মিথের উপর বিজ্ঞানের প্রভাব

মূলঃ জোসেফ ক্যাম্পবেল(1961)

আমি একদিন আমার একটি বিশেষ পছন্দের রেস্তোরায় খাবার জন্য বসেছিলাম, যখন একটি বার বছরের বালক তার স্কুলব্যাগটি নিয়ে আমার বাম পাশের জায়গাটিতে বসে পড়লো। তার পেছনে পেছনে আসলো তার চেয়েও একটি কমবয়েসী বালক, তার মায়ের হাত ধরে। তারা দুজনে এর পাশের দুটো আসনে বসে পড়লো। তারা যখন তাদের খাবারের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছিলো, আমার পাশে বসা বালকটি তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “জিমি আজকে মানুষের বিবর্তনের উপর একটি রচনা লিখেছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষক বলেছেন যে এটা সঠিক নয়, কারণ আমাদের আদি পিতা-মাতা হলেন আদম আর ইভ  ”।

আমি ভাবলাম, হায় খোদা! এ কেমন শিক্ষক!

পাশের আসনে বসা নারীটি বললেন, “তোমাদের শিক্ষক তো ঠিকই বলেছেন। আদম আর ইভই আমাদের আদি পিতা-মাতা”।

বিংশ শতাব্দীর একটি শিশুর জন্য এ  কেমন মা রে বাবা!

বালকটি বললো, “আমি জানি। তবে এটা ছিল একটা বৈজ্ঞানিক রচনা”।

এতো চমৎকার একটা জবাবের জন্য আমি তখন তাকে একটি স্বর্ণপদক দিতে প্রস্তুত ছিলাম।

তার মাতাটি অবশ্য এতো সহজে থেমে যাবার পাত্রী নন। তিনি রেগেমেগে বললেন, “ওহ! এই বৈজ্ঞানিকের দল! এরা তো জানে শুধুই তত্ত্ব”।

বালকটিও দমে যাবার পাত্র নয়। “হ্যাঁ, আমি জানি”, সে শান্তস্বরে বললো, “কিন্তু এই তত্ত্বগুলো সত্যায়িত (factualized) হয়েছেঃ তারা হাড়গুলো খুঁজে পেয়েছে।”

এরপর  তাদের দুধ আর স্যান্ডউইচ এসে পড়ায় এই আলোচনার এখানেই ইতি হলো।

আসুন আমরা এখন কয়েক মুহূর্ত মহাজগতের সেই পবিত্র রূপ নিয়ে চিন্তা করি, যা এই বালকটির মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন খুদে সত্যসন্ধানীদের দ্বারা কলুষিত হয়েছে।

মধ্যযুগের মধ্যভাগে, মোটামুটি দ্বাদশ এবং ক্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে, পৃথিবী সম্পর্কে দুটি ভিন্ন ধারণা প্রচলিত ছিল। বেশি জনপ্রিয় ধারণাটি ছিল যে পৃথিবী হলো একটি থালার মদ্যভাগের মতো সমতল, যেটা একটি মহাজাগতিক সমুদ্রে ভাসছে, যে সমুদ্রে সবরকমের প্রাণঘাতী বিপজ্জনক দানবের বসবাস। এটা হলো অনাদিকালের প্রাচীন একটা ধারণা, যার শেকড় পাওয়া যায় ব্রোঞ্জ যুগের প্রারম্ভে। এই ধারণা ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বের সুমেরিয়ানদের কুনেইফর্ম(Cuneiform) লিপিতে দেখতে পাওয়া যায়। পরবর্তীতে এটি বাইবেল দ্বারা স্বীকৃত হয়।

আরেকটু বেশি সিরিয়াসলি আমলে নেয়া মধ্যযুগীয় ধারণাটি হলো প্রাচীন গ্রীকদের, যেই ধারণা অনুসারে পৃথিবী সমতল নয়, বরং একটি চাইনিজ বাক্সের মতো আরও সাতটি ঘূর্ণায়মান গোলকের কেন্দ্রে একটি কঠিন স্থির গোলক। এই সাতটি গোলকের প্রত্যেকেই হলো একেকটি দৃশ্যমান গ্রহঃ চাঁদ, শুক্র ,বুধ, সূর্য, মঙ্গল, বৃহস্পতি, এবং শনি, যাদের নামে সপ্তাহের সাতটি দিনের নামকরণ করা হয়েছে। এই সাতটি শব্দের উচ্চারণে আবার একটি সুর তৈরি হয়, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘মহাজাগতিক গোলকের সুর’, যার সাথে আমাদের স্বরসপ্তকের মিল রয়েছে। এই সাতটি গ্রহের প্রতীক হিসেবে সাতটি ধাতুকে বেছে নেয়া হয়ঃ রুপা, পারদ, তামা, সোনা, লোহা, টিন, এবং সীসা। আত্মারা যখন স্বর্গ থেকে জন্মগ্রহণের জন্য মর্ত্য নেমে আসতো, নেমে আসার সময় তারা এইসব ধাতুর গুণাবলী নিজেদের মাঝে আত্মস্থ করে নিতো। এইভাবে, আমাদের শরীর আর আত্মা তৈরি হতো সেই একই উপাদানে যেই উপাদানে এই মহাজগত সৃষ্ট। অন্যভাবে বললে, আমাদের মধ্য যেন বেজে চলেছে এক মহাজাগতিক সুর।

এই আদি দর্শন অনুসারে, সঙ্গীত আর শিল্পকলার উদ্দেশ্য হলো আমাদের মনের সাথে এই মহাজাগতিক সুরের ঐকতান তৈরি করা, আমাদের চিন্তা আর জাগতিক কাজকর্ম যেই ঐকতানকে ছিন্ন করে। মধ্যযুগে এই সাতটি গোলকের অনুসঙ্গী ভাবা হতো জ্ঞানের সাতটি শাখাকেঃ ব্যাকরণ, যুক্তিবিদ্যা, অলঙ্কারশাস্ত্র, পাটিগণিত, সঙ্গীত, জ্যামিতি এবং জ্যোতির্বিদ্যা। আর এই সাতটি গোলক কেবল নিছক স্থবির গোলক ছিল না , তারা ছিল একেকটি জীবন্ত আধ্যাত্মিক শক্তি, যার দায়িত্বে ছিল দেবদূতেরা। অথবা, প্লাটো যেমনটা বলেছিলেন, কুহকিনীরা। আর এইসবের ঊর্ধ্বে ছিল ঈশ্বরের আলোকময় মহাজাগতিক আসন, যেখানে ঈশ্বর তার সিংহাসনে বসে আছেন। যখন মৃত্যুর পরে আত্মারা তাদের স্রষ্টার কাছে ফিরে যাবে, তারা তখন আবার এই সাতটি গোলকের মধ্য দিয়ে যাত্রা করবে। ফিরতি যাত্রার সময় তারা এই সাতটি গোলকের মধ্যে তাদের গুণাবলী পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় তাদের স্রষ্টার কাছে সমর্পণ করবে। সম্রাট এবং পোপকে ভাবা হতো ঈশ্বরের নিয়োজিত প্রতিনিধি, যারা ঈশ্বরের হয়ে পৃথিবী শাসন করেন। এভাবে মধ্যযুগীয় চিন্তার সর্বাঙ্গে মহাজাগতিক কাঠামো, শাসন ব্যাবস্থা এবং সমাজের একক ব্যাক্তির উন্নতির মাঝে সমন্বয় বজায় ছিল। দ্বিধাহীন আনুগত্যর মাধ্যমে একজন ক্রিশ্চিয়ান তাই শুধু তার সমাজের সাথেই নয়, তার নিজের স্বার্থ এবং প্রকৃতির নিয়মের সাথেও সমন্বয় সাধন করত। ক্রিশ্চিয়ান সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর বুকে স্বর্গীয় শৃঙ্খলার প্রতিরূপ; যার প্রতিফলন হতো ধর্মযাজকদের পোষাকে, রাজার সিংহাসনে, স্বর্গীয় চিত্রকল্পের দ্বারা অনুপ্রাণিত রাজ্যর জমকালো শাসনপ্রণালীতে, গির্জার ঘন্টায়, আর যাজকদের সমবেত সঙ্গীতের মাধ্যমে, যা পৃথিবীর সুরে ঘোষণা করতো মহাজগতের স্বর্গীয় বার্তা।

দান্তে তার ‘ডিভাইন কমেডি’তে মহাবিশ্বের এমন একটি রূপ তুলে ধরেন যা সেই সময়ের ধর্মীয় এবং বৈজ্ঞানিক ধারণা উভয়কেই সন্তুষ্ট করেছিল। শয়তানকে যখন তার অহংকার এবং অবাধ্যতার জন্য স্বর্গ থেকে ছুঁড়ে ফেলা হলো, সে একটা জ্বলন্ত ধূমকেতুর মতো পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে পৃথিবীর ভূমি ছিদ্র করে এর কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছেছিল। তখন সে যেই ভীষণ আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ উন্মোচন করেছিল, সেটা পরিচিতি পায় নরকের জ্বলন্ত কোটর হিসেবে। আর যে বিশাল আয়তনের ভূমি স্থানচ্যুত হয়েছিল তা দিয়ে গঠিত হয় স্বর্গ-নরকের মধ্যবর্তী স্থানের(Purgatory) পাহাড়। দান্তে একে উপস্থাপন করেছিলেন আকাশের দিকে মুখ করা দক্ষিণ মেরু হিসেবে। এই ধারণা অনুসারে, সম্পূর্ণ দক্ষিণ গোলার্ধ ছিল জলময়, আর তা থেকে ফুঁড়ে বেড়িয়েছিল এই বিশালাকার পর্বত, যার চূড়ায় রয়েছে পৃথিবীর বুকে স্বর্গ, যার কেন্দ্র থেকে উৎপত্তি হয়েছে চার পবিত্র নদীর, যাদের কথা ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে।

তাই আমরা এটা মনে করতে পারি যে যখন কলম্বাস তার সঙ্গীসাথিদের নিয়ে ‘নীল সাগরের’ ওপারে যাত্রা করেছিলেন, যেই সাগরকে তার প্রতিবেশীরা এবং সম্ভবত তার সহনাবিকেরাও বিশ্বাস করতো পৃথিবীর প্রান্তের সাগর হিসেবে, যা পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে। কলম্বাসের মনে সম্ভবত ছিল দান্তের জগতের আদলে একটা চিত্র, যার সম্পর্কে আসলে আমরা তার দিনলিপি থেকেই জানতে পারি। আমরা সেখান থেকে জানতে পারি যে, তার তৃতীয় সমুদ্রযাত্রার সময় যখন তিনি তার পলকা জলযানে করে মহা বিপদসঙ্কুল পরিবেশের মাঝে ত্রিনিদাদ আর মূল ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে পৌঁছুলেন, তিনি লক্ষ্য করলেন যে সেখানে বিপুল পরিমাণ সুপেয় জলরাশি(অরিনোকো পর্বত থেকে প্রবাহিত হওয়া) লবণের সাথে মিশেছে। এর বাইরের ভুখন্ড সম্পর্কে কিছুই না জানা থাকায় এবং তার মনে সেই মধ্যযুগীয় ধারণা  থাকায়, কলম্বাস ধারণা করলেন যে এই সুপেয় পানির উৎস হলো স্বর্গের নদী, যা বিপরীত পৃথিবীপৃষ্ঠের পাহাড়(Antipodal mountain) থেকে দক্ষিণ সমুদ্রে এসে পড়ছে। তদুপরি তিনি যখন উত্তরে যাত্রা শুরু করলেন, তিনি লক্ষ্য করলেন যে তার জাহাজ দক্ষিণে যাত্রাকালের সময়ের চেয়ে দ্রুতবেগে চলছে। তিনি এটাকে প্রমাণ হিসেবে ধরে নিলেন যে তার জাহাজ এখন নিম্নমুখে যাত্রা করছে, পুরাণে বর্ণিত পর্বতের শৈলান্তরীপের পাদদেশ থেকে।

আমি এভাবে চিন্তা করতে পছন্দ করি যে ১৪৯২ সাল থেকে পুরনো পৌরাণিক সিস্টেমের কর্তৃত্বের সমাপ্তি ঘটেছে, অন্তত সমাপ্তি প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটেছে, যেই পুরাণ মানুষকে অনাদিকাল থেকে টিকে থাকার রসদ যুগিয়েছিল এবং অনুপ্রাণিত করেছিল। কলম্বাসের যুগান্তকারী সমুদ্রযাত্রার কিছুকাল পরেই মাগেলান(Magellan)  জলপথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেন। এর কিছুদিন আগেই ভাস্কো ডা গামা আফ্রিকা থেকে ভারতে ভ্রমণ করেছিলেন। পৃথিবীর বুকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে অভিযান চালানো শুরু হলো, এবং পুরাণে বর্ণিত ভূগোলের ধারণা বাতিল হতে থাকলো। পৃথিবীর বুকেই কোথাও স্বর্গীয় উদ্যান রয়েছে, এটা প্রমাণের চেষ্টায় সেইন্ট থমাস অ্যাকুয়ানিয়াস কলম্বাসের সমুদ্রযাত্রার মাত্র আড়াইশ বছর আগে এরকমটি লিখেছিলেনঃ “পৃথিবী থেকে স্বর্গ বিচ্ছিন্ন রয়েছে সমুদ্র আর পর্বত দিয়ে। অথবা কোন উত্তপ্ত অঞ্চলের মাদ্ধ্যমে, যেটা অতিক্রম করা সম্ভব নয়। তাই যারা প্রাকৃতিক মানচিত্র নিয়ে লেখেন, তাদের লেখায় এর কোন বিবরণ নেই ”। এই সমুদ্রযাত্রার পঞ্চাশ বছর পরে কেপারনিকাস  সৌরকেন্দ্রিক মহাজাগতের উপর তার গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তার ষাট বছর পরে গ্যালিলিওর ছোট্ট টেলিস্কোপ কেপারনিকাসের মডেলকে বাস্তব ভিত্তি দেয়। ১৬১৬ সাথে গ্যালিলিও তদন্তকারী দলের দ্বারা দোষী স্যাব্বাস্ত হোন—যেমনটি আমার পাশে বসা বালকটি হয়েছিল তার মায়ের দ্বারা—পবিত্র ধর্মগ্রন্থের বিপরীতে যায় এমন মতবাদ প্রচার করার অপরাধে। আজকের যুগে অবশ্যই আমাদের কাছে অনেক বড় টেলিস্কোপ রয়েছে অনেক পর্বতের চূড়ায়, যেমন ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসনে এবং মাউন্ট পালোমারে, অ্যারিজোনার কিট পিকে, হাউইতে। এখন শুধু সূর্যই সৌরজগতের কেন্দ্র হিসেবে সর্বসম্মত নয়, আমরা এও জানি যে সূর্য হলো এই ছায়াপথের প্রায় দুশ বিলিয়ন জ্বলন্ত নক্ষত্রের মাঝে একটি নক্ষত্রঃ যেই ছায়াপথের আকার হলো একটি অদ্ভুত লেন্সের মতো, তার ব্যাস হলো হাজার হাজার আলোকবর্ষ। শুধু তাই নয়! আমাদের টেলিস্কোপগুলো আমাদেরকে আরও জানাচ্ছে যে এই জ্বলন্ত নক্ষত্রগুলোর মাঝে কিছু কিছু আলোর উৎস আসলে নিজেরা নক্ষত্র নয়, বরং তারা নিজেরাই একেকটি ছায়াপথ, প্রত্যেকটি আমাদের নিজেদের ছায়াপথের মতোই বিশালাকার এবং অচিন্ত্য, যাদেরকে দেখা গেছে সংখ্যায় হাজারে হাজারে। তাই মহাজগতের যে বিস্ময়কর চিত্র আজ বিজ্ঞানীদের চেষ্টায় আমাদের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে, সেটা নিশ্চিতভাবেই পূর্ববর্তী যে কোন সময়ের কল্পনার চেয়ে আমাদের মনে অনেক বেশি মুগ্ধতা এবং সম্মোহনের জন্ম দেয়। এর তুলনায় বাইবেলের খেলনা-ঘরের চিত্র নিতান্ত শিশুসুলভ—যা এমনকি এখন আর শিশুদের জন্যও উপযুক্ত নয়, আমরা যদি আমার পাশে বসা সেই খুদে পন্ডিতের কথায় ফিরে যাই, যে তার “হ্যাঁ, আমি জানি, তবে এটা ছিল একটা বৈজ্ঞানিক রচনা”। সে ইতোমধ্যেই তার শিক্ষাকে তার মায়ের চার্চের মধ্যযুগীয় থাবার কবল থেকে রক্ষা করার একটা উপায় খুঁজে পেয়েছে।

এতে শুধু মহাজগতের প্রকৃতি সম্পর্কিত পৌরাণিক ধারণাগুলোই ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায়নি, এর সাথে বদলে গেছে মানুষের জন্মের উৎস আর তার ইতিহাস। শেক্সপিয়ারের সময়েই, যখন যখন স্যার ওয়াল্টার রালেগ আমেরিকায় পা রেখে সেখানকার নতুন প্রাণীদের দেখলেন, যা অন্যদিকে তখনো অজানা ছিল, একজন সুদক্ষ নাবিক হিসেবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে নূহের পক্ষে কেবল একটি ভেলায় এতো প্রজাতির সংস্থান করা পুরোপুরি অসম্ভব ছিল, তা যত বড় ভেলাই হোক না কেন। বাইবেলের বন্যার গল্প ছিল অসত্য, যা প্রমাণ করা সম্ভব ছিল না। (মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা মারার জন্যই বোধহয়) আজ আমরা পৃথিবীর বুকে আদি মানবসদৃশ প্রাণীদের উৎপত্তির সময়কাল নির্ধারণ করছি, যা বাইবেলে বর্ণীত ঈশ্বরের পৃথিবীর বয়সের চেয়ে মিলিয়ন বছরের বেশি পুরনো। ইউরোপের প্রস্তরযুগীয় গুহাগুলো প্রায় ৩০,০০০ বছরের পুরনো। প্রথম কৃষিকাজের সূচনা হয়েছিল প্রায় ১০,০০০ বছর আগে, এবং প্রথম নগরের পত্তন হয়েছিল প্রায় ৭০০০ বছর আগে। তবে জেনেসিসের ৪:২ এবং ৪:১৭ অনুসারে, পৃথিবীর প্রথম মানব আদমের জ্যৈষ্ঠ পুত্র কাবিলকে(Cain) ঘোষণা  করা হয়েছে ‘পৃথিবীর বুকে একটি লাঙ্গল’ হিসেবে, যে কিনা ইডেনের পূর্বদিকে ইনোখ নামের একটি নগরীর গোড়াপত্তন করেছিল। আবারও বাইবেলের এই ‘তত্ত্ব’ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, এবং ‘তারা হাড়গুলো খুঁজে পেয়েছে!’।

এর সাথে সাথে তারা দালানগুলোও খুঁজে পেয়েছে, যেগুলোর সাথে ধর্মগ্রন্থের কাহিনীর কোন সামঞ্জস্য নেই। উদাহরণস্বরূপ, মিশরীয় ইতিহাসে দ্বিতীয় রামসেস(খ্রিষ্টপূর্ব ১৩০১-১২৩৪), অথবা মেরনেপ্টাহ(খ্রিষ্টপূর্ব ১২৩৪-১২১০) অথবা দ্বিতীয় সেটি(খ্রিষ্টপূর্ব ১২২০-১২০০) এর সময়কাল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় সেই সময়ের পুরাতাত্ত্বিক এবং হায়ারোগ্লিফিক ধ্বংসাবশেষ থেকে। তবে এখানে বাইবেলে বর্ণিত সেই বিখ্যাত মহামারীর কোন বর্ণনা নেই, এমনকি এর কাছাকাছি কোন কিছুর বর্ণনাও নেই। তদুপরি, অন্যান্য উৎস থেকে আমরা জানতে পারি যে, বেদুইন হিব্রু, ‘‘হাবিরু’’রা ইখনাটনের শাসনামল( খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৭৭-১৩৫৮) থেকেই কানানে হামলা করা শুরু করেছিল, রামসেসের সময়কালের এক শতাব্দী আগে। সোজা বাংলায় এর অর্থ হলো এই যে, এই হিব্রু লিপি থেকে সৃষ্টিতত্ত্ব, মহাপ্রস্থান, মরুভূমিতে চল্লিশ বছরের মতো ইহুদিদের যেসব জনপ্রিয় কিংবদন্তি রয়েছে, তারা কোন ‘ঈশ্বরের’ দ্বারা রচিত হয়নি। তারা মুসা নামের কোন ব্যাক্তির দ্বারাও রচিত হয়নি, বরং রচিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখকের দ্বারা, এবং যে সময়কালে ধারণা করা হয়েছিল তার অনেক পরবর্তী সময়ে। ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রথম পাঁচটি বই(তোরা) সন্নিবেশিত করা হয় ইজরার(খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী) পরবর্তীকালে। এবং যেই লিপিগুলো থেকে এই গ্রন্থগুলোর জন্ম হয়, তার উৎস পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব নবম শতাব্দী(যাদেরকে বলা হয় J  এবং E  লিপি) থেকে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত (P অথবা priestly/ যাজকীয় লিপি)। এখানে লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার হলো যে, নূহের বন্যার দুটি বিবরণ রয়েছে। প্রথমটি থেকে আমরা জানতে পারি নূহ তার ভেলায় “প্রতিটি জীবন্ত জিনিষ একজোড়া করে নিয়েছিলেন”(জেনেসিস ৬:১৯-২০; P লিপি, ইজরা পরবর্তী)।এবং দ্বিতীয়টি থেকে আমরা জানতে পারি  নূহ তার ভেলায় নিয়েছিলেন “প্রতিটি পরিচ্ছন্ন প্রাণী সাত জোড়া করে, এবং অপরিচ্ছন্ন প্রানী কেবল একজোড়া করে”(জেনেসিস ৭:২-৩; J লিপি, খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ শতাব্দী)। আমরা সৃষ্টি নিয়েও দুটি কাহিনী পাই, প্রথমটি জেনেসিস ২ তে, দ্বিতীয়টি জেনেসিস ১ এ। জেনেসিস ২ এর কাহিনী অনুসারে, শুরুতে একটি বাগান সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং তারপর এই বাগানের দেখাশোনা করার জন্য একজন মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছিল ; এবং তারপর অন্য প্রাণীদের সৃষ্টি করা হয়েছিল, এবং সবার শেষে(যেন স্বপ্নের মাঝে) মাতা ইভকে সৃষ্টি করা হয়েছিল আদমের পাঁজরের হাড় থেকে। অন্যদিকে, জেনেসিস ১ এর মতে, ঈশ্বর একা মহাজাগতিক সমুদ্রে দাঁড়িয়ে বললেন, “ Let there be light”; এবং এরপর পর্যায়ক্রমে মহাবিশ্বের জন্ম হলো। শুরতে আলো, এরপরে সূর্য, এর তিনদিন পরে উদ্ভিদ, প্রাণী এবং সবশেষে মানুষ, নারী এবং পুরুষ একসাথে। জেনেসিস ১ এর সময়কাল হলো খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী(অ্যারিস্টটলের সময়কাল) এবং জেনেসিস ২ এর সময়কাল হলো খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম অথবা নবম শতাব্দী( হেসিওডের সময়কাল)।

বিভিন্ন সংস্কৃতির মাঝে তুলনামূলক গবেষণার মাধ্যমে এটা প্রশ্নাতীতভাবে পরিষ্কার যে, একই রকম মিথ পৃথিবীর সবকোণায় পাওয়া যায়। যখন করটেস( Cortes) এবং তার ক্যাথলিক স্প্যানিয়ারডরা আজটেকদের মেক্সিকোতে পা রাখলো, স্থানীয় ধর্মের সাথে তারা তাদের নিজেদের ‘সত্যিকারের’ বিশ্বাসের এতো বেশি মিল খুঁজে পেল যে তা ব্যাখ্যা করা তাদের পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়লো। সেখানে উঁচু পিরামিড আকৃতির মন্দির ছিল, যেখানে দান্তের স্বর্গ-নরকের মধ্যবর্তী পর্বতের মতো পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধাপে আত্মার উত্তরণকে চিত্রায়িত করা হয়েছিল। সেখানে ছিল তেরটা স্বর্গ, যার প্রত্যেকটির  নিজস্ব ঈশ্বর অথবা দেবদূত ছিল, এবং নয়টি নরক, যেখানে আত্মাদের শাস্তি হতো। এদের সবার উপরে একজন বড় ঈশ্বর ছিলেন, যিনি ছিলেন মানুষের সকল চিন্তা এবং কল্পনার অতীত। এমনকি সেখানে একজন দেহধারী রক্ষাকর্তাও ছিলেন, যার জন্ম হয়েছিল এক কুমারী মাতার গর্ভ থেকে। যার মৃত্যু এবং পুনর্জন্ম হয়েছিল, যার একটা প্রতীক ছিল ক্রুশ। পাদ্রীরা এই মিথকে ব্যাখ্যা করার জন্য তাদের নিজস্ব দুটি নতুন মিথের উদ্ভাবন করলেন। প্রথমটা হলো যে, সেইন্ট থমাস সম্ভবত ঈশ্বরের বাণী প্রচারের জন্য আমেরিকা পৌঁছেছিলেন এবং এখানে তার গস্পেল প্রচার করেছছিলেন, তবে এই উপকূলগুলো রোমের প্রভাববলয় থেকে অনেক বেশি দূরবর্তী হবার কারণে ঈশ্বরের বাণী এখানে বিকৃত রূপ ধারণ করেছে। তাই তারা এখানে যা দেখছে, সেটা আসলে তাদের মূল ধর্মেরই এক অতি বিকৃত রূপ। দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি হলো, শয়তান তাদের ধর্মের প্রচারণা ব্যর্থ করার উদ্দেশ্য এখানে ইচ্ছাকৃতভাবেই ক্রিশ্চিয়ান বিশ্বাসের ব্যাঙ্গাতক সংস্করণ ছড়াচ্ছে।

আধুনিক গবেষকেরা সুশৃঙ্খলভাবে বিভিন্ন মিথ এবং ধর্মীয় আচারের তুলনামূলক গবেষণার মাধ্যমে দেখেছেন যে, প্রায় সবখানেই এমন একটি কিংবদন্তী রয়েছে যেখানে একজন কুমারী মাতা এক বীরের জন্ম দেয়, যার মৃত্যু এবং পুনর্জন্ম হয়। ভারতীয় উপমহাদেশ এমন উপকথায় ভর্তি, এবং আজটেক মন্দিরের মতোই এর উঁচু মন্দিরগুলো বিভিন্ন ধাপের মহাজাগতিক পর্বতের চিত্র পাওয়া যায়, যার চূড়ায় রয়েছে স্বর্গ এবং নিচে রয়েছে নরক।

বৌদ্ধ এবং জৈন সম্প্রদায়েও এরকম ধারণা পাওয়া যায়। আমরা যদি পেছনে তাকিয়ে ক্রিশ্চিয়ান পূর্ব যুগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি, মিশরীয় মিথে আমরা দেখব যে অসিরিসকে জবাই করা হয়েছে এবং তার পুনর্জন্ম হয়েছে। মেসোপটেমিয়ায় আমরা দেখি তাম্মুজকে, সিরিয়ায় আমরা দেখি অ্যাডোনিসকে, গ্রিসে আমরা দেখি ডায়োনাইসাসকেঃ এদের সবার মাঝেই ক্রিশ্চিয়ান যুগের যীশুর নকশা ছিল।

সব সময়ের সব সভ্যতার মানুষের মাঝেই তাদের নিজেদের মিথের প্রতিকী চরিত্রদের আক্ষরিক অর্থে নেয়ার প্রবণতা ছিল। এর মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে বিশেষ অবস্থানের অধীকারী হিসেবে ভাবতে পারতো, যাদের সাথে পরম স্রষ্টার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি বহুঈশ্বরবাদী গ্রিক এবং রোমান, হিন্দু এবং চায়নিজ; যদিও তারা সকলেই অন্যদের সংস্কৃতি এবং দেবতাদের সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতো, তারা সকলেই নিজেদের ঈশ্বরকেই সর্বশ্রেষ্ট হিসেবে ভাবতো, নিদেনপক্ষে অন্যদের ঈশ্বরের চেয়ে শ্রেষ্টতর গন্য করতো। এবং একেশ্বরবাদী ইহুদি, ক্রিশ্চিয়ান এবং মোহাম্মদীরা তো অন্যদের ঈশ্বরকে ঈশ্বর বলেই গণ্য করতো না, বরং শয়তান হিসেবে গণ্য করতো, এবং তাদের পূজারীদের শয়তানের উপাসক হিসেবে বিবেচনা করতো। মক্কা, রোম, জেরুজালেম এবং (কিছুমাত্রায় কম জোরালোভাবে) বেনারস এবং পেকিং তাই নিজেদের মতো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে  মহাজগতের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে  কাজ করে আসছে—যা একটা হটলাইনের মাধ্যমে সরাসরি ঈশ্বরের রাজ্যর সাথে যুক্ত।

তবে, আজকের দিনে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরেও এইসব দাবিকে আর সিরিয়াসলি নেবার জো নেই। আর এখানেই রয়েছে অতীব বিপদের ঝুঁকি। কারণ মানুষ যে শুধু তার মিথকে আক্ষরিকভাবে নিয়ে অভ্যস্ত তাই নয়,  এই মিথের সংকেত এবং প্রতীকগুলো সবসময়ের মতো আজো তাদের সভ্যতা, নৈতিকতা, প্রাণশক্তি এবং সৃজনশীলতার উৎস। এইসবকিছুর বিনাশের ফলে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। আর অনিশ্চয়তার সাথে দেখা দেয় অসাম্যাবস্থা। কারণ, যেমনটা নীটশে এবং ইবসেন দুজনেই জানতেন, জীবনের জন্য প্রয়োজন জীবনের প্রেরণাদায়ী ভ্রম। আর যেখানে ভ্রমের অবসান হয়, সেখানে শক্ত করে আঁকড়ে ধরার মতো কিছুই থাকে না, কোন নৈতিক ভিত্তি থাকে না। আমরা এরকমটা আগে ঘটতে দেখেছি। উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন(Primitive) মানব সম্প্রদায়ের মাঝে আধুনিক সাদা মানুষের অনুপ্রবেশের ফলে সেখানে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। যখন তাদের পুরনো ট্যাবুগুলো ভিত্তি হারিয়ে ফেলে, তারা সাথে সাথে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তারা অবক্ষয়ী হয়ে ওঠে, অন্যায় আর অপরাধের ডেরা হয়ে ওঠে।

আজ সেই একই ব্যাপার ঘটছে আমাদের ক্ষেত্রে। যখন আমাদের পুরনো মিথের ট্যাবুগুলো আধুনিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে ভিত্তিহীন হয়ে পড়ছে, সভ্য জগতের সবখানেই অপরাধ, মানসিক রোগ, আত্মহত্যা, নেশাজাতক মাদকের ব্যবহার, অসুখী পরিবার, উদ্ধত শিশু, হিংস্রতা, হত্যা এবং হতাশা বেড়ে চলেছে। আমি এগুলো বানিয়ে বলছি না, এগুলো ফ্যাক্ট। এইসব ব্যাপার আমাদেরকে ধর্মযাজকদের আহবান শুনে পুরনো ধর্মে ফিরে যাবার জন্য আবেদন জানায়। তারা আমাদের আধুনিক শিক্ষকের বিশ্বাস এবং আনুগত্যকেও চ্যালেঞ্জ জানায়। বিবেকবান শিক্ষকটি—যার কাঁধে তার ছাত্রের নৈতিক চরিত্র এবং পুঁথিগত শিক্ষার ভার উভয়ই নিয়োজিত—তিনি কি প্রথমে আমাদের প্রেরণাদায়ী মিথের প্রতি অনুগত হবেন- নাকি বিজ্ঞানের “প্রমাণিত”(Factualized) সত্যর প্রতি অনুগত হবেন? এই দুটো কি পরস্পরবিরোধী? নাকি ভ্রম আর সত্যর এই সংঘাতের মধ্যে থেকে কোন প্রজ্ঞা( Wisdom) নিহিত আছে, যার মাধ্যমে জীবনকে আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব?

আমার মতে, আমাদের সন্তান-সন্ততি বড় করার সময়কালে এটি একটি গুরুত্ববহ প্রশ্ন। আদতে এই সমস্যাটিই, সেদিন রেস্তোরায় আমার পাশে বসে ছিল। এক্ষেত্রে, শিক্ষক এবং অভিভাবক, দুজনেই ইতোমধ্যে সেকেলে হয়ে যাওয়া ভ্রমকে আঁকড়ে ধরেছিলেন—এবং আমার মনে হয় সার্বিকভাবে সমাজের বেশিরভাগ অভিভাবকের সেই দিকে যাওয়ার একটা প্রবণতা আছে। তারা তাদের কর্তৃত্ব জাহির করে অপ্রীতিকর সত্যর অনুসন্ধানকে রুদ্ধ করতে চান। এবং আমরা তাদের মনোভাবকে বুঝতে পারি, এমনকি কিছুমাত্রায় তাদের উদ্বেগ আমরা নিজেদের মাঝেও ধারণ করতে পারি, যেহেতু পৃথিবী মিথ্যার উপর ভর করেই বেঁচে থাকে— যারা সত্যর মুখোমুখি হবার সাহস পায় এবং সে অনুসারে নিজের জীবনকে সাজাতে পারে তাদের সংখ্যা বেশি নয়, বরং খুবই কম।

আমার বিশ্বাস যে, এই সংকটপূর্ণ সমস্যার সবচেয়ে ভালো উত্তর আছে মনোবিজ্ঞানের আবিষ্কারে, বিশেষত যে আবিষ্কারগুলো আমাদের মিথের উৎস এবং প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত।  মিথ সবসময়েই আমাদের সমাজের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এসেছে, এবং মিথকে ধর্মের মাধ্যমে মাহাত্ম্য দান করা হয়েছে। যেহেতু মিথের উপর বিজ্ঞানের প্রভাবের ফলে— বলা যায় একরকম অনিবার্যভাবেই–নৈতিক সাম্যাবস্থার স্থলন ঘটে, তাই আমাদের এখন একটা প্রশ্ন করা জরুরি। আমাদের জীবনধারণকারী মিথ সম্পর্কে কি এমন কোন বৈজ্ঞানিক ধারণা অর্জন করা সম্ভব, যাতে মিথের পর্যালোচনা এবং সমালোচনা করার পরেও, আমরা এর প্রয়োজনীয়তাকে বাতিল করে না দেই বা ভুলভাবে উপস্থাপন না করি? যাতে আমরা গোসলের পানির সাথে বাচ্চাটিকেও ফেলে না দেই?( Don’t throw the baby out with the bathwater-  এখানে এই বিশেষ বাগধারা ব্যবহার করা হয়েছে। এই বাগধারার অর্থ হলো, খারাপ কোন কিছুকে বাতিল করার সময় এর মাঝে ভালো অংশটুকুও ফেলে না দেয়া।-অনুবাদক)।

আমি যেমনটা আগেই বলেছি, ঐতিহ্যগতভাবে প্রচলিত ধর্মমতগুলোতে মিথের চরিত্র এবং ঘটনাগুলোকে ফ্যাক্ট হিসেবে শিক্ষা দেয়া হয়, এবং এটা ইহুদি এবং ক্রিশ্চিয়ান পরিমণ্ডলে বিশেষভাবে সত্য। মিশর থেকে যেন সত্যিই এক মহাপ্রস্থান ঘটেছিল, যীশু সত্যি সত্যিই পুনর্জন্ম নিয়েছিলেন। যেহেতু ঐতিহাসিকভাবে এই ঘটনাগুলোর সত্যতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ, তাই এই ঘটনাগুলো যে নৈতিক ভিত্তিগুলোকে সমর্থন করে সেগুলোও এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

যদি এই ঘটনাগুলোকে ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে ব্যাখ্যা না করে শুধুমাত্র ইতিহাসের উপরে নিক্ষিপ্ত কাল্পনিক উপাখ্যান হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, তাহলে মিথের গুরুত্ব তখন আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। যদিও মিথ মিথ্যা, এবং ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়, তবুও এই সার্বজনীনভাবে কাঙ্ক্ষিত মিথের চরিত্রগুলো আমাদের মনের সত্যর(facts of the mind) প্রতিনিধিত্ব করেঃ “মনের সত্যের রুপায়ন ঘটে কাল্পনিক ঘটনায়”, যেমনটা আমার বন্ধু মায়া ডেরেন(চলচিত্রকার) বলেছিলেন। এবং অবশ্যই যেখানে প্রয়োজন, ইতিহাসবিদ, পুরাতত্ত্ববিদেরা মানুষকে দেখাবেন যে মিথ আসলে অসত্য—যে আদতে বহু বর্ণ-সম্প্রদায়ের পৃথিবীতে ঈশ্বরের নির্বাচিত কোন বিশেষ সম্প্রদায় নেই। এমন কোন সত্য নেই যার সামনে আমাদের সকলকেই নতজানু হতে হবে। কেবলমাত্র একটি সত্য উপাসনালয় বলে কিছু নেই। তবে এর সাথে সাথে, মনস্তত্ত্ববিদ এবং মিথোলজিস্টদের জন্য “মনের সত্য” কে চিহ্নিত করা, বিশ্লেষণ করা এবং ব্যাখ্যা করা, এবং এদেরকে সুরক্ষার দায়িত্ব আরও গুরুত্ববহ হয়ে উঠবে। পুরনো ঐতিহ্যগুলো মিশে যাবার সাথে সাথে আমাদের দায়িত্ব হবে, মানুষ যেন তার বাইরের প্রকৃতি চেনার সাথে সাথে নিজের ভেতরের প্রকৃতি চিনতে পারে সেটা নিশ্চিত করা।

মনস্তত্ত্ববিদদের মাঝে গত প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ধরে এ ব্যাপারে মনোভাবের উল্লখেযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। স্যার জেমস যে ফ্রাজারের মহান এবং বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Golden Bough’  পড়ার সময়ে, যেটার প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯০ সালে, আমরা পড়ছিলাম উনবিংশ শতকের প্রতিনিধিত্বকারী একজন লেখককে , যার ধারণা ছিল যে মিথোলজির কুসংস্কারগুলো অবশেষে বিজ্ঞান দিয়ে ভুল প্রমাণিত হবে এবং তারপর অনন্তকালের জন্য তাদেরকে ছুঁড়ে ফেলা হবে। তিনি মিথের উৎস দেখেছিলেন যাদুবিদ্যায়, আর যাদুর উৎস দেখেছিলেন মনস্তত্ত্বে। অবশ্য তিনি নিজে একজন যুক্তিসম্পন্ন মানুষ হওয়ায় তিনি আমাদের ভেতরের যৌক্তিকতার শৃঙ্খলহীন তাড়নার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দেন নি। তিনি ধারণা করেছিলেন যে, একটা রীতি বা বিশ্বাসকে যখন অযৌক্তিক হিসেবে দেখানো হবে, তার সাথে সাথেই  সেটা উধাও হয়ে যাবে। তার ধারণা যে কতটা ভুল ছিল, সেটা বোলিং অ্যালিতে একজন দর্শকের অধ্যাপককে দেখলেই বোঝা যায়ঃ দেখুন বলটি তার হাত থেকে ছাড়ার পর তিনি কিভাবে তার শরীরকে দুমড়ে মুচড়ে বাঁকা করেন, যাতে বলটি দাঁড়িয়ে থাকা পিনগুলোকে ফেলে দিতে পারে। ফ্রাজারের ধারণা ছিল এরকম যে, যেহেতু সবকিছুই আমাদের মনে সংযুক্ত থাকে, মানুষ ভাবে যে তা ফ্যাক্টের সাথেও সম্পর্কিত। বৃষ্টির মতো শব্দ করে এরকম কোন বাদ্যযন্ত্র যদি বাজানো হয়, তাহলে বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা আছে। কোন যৌন মিলনের কোন ধর্মীয় আচার সম্পন্ন করা হলে প্রকৃতির উর্বরতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। যদি শত্রুর অবয়ববিশিষ্ট কোন পুতুলকে শত্রুর নাম দিয়ে পিন দিয়ে আঘাত করা হয়, তাহলে শত্রুটির মৃত্যু ঘটবে। অথবা তার পরনের কোন বস্ত্র, বা তার ব্যবহার্য জিনিষকে এরকমভাবে ব্যবহার করে একইরকম ফলাফল পাওয়া সম্ভব। ফ্রাজারের যাদুবিদ্যার প্রথম সূত্র তাই ছিল, “ Like produces Like”। ফ্রাজারের দ্বিতীয় সূত্র ছিল, “যে দুটি জিনিষ একসময় পরস্পরের সংস্পর্শে ছিল, তারা অনেক দূরত্বে থেকেও পরস্পরের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে”। ফ্রাজারের ভেবেছিলেন যে, যাদুবিদ্যা আর ধর্ম উভয়েরই উদ্দেশ্য হলো বাইরের প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। যাদু হলো অনুকরণাত্মক কাজের মাধ্যমে, এবং ধর্ম হলো এক অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার কাছে প্রার্থনা এবং বলিদানের মাধ্যমে প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের পন্থা। আমাদের ভেতরের জগতের সাথে এগুলোর সম্পর্ক নিয়ে তার সম্ভবত কোন খেয়ালই ছিলনা। তাই তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে যাদু এবং ধর্ম এক্সময় পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবে। কারণ তাদের যে উদ্দেশ্য ছিল, সেটা বিজ্ঞানই আরও ভালোভাবে পূরণ করতে পারবে।

ফ্রাজারের এইসব লেখার সাথে সাথে অবশ্য প্যারিসে তখন নিউরোলজিস্ট জিন মার্টিন চারকোট(Jean Martin Charcoat)  হিস্টিরিয়া, বাকশক্তিলোপ, সম্মোহিত অবস্থার মতো বিষয় নিয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন, এর সাথে এই গবেষণার তথ্যগুলোর সাথে ভাস্কর্য এবং চিত্রকলার সম্পর্কও দেখিয়ে যাচ্ছিলেন। ফ্রয়েড ১৮৮৫ সালে এই মাস্টারের সাথে এক বছর অতিবাহিত করেন, এবং এই শতাব্দীর শুরুর দিকে হিস্টিরিয়া, স্বপ্ন আর মিথের গবেষণায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেন। ফ্রয়েডের মতে, মিথ হলো মানুষের মনে তার স্বপ্নের প্রতিফলন। অন্যভাবে বললে, মিথ হলো সার্বজনীন স্বপ্ন(Public dream) , আর স্বপ্ন হলো ব্যাক্তিগত মিথ(Private myth)। তার মতে, দুটোই হলো শৈশবকালীন যৌনাকাঙ্ক্ষার দমনের লক্ষণ। ধর্ম আর নিউরোসিসের (মনোবৈকল্যর) মধ্যে মূল পার্থক্য হলো, প্রথমটি বেশি সার্বজনীন। দুটোই হলো আমাদের অচেতন মনের ভয় আর ভ্রমের প্রকাশ। তদুপরি, ফ্রয়েডের মতে, সবরকম শিল্পকলা, বিশেষত ধর্মীয় শিল্পকলা হলো  একইরকমভাবে রোগাক্রান্ত, এবং সবরকম দর্শনও। সভ্যতা নিজেই হলো অবচেতন মনের হতাশার এক রোগাক্রান্ত বিকল্প। তাই ফ্রাজারের মতো ফ্রয়েডও মিথ, যাদু আর ধর্মের জগতকে নেতিবাচকভাবে দেখেছিলেন, যেটা শেষমেষ বিজ্ঞান দিয়ে প্রতিস্থাপিত হবে।

একটি পুরোপুরি ভিন্ন আঙ্গিকে দেখেছিলেন কার্ল ইয়ুং(Carl Jung), যার দৃষ্টিতে মিথোলজি আর ধর্মের চিত্রকল্প ছিল ইতিবাচক, জীবনধারণকারী। তার চিন্তা অনুসারে, শুধু যৌনাঙ্গ নয়, আমাদের শরীরের সকল অঙ্গেরই তাদের উদ্দেশ্য এবং অভিপ্রায় রয়েছে, যার মাঝে কিছু আমাদের সচেতন নিয়ন্ত্রণের অধীনে, যদিও, সবগুলো নয়। আমাদের বহির্মুখী চেতনা প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে আমাদের অভ্যন্তরীণ শক্তির সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলতে পারে; এবং ইয়ুঙ্গের মতে, মিথ যদি যথাযথভাবে পাঠ করা হয়, তাহলে তারা সেই হারানো যোগাযোগ ফিরিয়ে আনতে পারে। মিথ আমাদেরকে চিত্রকল্পের ভাষায় মনের শক্তি সম্পর্কে বলছে, যেই শক্তি মানুষের চৈতন্য সবসময়েই ছিল, যেই শক্তি প্রজাতি হিসেবে মানুষের প্রজ্ঞার(Wisdom) প্রতিনিধিত্ব করে, যেই প্রজ্ঞাকে সঙ্গী করে মানুষ হাজার বছর পাড়ি দিয়েছে,  যাকে আমরা সনাক্ত করে নিজেদের জীবনে সুসংহত করতে পারি। তাই মিথ অতীতে কখনো বিজ্ঞানের জ্ঞান দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়নি, কখনো হবে না। কারণ বিজ্ঞানের জ্ঞান মূলত বহির্জগতের পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করে, আমরা গভীর ঘুমের অতলে যে জগতে প্রবেশ করি, সেই জগতের প্রতিনিধিত্ব করে না। আমাদের স্বপ্ন আর মিথ অধ্যয়ন করে আমাদের এই অভ্যন্তরের শক্তিগুলোর সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে আমরা এক বিশাল দিগন্ত এবং আমাদের ভেতরের গভীরতর এবং প্রজ্ঞাময় সত্ত্বার সাথে একটা বোঝাপড়ায় আসতে পারি। অনুরূপভাবে, যে সমাজ মিথপ্রেমী এবং তাদের মিথকে জীবন্ত রাখে, তারা মানবচেতনার সবচেয়ে গভীরতর, সমৃদ্ধতর স্থান থেকে পরিপুষ্ট হবে।

তবে, এখানে একটি বিপদের আশঙ্কাও আছেঃ কেউ  তার স্বপ্ন এবং উত্তরাধিকার সূত্রে আহরণ করা মিথে নিমজ্জিত হয়ে আধুনিক পৃথিবীর চেতনা থেকে দূরে সরে গিয়ে, প্রাচীন অনুভূতি এবং চিন্তার মাঝে আটকে যেতে পারে। তাই ইয়ুঙ্গের মতে, যা প্রয়োজন তা হলো, একটি কথোপকথন, যা কোন মেরুতেই আটকে থাকবে না। সচেতন এবং অচেতন মনের মাঝে একটি অবিশ্রান্ত কথোপকথন, যা অচেতন মন থেকে প্রেরিত সাংকেতিক চিহ্নগুলোকে সচেতন মনে গ্রহণ করতে সাহায্য করবে।

তাহলে সেই সমাজের শিশুদের ভাগ্য কি ঘটবে, যারা এরকম কোন মিস্থস্ক্রিয়া গড়ে তুলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে, সেই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত স্বপ্নকে পরম সত্য ভেবে আঁকড়ে ধরে থাকে? যারা চেতনা, বিজ্ঞান, যুক্তির নতুনত্বকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়? এক্ষেত্রে আমাদের জানা ইতিহাসই আমাদের জন্য সাবধানবার্তা হিসেবে কাজ করতে পারে।

আজকে সব স্কুলছাত্রই জানে যে আমরা যাকে আজ বিজ্ঞান বলে জানি, তার শুরুটা হয়েছিল গ্রীকদের হাত ধরে। তাদের অর্জিত বেশিরভাগ জ্ঞানই এশিয়াতে, পারস্য, ভারত এমনকি চায়নাতে পর্যন্ত পৌঁছেছিল। তবে এইসব প্রাচ্যদেশীয়(Oriental) জাতিই তাদের নিজস্ব মিথোলজিকাল চিন্তার ছাঁচে আটকে ছিল।  গ্রীকদের নৈর্ব্যক্তিক, বাস্তবধর্মী, অনুসন্ধানী এবং পরীক্ষালব্ধ দৃষ্টিভঙ্গিকে তারা পরিত্যাগ করেছিল।  উদাহরণস্বরূপ, বাইবেলের বিজ্ঞানের কথা চিন্তা করুন- একটি ওরিয়েন্টাল গ্রন্থ, যা সন্নিবেশিত হয়েছিল ম্যাক্কাবিয়ানদের(Maccabean) গ্রীকদের প্রভাবকে অস্বীকার করার পরে। এর সাথে অ্যারিস্টটলের বিজ্ঞানের কথা তুলনা করুন, অথবা অ্যারিস্টারকাসের(খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৫) কথা, যিনি ইতোমধ্যই বলেছিলেন পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। ইরাটসথিনিস(খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০) সঠিকভাবে পৃথিবীর পরিধি নিধারণ করে ফেলেছিলেন, যার হিসেবে পৃথিবীর পরিধি ছিল ২৪,৬৬২ মাইল( বিষুবরেখার দিকে সঠিক পরিমাপ হলো ২৪,৯০২ মাইল)। হিপ্পারকুস(খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০) সামান্য কয়েক মাইলের ব্যবধানে চাঁদের ব্যাস এবং পৃথিবী থেকে চাঁদের গড় দূরত্ব বের করে ফেলেছিলেন। এখন শুধু কল্পনা করুন; কত অযথা রক্তপাত, মানুষের কান্না—ধর্মত্যাগের অভিযোগে পুড়িয়ে হত্যা—এসবকিছুই এড়ানো যেত যদি ৫২৯ খ্রিষ্টাব্দে জাস্টিনিয়ান(Justinian) গ্রীক প্যাগান স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয়ার পরিবর্তে এগুলোকে উৎসাহিত করতেন! এর জায়গায় আমাদের সভ্যতার পোড়াকপালে জুটলো জেনেসিস ১ এবং ২, এবং বিজ্ঞানের এবং আমাদের সভ্যতার পরিপক্কতার জন্য আরও হাজার বছরেরও বেশি বিলম্ব।

বিজ্ঞানকে প্রত্যাখ্যান করার ফলে কি হতে পারে তার সবচেয়ে আগ্রহউদ্দীপক (Intertesting) ইতিহাসগুলোর একটা আমরা ইসলামের ক্ষেত্রে দেখতে পাই। শুরুতে ইসলাম বিজ্ঞানকে গ্রহণ করে স্বীকৃতি দিয়েছিল, বিজ্ঞানের ক্ল্যাসিকাল ধারণাগুলোর উন্নতিও ঘটিয়েছিল। পাঁচ- ছয়টি ফলপ্রসূ শতাব্দী ধরে আমরা ইসলামী সভ্যতায় বৈজ্ঞানিক চিন্তা, পরীক্ষা, গবেষণায় চিত্তাকর্ষক উন্নতি দেখতে পাই, বিশেষত চিকিৎসাশাস্ত্রে। কিন্তু তারপর, হায়! মুসলিম সম্প্রদায়ের কর্তৃপক্ষ, সুন্নাহ বা ঐক্যমত, যাকে নবী মোহাম্মদ সবসময়েই সঠিক হবে বলে আখ্যা দিয়েছিলেন—তারা জাঁকিয়ে বসলো। কেবলমাত্র কোরানে ঈশ্বরের বাণীই একমাত্র সত্যর বাহক হিসেবে বিবেচিত হতে থাকলো। বৈজ্ঞানিক চিন্তার ফলাফল হলো “পৃথিবীর সৃষ্টি এবং এর স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসের স্থলন”। তারপরে, এখানেই সমাপ্তি। যখন  গ্রীক শিক্ষার আলো কেবলমাত্র ইসলাম থেকে ইউরোপের দিকে যাত্রা করেছে– ১১০০ সালের দিকে—ইসলামী বিজ্ঞান এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান নিশ্চল হয়ে পড়লো। এবং তার পরে এক অর্থে ইসলাম নিজেই মৃত হয়ে পড়লো। শুধু বিজ্ঞান নয়, এর সাথে ইতিহাসের মশালও এরপর পশ্চিমের ক্রিশ্চিয়ানদের হাতে উঠলো। আমরা এরপরে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি, যা হয়েছিল দ্বাদশ শতাব্দী থেকে এর পরবর্তী সময়ে, একদল সাহসী এবং ক্ষুরধার প্রতিভাবান মনের আবিষ্কারের কল্যাণে, মানুষের ইতিহাসে যার কোন পূর্ব নজির নেই। এইসব মনের কাছে আমাদের যা ঋণ তা কারো পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব নয়, যদি কেউ ইউরোপের ভূমির যাদুমন্ত্রের বাইরে পা না রেখে থাকে। এইসব তথাকথিত “উন্নয়নশীল দেশে” আজকের সব সামাজিক সংস্কার হলো পশ্চিমা বহিরাক্রমণের(Invasion) ফলাফল। প্রত্যেক ছোট গোষ্ঠীই  প্রস্তরীভূত হয়ে তাদের নিজস্ব মিথের শৃঙ্খলে বন্দী হয়ে ছিল, পরিবর্তন শুধুমাত্র ঘটেছে সংঘাতের ফলে। যেমন যখন মুসলিম যোদ্ধারা ভারত আক্রমণ করলো, কিছু সময়ের জন্য চিন্তার আদান প্রদান ছিল অনিবার্য। অথবা যখন ব্রিটিশরা এসে দখল করলো এবং আরেকটি  অধ্যায়ের সূচনা হলো, সেখানে অবাক করার মতো অপ্রত্যাশিত উদ্ভাবন হয়েছিলো। অন্যদিকে, আমাদের নিজেদের পশ্চিমা জগতে,  জনাকয়েক মুক্তান্বেষী এবং মুক্তমনা মানুষের অবিরাম অনুসন্ধানের ফলে জ্ঞানচর্চায় এক ফলপ্রসূ অধ্যায় বজায় ছিল।

সবশেষে, একজন বিজ্ঞানীর কাছে ‘সত্য’ এর সংজ্ঞা কি হবে? অবশ্যই তা এক আধ্যাত্মিক সাধকের(Mystic) সংজ্ঞার চেয়ে ভিন্ন হবে। কারণ, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যা হলো সত্যিকার অর্থে মহান এবং মৌলিক একটি সত্য—সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং সবচেয়ে কঠিন সত্য- বিজ্ঞান কোন পরম ‘সত্য’র সন্ধান পেতে পারে না; এবং  পাবার ভান করে না। বিজ্ঞান কোন চূড়ান্ত রায় দেয় না, এবং দেবার ভান করে না। এটা একটি পরীক্ষামূলক প্রণালী, যা “কার্যকর অনুকল্প(হাইপোথিসিস)” মেনে কাজ করে, যা বর্তমানের সব ধারণকৃত জ্ঞানকে একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্য নিয়ে আসার চেষ্টা করে(“ ওহ! এইসব বৈজ্ঞানিকের দল!” “হ্যাঁ, আমি জানি। কিন্তু তারা হাড়গুলো খুঁজে পেয়েছে”) ।

তাহলে কি এখানে এরকম কোন সুপ্ত বাসনা আছে, যে একসময় আমরা সবকিছুর শেষ জেনে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবো?

অবশ্যই না! এখানে শুধু একটার পর আরেকটা অবিরাম অনুসন্ধান চলবে—একটি মনের মতো, যেটা আরো বেশি বিকশিত হতে চায়। যতক্ষণ সেই বিকাশ সম্ভব হচ্ছে, এই বিকাশই হবে আধুনিক মানুষের জীবনের পরিমাপ, তার সাথে সম্ভাবনাময় সেই পৃথিবীর পরিমাপ; যা সে যা সে নিজে জন্ম দিয়েছে এবং জন্ম দিচ্ছেঃ একটি পরিবর্তনশীল, নতুন চিন্তার, নতুন মাত্রার, অবিরাম রূপান্তরের পৃথিবী—একটি অনমনীয় নিশ্চলতার পৃথিবী নয়- যেখানে ‘সত্যকে’ এক পুঁথিতে বেঁধে ফেলা হবে।

তাই, আমার বন্ধুরা, আমরা কিছুই জানিনা, এবং বিজ্ঞানও আমাদেরকে পরম সত্যর সন্ধান দিতে পারেনা। কারণ বিজ্ঞান হলো শুধুই সত্যর প্রতি আকুলতা, এই অনুসন্ধান আমাদের যেখানেই নিয়ে যাক না কেন। তাই, আমার কাছে মনে হয় যে, এখানে এক গভীর প্রজ্ঞা নিহিত আছে, যা আমাদের পুরনো ধর্মগুলো আমাদেরকে কখনোই দিতে পারেনি, এমনকি সেদিকে ইঙ্গিতও করেনি। পুরনো পুথিগুলো আমাদের স্বস্তি দেয় তাদের সীমিত দিগন্ত দিয়ে। তারা আমাদেরকে এক প্রেমময়, দয়ালু, ন্যায়পরায়ণ পিতার কথা বলে যিনি বাইরে থেকে আমাদের উপর নজর রাখছেন, যিনি আমাদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত, যিনি তার মন দিয়ে আমাদের জীবনের সাথে মিশে আছেন। অন্যদিকে, আমাদের বিজ্ঞানের মতে, কেউ জানেনা বাইরে কি আছে, এমনকি “বাইরে” বলতে আদৌ কিছু আছে কিনা। যা বলা সম্ভব তা হলো, আমরা দেখতে পাচ্ছি এক বিপুল ঘটনারাজির অত্যাশ্চর্য প্রদর্শনী, যা আমাদের ইন্দ্রিয় আর তাদের যন্ত্রপাতি আমাদের মনের প্রকৃতি অনুসারে আমাদের মনের কাছে অনুবাদ করে দেয়। এবং আমাদের ভেতরে রয়েছে পুরোপুরি ভিন্ন প্রকৃতির চিত্রকল্পের প্রদর্শনী, যা আমরা অনুভব করি রাত্রিতে নিদ্রাকালীন সময়ে, যা আমাদের দিবাকালীন জীবনেও চলে আসতে পারে, এমনকি আমাদের পাগল করে ধ্বংস করে দিতে পারে। এইসব বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ চিত্রকল্পের গহীনে কি আছে তা কেবল আমরা অনুমানই করতে পারি অনুকল্পের(হাইপোথিসিস) মাধ্যমে। তারা কি, কোথায় আছে এবং কেন আছে—এসব সাধারণ প্রশ্নের উত্তর হলো পরম রহস্যাবৃত— এটাই একমাত্র পরম জ্ঞান- আর এটা মেনে নেয়ার মতো মহানুভবতা এখন আমাদের থাকতেই হবে।

এখন “Thou Shalt” বলে আর কিছু নেই। এমন কিছুই নেই যা কাউকে বিশ্বাস করতেই হবে, এমন কিছুই নেই যা কাউকে করতেই হবে। আবার, কেউ যদি চায়, কেউ এখনও সেই মধ্যযুগীয় খেলা খেলতে পারে, কিছু প্রাচ্যদেশীয় এমনকি কিছু আদিম খেলাও খেলতে পারে। আমরা একটি কঠিন সময়ে বাস করছি। আর যা কিছু আমাদেরকে পাগলাগারদ থেকে সুরক্ষা দেয় তার সবই আমরা যথেষ্ট(Good enough) বলে বিবেচনা করতে পারি— যারা স্নায়বিকভাবে  দুর্বল তাদের কথা মাথায় রেখে।

১৯৫৪ সালের শীতে আমি ভারতে ছিলাম, সে সময়ে আমার বয়সী এক ভদ্রলোকের সাথে আমার কথোপকথন হয়। আমাদের সৌজন্যমূলক কথাবার্তা শেষে ,তিনি একটু দূরত্ব বজায় রেখে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ তোমাদের পশ্চিমা গবেষকেরা বেদের(Veda) বয়সকাল সম্পর্কে কি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে?”

আপনার জানা প্রয়োজন যে, বেদ হলো হিন্দুদের কাছে  ইহুদীদের তোরার(Torah) সমতুল্য। এগুলো সবচেয়ে প্রাচীন লিপি, তাই সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।

“আচ্ছা”, আমি জবাব দিলাম, “বেদের বয়স যা ভাবা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক কম। সাম্প্রতিককালে, আমার যতদূর মনে পড়ে, বেদের বয়স নির্ধারিত হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১০০০ শতাব্দীর মধ্যে। তুমি সম্ভবত এটা জেনে থাকবে যে”, আমি যোগ করলাম, “ ভারতের মাঝেই বৈদিক সভ্যতার চেয়ে প্রাচীন সভ্যতার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে”।

“হ্যাঁ”, ভদ্রলোকটি রগচটা না হয়ে শান্তভাবে ঋজুস্বরে বললেন, “আমি জানি; তবে একজন সনাতন হিন্দু হিসেবে আমি বিশ্বাস করতে পারি না যে পুরো মহাবিশ্বে বেদের চেয়ে প্রাচীনতর আর কিছু আছে”। এবং সে এটা সত্যিই বিশ্বাস করে বলেছিল।

“ঠিক আছে”, আমি বললাম। “তাহলে তুমি এটা জিজ্ঞেস করলে কেন?”

তবে প্রাচীন ভারতকে তার প্রাপ্যটুকু দিতে আমি উপসংহার হিসেবে একটি হিন্দু মিথ দিয়ে সমাপ্তি টানছি। আমার কাছে মনে হয় এই মিথটি আজকের মানব ইতিহাসের এই সংকটময় সময়ে মানুষের অভিযাত্রার অনুভূতিকে সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।

এটা আমাদেরকে মহাবিশ্বের সেই সময়ের ইতিহাসের কথা বলছে, যখন দেবতা আর তাদের প্রধান শত্রু প্রতি-দেবতারা(Anti-gods) এক অনন্ত যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। তারা একসময় এক সাময়িক যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নিল, সকলে মিলে একসাথে দুধসাগর(Milky ocean)—মহাজাগতিক সাগর মন্থন(Churn) করার জন্য—কারণ এর মাখন থেকে অমরত্ব পাওয়া যায়। তারা তাদের মন্থন করার যন্ত্র হিসেবে মহাজাগতিক পর্বত(দান্তের গল্পে স্বর্গ নরকের মধ্যবর্তী পর্বতের অনুরূপ) তুলে নিল, এবং এর চারপাশে মহাজাগতিক সর্পকে পেঁচিয়ে নিল। তারপর, দেবতারা এর একমাথা ধরে এবং প্রতি- দেবতারা আরেক মাথা ধরে  এই মহাজাগতিক পর্বতকে ঘোরাতে থাকলো। এভাবে সহস্র বছর মন্থন করার পর এর পানির মধ্য থেকে এক বিষাক্ত কালো ধোঁয়ার মেঘ বের হয়ে এল, এবং তখন বাধ্য হয়ে মন্থন করা বন্ধ করতে হলো। তারা এক অভূতপূর্ব শক্তির উৎসকে স্পর্শ করে ফেলেছে, এবং শুরুতেই যা তারা প্রত্যক্ষ করছে তা হলো এর প্রাণঘাতী শক্তি। কাজ যদি চালিয়ে যেতে হয়, তাদের কাউকে কাউকে সেই বিশাক্ত ধোঁয়া গলাধঃকরন করে আত্মীভূত করে ফেলতে হবে।  তাদের জানামতে এই কাজ করার মতো ক্ষমতাবান  কেবল একজনই ছিলেন, যোগের প্রতিনিধিত্বকারী আদি দেবতা শিব(Shiva), যিনি ছিল এক ভয়ঙ্কর রুদ্রমূর্তি। তিনি সেই সম্পূর্ণ বিষাক্ত মেঘকে তার ভিক্ষার থলেতে নিয়ে নিয়ে এক ঢোঁকে গিলে ফেলে তার যোগবলে সেই ধোঁয়া তার গলায় ধরে রাখলেন, ফলে তার গলা নীল হয়ে উঠলো; আর তখন থেকে তিনি নীলকণ্ঠ নামে পরিচিত। যখন এই বিস্ময়কর কাজটি শেষ হলো, দেবতা আর প্রতি-দেবতারা আবার তাদের কাজে ফেরত গেলেন। তারা মন্থন করতেই থাকলেন, করতেই থাকলেন, করতেই থাকলেন। তারপর একসময়ঃ ধূম! মহাজাগতিক সমুদ্র থেকে আশ্চর্য সব বিস্ময় বের হতে শুরু করলোঃ চন্দ্র, সূর্য, আট মাথাওয়ালা এক ঐরাবত, এক অপূর্ব ঘোড়া, কিছু মহৌষধ, এবং সবশেষে, আহা! অমৃতের মাখনভর্তি এক অত্যুজ্জ্বল কলসি।

এই প্রাচীন ভারতীয় মিথ আমি আজকের পৃথিবীর জন্য এক উপযুক্ত রূপক হিসেবে বিবেচনা করি, যেখানে আমাদেরকে সনির্বদ্ধভাবে উৎসাহের সাহে নির্ভয়ে কাজ করে যেতে হবে।

(জোসেফ ক্যাম্পবেলের “Myths to Live By” গ্রন্থ থেকে অনুদিত)

 

Comments

আপনার আরো পছন্দ হতে পারে...

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
জানান আমাকে যখন আসবে -
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x