আমরা থাকতাম একটা বেলে রঙের পাথরের ঘরে যার দরজার উপর একটা পাখা-ওয়ালা সাপ আর একটা সৌরবলয় ছিল। ঘরটাকে দেখে মনে হতো এটা প্রাচীন সুমেরিয়া অথবা ইন্ডিয়ানা জোন্সের কোনো ঘর। ঘরটা অবশ্য দুটোর কোনোটাই ছিলো না। কিন্তু নিউইর্য়কের উত্তর অংশে যেমনটা মানুষ আশা করে, এটা সেরকম কিছুও ছিলো না। আমাদের বাসার সামনে একটা গভীর খাঁড়ি ছিলো, আর তার ওপারে ইথাকা শহর। গত শতকের শুরুর দিকে ঘরটা কর্নেলের একটা সিক্রেট সোসাইটি “Sphinx head Tomb” এর প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অবশ্য গত শতকের মাঝামাঝি সময়ের পর কয়েকটা শোবার ঘর আর একটা রান্নাঘর যোগ করা হয়। ১৯৮০ সালের দিকে এটাকে পরিপূর্ণ ঘরে রূপান্তরিত করা হয়। আমি আমার অসাধারণ বাবা-মায়ের সাথে থাকতাম এখানেই।
আমার বাবা, জ্যোতির্বিদ কার্ল সেগান, কর্নেলে মহাকাশবিজ্ঞান আর critical thinking শেখাতেন। ১৯৮০ সালের দিকে তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ঘন ঘন টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে মহাবিশ্বের সংক্রামক কৌতুহল ছড়িয়ে দিতে থাকেন। কিন্তু Sphinx Head Tomb-এর ভেতর তিনি আর আমার মা অ্যান ড্রুয়ান বই-প্রবন্ধ- চলচ্চিত্রের কাহিনী লিখতেন। যে কুসংস্কার, আধ্যাত্মবাদ, আর অন্ধ বিশ্বাস সমাজকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করছিলো, সেগুলোকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দর্শন দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার জন্য কাজ করছিলেন। ওরা একে অন্যকে অনেক ভালবাসতেন, আমি এখন বুঝতে পারছি তাঁদের পেশাদারী সাহায্য তাঁদের ভালবাসারই অন্য এক রূপে প্রকাশ ছিল। এরকমই একটা প্রজেক্ট ছিল ১৯৮০ সালের ১৩ পর্বের পিবিএস সিরিজ কসমস যা ওরা যৌথভাবে লিখেছিলেন, আর বাবা উপস্থাপনা করেছিলেন। অনুষ্ঠানটার পুনর্জন্ম ঘটিয়েছেন আমার মা (নীল ডিগ্রাস টাইসনের কসমস, ২০১৪ সালে)।
প্রাথমিক স্কুল শেষ করার পর আমার বাসায় প্রতিরাতে খাবার টেবিলে সংশয়বাদী চিন্তা আর মহাবিশ্বের ধর্ম নিরপেক্ষ ইতিহাসের পরিপূর্ণ শিক্ষা দেয়া হতো। তাঁরা খুব ধৈর্যের সাথে আমার অসীম সংখ্যক “কেন”-র উত্তর দিতেন। কখনো বলেন নি “আমি বলেছি, তাই!” অথবা “এটা এই রকমই”। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সুচিন্তিত আর সৎ জবাব দিয়ে দিতেন তাঁরা; এমনকি সেসব প্রশ্নেরও, যেগুলোর কোনো উত্তর হয় না।
খুব ছোটবেলায় একদিন আমি বাবাকে তাঁর বাবা-মায়ের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। আমি নানা-নানীকে দেখেছি, কিন্তু দাদা-দাদীকে কেনো দেখিনি – তা জানতে চেয়েছিলাম।
“কারণ তাঁরা মারা গেছেন” তিনি বলেন।
“তুমি আবার তাঁদের দেখতে পারবে?” আমি জানতে চাইলাম।
তিনি খুব ভেবেচিন্তে উত্তর প্রস্তুত করছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন, বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে পারলে তিনি আর কিছু চাইতেন না। কিন্তু তাঁর কাছে এমন কোনো কারণ বা প্রমাণ নাই যা মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে সমর্থন করে, তাই তিনি আবেগের লোভে পড়তে পারেন না।
“কেনো?” আমি আবার জানতে চাইলাম।
তিনি খুব কোমল সুরে বললেন যে কোনো কিছুতে বিশ্বাস করার জন্য তাকে সত্য বলে বিবেচনা করা খুব বিপদজনক। নিজেকে এবং অন্যকে, বিশেষ করে যারা কর্তৃত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার মনোভাব যদি না থাকে তবে একজন মানুষকে খুব সহজেই বোকা বানানো যায়। তিনি আমাকে বলেন – “কোনো কিছুর যদি সত্যতা থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে সেটা সূক্ষ্ম যাচাই সহ্য করার ক্ষমতা রাখে”।
আমার যতদূর মনে পড়ে, সেবারই প্রথম আমি মৃত্যুর চিরস্থায়ী রুপের কথা জানতে পেরেছিলাম। আমি গভীরভাবে নিজের অস্তিত্বের সংকটে পড়ে গিয়েছিলাম। তাঁরা আমাকে স্বান্তনা দিয়েছিলেন, কিন্তু অবশ্যই তাদের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা থেকে বিচ্যুত না হয়েই।
“ঠিক এই মুহূর্তে তুমি কিন্তু জীবিত! এটা কিন্তু মোটেও সাধারণ কিছু নয়” তাঁরা আমাকে বললেন, “একটা মানুষ জন্ম নেয়ার রাস্তায় যে কতগুলো বাঁক আছে, সেই অসীম সম্ভাবনার কথা যখন চিন্তা করবে, তখন এই জীবনের জন্যে আপনাআপনিই কৃতজ্ঞতা অনুভব করবে। ভাবো, অসীম সংখ্যক সেই বিকল্প মহাবিশ্বগুলোর কথা, যেখানে হয়তো তোমার প্র-প্র-পিতামাতার কখনো দেখাই হয়নি। আর সে কারণে হয়তো তোমার অস্তিত্বই নেই! তারপর ভাবো, তুমি এমন একটা গ্রহে বিবর্তিত হয়েছো যেখানে তুমি শ্বাস নিতে পারছো, যার পানি পান করতে পারছো, আর এর সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র থেকে উষ্ণতা পাচ্ছো! ডিএনএ জিনিসটার মাধ্যমে কিন্তু তুমি অনেক অনেক প্রজন্মের সাথে সংযুক্ত। আরো বড় ব্যাপার হচ্ছে, তোমার শরীরের প্রতিটি কোষ একটা নক্ষত্রের অন্তরে তৈরি হয়েছিলো। “আমরা নক্ষত্রের টুকরো দিয়েই তৈরি” বাবার এই কথাটা খুব বিখ্যাত হয়েছিলো। এবং তিনি আমাকে এই কথাটার সত্যতা অনুভব করিয়েছিলেন।
আমার বাবা-মা আমাকে শিখিয়েছেন – জীবন যদিও চিরস্থায়ী নয় এবং এজন্যেই বেঁচে থাকাটা এতো সুন্দর একটা জিনিস; যার জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। জীবন যদি চিরস্থায়ী হতো, তবে এটা এতো সুন্দর হতো না।
আমার বয়স যখন ৭ তখন আমরা আরো বড় একটা বাসায় উঠি, মূলত আমার ভাই স্যামের জন্মের প্রস্তুতি নিতে। বাবা-মা Sphinx Head Tomb উন্নয়ন কাজে হাত দিয়েছিলেন বলে সেটা কিছু দিন খালি ছিলো। তাঁদের পড়া-লেখা আর কাজ করার জন্য একটা আলাদা জায়গা দরকার ছিলো। বাড়ি পুনর্নির্মাণ ব্যাপারটা বেশ একটা লম্বা কাজ, এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পুনর্জন্ম লাভ করা সেই বাসায় খুব একটা কাজ করা হয়নি বাবার। তাঁকে দুর্বল, ম্লান, এবং ফ্যাকাশে দেখাতো। রক্ত পরীক্ষার পর জানা গেলো, তাঁর রক্তে খুব দুর্লভ একটা রোগ হয়েছে।
আমরা সিয়াটলে চলে গেলাম যাতে করে বাবা ভালো ডাক্তার দেখাতে পারে। উপশম, অবনতি, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন; অবনতি, দ্বিতীয় অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন, উপশম; অবনতি, তৃতীয় অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন…… তারপর ১৯৯৬ সালের দক্ষিণায়নের (winter solstice) মৌসুমে তিনি মারা যান, আমার বয়স তখন ১৪।
আমাদের Sphinx Head Tomb এর বাসা অব্যবহৃত পড়ে ছিল, ধীরে ধীরে সেটা বাবার লেখা পেপার, নোট, ছবি, কার্যতালিকা, জন্মদিনের কার্ড, ছোটবেলার আঁকা ছবি, আর রিপোর্ট কার্ডে ভরে ওঠে। ১৮ ফুট উঁচু ফাইল ক্যাবিনেটে হাজারো কাগজপত্র জমা হতে থাকে। মা বাবার এসব নথিপত্র রাখার জন্য জায়গা খুঁজতে থাকেন যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে আমার বাবার মহান কর্মজীবনের কথা, কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সংস্থা এই নথিপত্রের সংরক্ষণ আর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি।
মায়ের বয়স বাড়ার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন – বাবার ঐতিহ্য ধরে রাখবেন; তাঁদের যৌথ প্রযোজনায় করা কাজগুলো তাঁর মৃত্যুর পরও চালিয়ে যাবেন। যখন তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না, ঠিক কিভাবে কসমসের কাজ শুরু করবেন, তখন তিনি চার বছর ধরে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। শেষ পর্যন্ত সেথ ম্যাকফারলেন (ফ্যামিলী গাইয়ের স্রষ্টা, যিনি বাবার কাজের অনেক বড় ভক্ত ছিলেন)-এর সাথে মায়ের দেখা হয়। আর তারপর, নতুন কসমসের কাজ শুরু হয়, সেথের অসামান্য সাহায্যে। আমার মায়ের ধরা হাল আর নীল ডিগ্রাস টাইসনের মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনায় কসমস কয়েক মিলিয়ন মানুষকে বিজ্ঞানের রাজকীয়তা আর বাবার আনন্দঘন সংশয়বাদ শেখায়।
কিন্তু সেথ আমাদের জন্য শুধু এটুকুই করেননি! তিনি বাবার কাজগুলো রক্ষার জন্য আরও বড় একটা কাজ করেছেন, যেটা সম্পর্কে টুইটারে ঝড় ওঠেনি। তিনি Sphinx Head Tomb-এ রাখা সকল নথিপত্র- পারমাণবিক শীতকাল সম্পর্কে লেখা সকল প্রবন্ধ, শুক্র গ্রহের (ভেনাস-এর) আবহাওয়ার উপর লেখা প্রবন্ধগুলো, বাবার চিন্তাভাবনার সমষ্টি, আর ছেলেবেলায় আঁকা একটা আন্তঃনাক্ষত্রিক মিশনের ছবি- সবকিছু লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসে রাখার ব্যবস্থা করে দেন।
এই অসাধারণ সম্মান আমাকে ভাবিয়ে তোলে। বাবা মারা যাওয়ার পর একপ্রকার অমরত্ব লাভ করেছেন – হোক সেটা ছোটো, মানবিক, এবং জাগতিক অমরত্ব। কিন্তু এটাই একমাত্র প্রকার অমরত্ব যা একজন মানুষ পেতে পারে। একদিন হয়তো আমাদের সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। লাইব্রেরী অফ কংগ্রেস অন্য কারো কাছে আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির মত হয়ে যাবে। আমাদের প্রজাতি একটা সময় মারা যাবে, অথবা অন্যকিছুতে বিবর্তিত হবে; আমরা যা শ্রদ্ধা করি, তারা হয়তো সেটাকে শ্রদ্ধা করবে না। আর তারপর কয়েক বিলিয়ন বছর পর সূর্য মারা যাবে, আর সাথে চলে যাবে পৃথিবীতে থাকা সকল প্রাণ।
বড় হওয়ার সময় বাবা আমাকে বুঝিয়েছিলেন কেন অমরত্ব লাভ অসম্ভব। কিন্তু আমি এখন ভাবি, ২৩ অথবা ২৪ শতকের কোনো কিশোর আমার বাবার লেখনীর দিকে তাকিয়ে কী ভাববে না যে, কোনো না কোনোভাবে তিনি এখনো আছেন?
এই নভেম্বরের চঞ্চল আর ধূসর দিনগুলিতে, বাবার ৭৯তম জন্মবার্ষিকীর সপ্তাহে আমার পরিবার, আমাদের বন্ধুরা, আর বাবার ছাত্র ও সহকর্মীরা ওয়াশিংটন ডিসিতে সমবেত হন The Seth MacFarlane Collection of Carl Sagan and Ann Druyan Archive এর উদ্বোধনে। কিন্তু যখন আমি আমেরিকার ইতিহাসের সেই গির্জায় ঢুকলাম, বেশ অবাক হলাম – অমরত্ব দেখে নয়, বরং এর বৈপরীত্য দেখে। আমার সামনেই ছিল গুটেনবার্গ বাইবেলের আসল কপি আর গেটিসবার্গ এড্রেস! তখনই আমার মাথায় বজ্রপাতের মত আপতিত হলো – এটা চিরস্থায়ী জীবনের স্মৃতিস্তম্ভ নয়, এটা একটা কবরস্থান!
মাঝে মাঝে দম্পতিরা যেভাবে বিয়ের শপথ নবায়ন করেন, আমরাও সেদিন আমাদের দুঃখ নবায়ন করলাম। আর ঠিক সেই মূহুর্তে, বাবা সেই মানুষগুলোর অন্তরে অত্যন্ত তীব্রভাবে জীবিত ছিলেন, যারা তাকে ভালোবাসতো; আবার তার অনুপস্থিতিটাও ছিলো অত্যন্ত দুঃখজনক। সেদিন লাইব্রেরী অফ কংগ্রেসে, নশ্বরতা আর অবিনশ্বরতার এই প্রহেলিকা আমার জন্য খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু এটাও সেই বিশাল মহাবিশ্বে আমাদের ছোট্ট অবস্থানের ধাঁধাটার মতোই, যেটা বাবা-মা আমাকে Sphinx Head Tomb-এ বলেছিলেন।
মূল প্রবন্ধ –
Lessons of Immortality and Mortality From My Father, Carl Sagan – Sasha Sagan.
অনুবাদ সহায়তা – আদৃতা হাবীব
বিঃদ্রঃ লেখাটি ইতোপূর্বে অনুবাদকদের আড্ডায় প্রকাশিত হয়েছে।
ভালো অনুবাদ হয়েছে
Thanks আমি এই ওয়েবসাইট থেকে carl sagan কে চিনেছি । Carl sagan এর মতোো ভালো মানুষ হয় না । He is the best man for me .