingdom: Fungi

• Phulum: Ascomycota

• Class: Dothideomycetes

• Subclass: Incertae sedis

• Order: Botryosphaeriales

• Family: Botryosphaeriaceae

• Genus: Macrophomina

• Species: Macrophomina phaseolina

২০১২ সালে তাঁর দল পাটের জন্য এই ক্ষতিকর ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করায় উন্নত পাটের জাত উদ্ভাবনের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় বাংলাদেশকে। ড. মাকসুদুল আলম প্রথম চমক দিয়েছিলেন পেঁপের জীবনরহস্য ভেদ করে। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইতে নানা রোগের কারণে ভীষণ ক্ষতির শিকার হচ্ছিলেন পেঁপেচাষীরা। মুক্তির প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা। ফল মিলছিলো না। মাকসুদুল আলম এ গবেষণায় সফল হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। এবার তাঁর কাছে ডাক আসে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে, রাবারের জীবনরহস্য উন্মোচনের। প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ দিয়ে গবেষণার সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয় তাঁকে। এখানেও তিনি যথারীতি সফল। মস্কো, হাওয়াই, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর বা দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান বিশ্ববিদ্যালয়ে মাকসুদুলের নেতৃত্বে গবেষণার পর গবেষণায় আলোকিত হতে থাকে প্রাণের বিচিত্র জীবনরহস্য।

এরই মধ্যে ঘটে চমকপ্রদ এক ঘটনা। নভেম্বর ২০০৯-এ প্রথম আলোর এক ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হয় তাঁর কৃতিত্বগাথা: ‘পেঁপের পর রাবারের জিন-নকশা উন্মোচন করলেন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম: উন্মোচিত হোক আমাদের পাটের জিন-নকশা’। তাতে চোখ পড়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর। মাকসুদুলকে তিনি দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে দায়িত্ব দেন পাটের জীবন-নকশা উন্মোচনের। তাঁর পাট ও ছত্রাকের জীবনরহস্য ভেদের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। সে গবেষণায় ছিল এ দেশের প্রায় ৩০ জনের এক গবেষকদল। এর মূল নেতৃত্বে ছিলেন মাকসুদুল আলমসহ মোট পাঁচজন গবেষক। তিন বছর মেয়াদের সে প্রস্তাবিত গবেষণার ফল তাঁরা বের করে আনেন এক বছরের মাথায়। মাকসুদুল আলমের জন্য মাসে ১৬ লাখ টাকা পারিশ্রমিক ধরা হয়েছিল। তিন বছরে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় পৌনে ছয় কোটির টাকা। কিন্তু সে পারিশ্রমিক তিনি গ্রহণ করেননি। মাকসুদুল আলমের মূল লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞানকে এলিটদের ক্লাব থেকে বের করে সাধারণের স্তরে পৌঁছে দেওয়া।

এ শিক্ষা তাঁর মধ্যে এসেছে শৈশবেই, মায়ের প্রেরণায়। একাত্তরের ৩ এপ্রিল মাকসুুদুলের বাবা দলিলউদ্দীন আহমেদকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। শক্তহাতে সংসারের হাল ধরেন  মা লিরিয়ান আহমেদ। সব বাধা পেরিয়ে যোগ্য করে তোলেন সন্তানদের। তাঁর এই হার না-মানার চেতনাই সঞ্চারিত হয়েছে সন্তানের মধ্যে।মাকসুদুল আলম শুধু নিজেই গবেষণা কাজ নিয়ে এগিয়ে যাননি। দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জিন বিজ্ঞানী তৈরীর কাজও অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিলো। পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতায় একটি বায়োটেকনোলজি সেন্টার স্থাপিত হয়েছে। এক ঝাঁক তরুণ জিন বা জিনোম বিজ্ঞানীও তৈরী করে গেছেন তিনি।

মৃত্যু

যকৃতের জটিলতায় ভুগতে থাকা মহৎ এই বিজ্ঞানী ২০১৪ সালের ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে কুইন্স মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

Comments

Avatar

MHLikhon

বর্তমানে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার বিজ্ঞানে অধ্যায়নরত। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ও ভ্রমণ নিয়েই চলে যায় দিন! লেখালেখিও এগুলো নিয়েই।

আপনার আরো পছন্দ হতে পারে...

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
জানান আমাকে যখন আসবে -
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x