অসংখ্য মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতা রয়েছে যার সূত্রপাত ঘটে মূলতঃ মানসিক চাপ বা পীড়ন বা স্ট্রেস থেকে। আর এমন অসুস্থতা তো খুঁজে পাওয়াই মুশকিল যা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে মানসিক চাপ দ্বারা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয় না। শুধু তাই নয়, এটি আমাদের আচার-আচরণ ও চিন্তা-চেতনায়ও জোরালো প্রভাব ফেলে, কারণ এর মূল প্রোথিত আছে শরীরের গভীরে। আমরা মানসিক চাপ বা স্ট্রেস সম্পর্কে কম-বেশী জানলেও এর রসায়ন সম্পর্কে সেভাবে জানি না। জানলে হয়তো আমরা এর ভয়াবহতা মাথায় রেখে একে এড়িয়ে চলার কৌশলগুলো রপ্ত করতে বেশী মনোযোগী হতাম।
স্ট্রেস বা পীড়ন মূলতঃ আমাদের শরীরের একটি স্বয়ংক্রিয় আত্মরক্ষা পদ্ধতি যা আমাদের অস্তিত্বের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিপদ-আপদের বিরুদ্ধে কাজ করে। আত্মরক্ষা করার এই বৈশিষ্ট্য জন্মগত। বিপদ-আপদ, যাকে আমরা পীড়ক (Stressor) বলি, সেগুলোর আগমনে আমাদের সমবেদী স্নায়ুতন্ত্র (Sympathetic nervous system) এবং অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি (endocrine glands) সম্মিলিতভাবে দেহকে প্রস্তুত করে যাতে দেহ বিপদ সংকুল পরিস্থিতি থেকে হয় পালিয়ে যেতে পারে, নয় বাঁচার জন্য লড়তে পারে। প্রতিপক্ষ বিপদকে কাবু করবার জন্য শরীরের এই বিশেষ প্রতিক্রিয়াকে “লড়ো নয়তো ভাগো” প্রতিক্রিয়া বা Fight or flight response বলা হয়।
বিষয়টি আরো ভালোভাবে বুঝার জন্য একটি দৃশ্য কল্পনা করতে পারেন। ধরুন, আপনার বন্ধু আপনাকে সুন্দরবন ঘুরে দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সেখানকার রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আপনি সুন্দরবন পৌঁছলেন। আপনাদের নৌকায় কোনোকিছুর কমতি ছিল না, তাই তীর থেকে একটু দূরে যেতে ভয়ও ছিল না। রয়েল বেঙ্গল টাইগার মামা সাঁতরে আর কতদূরই বা আসতে পারবে? ভয়হীন চিত্তে বসে গেলেন গানের আড্ডায়। সবে যখন আপনার বন্ধু গিটারে সূর ধরেছে, এমন সময় দেখতে পেলেন ইয়া বড় এক রাজ গোখরো (King cobra) গানের টানে চলে এসেছে। ঠিক যে মুহূর্তে আপনি গোখরো ভাইকে দেখতে পেলেন, সে মুহূর্তে আপনার মস্তিস্ক কিছু শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটাবে যাতে আপনার শরীর আসন্ন বিপদ থেকে বেঁচে ফিরতে পারে। পরিবর্তনগুলো এরকম-
১. হৃদ-কম্পন ও রক্তচাপ বৃদ্ধি করা যাতে শরীরের প্রান্তীয় কোষগুলোতেও রক্ত সরবরাহ হতে পারে।
২. চোখের মণি বড় হওয়া যাতে বেশী আলো প্রবেশ করতে পারে এবং দৃষ্টি সীমানা বৃদ্ধি পায়।
৩. ত্বকের শিরাগুলো সংকুচিত হওয়া যাতে বিপদের সময় ত্বকের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পেশীগুলোতে রক্তের সরবরাহ বাড়ে। একারণে এসময় শীত শীত অনুভূত হয়, কারণ তখন ত্বককে উষ্ণ রাখার জন্য যথেষ্ট রক্ত ত্বকে থাকে না। ভয় পাওয়া থেকে এমন অনুভূতি আমরা প্রায়ই লক্ষ করি।
৪. রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যাওয়া যাতে বাড়তি শক্তি উৎপাদনে ব্যাঘাত না ঘটে।
৫. এ্যাড্রিনালিন হরমোন এবং গ্লুকোজের ক্রিয়ায় পেশীর শক্তিশালী আর টানটান হওয়া। এর ফলে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়, যাকে আমরা বলি শরীরে কাঁটা দেওয়া (Goose bumps)। এরকম হয় কারণ এসময় ত্বকের লোমের চারপাশের পেশীগুলো টানটান হয়ে আশেপাশের ত্বকসহ উপরের দিকে ফুলে উঠে।
৬. ফুসফুসের ক্ষুদ্র পেশীগুলো শিথিল হওয়া যাতে অধিক অক্সিজেন দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে।
৭. অপেক্ষাকৃত অগুরুত্বপূর্ণ তন্ত্রগুলো (যেমন-পাচনতন্ত্র, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা) বন্ধ হয়ে যাওয়া, যেন ঐ মুহুর্তে যে কাজগুলো জরুরী সে কাজগুলোতে শক্তি সরবরাহ করা সম্ভব হয়।
৮. ছোটখাট বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে উপস্থিত পীড়ক (এখানে গোখরো) মোকাবিলায় সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়া।
এই সামগ্রিক পরিবর্তনই লড়ো নয়তো ভাগো প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়া থেকে সুফল পেয়ে আপনাদের কেউ কেউ নৌকা থেকে ঝাঁপিয়ে কূলে ফিরতে সমর্থ হলেন, দু-একজন উদ্যোগী হয়ে গোখরো ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ শুরু করলেন এবং অবশেষে জয়ী হলেন। জীবনগ্রাসী এই বিপদ থেকে বেঁচে ফিরতে পেরে আপনারা ভীষণ শান্ত আর পরিশ্রান্ত অনুভব করতে লাগলেন। এসময় ঘুমিয়ে পড়াটাও অস্বাভাবিক নয়। আপনার শরীরের এমন উত্তেজিত হওয়া থেকে প্রশান্ত হওয়া পর্যন্ত সবগুলো কাজই আপনার দেহাভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া কিছু জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া। এই রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলোকে সামগ্রিকভাবে ”লড়ো নয়তো ভাগো” প্রতিক্রিয়া বলা হয়। এ থেকে একটি বিষয় খুব পরিষ্কার যে, লড়ো নয়তো ভাগো প্রতিক্রিয়াটি বিপদের সময় জীবন রক্ষার জন্য অনস্বীকার্য। একটু ভাবুন তো, যদি বিপদের মুহূর্তে আপনার দেহে ঐ পরিবর্তনগুলো না হত তাহলে তো গোখরোর হাতে জীবনটা সঁপে দেয়া ছাড়া উপায় ছিল না!
আসুন এবার দেখি লড়ো নয়তো ভাগো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে শরীর কীভাবে কাজ করেছে। যখন কেউ চাপের মধ্যে বা পীড়াদায়ক পরিস্থিতিতে পড়ে, তখন মস্তিষ্কের এমিগডালা নামক অংশ থেকে (যেখানে মূলত আবেগ তৈরি হয়) হাইপোথ্যালামাস নামক অংশে একটা সংকেত যায়। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস মূলত নিয়ন্ত্রণ বা আদেশদানকারী কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ সে শরীরের চাহিদা বুঝতে পেরে সে অনুযায়ী অন্য তন্ত্রগুলোকে পদক্ষেপ নেয়ার সংকেত দেয়। তো, এমিগডালা থেকে সংকেত পেয়ে হাইপোথ্যালামাস দুটি তন্ত্রকে চালু করে যাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লড়ো নয়তো ভাগো প্রতিক্রিয়াটি শুরু হয়, আবার এক পর্যায়ে শেষও হয়। তন্ত্র দুটোর একটি হচ্ছে সমবেদী স্নায়ুতন্ত্র, যা স্নায়ুর মধ্য দিয়ে কাজ করে। যখন এই তন্ত্র হাইপোথ্যালামাস হতে সিগন্যাল পায়, তখন এটি শরীরকে সার্বিকভাবে সতর্ক করে। এর প্রভাবে শরীরের সার্বিক গতি বেড়ে যায়, শরীর শক্ত হয়ে উঠে, ঠিক নৌকায় গোখরো ভাইকে দেখামাত্র শরীর যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তেমন। এসময় সমবেদী স্নায়ুতন্ত্র বিভিন্ন গ্রন্থি এবং নরম মাংশপেশীকে সংকেত পাঠায় যাতে তারা নিজ নিজ কাজে নেমে পড়ে। একইসাথে সে এ্যাড্রিনাল গ্রন্থির মেডুলা নামক অংশকে (গ্রন্থির অভ্যন্তরীণ অংশ) নির্দেশ দেয় যেন এপিনেফ্রিন এবং নরএপিনেফ্রিন নামক হরমোন দুটিকে রক্তস্রোতে ছাড়া হয়। এরা স্ট্রেস হরমোন নামে পরিচিত। এরা হৃদ-কম্পন ও রক্তচাপ বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু শারীরিক পরিবর্তন ঘটায়।
একইসাথে মস্তিষ্কের পিটুইটারী গ্রন্থিকে সক্রিয় করার মধ্য দিয়ে হাইপোথ্যালামাস আরেকটা কাজ করে। এ্যাড্রিনাল গ্রন্থির কর্টেক্স নামক অংশকে (গ্রন্থির বহির্ভাগ) সক্রিয় করে। এর ফলে এ্যাড্রিনাল কর্টেক্স হতে কর্টিসলসহ ত্রিশটি ভিন্ন ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয় যারা সমবেদী তন্ত্রের মত স্নায়ুর মধ্য দিয়ে নয়, বরং রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে কাজ করে। এরা লড়ো নয়তো ভাগো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে বিভিন্ন কাজ করে থাকে। এই সামগ্রিক শারীরিক প্রতিক্রিয়ার লক্ষ্য কিন্তু একটাই, বিপদের মুহূর্তে টিকে থাকা। হয় দৌড়ে পালানোর জন্য, নয়তো বিপদের সাথে লড়বার জন্য শরীরকে প্রস্তুত করা। তবে বিপদ যখন তিরোহিত অর্থাৎ গোখরোকে একবার যখন আপনারা পরাজিত করলেন, তখন হাইপোথ্যালামাসের নির্দেশে সমবেদী স্নায়ুতন্ত্র কাজ বন্ধ করে দেয়, আর উপ-সমবেদী স্নায়ুতন্ত্র (Parasympathetic nervous system) হঠাৎ গর্জে উঠা শরীরটাকে আস্তে আস্তে প্রশমিত করে। একারণে গোখরো পরাজিত হবার পর আপনারা শান্ত এবং পরিশ্রান্ত অনুভব করেছিলেন।
সমস্যা হচ্ছে, উপকারী এই শরীরী প্রতিক্রিয়া শরীরের জন্য ভয়ানক ক্ষতিরও কারণ হতে পারে। আমরা জানলাম যে পীড়কের (যেমন, গোখরো) উপস্থিতিতে শরীর এই পীড়ন প্রতিক্রিয়া বা লড়ো নয়তো ভাগো প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। সাধারণত অস্তিত্বের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়কেই মস্তিষ্ক পীড়ক হিসেবে গণ্য করে। তবে কখনও কখনও কাংখিত বা আনন্দের বিষয়গুলোও পীড়নের কারণ হতে পারে। যেমন – সন্তান ধারণ করা, ভ্রমণে যাওয়া, নতুন বাসায় উঠা, পদোন্নতি পাওয়া ইত্যাদি। এ সময়গুলোতে আমরা বড় ধরনের পরিবর্তনের মুখোমুখি হই যার জন্য প্রয়োজন পড়ে বাড়তি চেষ্টা এবং নতুন দায়িত্ব ও পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা। তাই আমরা বিষয়গুলো নিয়ে আতংকিত হই আর তখনই মস্তিষ্ক এগুলোকে পীড়ক মনে করে পীড়ন প্রতিক্রিয়া শুরু করে। তবে এটা ঠিক যে, ভিন্ন ভিন্ন মানুষ পীড়াদায়ক পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। একজনের জন্য যা পীড়াদায়ক, অন্যজনের জন্য তা নাও হতে পারে। একজন বাগ্মীকে কোনোরূপ প্রস্তুতি ছাড়া মঞ্চে তুলে দিলেও তিনি এতটুকু চিন্তিত না হয়ে কর্ম সম্পাদন করে আসতে পারবেন। কিন্তু একই কাজ যদি একজন লাজুক মানুষকে করতে বলা হয়, তবে তিনি ঘেমে নেয়ে একাকার হতে পারেন। কারণ তিনি তখন তার অপারগতার কথা ভেবে চাপ অনুভব করছেন। আবার এমন মানুষও আছেন, যাদের জন্য বিশেষ কোনো একটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করাটাও পীড়াদায়ক। সাধারণত বেশীরভাগ মানুষ যেসব বিষয়ে পীড়া অনুভব করেন, সেগুলো হলো-
১. চাকুরী বা চাকুরী হতে অবসর গ্রহণ সম্পর্কিত
২. সময় বা অর্থের অভাব
৩. কাছের মানুষের মৃত্যু
৪. পারিবারিক সমস্যা
৫. শারীরিক অসুস্থতা
৬. বাসস্থান পরিবর্তন
৭. বিবাহ-বন্ধন বা বিবাহ-বিচ্ছেদ ইত্যাদি।
এছাড়াও রয়েছে গর্ভপাত, যানবাহনে চলাচলের সময় সড়ক দুর্ঘটনার ভয়, প্রতিবেশীর সাথে ঝামেলা, গর্ভধারণ বা নতুন বাবা-মা হওয়া, অতিরিক্ত শব্দ বা জনসমাগম বা অন্যান্য দূষণ, কোনো কাংখিত ফলাফল বা দিনের জন্য অপেক্ষা করা ইত্যাদি।
উপরোক্ত তথ্যগুলো থেকে বলা যায়, আপনি সারাদিনই গোখরোবেষ্টিত। কেননা আপনার বস গোখরো, রাস্তার জ্যাম গোখরো, কাজের ডেডলাইন গোখরো, এমনকি ভ্রমণে যাবার মত আনন্দের বিষয়ও হয়তো আপনার জন্য গোখরো। এভাবে প্রতিনিয়ত গোখরো দিয়ে বেষ্টিত থাকলে আপনার লড়ো নয়তো ভাগো প্রতিক্রিয়াটি আর প্রশমিত হবে না। আপনার হৃদ-স্পন্দন, রক্তচাপ, রক্তের গ্লুকোজ সবসময় উঁচুতে থাকবে। এতে আপনার রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, হার্ট-অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে, স্থূলতা, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগ দেখা দিতে পারে। আর হ্যাঁ, আপনার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যেতে পারে। আরো দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ২০১২ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, যেসব বাবা-মা উপুর্যপরি পীড়নের মুখোমুখি হয়েছেন (হতে পারে তা অর্থনৈতিক বা সামাজিক বা পারিবারিক কোনো সমস্যা), তাদের ছেলেমেয়েরা স্থূলতা রোগে বেশী ভোগে। অর্থাৎ শুধু আপনি নন, আপনার সন্তানও আপনার পীড়নের বলি হতে পারে। তবে স্বস্তির বিষয় এই যে, চাইলেই আমরা পীড়নকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি এবং অনেকে তা করিও। কেউ হয়তো শারীরিক কসরত করি, কেউ প্রার্থনা। কেউ ভালো বন্ধু বা পরিবারের সাথে সময় কাটাই, কেউ করি যোগ ব্যায়াম। কেউ বা গভীর শ্বাস নেয়ার অনুশীলন করি, কেউ ধ্যান। তবে সবচেয়ে বেশী যা প্রয়োজন তা হল, স্ট্রেস বা পীড়নের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন। যে বিষয়টি আমার মধ্যে মানসিক চাপ বা পীড়ন তৈরী করছে, তা নিশ্চয় আমার সুস্থ জীবনের থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ নয়!
তথ্যসূত্র
https://en.wikipedia.org/wiki/Fight-or-flight_response
https://www.health.harvard.edu/staying-healthy/understanding-the-stress-response
খুব সুন্দর লেখা, বিষন্নতা নিয়ে লিখুন।
অনেক ধন্যবাদ। অবশ্যই লিখব!
অনেক তথ্যবহুল।ভাল লাগল অনেক।