কেন তিনি অবিস্মরণীয়? তার আগে কি কেউ ফিল্ড মেডেল পাননি?
অবশ্যই পেয়েছেন। কিন্তু তিনি ফিল্ড মেডেলের ইতিহাসে অমর হয়ে রইবেন মেডেল জয়ী প্রথম মহিলা গণিতবিদ এবং প্রথম ইরানী নাগরিক হিসেবে। এই লেখা প্রসব করা পর্যন্ত তিনিই একমাত্র মহিলা, যিনি এই সম্মাননা পেয়েছেন। ভবিষ্যতে আরও অনেক নারী ম্যাথমেটিশিয়ান এই সম্মান পাবেন, কিন্তু ২০১৪ সালে মারিয়ামের ফিল্ড মেডেল পাওয়ার পর এখন পর্যন্ত আর কোনো মহিলা গণিতবিদকে এই সম্মানে ভূষিত করা হয়নি। তাই মারিয়াম প্রয়াণ করলেন ফিল্ড মেডেল জয়ী প্রথম নারী, ফিল্ড মেডেল জয়ী একমাত্র নারী গণিতবিদ, এবং ফিল্ড মেডেল জয়ী প্রথম ইরানী হিসেবে, ইতিহাস তৈরি করে।
প্রথম অনুচ্ছেদ পড়ে অনেক পাঠক হয়ত ভাবছেন, বিজ্ঞানীদের মধ্যে আবার মহিলা-পুরুষের ভেদাভেদ আনা হচ্ছে কেন? মারিয়াম একজন ফিল্ড মেডেল স্কলার, ব্যস! একজন মহিলা হিসেবে উনাকে হাইলাইট করে কি লিঙ্গ বৈষম্যকেই উস্কে দেওয়া হচ্ছে না? হ্যাঁ, আমিও জানি বিজ্ঞানীদের লিঙ্গভিত্তিক সম্বোধন করা উচিত নয়। শুধু বিজ্ঞানী কেন, সমাজে যাদেরই অবদান আছে, তাদের মধ্যে নারী-পুরুষ বিবেচনায় আনলে দুটো লিঙ্গের মধ্যে Sex-গত যে পার্থক্য, সেটা ছাড়িয়ে Gender-জনিত চিরাচরিত বৈষম্যগুলোকেই জিইয়ে রাখা হয়। কিন্তু যে সমাজে মেডিসিনে নোবেল প্রাপ্ত পুরুষ বিজ্ঞানী টিম হান্ট বলেন, “নারী এবং পুরুষ বিজ্ঞানীদের একসাথে এক ল্যাবে কাজ করা উচিত না। কারণ এতে পুরুষেরা নারীদের প্রেমে পড়ে, নারীরা পুরুষদের এবং যখন আপনি নারীদের সমালোচনা করবেন, তখন তারা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়”, সে সমাজে নারী বিজ্ঞানীদের হাইলাইট করে লেখালেখির প্রয়োজন আছে। যেখানে আমরা বয়েজ স্কুল/গার্লস স্কুল উঠিয়ে কোএডুকেশনের চিন্তা করি, সেখানে বিজ্ঞান জগতের সর্বোচ্চ সম্মাননা পাওয়া একজনের মুখ থেকে নারীদের দোষী সাব্যস্ত করে লিঙ্গভিত্তিক ল্যাব চালু করার পরামর্শ আমাদের আতংকিত করে বৈকি!
নারীদের দুর্বল ভাবা, হেয় করা, যথার্থ সম্মান না দেওয়া, গবেষণা কাজের স্বীকৃতি না দেওয়া (রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন সর্বপ্রথম ডিএনএ-এর ডাবল হেলিক্স মডেলের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু তার আবিষ্কার ব্যবহার করে ওয়াটসন-ক্রিক যেভাবে বিখ্যাত হয়ে আছেন, রোজালিন্ডের নাম সেভাবে ছড়িয়েছে কি?), একই লেভেলের গবেষণা করার পরও পুরুষ গবেষককে সম্মান দেওয়া কিন্তু নারী গবেষককে এড়িয়ে যাওয়া (মেরি কুরি এবং পিয়েরে কুরি দুজনেই একসাথে তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। কিন্তু আপনি জানেন কি, নোবেল কমিটি শুধু পিয়েরে কুরিকেই নোবেল পদকের জন্য মনোনীত করেছিলো? অথচ তেজস্ক্রিয়তার উপর গবেষণা প্রথমে মেরিই শুরু করেছিলেন। পিয়েয়ে স্ত্রীর আইডিয়ায় মুগ্ধ হয়ে পরে গবেষনায় যোগ দিয়েছিলেন) ইত্যাদি আজকালকার কথা নয়। প্রাচীন মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের হাইপেশিয়ার কথা মনে পড়ে? উনাকে মনে করা হয় ইতিহাসের প্রথম নারী গণিতবিদ। কিন্তু বেচারাকে তার বুদ্ধিমত্তার জন্য ভোগ করতে হয়েছিলো পুড়ে মরার অভিজ্ঞতা। ইতিহাসবিদদের মতে, হাইপেশিয়ার ভয়ংকর পরিণতি নারীদের বিজ্ঞানমুখী না হওয়ার ক্ষেত্রে বিশাল প্রভাব ফেলেছিলো। তাই নারীদের বিজ্ঞান জগতে প্রবেশ করতে অনুপ্রেরণা যোগানোর জন্যেই হোক, কিংবা নারী বিজ্ঞানীদের প্রচার-প্রসার-প্রাপ্য স্বীকৃতি দানের জন্যেই হোক, বিজ্ঞানী হিসেবে নারীদেরকে আলাদাভাবে হাইলাইট করার প্রয়োজনীয়তা এখনো আছে।
আসি মারিয়াম মির্জাখানির কাছে। তার জীবনী সম্পর্কে বিস্তারিত খুব একটা পাওয়া যায় না অন্তর্জাল জগতে। তবুও পাঠকের ক্ষুধা মেটাবার জন্য যথেষ্ট তথ্য এই লেখায় পাওয়া যাবে, আশা করি।
প্রাথমিক জীবন এবং গণিতের প্রতি ঝোঁকের শুরু
মারিয়াম ইরানের তেহরানে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭৭ সালের ৩ মে। ছোটবেলায় তার ঝোঁক ছিলো যেকোনো বই পাওয়ামাত্রই সেটা পড়ে ফেলার দিকে। তখনও ভবিষ্যৎ গণিতবিদের মাথায় গণিত সম্পর্কে কোনো আগ্রহ জন্মায়নি। তিনি টেলিভিশনে মারি কুরি, হেলেন কিলার প্রমুখ বিখ্যাত নারীদের জীবনী দেখতেও পছন্দ করতেন। চিত্রশিল্পী ভিন্সেন্ট ভ্যান গগকে নিয়ে রচিত উপন্যাস “Lust for Life” কিংবা বিখ্যাত নারীদের জীবনী – সবই মারিয়ামকে প্রভাবিত করেছিলো “জীবনে বড় কিছু করতে হবে” এই উপলব্ধিতে আসার জন্য। হয়ত সেই উপলব্ধি ঘুরপাক খাচ্ছিলো একজন লেখক হওয়ার স্বপ্নের আশেপাশে!
ইরাক-ইরান যুদ্ধ যখন শেষ হওয়ার পথে, তখন মারিয়াম তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জীবন শেষ করেন। সে সময় উদ্যমী ছাত্রছাত্রীদের জন্য উচ্চশিক্ষার অনেক সুযোগ তৈরি হচ্ছিলো। মারিয়াম তেহরানের “ফারজানেগান মিডল স্কুল ফর গার্লস”-এ ভর্তির জন্য পরীক্ষা দেন এবং টিকে যান। ইরানের টপ ক্লাস বুদ্ধিমানদের জন্য স্বয়ং ইরান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হতো স্কুলটি। মিরিয়ামের মতে, তিনি ছিলেন ইরানের ভাগ্যবান জেনারেশনের সদস্য। কৈশোরকালে তার পা পড়তে পড়তে যুদ্ধ পরবর্তী ইরানের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটামুটি স্থিতিশীল হয়ে গিয়েছিলো।
নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রথম সপ্তাহেই মারিয়ামের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে রয়া বেহেশ্তি-এর, যিনি বর্তমানে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি স্টেটে অবস্থিত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের প্রফেসর হিসেবে কর্মরত আছেন। দুই বন্ধু মিলে প্রায় প্রায় চলে যেতেন স্কুলের কাছে যে বইয়ের দোকানগুলো ছিল, সেগুলোতে। দোকানে ঢুকে বই ঘাঁটাঘাঁটি করে পছন্দ করা যেত না, তাই দুজনে মিলে যেটাই সামনে পেতেন, কিনে আনতেন। মারিয়াম স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, “ব্যাপারটা শুনতে এখন আজব লাগে! কিন্তু বইগুলো এত সস্তা ছিল যে, এলোপাথাড়ি কিনতে আমাদের গায়ে লাগতো না।”
স্কুলের প্রথম বছরে মারিয়াম অংকে বেশ খারাপ ফলাফল করেছিলেন। তার গণিত টিচারের ধারণা হয়ে গিয়েছিলো, মারিয়াম খুব একটা বুদ্ধিমান নয়। টিচারের এই অভিব্যক্তি মারিয়ামের আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরিয়ে দেয়। কিশোর বয়সে “আমাকে নিয়ে অন্যরা কী ভাবছে?” ধরনের চিন্তাভাবনা ছেলেমেয়েকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে থাকে। আর সে প্রভাবের ফলে মারিয়াম গণিতের উপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। কিন্তু পরের বছর মারিয়াম পেলেন এমন একজন গণিত শিক্ষককে, যিনি মিরিয়ামকে উৎসাহ দিলেন গণিতের ব্যাপারে। মিরিয়ামও খুব দ্রুত প্রচুর উন্নতি ঘটিয়ে ফেললেন গণিত বিষয়টায়। বেহেশ্তির মতে, “স্কুলের দ্বিতীয় বছর থেকে মিরিয়াম হয়ে উঠেছিলো একজন তারকা!”
উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি বছর “ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিয়াড ইন ইনফরমেটিক্স” নামে যে প্রতিযোগিতাটা হয়, সে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথমে জাতীয় পর্যায়ে বিজয়ী হতে হয়। তো মারিয়াম আর বেহেশ্তি যখন ফারজানেগান স্কুলের স্টুডেন্ট, সে সময় জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীদের যে প্রশ্নগুলো দেওয়া হয়েছিলো, তার কপি দুই বন্ধুর হাতে আসে। কয়েকদিনের খাটাখাটনি শেষে দুজনে ছয়টা প্রশ্নের মধ্যে মাত্র তিনটার সমাধান বের করতে সক্ষম হন। এরপর দুই বন্ধু মিলে চিন্তা করতে শুরু করেন, এ ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ নিলে তাদের পারফরম্যান্স কেমন হবে? সেই সূত্র ধরে তারা গেলেন স্কুলের প্রিন্সিপালের কাছে। বললেন, ছেলেদের উচ্চ বিদ্যালয়ে যে ধরনের গণিতের সমস্যা সমাধান বিষয়ক ক্লাস হয়, তাদেরকেও সেরকম ক্লাস করার সুযোগ দিতে হবে। প্রিন্সিপালটি ছিলেন দৃঢ় মনের একজন মহিলা। মারিয়ামদের দাবী তাকে ভাবিয়ে তুললো। কিন্তু ইরানের আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড দলে কখনও কোনো মেয়েকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাই প্রিন্সিপালকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিলো এই ব্যাপারে। তবুও তিনি মারিয়ামকে বলেছিলেন, “তুমি অবশ্যই অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে পারবে। যদিও মেয়ে হিসেবে তুমিই প্রথম অংশগ্রহণকারী হবে, কিন্তু এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই, তুমি পারবে।” প্রিন্সিপালের এই কথাগুলো মারিয়ামের জীবনকে অনেকখানি প্রভাবিত করেছিলো।
১৯৯৪ সালে এলো বিখ্যাত সেই দিন। মারিয়াম এবং বেহেশ্তি মিলে গঠন করলেন ইরানের গণিত অলিম্পিয়াড দল। অলিম্পিয়াডের টেস্টে মারিয়াম যে স্কোর তুললেন, তার জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হল সোনার মেডেল দিয়ে। বলা বাহুল্য, মারিয়ামই ছিলেন প্রথম ইরানীয় ছাত্রী যিনি গণিত অলিম্পিয়াডে সোনার মেডেল জিতেছেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে ১৮ বছর বয়সী মারিয়াম গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়ে পারফেক্ট স্কোর অর্জন করেন এবং দু’দুটো সোনার মেডেল বগলদাবা করেন! এ ধরনের প্রতিযোগিতায় তার পারফরম্যান্স কেমন হতে পারে, সে কৌতূহল থেকে এত বড় সাফল্যে জড়িয়ে গিয়ে মারিয়াম গণিতের প্রতি তীব্র ভালোবাসা অনুভব করলেন। তার মতে, চেষ্টা করার মাধ্যমে আপনি গণিতের সৌন্দর্য বুঝতে পারবেন।
গবেষণা এবং শিক্ষাদান
১৯৯৯ সালে মারিয়াম তেহরানের শরীফ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান পিএইচডির জন্য। সেখানে গিয়ে তিনি আরেক ফিল্ড মেডেলপ্রাপ্ত গণিতবিদ কার্টিস ম্যাকমুলেন-এর সেমিনারে যোগ দেওয়া শুরু করেন। প্রথম প্রথম ম্যাকমুলেনের লেকচারের আগামাথা মারিয়াম কিছুই বুঝতেন না, কিন্তু “hyperbolic geometry” বিষয়টার সৌন্দর্য তাকে অভিভূত করে ফেললো। তিনি ম্যাকমুলেনের অফিসে গিয়ে আধাখেঁচড়া ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে তাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলতেন, আর প্রফেসরের কথা নোট করে রাখতেন ফার্সি ভাষায়। অর্থাৎ ভাষার ব্যবধান মারিয়ামের জানার ইচ্ছেতে কখনও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। পরে ম্যাকমুলেনের আন্ডারেই ২০০৪ সালে মারিয়াম তার পিএইচডি শেষ করেন। মারিয়ামের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো বিভিন্ন ধরনের hyperbolic surface । কিন্তু যখন তিনি পিএইচডি শুরু করেন, তখনও এই সারফেসগুলো নিয়ে অনেক সরল প্রশ্নের উত্তর ছিল অজানা। মারিয়াম চিন্তা করলেন, hyperbolic surface নিয়েই করবেন তার পিএইচডির গবেষণা। পিএইচডি থিসিস পেপারে মারিয়াম hyperbolic surface সংক্রান্ত দুটো সমস্যার সমাধান করেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ বেন্সন ফার্ব-এর মতে, মারিয়াম তার থিসিসে যেটা করে দেখিয়েছেন, বেশিরভাগ গণিতবিদই কখনও এমন সুন্দর কিছু উপস্থাপন করতে পারবেন না।
মারিয়াম নিজেকে “ধীরস্থির” হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। অনেক গণিতজ্ঞ যেমন দ্রুত একটার পর একটা সমস্যা সমাধান করে ফেলেন, মারিয়াম তেমনটা ছিলেন না। এমনও সমস্যা আছে, যেগুলো নিয়ে মারিয়াম এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ভাবছিলেন! কিন্তু তারপরও কোনো সমাধানে তিনি পৌঁছুতে পারেননি। কিন্তু তাই বলে দ্রুত যারা সমস্যার সমাধান করে ফেলেন, সেসব গণিতজ্ঞদের নিয়ে তার মধ্যে কোনো ভয়ও কাজ করত না। নিজের সম্বন্ধে তিনি বলতেন, “আমি সহজে হতাশ হই না। কিছু ক্ষেত্রে আমি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী।”
মারিয়াম যখন হার্ভার্ডের শিক্ষার্থী, তখন তার পরিচয় হয় ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি (MIT)-এর শিক্ষার্থী জান ভন্ড্রাকের সাথে। পরবর্তীতে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, এবং তাদের একটি কন্যা সন্তানও হয়। তো, জানের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, মারিয়ামের “ধীরস্থির” বৈশিষ্ট্য শুধুমাত্র গণিতের ক্ষেত্রে নয়, বরং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও মারিয়াম এই স্বভাব ধরে রেখেছিলেন। দুজনেই যখন শিক্ষার্থী, তখন একদিন জান এবং মারিয়াম দৌড়াতে বের হন। জান ভেবেছিলেন, মারিয়াম ছোটখাট মানুষ এবং তিনি ব্যায়াম-বীর। তাই তিনিই দৌড়ে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবেন। ভাবনা মাফিক প্রথমে জানই এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আধা ঘণ্টা পর কাহিল হয়ে তিনি দৌড়ে ক্ষান্ত দেন। কিন্তু মারিয়াম ধীরগতিতেই পুরো রাস্তা দৌড়ে পার হয়েছিলেন।
যখনই মারিয়াম গণিত নিয়ে চিন্তা করতেন, তখনই তিনি ডুডল আঁকতেন (তার গবেষণার সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন চিত্র আর সার্ফেসের ছবি)। সেসব চিত্র আমাদের কাছে হিবিজিবি আঁকাআঁকি মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়, যেমনটি মনে হতো জানের কাছেও। মারিয়ামের ছিলো বিশাল আকারের সব কাগজ, যেগুলো মেঝের উপর বিছিয়ে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছবি আঁকতেন। জনের মনে হতো, মারিয়াম যেন একই ছবি বারবার আঁকছেন! তাছাড়া বাসায় মারিয়ামের যে অফিস ছিল, সেটার অবস্থাও ছিলো শোচনীয়। কাগজপত্র আর বই ছড়ানো ছিটানো ছিলো যেখানে সেখানে। জন ভেবে পেতেন না, এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে মারিয়াম কাজ করেন কীভাবে। কিন্তু তিনিই আবার সমাধান দিলেন, “মারিয়াম যে সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করত, সেগুলো এতটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে আর জটিল ছিলো যে, স্বাভাবিক গণিতের মত ধারাবাহিক উপায়ে আর গুছিয়ে সেগুলোর সমাধান করা সম্ভব হতো না।”
মারিয়ামের ভাষ্যমতে, আঁকাআঁকি তাকে গণিতের কঠিন সমস্যায় ফোকাস করতে সাহায্য করতো। “সবকিছু বিস্তারিতভাবে লিখে রাখা বেশ কঠিন একটা কাজ। সে জায়গায় একটা চিত্রের মাধ্যমেই বিস্তারিত অনেক কিছু ফুটিয়ে তোলা যায়।” মারিয়ামের তিন বছরের মেয়েও মাকে কাগজে লিখতে দেখলে বলে উঠত, ‘দেখো দেখো, মা আবারও ছবি আঁকছে!’
২০০৪ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করার পর একইসাথে মারিয়াম প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এসিস্টেন্ট প্রফেসর হিসেবে এবং Clay Mathematics Institute-এ যোগ দেন রিসার্চ ফেলো হিসেবে। দুই জায়গায়ই তিনি ২০০৮ সাল পর্যন্ত কাজ করেন এবং ২০০৮ সালে প্রফেসর হিসেবে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে যোগ দেন।
মারিয়ামের কাজ ছিলো তাত্ত্বিক গণিত নিয়ে। কিন্তু সেই কাজই ভূমিকা রাখতে পারে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের বহুল চর্চিত “কীভাবে ব্রহ্মাণ্ড তৈরি হলো?” প্রশ্নের উত্তরের খোঁজ পেতে। কারণ মারিয়ামের কাজ কথা বলে কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি নিয়ে, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স এবং প্রকৌশল বিদ্যা নিয়ে। তার কাজ অবদান রাখে প্রাইম নাম্বার সংক্রান্ত গবেষণায় কিংবা ক্রিপ্টোগ্রাফিতে। তবে “মারিয়ামের কাজের পদ্ধতি কী?” সে সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, তার কাজের কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই। ব্যাপারটা অনেকটা জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার মত। হারিয়ে গেলে বুদ্ধি খাটিয়ে নতুন নতুন কৌশল বের করা লাগে, যেন জঙ্গল থেকে বেঁচে বর্তে ফিরে আসা যায়!
ফিল্ড মেডেল জয়
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটা ইমেইল আসে ফিল্ড মেডেল কমিটির কাছ থেকে, যেখানে বলা হয় গণিত জগতে অসামান্য অবদান রাখার জন্য মারিয়াম মির্জাখানিকে ফিল্ড মেডেলে ভূষিত করা হবে। মারিয়ামের কাছে ইমেইলটা এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিলো যে, তিনি ভেবে নিলেন কমিটির ইমেইল আইডি হ্যাক করা হয়েছে। গণিতে তো তার অবদান অসামান্য নয়! নিজের কাছে মনে হয়, তার অবদান খুবই সামান্য। কিন্তু তার এই সামান্য অবদান গণিতের দুনিয়াকে ভালোই টালমাটাল করে দিয়েছে, বুঝা যায়।
উল্লেখ্য, চার বছর পরপর এই মেডেল দেওয়া হয়, এবং শুধুমাত্র চল্লিশ বছরের কম বয়সী গণিতজ্ঞরা এই মেডেল পাওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হন। আমাদের সমাজে যেহেতু গণিত জগতে পুরুষের তুলনায় নারীদের পদচারণা কম ঘটে থাকে (এর পেছনে সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক নানা কারণ জড়িত), তাই ফিল্ড মেডেল পাওয়ার মত যোগ্য একজন নারী গণিতজ্ঞ তৈরি হতে সময় লেগে গেছে প্রচুর (যেহেতু এই পুরস্কার শুধুমাত্র <৪০ বছরের কাউকে দেওয়া হয়, তাই নারীরা এই ক্ষেত্রে কম সুবিধা পেয়ে থাকেন। কারণ এই বয়সসীমার মধ্যে অনেকেই গবেষণার সাথে টানা যুক্ত থাকতে পারেন না, তাদেরকে সন্তান পালনের দিকেও মনোযোগ দিতে হয়)। ১৯৩৬ সালে চালু হওয়ার পর ফিল্ড মেডেলকে দীর্ঘ ৭৮ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে কোনো নারী গণিতজ্ঞের হাতে উঠার জন্য। অবশেষে মারিয়াম সেই আফসোস ঘুচিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল শহরে আন্তর্জাতিক গণিত সমিতির আয়োজনে ২০১৪ সালের ১৩ আগস্ট পৃথিবীর বাঘা বাঘা গণিতবিদদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো যে মহাসভা, সেখানে মারিয়াম ফিল্ড মেডেল গ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে মারিয়াম বলেছিলেন, “এটা অনেক বড় একটা সম্মান! কিন্তু আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হব যদি এই অর্জন নারী গণিতবিদ এবং বিজ্ঞানীদের উৎসাহিত করে। আমি নিশ্চিত, আসছে বছরগুলোয় আরও অনেক নারী এ ধরনের পুরস্কার অর্জন করবেন।”
ক্যান্সারের সাথে বসবাস এবং প্রয়াণ
২০১৩ সালে মারিয়ামের স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে। চার বছর ধরে এই ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করার পর ২০১৭ সালে এসে সেটা ছড়িয়ে পড়ে তার অস্থিমজ্জা বা বোনম্যারোতে। অবস্থার অবনতি ঘটায় ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই আমেরিকার এক হাসপাতালে মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই নারী। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মারিয়াম স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট মার্ক ল্যাভিন আশা ব্যক্ত করে বলেছেন, হয়তো মারিয়াম অনেক কম বয়সে, অসময়ে চলে গেছেন। কিন্তু তার প্রভাব তিনি রেখে গেছেন হাজার হাজার নারীর উপর, যারা তাকে দেখে বিজ্ঞান আর গণিত জগতে পা দিতে উৎসাহ বোধ করবে।
তথ্যসূত্র
১) A Tenacious Explorer of Abstract Surfaces
২) Maryam Mirzakhani, first woman to win maths’ Fields Medal, dies
৩) Maryam Mirzakhani, Stanford mathematician and Fields Medal winner, dies
৪) উইকিপিডিয়া
৫) Stanford’s Maryam Mirzakhani wins Fields Medal