করোনা ভাইরাসঃ এক অতিমারির অদেখা গাণিতিক রূপ।

পৃথিবীর ইতিহাস যদি আমরা কালের আবর্তে পর্যালোচনা করতে থাকি তবে দেখব যে, ছোট-বড় নানা রকম মহামারিতে শুধু মানবজাতিই নয়।পশুপাখিও আক্রান্ত হয়েছে অসংখ্যবার। বড় মহামারি যেমন- জাস্টিনিয়ান প্লেগ, দ্য ব্ল্যাক ডেথ, দ্য গ্রেট প্লেগ, কলেরা, ইয়োলো ফিভার, স্প্যানিশ ফ্লু, এশিয়ান ফ্লু, ইবোলা ইত্যাদি পৃথিবী থেকে কেড়ে নিয়েছে কোটি কোটি প্রাণ। প্রত্যেকটি মহামারিই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে,আমরা যতই সভ্য হতে সভ্যতর হই না কেন,প্রকৃতির কাছে আমরা বরাবরের মতই অসহায়।

প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্র গ্রিসে টাইফাস মহামারিতে এথেন্সের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ সে সময়টিতে মারা গিয়েছিলো। বিউবনিক প্লেগে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ মারা যায়, যা তৎকালীন জনসংখ্যার প্রায় ছাব্বিশ শতাংশ। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে ‘‘দ্য ব্ল্যাক ডেথ’’ খ্যাত প্লেগ মহামারিতে পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। আবার ধারণা করা হয় ভারতীয় উপমহাদেশে কলেরার তান্ডবলীলায় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দ অবধি প্রায় সাতাশি লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। অন্যান্য মহামারিতে মৃত্যুর পরিসংখান উল্লেখ করলে প্রবন্ধের পরিধি কেবল বাড়তেই থাকবে। তবে বাস্তবতা হলো, সেই পৌরাণিক সময় থেকে অদ্যাবধি নানা মহামারি পৃথিবী থেকে কেড়ে নিয়েছে অসংখ্য প্রাণ।

সাম্প্রতিক সময়ে নোভেল করোনাভাইরাসের ত্রাসে গত কয়েক মাস ধরে প্রায় সারা পৃথিবী কার্যত গৃহবন্দি। স্তব্ধ হয়ে আছে জনজীবন।এক গভীর অনিশ্চিয়তা গ্রাস করেছে পুরো পৃথিবীকে।তবুও সুদিনের আশায় থেমে নেই মানুষ। ভাইরাসটিকে জয় করতে ডাক্তার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য,নানা রকম সেচ্ছাসেবক দলের সদস্যরা একদিকে যেমন দিন-রাত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন,তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানীরাও প্রতিনিয়ত গবেষণা করে যাচ্ছেন ভাইরাস টির গতি-প্রকৃতি বুঝে ওঠার জন্য।গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পরা নোভেল করোনা ভাইরাসটির সম্বন্ধে গত কয়েক মাসের ব্যবধানে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন গবেষণা পত্রও বেড়িয়েছে। এসব গবেষণার কল্যানে আমরা ভাইরাসটির চরিত্র, বৈশিষ্ট্য কিছুটা পড়েছি, জেনেছি। বিভিন্ন দেশে ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব কেমন, কি ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তাও কাগজে, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে, আন্তর্জালে, সামাজিক মাধ্যমে উঠে এসেছে। আমরা শুনছি এপিডেমিওলোজি বা মহামারির বিভিন্ন তত্ত্ব, বিভিন্ন সংজ্ঞা।

এপিডেমিওলোজিস্ট বা মহামারি বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন রকম সিমুলেশন মডেল নিয়ে কাজ করেন, কোনো মহামারির ব্যাপ্তির পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য। সেই পূর্বাভাস থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ মহামারিকে প্রতিরোধ করতে বিভিন্ন রকম কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকেন।তবে এক্ষেত্রে দুঃখের বিষয় হল,আমরা যারা মহামারি বিশেষজ্ঞ নই, তারা অনেক সময় এই সিমুলেশন মডেল গুলোর গুঢ় তত্ত্বের মর্ম যথার্থ ভাবে বুঝতে সক্ষম হই না। কিন্তু তা সত্ত্বেও যারা ভাইরাসটির গতি প্রকৃতি সম্বন্ধে বুঝতে আগ্রহী তারা এইসব সিমুলেশন মডেলের গভীরে প্রবেশ না করে বা কোনো পূর্ভাবাস করার চেষ্টা না করেই, শুধু কোনো সংক্রামক ব্যাধির সংক্রমণ বৃদ্ধির হার বিষয়ক যেই পরিসংখ্যান আছে সেগুলোকে আমরা সহজ কিছু গাণিতিক ফরমুলার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে পারি।যা আমাদের এই সিমুলেশন মডেল গুলো বুঝতে সাহায্য করবে।

বর্তমানে মানবসভ্যতার সামনে এক ভয়াবহ বিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে করোনাভাইরাস সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯!

বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতির গ্রাফ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্য কোনো মহামারী এত দ্রুত এমন ভয়াবহ রূপে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েনি।আমরা যদি বাংলাদেশের দিকে তাকাই তবে দেখব যে, সেখানে গত ৩রা মার্চ প্রথম, তিনজন কোভিড-১৯ রোগী সনাক্ত হয়।এরপরের দু-তিন সপ্তাহ যেতে না যেতেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা পঞ্চাশের ঘরে উঠে যায়। পঞ্চম সপ্তাহে গিয়ে সেটি একশত ছাড়িয়ে যায়।ষষ্ঠ সপ্তাহেই গিয়ে দাঁড়ায় এক হাজারের কোঠায়।

এর পরবর্তী সপ্তাহ গুলোতে আপনারা যদি বাংলাদেশে ভাইরাসটির দৌরাত্ম্য নিয়ে বিভিন্ন পরিসংখ্যান ঘাটাঘাটি করেন তবে দেখবেন যে, বাংলাদেশে ভাইরাসটিতে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছেই!অনেকের কাছেই এই লাফিয়ে বৃদ্ধিটি বিস্ময়ের ঠেকতে পারে।ভাবতে পারেন খুব গোলমেলে ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বা ছড়িয়ে পড়ছে ভাইরাসটি!আদোতে আসলে এই ধারণাটি মোটেই সঠিক নয়।ভাইরাসটিতে আক্রান্তের সংখ্যা কিংবা ভাইরাসটির ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পরা পুরোটাই একটি নির্দিষ্ট গাণিতিক প্রক্রিয়া মেনেই চলতে থাকে।অর্থাৎ আপনি আগে থেকেই আন্দাজ করতে পারবেন এই ভাইরাসটি দ্বারা সম্ভাব্য কত জন ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারেন।একে আমরা গাণিতিকভাবে জ্যামিতিক বৃদ্ধি বা Geometric Growth বলতে পারি।আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা সূচকীয় বৃদ্ধি বা Exponential Growth কে জ্যামিতিক বৃদ্ধির সমার্থক হিসেবে তুলে ধরেন।কিন্তু আদোতে এই দুটো জিনিস মোটেই এক নয়।

তবে আসুন জানা যাক জ্যামিতিক বৃদ্ধি ও সূচকীয় বৃদ্ধির মধ্যকার পার্থক্যটি আসলে কোথায়।

কোনো ভাইরাস জনিত মহামারির ছড়ানো নির্ভর করে সেই ভাইরাসের রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বারের( Reproductive Number) ওপর।রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার যদি শূন্য হয় তবে ভাইরাসটি একজন থেকে অপরজনের কাছে ছড়ায় না। রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার এক হলে ভাইরাসটি একজনের মাধ্যমে শুধু অপর একজনের দেহেই ছড়ায়।এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হল গাণিতিক বৃদ্ধি বা Arithmetic Growth. কিন্তু এই সংখ্যা যদি দুই বা ততোধিক হয় তবে ভাইরাসটি জ্যামিতিক প্রক্রিয়ায় ছড়াতে থাকে।
এখন অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে,জ্যামিতিক বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি আসলে কি?খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে,কোনো সিস্টেমের জ্যামিতিক বৃদ্ধি হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যার কোনো নির্দিষ্ট সময়ে পরিবর্তন কেবল সেই সময়ে উপস্থিত সেই সিস্টেমের মোট পরীক্ষাধীন বস্তুর পরিমাণের উপর নির্ভর করে।যেমন দিনকে দিন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা যত বাড়তে থাকবে,তেমনি ভাইরাসটি দ্বারা নতুন ব্যাক্তিদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও ততো বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
আবার বিভিন্ন ভাইরাসের ক্ষেত্রে রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বারটি ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমের উপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।যেমন HIV ভাইরাসটি একজন আক্রান্ত ব্যাক্তির দেহ নিঃসৃত রক্ত,বীর্য (Body Fluids) এগুলোর মাধ্যমে অন্যজনের দেহে ছড়াতে পারে।তাই HIV এর রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার কেবল এই মাধ্যম গুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই বায়ু,পানি ইত্যাদি মাধ্যমে HIV ভাইরাসটির রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বারটি শূন্য।

এখন যদি ধরা হয়, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত একজন ব্যক্তি ভাইরাসটিকে একদিনে সর্বোচ্চ r জন ব্যক্তির মধ্যে ছড়াতে পারে, তবে এক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসটির রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার হবে r। যদি এই পরীক্ষাধীন সময়টিতে করোনা ভাইরাসে মোট আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা P হয়ে থাকে। তবে পরীক্ষাধীন সময়ের একদিন পর করোনা ভাইরাসে নতুন করে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যাটি দাঁড়াবে P×r=Pr
( যেহেতু একদিনে একজন ব্যাক্তি থেকে সর্বোচ্চ r জন ব্যক্তির মধ্যে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে।সুতরাং P জন আক্রান্ত ব্যাক্তি P×r জন নতুন ব্যক্তির মধ্যে ছড়াবে)

সুতরাং একদিন পর মোট আক্তান্ত ব্যাক্তির সংখ্যাটি দাঁড়াবে =আগের দিনের মোট আক্তান্ত + সেইদিনে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা।
X = P +P.r = P.(1+r) = P.(1+r)¹

আবার দ্বিতীয় দিনে নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যাটি দাঁড়াবে = P.(1+r)×r = P.(1+r)r

সুতরাং দ্বিতীয় দিনে মোট আক্তান্ত ব্যাক্তির সংখ্যাটি হবে
X= P.(1+r)+P.(1+r)r = P.(1+r).(1+r) =P.(1+r)²

একই ভাবে আমরা যদি n তম দিনে মোট আক্রান্ত ব্যাক্তির সংখ্যাটি হিসেব করতে চাই,তবে সংখ্যাটি দাঁড়াবে
X=P.(1+r)ⁿ
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এটি একটি সাধারণ ফরমুলা।
ফরমুলাটিকে এখন একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করুন।চিনতে পারলেন কি? জ্যামিতিক বৃদ্ধির এই ফরমুলাটির সাথে হয়ত আমরা অনেকেই অনেক আগে থেকেই পরিচিত।যারা ব্যাবসা বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছেন কিংবা মাধ্যমিকে সুদকষার অংক করেছেন তারা হয়ত জানেন,ব্যাংকে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা রাখলে সেটি সুদ সমেত এই ফরমুলাতেই চক্রবৃদ্ধির আকারে ফুলেফেঁপে ওঠে!

জ্যামিতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে সাধারণ ফরমুলাটি আমরা কিছুকাল আগে প্রতিষ্ঠা করেছি, মনে রাখতে হবে সেখানে n কিন্তু বিচ্ছন্ন(Discrete) একটি সময়।এখানে বিচ্ছিন্ন বলতে একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর n এর মানের জন্য আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা দেখানো হয়েছে।কিন্তু n এর মান যদি নিরবিচ্ছিন্ন (Continuous) হয় অর্থাৎ n এর মান যদি প্রতিটি একক মুহূর্তের জন্যই গণনা করা হয় তবে জ্যামিতিক বৃদ্ধির এই ফরমুলাটিকেই সূচকীয় বৃদ্ধি বা Exponential Growth বলা হবে।
এক্ষেত্রে আমরা যেমন নতুন একটি গাণিতিক ফরমুলা দেখতে পারব, তেমনি রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার টিকেও এখন নিরবিচ্ছিন্ন ভাবেই চিন্তা করতে হবে।
আমরা যদি পুরো ব্যাপার টিকে গাণিতিক বিশ্লেষণের দ্বারা ব্যাখা করতে চাই তবে নিরবচ্ছিন্ন সময়ের ক্ষেত্রে আমরা লিখতে পারি,
n → ∞ ( “n” tends to Infinity. )
সেক্ষেত্রে জ্যামিতিক বৃদ্ধির ফরমুলাটি দাঁড়াবে X=P.eⁱᵅ
লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন এই ফরমুলাটিতে স্বাভাবিক লগাদিরমের ভিত্তি এক্সপোনেশিয়াল (Exponential) “e” চলে এসেছে।তাই জ্যামিতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই ফরমুলাটিকেই আমরা সূচকীয় বৃদ্ধির ফরমুলা হিসেবে চিহ্নিত করব।সুতরাং আমরা বলতে পারি সকল সূচকীয় বৃদ্ধি জ্যামিতিক বৃদ্ধি ,কিন্তু সকল জ্যামিতিক বৃদ্ধি সূচকীয় বৃদ্ধি নয়!

এখন সূচকীয় বৃদ্ধির ফরমুলাটিতে যে নতুন একটি বর্ণ “i”, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, সেটি হচ্ছে নিরবিচ্ছিন্ন সময়ের ক্ষেত্রে ভাইরাসটির নতুন রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার।
আর এখানে “a” যে কোনো সময়কে চিহ্নিত করছে।আরো একটি বিষয় বিশেষ ভাবে লক্ষ্যনীয় যে,
যদি i > 0 হয়, তবে X=P.eⁱᵅ এই সূচকীয় ফরমুলাটিকে আমরা সূচকীয় বৃদ্ধি (Exponential increase /Growth ) বলেই অবিহিত করব।
আর যদি i < 0 হয়, তবে X=Pe⁻ⁱᵅ ফরমুলাটি কে বিপরীতক্রমে সূচকীয় ক্ষয় (Exponential Decay) বলে অবিহিত করা হবে।
যখন আমরা শুনতে পাই কোনো মহামারিকে মানুষ তার বশে নিয়ে আসছে, তখন কিন্তু সেখানে এই সূচকী ক্ষয় প্রক্রিয়াটিই চলতে থাকে।আমরা যদি বিভিন্ন মহামারির এপিডেমিক গ্রাফকে বিভিন্ন দিক হতে ভিজুয়ালাইজ করি তাহলে একটি অদ্ভুত মিল দেখতে পাব। প্রায় প্রতিটি মহামারিতেই গ্রাফের শুরুর দিক থেকে আক্রান্তের সংখ্যা, বৃদ্ধির হার অনেকটা সূচকীয় অথবা জ্যামিতিক শেপের মত হয়ে থাকে। কার্ভের পিক (চূড়া) হঠাৎ বেড়ে যেতে থাকে। মহামারি শেষ হওয়ার পর গ্রাফটি যে আকৃতি পায় তা অনেকটা নরমাল ডিস্ট্রিবিউশনের কাছাকাছি হয়ে থাকে, তবে পুরোপুরি নরমাল নয়।

ইবোলা, গ্রেট প্লেগ, সার্স, স্পানিশ ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, ইয়োলো ফিভার মহামারির এপিডেমিক গ্রাফ।

কোভিড-১৯ এর এপিডেমিক গ্রাফের দিকে তাকালে আমরা সেই একই কার্ভের সম্মুখভাগ দেখতে পাই। করোনাভাইরাস শুরুর দিক থেকে এক্সপোনেনশিয়াল রূপে এগোচ্ছে, ভাইরাসের আক্রান্তের হার ক্রমশ কার্ভটিকে হাই পিকে নিয়ে যাচ্ছে। কার্ভের কার্টোসিস ক্রমশ সূচালো হচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে কার্ভের পরিণতি কী হতে পারে?

কোনো এপিডেমিক গ্রাফের ধরণ আজীবন এক্সপোনেনশিয়াল থাকা সম্ভব নয়।অনন্তকাল ধরে যদি আক্রান্ত এবং মৃত্যুবরণের সংখ্যা বাড়তেই থাকে তবে মানবজাতির অস্তিত্ব সেখানেই বিলুপ্ত হবে। এজন্যই স্রষ্টা কোনো মহামারীর গ্রাফকে আনন্তকাল এক্সপোনেনশিয়াল রাখেননি। অন্তত অতীতের গ্রাফগুলো তাই বলে। কার্ভের আরেকটি পরিণতি হতে পারে লজিস্টিক কার্ভের মতো অর্থাৎ হাই পিকের পরে প্যারালাল হয়ে যাবে, বাস্তবে সেটাও সম্ভব নয় কারণ আক্রান্তের সংখ্যা কখনোই স্থির থাকবে না, প্রতিনিয়ত কেউ সুস্থ হয়ে যাবে, কেউ মৃত্যুবরণ করবে অথবা কেউ নতুন আক্রান্ত হবে। সুতরাং কার্ভের আরেকটি পরিণতি থাকে সেটা হল নিম্নমুখী হওয়া। বাস্তবে অতীতের প্রতিটি মহামারীতে সেটিই হয়েছিল, কার্ভের পিক হাই হওয়ার পর সময়ের সাথে সাথে ক্রমশঃ নিম্নমুখী হতে হতে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।

বিশ্ব করোনার মহামরি কার্ভ এবং চীনের মহামারি কার্ভ।

করোনার কার্ভের দিকে লক্ষ্য করলে এক্সপোনেনশিয়াল অংশটি অতীতের প্রাকৃতিক প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি মাত্র। চীনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ইতোমধ্যে নতুন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা শূন্য অর্থাৎ কার্ভটি ক্রমশ নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে এবং এভাবেই একসময় মহামারিটি বিলুপ্ত হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করোনা পরিস্থিতি বিষয়ক গ্রাফ।

অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও কমবেশি একই প্যাটার্ন পাওয়া যাবে। তবে দেশগুলোর নিজস্ব ব্যবস্থাপনা নির্ধারণ করবে কার্ভটি কত দীর্ঘ হবে অর্থাৎ মহামারী কোন দেশে কতদিন ধরে চলমান থাকবে।

এখন আপনাদের  মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আগামী একমাসে করোনায় সম্ভাব্য আক্রান্তের সংখ্যাটি কত হতে পারে?

প্রবন্ধটিতে আগেই উল্লেখ করেছি যে,জ্যামিতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার দুই বা ততোধিক হয়ে থাকে।সুতরাং কোনো অতিমারি সংক্রমণের ক্ষেত্রে জ্যামিতিক বৃদ্ধির সর্বনিম্ন রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার হল দুই। যদি ধরেই নেয়া হয় করোনা ভাইরাসের রিপ্রোডক্টির নাম্বার দুই তবে একজন কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি দিনে সর্বোচ্চ দুই জনের মাঝে এই ভাইরাসটি ছড়াতে সক্ষম হবে।
সুতরাং প্রথম দিনে একজন আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ হতে নতুন করে দু’জন আক্রান্ত হবেন।উপস্থাপনের সুবিধার্থে আমরা লিখতে পারি,

প্রথম দিনে আক্রান্ত = 1⨯2=2¹

দ্বিতীয় দিনে আবার সেই দুই জন ব্যক্তি প্রত্যেকেই দু’জন করে মোট চারজন ব্যক্তিকে আক্রান্ত করবে।

দ্বিতীয় দিনে আক্রান্ত =(1⨯2)+(1⨯2)=4=2²

তৃতীয় দিনে আক্রান্ত এই চারজন ব্যক্তি আবার প্রত্যেকেই নতুন দুজনকরে মোট আট জনকে আক্রান্ত করবে।

তৃতীয় দিনে আক্রান্ত =(1⨯2)+(1⨯2)+(1⨯2)=8=2³

এখন প্রত্যেক দিনের শেষে প্রাপ্ত সংখ্যা গুলোর দিকে একটু বিশেষ নজর দিন।কিছু বুঝতে পারলেন? দেখবেন প্রতিটি দিনেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ভাইরাসটির রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বাররের গুণিতিক!অর্থাৎ আপনি যদি রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার, দুই এর উপর ঘাত(Power) হিসেবে কোনো দিনের ক্রমবাচক সংখ্যাটিকে দেন তবে যে সংখ্যাটি পাবেন, সেই সংখ্যাটিই ঐ দিনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত নতুন ব্যক্তির সংখ্যা নির্দেশ করবে।

সুতরাং n তম দিনের ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসে নতুন করে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যাটি দাঁড়াবে,

(রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার)ⁿ= 2ⁿ

এখন যদি পরীক্ষাধীন সময় হতে n = 30 দিন পর করোনা ভাইরাসটিতে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা আপনাকে বের করতে বলা হয়,তবে আপনি কি করবেন? তখন শুধু 2ⁿ, এই ফরমুলায় n এর স্থানে 30 বাসিয়ে দিবেন। গণনায় আপনাকে একটু সাহায্য করছি, সংখ্যাটি হবে,
2³⁰ = 1,073,741,824. সংখ্যাটির বিশালত্ব হয়ত আমাকে ইতোমধ্যে বিস্মিত করেছে।কারণ আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৩০তম দিনে গিয়ে একশত কোটির ঘর ছাড়িয়ে যাবে।যেটি কিনা বাংলাদেশের জনসংখ্যা অপেক্ষা পাঁচ গুণ বেশি মানুষকে আক্রান্ত করবে! সুতরাং এতোক্ষণে এটি নিশ্চয়ই বুঝেছেন,কোনো সংক্রমণ ব্যধি যদি আজীবন জ্যামিতিক হারেই বাড়তে থাকে তবে সেটি কালেভদ্রে কতটা ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে।
এখন অনেকের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই একটি প্রশ্ন উঁকি দিতে পারে যে,করোনা ভাইরাসটি উৎপত্তির সময় হতে পাঁচ পাঁচটি মাস অতিবাহিত হলেও কেন আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা এখন পর্যন্ত এক কোটির ঘরও ছুঁতে পারেনি? এর কারণ একটাই,ভাইরাসটি সব সময় একই ভাবে ছড়াতে পারে নি আর হয়ত পারছেও না।অর্থাৎ ভাইরাসটি ছড়ানোর ক্ষেত্রে জ্যামিতিক বৃদ্ধির যে চেইনটি আছে , সেটি বিভিন্ন অংশে ভেঙ্গে গেছে ও যাচ্ছে

এই চেইনটি ভেঙ্গে যাওয়ার একটি সহজ কারণ হতে পারে সামাজিক দুরত্ব, হতে পারে সরকার কর্তৃক পরিচালিত দীর্ঘ লকডাউনের ফলাফল, এও হতে পারে আপনার ব্যক্তিগত সচেতনতার জন্য, একদিনের মাস্ক পরার জন্য,সাবান কিংবা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করার জন্য।আবার এমনও পারে হতে পারে, আমরা ভাইরাসটিকে ছড়াতে দিতে চাইনা সেজন্য।

করোনা প্রকৃতি সৃষ্ট নাকি মানব সৃষ্ট, এই বিষয়ের পক্ষে বিপক্ষে রয়েছে অনেক তর্ক, অনেক বিবাদ।কিন্তু বাস্তবতা হল,করোনার উৎপত্তি হয়েছে উন্নত বিশ্বের একটি দেশেই! উন্নত বিশ্বের দেশ গুলো তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি, পিছিয়ে পরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে যুদ্ধ,অন্তর বিবাদ সৃষ্টি কিংবা আন্তঃবিশ্বে বিভিন্ন কূটনীতিক কলহের জেরে যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছে,তার সিঁকি পরিমাণও যদি চিকিৎসা বিজ্ঞান কিংবা পুরো বিশ্বের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ব্যয় করত হবে হয়ত করোনার এই আকস্মিক দৌরাত্ম্য আমাদের এতো দীর্ঘ সময় ধরে দেখতে হত না।তাই করোনা মানব জাতিকে নতুন করে ভাবনার খোরাক দিয়েছে।আমরা কি আগামীতেও দুর্বল ও অসহায়দের ধ্বংসের উৎসবে মেতে থাকব নাকি একটি মানবিক পৃথিবী গড়ার জন্য নতুন করে পদক্ষেপ নেব?

তথ্য সূত্রঃ

https://www.worldometers.info/coronavirus/

https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC5348083/

https://en.wikipedia.org/wiki/E_(mathematical_constant)

Comments

Avatar

ইসলামুল আলম প্রান্ত

বেঁচে আছি নিজেকে বাঁচাতে নয়, নিজের অস্তিত্বকে বাঁচাতে চাই।

আপনার আরো পছন্দ হতে পারে...

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
জানান আমাকে যখন আসবে -
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x