এমন একটি পৃথিবী যেখানে অসম্ভব বলে কিছু নেই! ভাবতেও অবাক লাগে এমন বিশ্ব কল্পনা করতে! কিন্তু হয়ত খুব শীঘ্রই আমরা এমন একটি বিশ্ব প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছি! আর এটা সম্ভব হওয়ার সম্ভাবনার নাম হল ন্যানো টেকনোলজি। এই প্রযুক্তির কল্যাণেই খুব শীঘ্রই নতুন শিল্প বিপ্লবের সৃষ্টি হবে; যা বদলে দেবে পুরো পৃথিবীকেই, যার ছোঁয়া ইতোমধ্যেই প্রত্যক্ষ করা যায়।
একটি বাড়ি কল্পনা করুন, যার দেয়ালের রং কাজ করছে সোলার প্যানেল হিসেবে এবং ইটগুলো এক একটি ব্যাটারির ন্যায় কাজ করছে! কিংবা যে রাস্তা দিয়ে আমরা চলাচল করি, সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে তা একটি বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের শক্তির যোগান দিচ্ছে! অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে? বর্তমান বিশ্ব যে ভাবে সামনে এগোচ্ছে তাতে অসম্ভব বলে কিছু নেই! এই অসম্ভবকে বাস্তবমুখী করার দারুণ একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হলো “ন্যানো টেকনোলজি’’।
ন্যানো টেকনোলজি’র ইতিহাস
আমেরিকান বিখ্যাত পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান ১৯৫৯ সালে তার “There’s Plenty of Room at the Bottom ” আলোচনায় প্রথম ন্যানো টেকনোলজির ধারণা বর্ণনা করেছিলেন। তিনি পরমাণুর প্রত্যক্ষ ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে সংশ্লেষণের সম্ভাবনা বর্ণনা করেছিলেন সেই আলোচনায়। এজন্য রিচার্ড ফাইনম্যান (Richard Feynman) কে ন্যানো প্রযুক্তির জনক বলা হয়।
সংজ্ঞায়ন
অভিধান থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, “পারমাণবিক বা আণবিক মাত্রায় অতিক্ষুদ্র যন্ত্র তৈরি করার জন্য ধাতব বস্তুকে সুনিপুণভাবে কাজে লাগানোর বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিকে ন্যানো প্রযুক্তি বা টেকনোলজি বলে’’।
Nano শব্দটি গ্রিক nanos শব্দ থেকে এসেছে যার আভিধানিক অর্থ জাদুকরী ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষুদ্রাকৃতির মানুষ। ন্যানো হলো একটি পরিমাপের একক। ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগকে বলা হয় ১ ন্যানো মিটার। অর্থাৎ 1 nm = 10-9 m।
ন্যানো টেকনোলজি বলতে আসলে কি বুঝায়?
আমরা দৈনন্দিন জীবনে মাইক্রোস্কোপিক জগতের ব্যবহার নিয়ে প্রায়ই আলোচনা করে থাকি। বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ইত্যাদির আকার বলার জন্য আমরা মাইক্রোস্কোপের কথা বলে থাকি। আবার আমরা সাধারণ ল্যাবোরেটরিতে মাইক্রোস্কোপের ব্যবহারও করে থাকি। কিন্তু এর চেয়েও হাজার গুণ ক্ষুদ্রের কথা চিন্তা করতে হবে। যেতে হবে ক্ষুদ্রতর থেকে ক্ষুদ্রতম পর্যায়ে। মানুষের একটি চুল প্রায় ৬০,০০০ ন্যানোমিটার পুরু হয়! তাহলে কীভাবে চিন্তা করা যায় ন্যনোমিটার বলতে কী বোঝানো হয়?
একটি ফুটবলের কথা চিন্তা করুন। ন্যানোমিটার বলতে যদি একটি ফুটবলের কথা বলা যায় তাহলে একটি করোনা ভাইরাস হলো মানুষের সমান। একটি মুরগী পৃথিবীর সমান। তাহলে ন্যানোমিটার বলতে কত ক্ষুদ্রতম বোঝায়! ন্যানো টেকনোলোজি ১০০ ন্যানো মিটারের ছোট কাঠামো নিয়ে কাজ করে ।ন্যানো টেকনোলজির জগতকে বলা হয় ন্যানোস্কোপিক জগত।
ন্যানোস্কোপিক জগত পদার্থকে কীভাবে প্রভাবিত করে?
ন্যানো টেকনোলজিতে মূলত পদার্থের অণু পর্যায়ে কাজ করা হয়। এতে পদার্থের মূল ভূমিকা পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। গলনাংক, স্ফুটনাংক সহ আরো স্বাভাবিক আচরণগুলো পরিবর্তিত করা সম্ভব হয়। বিজ্ঞানীরা ন্যানো পর্যায়ে মূলত এই সকল ধর্মগুলোর পরিবর্তন এবং কী কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে- সেগুলো নিয়েই বিশদ গবেষণা করেন। সুতরাং, পরীক্ষিত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পদার্থের মূল রুপ পরিবর্তন করে নতুন সৃষ্টি সম্ভব যা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করে দিচ্ছে আমাদের বর্তমান বিশ্বকে।
ন্যানো টেকনোলজি কি কাজে আমরা ব্যবহার করছি?
এই প্রসঙ্গে সহজ উত্তর হলো আপনার হাতে থাকা স্মার্টফোনটি। এই ফোনের স্ক্রিনটি টাচ বা স্পর্শ প্রযুক্তিতে কাজ করে। এই টাচ প্রযুক্তির সম্পূর্ণটাই সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র ন্যানো টেকনোলজির কারণে। এই স্ক্রিনের ওপর আমরা অন্য একটি কাঁচ ব্যবহার করি যা স্ক্র্যাচ থেকে বাঁচিয়ে দেয়। এটিও ন্যানো টেকনোলজির উদাহরণ।
প্রথম যখন কম্পিউটারের আবিস্কার হয় তখন এর আকার সম্পর্কে কল্পনা করতে গেলে একটি বৃহৎ ঘরের কথা কল্পনা করতে হয়। কিন্তু বর্তমানকালে এসে আমরা সেই কম্পিউটারকে ছোট্ট একটি ব্যাগে রাখতে পারি- যার নাম ল্যাপটপ। হার্ডডিস্ক, এস ডি কার্ড, চিপসেট, সোলার প্যানেল, সেমি কন্ডাক্টর – এরকম আরো শত সহস্র প্রযুক্তির কথা বলা যাবে যা আমরা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করে থাকি শুধুমাত্র ন্যানো প্রযুক্তির কল্যাণে। এগুলোর আকার যেমন ছোট ঠিক তেমনি এদের কার্যক্ষমতা কয়েক লক্ষগুণ বেশি।
হাঁটার সময় ব্যয়িত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তা দিয়ে ফোন চার্জ করার মত ঘটনা অনেকেই শুনে থাকবেন। এটা সম্ভবপর হওয়ার মূল কারণ ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার।
এছাড়াও ন্যানো টেকনোলজিকে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট রোগাক্রান্ত স্থানকে সারিয়ে তোলা যায়। ফলে এত ওষুধ কিংবা মেজর সার্জারির প্রয়োজন হবে না- যা পাল্টে দেবে চিকিৎসা বিজ্ঞানকে। ইতোমধ্যে আমরা কার্ডিয়াক সার্জারিতে ন্যানো প্রযুক্তির ফলাফল প্রত্যক্ষ করছি।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাগুলো কী?
ইলেক্ট্রিক সেক্টরে ন্যানো টেকনোলজি বহু আগে থেকেই প্রচলিত আছে, যার প্রমান আমরা প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে প্রত্যক্ষ করছি। বর্তমানকালের চ্যালেঞ্জ এই সেক্টরে আরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রযুক্তি সৃষ্টি করা। ইন্টেল প্রসেসরে সিলিকন এর উপর প্যাটার্ন করে যে সার্কিট বানানো হয় তার বর্তমান সাইজ হল ১০০ ন্যানোমিটার। ভবিষ্যতে এর আকার ৫০ ন্যানোমিটার হবে। পাশাপাশি বৃদ্ধি পাবে এর তথ্য সংরক্ষণের সক্ষমতা। ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে এসেছে নতুন ধারা- খুব সংক্ষেপে যা আলোচনা করার অর্থ বৃথা চেষ্টা করা।
পরিবেশ নিয়ে আলোচনায় আমরা প্রায়ই বলে থাকি যে পৃথিবীতে সুপেয় পানির অভাব তীব্র আকার ধারণ করবে ভবিষ্যতে। কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন যে, এই ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করে আমারা সমুদ্রের লবণাক্ত বিশাল জলরাশিকে স্বাদুপানিতে পরিণত করতে পারি, সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয় যেদিন আমরা অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে ন্যানো টেকনোলজিকে ব্যবহার করে খুব সহজেই এই প্রক্রিয়া বাণিজ্যিকভাবে শুরু করতে পারব।
এক গবেষণা থেকে দেখা যায়, জলবায়ুর পরিবর্তনকে রোধ করার জন্য ন্যানো টেকনোলজির ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে বর্জ্যের পরিমাণ বহুলাংশে কমে যাবে, কমে যাবে বিষাক্ত গ্যাস নির্গমনের হার। ফলশ্রুতিতে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হারের পরিমাণ কমে যাবে কয়েকগুণ।
ন্যানো টেকনোলজির কল্যাণেই আমরা পেতে যাচ্ছি গ্রাফিনের বাস্তবিক প্রয়োগ। এটিই এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে শক্তিশালী বস্তু। গ্রাফিনের তরল কোন কঠিনের ওপর ব্যবহারের ফলে কঠিন বস্তুটির দৃঢ়তা যে পরিমাণ বেড়ে যায় তা কল্পনার বাইরে। এর বাণিজ্যিক ব্যবহার একবার শুরু হয়ে গেলে গ্রাফিনই হয়ে যেতে পারে শিল্প বিপ্লবের নতুন কারিগর।
পরিশেষে, ন্যানো টেকনোলজির ভবিষ্যৎ কি এই প্রশ্নের চেয়ে ন্যানো টেকনোলজির ব্যবহার কি কি করতে পারে না তাই নিয়ে ভাবনাটাই অধিক যুক্তিযুক্ত। ভবিষ্যৎ পৃথিবী এক আমূল বিবর্তনের অপেক্ষা করছে ন্যানোস্কোপিক জগতের জয়যাত্রার কারণে। হয়ত খুব শীঘ্রই আমরা নতুন এক শিল্প বিপ্লবের দেখা পাব এই ন্যানোস্কোপিক জগতের কল্যাণে।