জ্যোতির্বিজ্ঞানী (আরো ভালো করে জ্যোতিঃপদার্থবিদ), বিজ্ঞান জনপ্রিয়কারী, সোশ্যাল এডুকেটর নীল টাইসনের পরিচয় নতুন করে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। নভেম্বরের ১০ তারিখে Neil Degrass Tyson আসবেন লুইজিয়ানার নিউ অরলিয়েন্সে। আমি যেখানে থাকি, সেই ব্যাটন রুজ শহর থেকে গাড়িতে করে যেতে মাত্র সোয়া এক ঘণ্টার মত লাগে। এই সুযোগ তো হেলায় হারানো যায় না। তাই, খবর পেয়ে টিকেট কেটে রেখেছিলাম অক্টোবরেই। নির্দিষ্ট দিনে জায়গামত হাজির হয়ে গেলাম ৬ঃ১০ এর দিকে। সাড়ে ছয়টায় খুলবে সেইংগার থিয়েটারের গেইট, আর প্রোগ্রাম শুরু হবে সাড়ে সাতটায়।
গেইটে দাঁড়িয়ে অনেকের সাথে কথা বললাম। সবাই বেশ উত্তেজিত। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার দেড় বছর আগের সেমিনারেও এসেছিলেন, ওটা নাকি ভিন্ন একটা টপিক নিয়ে ছিলো। এবারের টপিক – ব্রহ্মাণ্ডে প্রাণের সন্ধান (In Search of Life in Universe). যাই হোক, সাড়ে ছয়টায় গেইট খোলা হলো। আস্তে আস্তে ২৭০০ দর্শক ধারণক্ষমতাসম্পন্ন গ্যালারি পূর্ণ হয়ে যেতে শুরু করলো। প্রোগ্রাম শুরুর ঠিক আগে আগে আর কোনো সিটই ফাঁকা রইলো না। বেশ সুন্দর একটা থিয়েটার। আশেপাশে বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন ডিজাইন করা ছিলো। আর ওপরে নীল আকাশের মত সিলিং-এ ছোটো ছোটো বাতি মিটমিট করছিলো।
৭ঃ৩৫ এর দিকে হুইল চেয়ারে করে এক আমেরিকান ফুটবলার (নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না) এসে সেমিনার উদ্বোধন করলেন। তিনিও স্টিফেন হকিং এর মত মেশিন দিয়ে কথা বলেন। বললেন, তিনি বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল আগ্রহী এবং পরম কৃতজ্ঞ; কারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছাড়া উনি চলতে পারতেন না, কথা বলতে পারতেন না। আরো বললেন, তার প্রিয় ব্যক্তিত্বদের তালিকাতে নীল ডিগ্রাস টাইসন আছেন দুই নম্বরে, বিজ্ঞানের প্রচার নিয়ে তার কাজকর্মের জন্য। আর তালিকার এক নম্বরে আছেন কার্ল সেগান। উল্লেখ্য, কার্ল সেগানের নাম এই দুই-আড়াই ঘণ্টার সেমিনারে এবারই প্রথম উচ্চারণ হলো, তবে এবারই শেষ নয়। বারবার, কিছুক্ষণ পরপরই সেগানের নাম নিয়েছেন নীল টাইসন। সেই গল্প যথাসময়ে আসছে।
অতঃপর টাইসন এলেন, হাততালিতে গমগম করতে লাগলো গোটা গ্যালারি। তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ফুটবলার সাহেবকে ধন্যবাদ দিলেন। এবং ওনার উদ্দেশ্যে বললেন, “কার্ল সেগানকে উনি এক নাম্বারে রেখেছেন, কিন্তু তাতে আমার এতোটুকু আপত্তি নেই। সেগানের সাথে একই লিস্টে থাকতে পেরে আমি কৃতজ্ঞ।” এরপরেই কৌতুক করে বললেন, “তবে একটা জিনিস ঠিক – ওনার প্রিয় ব্যক্তিত্বদের তালিকায় জীবিতদের মধ্যে আমিই এক নম্বর।”
প্রথমে তিনি আমাদেরকে একটু বাজিয়ে দেখতে চাইলেন। বললেন, “শুরুতেই আপনাদের প্রত্যাশাটাকে একটু বাগে নিয়ে আসা প্রয়োজন মনে করছি। আমি জানি, এটা একটা স্টেজ, আপনারা দর্শক আর আমি এক ধরনের পারফর্মার। কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার করে নেয়া দরকার। আমি কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে শুধু কথা বলবো, আর কিছু কিন্তু করবো না। অন্য কোনো ধরনের পারফর্ম্যান্স (নাচ, গান) কিন্তু করবো না। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলবো। সবাই আমার বক্তব্যটা বুঝতে পারছেন তো?”
সবাই ব্যাপক হাসি আর হাততালিতে ফেটে পড়লো। মাইক্রোসফটকে ধন্যবাদ দিয়ে তিনি স্লাইড চড়ালেন।
The Search for Life in the Universe
শুরুতেই তিনি আমাদের সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলো নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। ব্রহ্মাণ্ডটা অনেক বিশাল। কতটুকু বিশাল? আমাদের ধারণার চেয়েও বিশাল। আপনি যত বড় কল্পনা করতে পারছেন, অসীম কিন্তু তার চেয়েও বড়। আর এই নিরন্তর ব্রহ্মাণ্ডের দিকে আমরা চোখে মেলেছি কেবল। কেপলার উপগ্রহ এই মুহূর্তে তাকিয়ে আছে প্রায় দেড় লক্ষ নক্ষত্রের দিকে। সৌরজগতের বাইরে এখন পর্যন্ত ৪০০০ জগতকে গ্রহ বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা, ১০০০ এর বেশি জগতকে গ্রহ হিসেবে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া গেছে। গত দুই বছরেই (২০১৪ আর ২০১৫ সালেই) সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গ্রহকে এই তালিকায় যুক্ত করেছে কেপলার। এবং ধারণা করা হচ্ছে, ব্যাপক সংখ্যক গ্রহ শীঘ্রই এই তালিকায় যুক্ত হবে।
এ যাবত যত গ্রহ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে Kepler 452b কে পৃথিবীর খুব কাছাকাছি বলে মনে করা হচ্ছে। পৃথিবীর সাথে এর এতোটাই মিল যে একে Earth 2.0 বলা হচ্ছে। অবশ্য এই নামটা নীল টাইসনের পছন্দ হয়নি বলে জানালেন। কারণ, শুনতে মনে হচ্ছে, এটা পৃথিবীর পরের সংস্করণ, আরো উন্নত সংস্করণ। এটাতে নাকি পৃথিবীকে খাটো করে দেখা হচ্ছে। আর আমরা শুধু দূর থেকে দেখেছি, এখনো অনেক কিছু জানা বাকি, যে কাজটা কেপলার করার চেষ্টা করছে প্রতিনিয়ত।
এরপরেই তিনি সবাইকে মিডিয়া কিভাবে এসব সংবাদকে প্রচার করে, সে ব্যাপারে সাবধান করলেন। উদাহরণের জন্য তিনি কয়েকদিন আগের একটা রিসার্চ পেপারের সারাংশ পুরোটা পড়ে শোনালেন, একদম প্রত্যেকটা শব্দ। মূল কথাটা হলো, একটা নক্ষত্রের আলোর মধ্যে কিছুটা অনিয়মিতভাবেই বেশ অনেকটা পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। এবং বিজ্ঞানীরা এর কারণ হিসেবে ধারণা করছেন ঐ নক্ষত্রের সৌরজগতের বাইরের কিছু ধূমকেতুর অংশের জন্য এমন হয়ে থাকতে পারে (এটাও সারাংশে আছে)। আর সেই প্রবন্ধটিকে কেন্দ্র করে সব জায়গাতে, এমনকি অনেক জনপ্রিয় বিজ্ঞান ব্লগেও, সংবাদগুলোর শিরোনাম প্রচার করা হলো এভাবে – কেপলার কি এলিয়েন মেগাস্ট্রাকচার খুঁজে পেয়েছে? তিনি বললেন, আমরা প্রাণের সন্ধান করে যাবো, তবে এই চর্চাতে আরো সতর্কতার প্রয়োজন আছে।
মানুষ যে কত সহজে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে! যেমন, UFO (Unidentified Flying Object বা অসনাক্তকৃত উড়ন্ত বস্তু) এর সাথে তাৎক্ষণিকভাবেই ভিনগ্রহবাসীদেরকে যুক্ত করে ফেলে। আরে বাপ, আপনারা নিজেরাই তো বলছেন Unidentified, তার মানে আপনি জানেন না এটা কী! তাহলে একদম পরের লাইনেই এটাকে এলিয়েনদের মহাকাশযান হিসেবে সনাক্ত করে ফেললেন কী করে? এক লাইনের মধ্যেই “সম্পূর্ণ অনিশ্চিত” থেকে “সম্পূর্ণ নিশ্চিত” ক্যামনে হলেন? এরকম ভুল তো আমরা আগেও করেছি। পিরামিড কী করে বানানো হয়েছে, কোনো ধারণাই নেই। তার মানে, নির্ঘাৎ এলিয়েন। আরে ভাই, এইমাত্র না বললেন, “কোনো ধারণাই নেই”?
ধর্মগুলোর ব্যাপারেও এমনটাই হয়েছে। এবং ইতিহাসের অনেক মেধাবী ব্যক্তিও এই ভুল করে গেছেন। নিউটন জানতেন, মহাকর্ষের কারণেই গ্রহগুলো সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। কিন্তু স্পর্শ না করেও সূর্য কিভাবে গ্রহগুলোকে ঘোরাচ্ছে, সে ব্যাপারে নিউটনের কোনো ধারণা ছিলো না। তখন তিনি লিখেছিলেন, “হয়তো ঈশ্বর এখানে হস্তক্ষেপ করেছেন।” পরে মাইকেল ফ্যারাডে এসে প্রমাণ করলেন, সূর্য নিজে স্পর্শ করে না ঠিকই, কিন্তু তার চারপাশে যে মহাকর্ষ ক্ষেত্র আছে, সেটা ঠিকই পৃথিবীর মহাকর্ষ ক্ষেত্রকে স্পর্শ করে, এবং এভাবেই সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘোরে।
আমাদের সৌরজগত
প্লুটো
এরপর তিনি আমাদের সৌরজগতের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। একটা স্লাইডে শুধু একটা কথা লেখা ছিলো, PLUTO. পরের স্লাইডে লেখা NO. Get Over it. এখনো যারা মনে করে, প্লুটো আমাদের সৌরজগতের একটি গ্রহ, শুরুতেই তাদের জন্য এটা খোলাসা করে দিলেন তিনি যে “না, প্লুটো এখন আর গ্রহ নয়। মাফ করেন।” অতঃপর, চলুন মুখ ফেরাই মঙ্গলের দিকে।
মঙ্গল
স্ক্রিনে মঙ্গলের ভূ-পৃষ্ঠের একটা ছবি ভেসে এলো, যেটা ওখানেই থাকা একটা রোভার (ভ্রমণকারী যন্ত্র) তুলেছে। ছবিটা আসার পর তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, দর্শক কিছু বলছে না দেখে তিনি বললেন, “আরে, কী আশ্চর্য! কারো মধ্যে দেখি কোনো উত্তেজনা নেই! এটা ভিন্ন একটা গ্রহের ছবি! পৃথিবীতে বসানো কোনো স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিও না, ওখানেই ঘোরাফেরা করছে এমন একটা রোভারের তোলা ছবি! এসব কি চাট্টিখানি কথা নাকি? দাঁড়ান, আরেকবার ট্রাই করি।” বলে আগের স্লাইডে গিয়ে আবার মঙ্গলের ছবিতে এলেন। দর্শকদের মধ্যে কেউ কেউ হাসতে লাগলো। আর অনেকেই বিস্ময়সূচক “ওওওওওও” করে উঠলো। নীল টাইসনও হেসে ফেললেন, “এইবার হয়েছে। হা হা হা”।
মঙ্গলে প্রাণ আছে কিনা, সেই গবেষণা শুরু হয়েছে পার্সিভেল লাওয়েলের সময় থেকে। তার কাছে ঐ সময়কার সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ ছিলো। তিনি মঙ্গলের গায়ে কিছু খাঁজ দেখেছিলেন। একই সময় ইতালিতে আরেকজন সেই খাঁজগুলোকে বলেছিলেন “ক্যানালি”, কারণ ইতালিয়ান ভাষায় প্রণালী বা চ্যানেলকে বলা হয় ক্যানালি। সেই “চ্যানেল” আমেরিকাতে এসে লাওয়েলের দেয়া জ্বালানিতে হয়ে গেলো ক্যানেল বা খাল। এখন, খাল জিনিসটার সাথে বুদ্ধিমান প্রাণীর যোগসূত্র আছে। ঐ সময়েই মোটামুটি অনেকেই জানতো, মঙ্গলের দুই মেরুতে বরফ আছে, অর্থাৎ আটকে পড়া পানি আছে। লাওয়েল সিদ্ধান্ত নিলেন, নিশ্চয়ই সেখান থেকে বিষুব অঞ্চলে পানি আহরণের জন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী এই খাল বানিয়েছে। তাকে চ্যালেঞ্জ করার মত তেমন কেউ ছিলো না। কে চ্যালেঞ্জ করবে? সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ তো তার কাছে। আর গল্প যে কিভাবে চেঞ্জ হয়, এটা তো ৭ বছরের বাচ্চাদেরকে ক্লাসরুমে শেখানো হয়। এই জায়গায় এসে টাইসন দর্শকদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, “এখানে আছে নাকি এমন কেউ, যার বয়স ৭/৮ বছর?”
সামনের সারিতে একটা বাচ্চা ছেলে হাত তুললো। উনি বললেন, “তুমি কি ক্লাসে এমন কোনো খেলা খেলেছো, যেখানে টিচার একজনের কানে কানে একটা গল্প বলে। আর সেখান থেকে প্রত্যেকটা বাচ্চা আরেকজনের কানে বলতে থাকে, এভাবে এগিয়ে যায়?” ছেলেটা বললো, “হ্যাঁ, খেলেছি।” তখন টাইস জিজ্ঞেস করলেন, “শেষ ব্যক্তিটা যখন গল্প বলে, তখন কী হয়?” বাচ্চাটা বললো, “একদম আলাদা একটা গল্প হয়”। টাইসন বিজয়ীর হাসি দিয়ে বললেন, “সেটাই”।
খেয়াল করলে দেখবেন, লাওয়েলের বই Mars and its canals এবং Mars as the abode of life বইগুলোর ঠিক পরবর্তী সময়েই এইচ জি ওয়েলসের বই War of the Worlds বের হয়েছিলো, যেখানে এলিয়েনরা আমাদের এখানে এসে নিজেদের আস্তানা গড়তে চাইছিলো। টাইসন জিজ্ঞেস করলেন, “জানেন নিশ্চয়ই, ঐ এলিয়েনরা কোত্থেকে এসেছিলো?” এটার উত্তর মোটামুটি সবাই জানে, মঙ্গল থেকে।
কিন্তু আসলেই মঙ্গলে প্রাণ আছে কিনা, সেটা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা আবিষ্কার হয়েছিলো ১৯৯৬ সালে। একটা উল্কাপিণ্ড পাওয়া গিয়েছিলো পৃথিবীতে, যেটার বৈশিষ্ট্যগুলো মঙ্গলের শিলাখণ্ডের সাথে মিলে যায়? কিভাবে বোঝা গেলো যে এটা মঙ্গলের সাথে মেলে? কারণ, আমরা মঙ্গলে যান পাঠিয়েছি, সেখানকার বায়ুমণ্ডলের গঠন জানি। আর এই উল্কাপিণ্ডের ভেতরে যে ছিদ্র ছিলো, সেগুলোর ভেতর থেকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বাতাস সংগ্রহ করা হয়েছে, এবং দেখা গেছে বায়ুমণ্ডলের উপাদানগুলোর শতকরা হার একদম মঙ্গলের সমান। আর এতে আরো একটা জিনিস পাওয়া গেছে, PAH – Polycyclic Aromatic Hydrocarbon. এটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে না যে, মঙ্গলে আসলেই কোনো একসময় প্রাণ ছিলো কিনা, কিন্তু এটা একটা হাইড্রোকার্বন এবং প্রাণের ভৌত ভিত্তিমূলক উপাদান এগুলোই। যদি এমন হয়ে থাকে যে্ মঙ্গল থেকে উড়ে আসা এই ধরনের উপাদানগুলোই পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টির জন্য দায়ী, তাহলে আমরা সবাই কিন্তু এক হিসেবে মঙ্গলবাসী।
টাইসন বললেন – বাই দ্যা ওয়ে, একটা জিনিস খেয়াল করে দেখেছেন, জীববিজ্ঞানীরা নামকরণের ব্যাপারে খুব কাব্যিক। আমরা, জ্যোতির্বিদ (astronomer) বা জ্যোতিঃপদার্থবিদ (astrophysicist)-রা এই ক্ষেত্রে একদমই কাব্যপ্রতিভার পরিচয় দেই না। আমাদের নামগুলো একটু বেশিই আক্ষরিক। যেমন, লাল রঙের দানবীয় নক্ষত্রদেরকে আমরা কী বলি? Red Giants! আলোও বের হয় না, এমন কালো রঙের গহবরকে আমরা কী বলি? Black Hole! সৃষ্টির শুরুতে বিশাল বিস্ফোরণকে আমরা কী বলি? Big Bang! – – – এখানে অবশ্য আমি বলতে চেয়েছিলাম, কথাটা আসলে ঠিক না। জীববিজ্ঞানীরাও মাঝে মাঝে বেশ অল্প সময়ে অকাব্যিক নাম দিয়ে থাকেন। যেমন, যে তিমি হত্যা করে – Killer Whale, যে তিমি দেখতে শুক্রাণুর মত – Sperm Whale, ইত্যাদি।
যাই হোক, টপিকে ফিরে আসি। উনি বললেন, যে কারণে ঐ উল্কাপিণ্ড থেকে জোরালোভাবে ধারণা করা হচ্ছে যে মঙ্গলে একসময় প্রাণ ছিলো, তার কারণ হচ্ছে লোহা। সেখানে দুই ধরনের আয়রন পাওয়া গেছে – জারিত লোহা (oxidized iron), এবং কম ঘনত্বের লোহা (reduced iron). ঠিক যেমনটা আমাদের শরীরে পাওয়া যায়। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন পর্যন্ত একটা প্রেস কনফারেন্স ডেকেছিলেন এটা নিয়ে, যে দৃশ্যটা ১৯৯৭ সালে Contact মুভিটাতে ব্যবহার করা হয়েছিলো। তবে কনট্যাক্টের কাহিনী মঙ্গলের উল্কা নিয়ে নয়, আমাদের সৌরজগত থেকে অনেক দূরে কোনো এক গ্রহ থেকে আসা সংকেত নিয়ে। সেই সংকেতের প্রেস কনফারেন্স হিসেবে এই দৃশ্যটা দেখানো হয়েছিলো। আপনারা জানেন হয়তো যে, Contact কার্ল সেগানের লেখা সায়েন্স ফিকশন!
দূর থেকে তোলা মঙ্গলের ছবিতে অনেকেই মানুষের মুখ দেখেছেন। তখন অনেকে ওখানে প্রাণ আছে বলে লাফালাফি করেছিলো। ওরা এটা চিন্তা করলো না যে এতো প্রাণী থাকতে মানুষের মুখ কেন থাকতে যাবে? পৃথিবীতেই তো প্রায় সব রকম প্রাণীর চেহারা মানুষের চেয়ে ভিন্ন। তাহলে ভিন্ন একটা গ্রহতে কেন মানুষের চেহারা সমৃদ্ধ কোনো গঠন বানাবে কেউ?
পরে যখন আমরা রো হাই রেজোলিউশনে ছবি তুললাম, তখন দেখলাম যে আসলে ওখানে কিছু নেই।
আমরা প্যাটার্ন বা নকশা জিনিসটা ধরতে বেশ ওস্তাদ। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন জায়গাতেও নকশা দেখি যেখানে ওটা নেই। অর্থাৎ, আমরা নকশা সনাক্তকরণে এতোটাই দক্ষ যে সেটাই অদক্ষতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইংরেজিতে উনি বলেছিলেন, We are so good at pattern recognition that we are bad. আমরা যা দেখতে চাই, সেটা দেখি। আমাদের চেহারা যদি গলদা চিংড়ির মত হতো, তাহলে আমরা সেখানে গলদা চিংড়ি দেখতে পেতাম। এখানে তিনি জানিয়ে রাখলেন, গলদা চিংড়ি তার সবচেয়ে প্রিয় খাবার।
বৃহস্পতি
বৃহস্পতির আলোচনা তিনি শুরুই করলেন কার্ল সেগানের লেখা একটা সায়েন্স আর্টিকেল দিয়ে, যেটার নাম ছিলো Particles, environments, and possible ecology in the Jovian atmosphere. এটা ১৯৭৬ সালে পাবলিশ হয়েছিলো। ওখানে বলা হয়েছিলো, বৃহস্পতির যা আমরা দেখি তার সবই আসলে গ্যাস, এবং যদি কোন শক্ত ভূপৃষ্ঠ থাকেও, সেটা অনেক গভীরে। সেখানে কোনো প্রাণ থাকলে হয়তো বায়ুমণ্ডলে থাকবে। এক আর্টিস্ট সেখান থেকে ধারণা নিয়ে কিছু ছবি এঁকেছিলেন, যেগুলো সেগান ১৯৮০ এর জনপ্রিয় বিজ্ঞানভিত্তিক টিভি শো কসমস-এ দেখিয়েছিলেন।
যাই হোক, জুপিটারের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো প্রার্থী হচ্ছে জুপিটারের চাঁদ Enceladus. ওটা বরফ দিয়ে ঢাকা, কিন্তু সেখানে কিছু Geyser বা উষ্ণ প্রস্রবণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, তরল পানি। তরল পানি মানে সেখানে একশন থাকতে পারে, প্রাণ থাকতে পারে। অবশ্য জুপিটারের চাঁদগুলোর মধ্যে Europa নাকি টাইসনের সবচেয়ে প্রিয়। ইউরোপা নিয়ে ওনার কিছু বক্তব্য ছিলো, যেগুলো Europa Report নামে একটা সায়েন্স ফিকশন মুভিতে ব্যবহার করতে চেয়ে প্রযোজক যোগাযোগ করেছিলো। উনি বললেন, “আচ্ছা, সমস্যা নাই। এরপর ওরা আমাকে একটা চেক পাঠিয়ে দিলো। এর চেয়ে সহজে টাকা কামাই আমি আর কখনো করিনি।” মজা করে কোনো এক অদৃশ্য তৃতীয় পক্ষকে বললেন, “That’s great. Do you want more?” জানালেন, মুভিটা নেটফ্লিক্সে আছে। সময় পেলেই দেখে ফেলবো ঠিক করলাম।
শনি
এটাই নাকি আমাদের সৌরজগতে টাইসনের দ্বিতীয় প্রিয় গ্রহ। প্রথমটা অবশ্যই পৃথিবী! উনি বললেন, “আপনারা সবাই তো জানেন, শনির চারপাশে একটা বলয় আছে। কিন্তু এটা কি কেউ জানেন যে, শনিগ্রহে অরোরা-ও আছে?” এরপর তিনি অরোরা’র ছবি দেখালেন…
অরোরা মানে হচ্ছে শনিরও পৃথিবীর মত একটা চৌম্বকক্ষেত্র আছে, যেটা সৌরবায়ুকে ঠেলে মেরুর দিকে পাঠিয়ে দেয়, এবং সেটা রাতের আকাশে আয়নের সাথে বিক্রিয়া করে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শনিতে প্রাণ আছে কিনা, সেই আলাপে না গিয়ে তিনি চলে গেলেন শনির চাঁদগুলোর মধ্যে একটাতে, Titan-এ। ওখানে মিথেনের হ্রদ আছে। আর মিথেন তো হাইড্রোকার্বন, যার গুরুত্ব নিয়ে আগেই বলা হয়েছে। কার্ল সেগানের কসমস এসেছিলো ১৯৮০ সালে। ২০১৪ তে যখন টাইসন আরো একবার কসমস নিয়ে এলেন, তখন সেখানে কাল্পনিক জাহাজে করে উনি আমাদেরকে টাইটানে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এই পর্যায়ে এসে উনি দর্শকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে কসমস দেখেনি?” দর্শকদের মধ্যে প্রায় সবারই দেখা ছিলো, একদম হাতে গোণা কয়েকজন হাত তুললো। টাইসন তাদের মধ্যে একজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাহলে আপনাকে কে টেনে এনেছে এখানে? কারণ, আমি কে, কী করি, সেই ব্যাপারে তো আপনার কোনো ধারণাই নেই।” মহিলা জবাবে ইউটিউবে ভিডিও দেখেছেন এই টাইপ কিছু একটা বলেছিলো।
ভেনাস, নেপচুন, আর ইউরেনাস নিয়ে তিনি তেমন কিছু আর বললেন না। চলে এলেন পৃথিবীতে…
পৃথিবী
স্লাইডে বড় করে EARTH কথাটা ভেসে এলো। উনি বললেন, “পৃথিবীর কথা ভাবলেই আমাদের এক মমতাময়ী স্তন্যপায়ী মায়ের কথা মনে হয়। এজন্যে আমরা একে মাদার আর্থ বলি। এখানে, একটু নির্দিষ্ট করে স্তন্যপায়ী শব্দটা বলা জরুরি। কারণ, এমন অনেক মা আছে প্রাণীজগতে যে সন্তানকে টুপ করে গিলে ফেলে।” তবে, পৃথিবী কি আসলেই খুব মমতাময়ী?
এবার, স্লাইডে EARTH লেখাটার নিচে ভেসে এলো WANTS TO KILL YOU. বন্যা, দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, জলোচ্ছাস, অগ্ন্যুৎপাত, হারিকেন/টাইফুন (উনি মজা করে বললেন, এটার কথা তো আপনাদের ভাল করেই জানা। নিউ অরলিয়েন্সবাসীর তো একদম সামনাসামনি অভিজ্ঞতা আছে।), এমন আরো অনেক কিছুই আপনাকে ধ্বংস করতে চায়। আর ব্রহ্মাণ্ড?
ব্রহ্মাণ্ডও আপনাকে ধ্বংস করতে চায়। গামা রশ্মির বিস্ফোরণ, সুপারনোভা বিস্ফোরণ, কৃষ্ণগহবর, সৌরঝড়, ধূমকেতুর আক্রমণ, গ্রহাণুর আক্রমণ – সব মিলিয়ে ব্রহ্মাণ্ড আপনার ওপরে খুবই ক্ষ্যাপা। ডায়নোসরদেরকে তো একটা গ্রহাণু এসে একেবারে বিলুপ্তই করে দিলো, প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে। ১৯০৮ সালে একটা ধূমকেতু এসে আঘাত করেছিলো সাইবেরিয়াতে, যেটাকে তুঙ্গুসকা ইভেন্ট বলে। কার্ল সেগান তার (১৯৮০ সালের) কসমসের চতুর্থ এপিসোড Heaven and Hell-এ দেখিয়েছিলেন। কয়েক বছর আগে (২০১৩ সালে), রাশিয়াতে একটা উল্কা আঘাত করলো, যাতে প্রায় ১৬০০ জন আহত হয়েছিলো, কিন্তু কেউ মারা যায়নি। কারণ, তুঙ্গুসকা ইভেন্টের মত ওটাও মাটিতে আঘাত করার আগেই বায়ুমণ্ডলে বিস্ফোরিত হয়েছিলো। কিন্তু একটা শকওয়েভ তো ছিলোই, যে কারণে যারা “ও মা গো, আকাশে আলো” দেখে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো, তাদের জানালার কাঁচ ফেটে ওরা আহত হয়েছিলো।
টাইসনের কাছে নাকি এই এস্টেরয়েড বা গ্রহাণুগুলো প্রকৃতির কাছ থেকে আসা একেকটা সতর্কসংকেতের মত।
যেন প্রকৃতি জিজ্ঞেস করছে, “তো, স্পেস প্রোগ্রামের আপডেট কী, অ্যাঁ?”
ব্রহ্মাণ্ডের গঠন এবং পৃথিবীতে প্রাণের গাঠনিক উপাদান
ব্রহ্মাণ্ডের গঠন কী দিয়ে? কোন কোন মৌল সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ব্রহ্মাণ্ডে? এই প্রশ্নের জবাবে টাইসন একটা তালিকা দেখালেন। সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় হাইড্রোজেন, কারণ এটাই সবচেয়ে সরল মৌল, বানাতে মাত্র একটা প্রোটন লাগে। এটা রইলো তালিকায় সবার ওপরে। এরপর দুই প্রোটনওয়ালা হিলিয়াম। এরপর যথাক্রমে অক্সিজেন, কার্বন, নাইট্রোজেন, এবং ওনার সবচেয়ে প্রিয় মৌল – অন্যান্য। হা হা হা!
এইবার দেখালেন, আমাদের এই পৃথিবীতে পাওয়া প্রাণের শরীর কী দিয়ে তৈরি। আমাদের শরীরে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন, কারণ শরীরের বেশির ভাগই পানি। আর পানি বানাতে লাগে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন। ব্রহ্মাণ্ডের গঠনেও এই দুটো প্রথম তিনটার মধ্যেই আছে। মাঝ থেকে হিলিয়াম আমাদের শরীরে একেবারে নেই বললেই চলে। কেন? কারণ, হিলিয়াম একটা নিষ্ক্রিয় গ্যাস, একে দিয়ে কিছু করানো যায় না।
এরপরেই আছে কার্বন – ব্রহ্মাণ্ডের গঠনেও, আমাদের শরীরেও! আমরা কার্বনভিত্তিক প্রাণী। কার্বন কিভাবে প্রাণের এতো বৈচিত্র্য ধারণে সক্ষম হলো? কারণ, কার্বন যত উপায়ে যৌগ গঠন করতে পারে, আর কেউ পারে না। কার্বন উপস্থিত, এমন যতগুলো যৌগ আছে, সকল মৌল মিলেও এতো যৌগ নেই। এখানে তিনি মজা করে বললেন, কে যেন ওনাকে বলেছিলেন যে কার্বন নাকি পর্যায় সারণির বেশ্যা (Slut of the periodic table)….. হা হা হা!
তাই, এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রাণ কার্বনভিত্তিক হলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এরপর আমাদের শরীরে আছে নাইট্রোজেন, ঠিক ব্রহ্মাণ্ডের মতই। তারপর আছে, আবারো ওনার ফেভারিট – অন্যান্য। এখান থেকে দুটো জিনিস প্রমাণ হয়, বললেন টাইসন।
১) আমরা যে নিজেদেরকে স্পেশাল মনে করি, তা গাঠনিক দিক থেকে অন্তত ঠিক না। ব্রহ্মাণ্ডে সবচেয়ে বেশি যে মৌলগুলো পাওয়া যায়, আমরা সেগুলো দিয়েই তৈরি। এমন যদি হতো যে, আমরা বিসমাথ দিয়ে তৈরি, তাহলে বরং আমরা স্পেশাল হতাম। কারণ, ঐ ব্যাটাকে সহজে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
২) কিন্তু তাই বলে কি আমরা স্পেশাল নই? অন্য একটা দিক থেকে আমরা স্পেশাল। কিভাবে? আমরা যে শুধু এই ব্রহ্মাণ্ডে আছি, তাই নয়। বরং ব্রহ্মাণ্ড নিজেই আমাদের মধ্যে আছে। ব্রহ্মাণ্ডের উপাদান দিয়েই আমরা তৈরি। আমাদের সাথে ব্রহ্মাণ্ডের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর।
যাই হোক, আমাদের পৃথিবীতে সকল প্রাণই কার্বনভিত্তিক, আমরা অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে আলাদা কিছু নই। আগে একটা প্রাণবৃক্ষ (Tree of life) দেখানো হতো, যেখানে মানুষ ছিলো সবার ওপরে। দেখে মনে হতো যেন, বিবর্তনের উদ্দেশ্য বা শেষ লক্ষ্য হচ্ছে মানুষ তৈরি করা। নতুন একটা প্রাণবৃক্ষ বানানো হয়েছে, যা আরো নিখুঁতভাবে প্রাণের বিবর্তনকে তুলে ধরে।
লাল একটা উপবৃত্ত দেখতে পাচ্ছেন? অনেকবার জুম করলে সেখানে পাবেন You are here; ওখানেই মানুষের অবস্থান। আমাদের খুব কাছাকাছিই আছে ইঁদুর আর শিম্পাঞ্জী। আর এজন্যেই ইঁদুরের ওপর এতো গবেষণা।
ব্রহ্মাণ্ডে বুদ্ধিমান প্রাণীর উপস্থিতি
ওপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, ব্রহ্মাণ্ডের অনেক জায়গাতেই কার্বনভিত্তিক প্রাণ থাকা মোটেও অসম্ভব কিছু না। হয়তো বিলিয়ন জগতে কার্বনভিত্তিক প্রাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেমিনারের এক জায়গাতে তিনি বলেছিলেন, “Billions. Ah, love that word! কেমন একটা বুম আওয়াজ হয় এই শব্দটাতে! বিলিয়ন্স! আসুন, সবাই মিলে একসাথে এই শব্দটা বলি – কার্ল সেগানের জন্য। ১, ২, ৩…… “
দর্শকদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি একসাথে বলে উঠলো, BILLIONS. গমগম করে উঠলো গোটা গ্যালারি। এরপরেই সেগানের উদ্দেশ্যে হাততালিতে ফেটে পড়লো।
যারা জানেন না, তাদের জন্য বলছি, সেগানের একটা বই আছে, Billions and Billions. সেটার ভূমিকার একাংশ বাংলা অনুবাদে পড়তে পারেন অনুবাদকদের আড্ডার ব্লগে। অনেকের কাছেই এই শব্দটা কার্ল সেগানের ইমেজ বয়ে নিয়ে আসে। আর টাইসন তো সেগানের অনেক বড় ভক্ত, তা তো সবাই বুঝেই ফেলেছেন।
এই পর্বে এসে টাইসন আলোচনা করলেন, ব্রহ্মাণ্ডের কত জায়গায় প্রাণ থাকতে পারে, সেটা নিয়ে বানানো ফ্র্যাংক ড্রেইকের সমীকরণ নিয়ে। সেই সমীকরণ নিয়ে যারা জানতে চান, তারা সেগানের ভিডিওটা দেখতে পারেন। সেগান ড্রেইকের বন্ধু ছিলেন, আর বন্ধুর সমীকরণ নিয়ে কসমস সিরিজে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। অনুবাদকদের আড্ডার অনুবাদও আছে ভিডিওর সাথে। টাইসন সেটার আরো সহজ একটা সংস্করণ দেখালেন,
N – civilizations = N – stars x f – planets x f – life x f – intelligent life
এখানে N দিয়ে সংখ্যা আর f দিয়ে ভগ্নাংশ বোঝানো হচ্ছে। কতগুলো নক্ষত্র, তার কয়টাতে গ্রহ আছে, গ্রহগুলোর কয়টাতে প্রাণ আছে, আর কত ভগ্নাংশে বুদ্ধিমান প্রাণ আছে, তা এই সমীকরণে বোঝানো হচ্ছে।
এরপর তিনি বললেন, Contact সিনেমার প্রিমিয়ারে ওনাকে ডাকা হয়েছিলো। কারণ, ওটার লেখক কার্ল সেগান, আর সেগানের সদ্য বিধবা স্ত্রী অ্যান ড্র্যুইয়ানকে (সেগান ১৯৯৬ সালে মারা গিয়েছিলেন, আর সিনেমা বের হয়েছিলো ১৯৯৭ সালে) টাইসন চিনতেন। সেখানে নায়িকা জুডি ফস্টার কথায় কথায় নায়ক ম্যাথিউ ম্যাককোনাহেইকে এই সমীকরণটা বলছিলো। জুডি বলছিলো, “দেখেছো, আমাদের এই ছায়াপথেই ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র আছে। যদি প্রত্যেক মিলিয়নের মধ্যে একটা নক্ষত্রে গ্রহ থাকে, যদি সেরকম মিলিয়ন গ্রহের একটাতেও যদি প্রাণ থাকে, আর সেই গ্রহগুলোর মিলিয়নের মধ্যে একটাতেও যদি বুদ্ধিমান প্রাণ থাকে, তবুও এই ছায়াপথে বুদ্ধিমান প্রাণসমৃদ্ধ মিলিয়ন গ্রহ থাকবে।”
টাইসন পুরো ক্লিপটা দেখালেন। এরপর বললেন, “এটা দেখে আমি বলে উঠেছিলাম, ‘কী?’।”
এটা তো ১ এর চেয়েও কম। টাইসন এই ব্যাপক ভুলের জন্য জুডি ফস্টারকে দুষলেন। বললেন, “সে তো নিজের স্ক্রিপ্ট পড়ে দেখেছে, আর নিশ্চয়ই সে হাই স্কুল বীজগণিতের জ্ঞানও রাখে। একটু হিসাব করে দেখবে না?”
সিনেমা হলে আমার কয়েক সিট পাশেই দেখি – ফ্র্যাংক ড্রেইক স্বয়ং সেখানে উপস্থিত। তাকে বললাম সাথে সাথে, “এটা কী হলো?” তিনি সামান্য মুচকি হেসে বললেন, “chill out”…… ফ্র্যাংক ড্রেইক নিজে, তার নিজের সমীকরণের ভুল দেখে আমাকে বললেন, “আরে রাখো মিয়া, বাদ দাও।”
অবশ্য মুভির মধ্যে প্রভূত ভুল নিয়ে টাইসন খুবই সচেতন। যেমন, টাইটানিকের যে সিনে জ্যাক ডুবে যাচ্ছিলো, সেটার আকাশ দেখে টাইসন বলে উঠেছিলেন, “ভুয়া! কারণ, নক্ষত্রগুলো ঠিক জায়গাতে নেই। আকাশের অর্ধেক সাইড বাকি অর্ধেকটার প্রতিবিম্ব। এই ভুল ধরতে হলে এস্ট্রোনমার হওয়া লাগে না।”
যাই হোক, বেশির ভাগ সিনেমাতেই এলিয়েনদেরকে খারাপ শত্রু হিসেবে দেখানো হয়। টাইসন কোনোভাবেই এটা মেনে নিতে রাজি নন যে, এলিয়েন এলে ওরা আমাদের ক্ষতি করতে চাইবে। আমরা ওদেরকে খারাপ হিসেবে দেখি, কারণ আমাদের কাছে উদাহরণ হিসেবে শুধু আমাদের নিজেদের কাজকর্মই আছে। আমরা নিজেরা মানবপ্রজাতির অন্যদের সাথে যেমন ব্যবহার করি, এলিয়েনরাও আমাদের সাথে তাই করবে বলে মনে করি।
ব্রহ্মাণ্ডের ভিন্ন সভ্যতার কাছে পাঠানো বাণী
আমাদের সৌরজগতের মায়া ছেড়ে, সূর্যের মহাকর্ষ ছিন্ন করে বেরিয়ে যাওয়া প্রথম দুটো মহাকাশযানের নাম হচ্ছে Pioneer 10 and 11. এই দুটোই নাসার মহাকাশযান, এবং সেগান দীর্ঘদিন নাসার উপদেষ্টা বোর্ডে দায়িত্ব পালন করেছেন। পাইওনিয়ার প্রজেক্টের কথা জানার পর তিনি প্রস্তাব করলেন, “যদি এরা অন্য কোনো নক্ষত্রের দিকেই যায়, তাহলে এগুলোর মধ্যে আমরা নিজেদের কোনো বার্তা যোগ করছি না কেন?” এই বলে তিনি একটা টীম গঠন করলেন, যারা একটা ফলক বানালো। ফলকসহ সেগানের ছবি দেখালেন টাইসন।
এরপর তিনি ব্যাখ্যা করলেন, সেই ফলকে কী কী আছে। প্রথম মৌল হাইড্রোজেনের প্রতীক, আশেপাশের বিভিন্ন পালসার-এর অবস্থান যাতে আমাদের সূর্যের অবস্থান বোঝা যায়, সৌরজগতের কোন গ্রহে আমরা আছি, আর একটা পুরুষ ও একটা নারীর চিত্র।
টাইসন বললেন, এই ছবিটা দেখে অনেক নারীবাদী রেগে গিয়ে বলেন, পুরুষটা কেন অভিবাদন দিচ্ছে, নারীটা দিচ্ছে না কেন? কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছেন, যে সময়ে এটা বানানো হয়েছিলো, নারীর চিত্র যোগ করাটাই অনেক সাহসের ব্যাপার ছিলো, তাও আবার নগ্ন চিত্র। একটা কমিকস বের হয়েছিলো, যেখানে স্যুট পরা একটা এলিয়েন এই ফলক খুঁজে পেয়ে আরেক এলিয়েনকে দেখিয়ে বলছে, “এই দ্যাখো, এরা দেখতে আমাদের মতই। পার্থক্য হচ্ছে, এরা কাপড় পরে না।”
সেটা ১৯৭২ সালের কথা। ১৯৭৭ সালে আরো দুটো মহাকাশযানকে সৌরজগতের বাইরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। এই দুটোই সবচেয়ে বিখ্যাত – ভয়েজার ১ এবং ২। এবার সেগান সেখানে গোটা একটা রেকর্ড যোগ করলেন। যেটাকে বলা হয়, Sounds of Earth. এখানে অনেক অনেক প্রাকৃতিক শব্দ আছে, প্রাণীর ডাক আছে। এটাতে ৫০টার বেশি ভাষায় অভিবাদন আছে, যেগুলো নিউইয়র্কের রাস্তায় বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিলো। এতে মোজার্ট, বিটোফেন, বাখ এর মিউজিক আছে।
ভয়েজার যখন শনির কক্ষপথ পার করে ফেলেছে, সেই ৩.৭ বিলিয়ন মাইল দূরত্ব থেকে, পৃথিবীর একটা ছবি তোলার জন্য নাসাকে অনুরোধ করলেন কার্ল সেগান। সেই ছবিটা দেখানোর আগে, টাইসন ম্যানেজমেন্টকে অনুরোধ করলেন গ্যালারির সব আলো নিভিয়ে ফেলতে। বললেন, “I want maximum impact for this photo”. গ্যালারির সিলিং-এ তারার মত মিটমিটে আলো জ্বলছিলো তখনো, কিন্তু বাকি সব আলো নিভিয়ে দেয়া হলো। তারপর স্ক্রিনে ভেসে এলো এই ছবিটা…
টাইসন অন্ধকারের মধ্যেই বলতে লাগলেন, এই ছবিটা খুবই বিখ্যাত হয়েছিলো। এটাকে দেখে কার্ল সেগান পৃথিবীর নাম দিয়েছিলেন Pale Blue Dot. এই নামে উনি একটা বইও লিখেছিলেন। সেই বই থেকে একটা অংশ পড়ে আজকের এই সেমিনার শেষ করছি……
(মুশাররাত শামা আর আমি এই অংশটা অনুবাদ করেছিলাম অনেক আগেই)
“এই সুবিশাল দূরত্ব থেকে, পৃথিবীকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে হওয়ার কথা না। কিন্তু আমাদের জন্য ব্যাপারটা একটু ভিন্ন।
বিন্দুটির দিকে আরেকবার তাকান – এটাই পৃথিবী, আমাদের বসত, আমরা এটাই। এখানেই ওরা সবাই – যাদের আমরা ভালোবেসেছি, যতজনকে আমরা চিনি, যাদের যাদের কথা আমরা শুনেছি – তাদের সবাই এখানেই তাদের জীবন কাটিয়েছে। আমাদের সারা জীবনের যত দুঃখ কষ্ট, হাজার হাজার ধর্ম, আদর্শ আর অর্থনৈতিক মতবাদ, যত শিকারী আর লুণ্ঠনকারী, যত সাহসী-ভীরু, সভ্যতার নির্মাতা আর ধ্বংসকারী, যত রাজা আর প্রজা, যত প্রেমিক-প্রেমিকা, যত বাবা মা, স্বপ্নে বিভোর শিশু, আবিষ্কারক, পরিব্রাজক, যত নীতিবান শিক্ষক, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, যত “সুপারস্টার”, যত জাঁহাবাজ নেতা, মানব ইতিহাসের সকল সাধু আর পাপী, সবাই তাদের জীবন কাটিয়েছে আলোয় ভেসে থাকা ধূলোর ঐ ছোট্টো কণাটিতে।
অসীম এই মহাবিশ্বে, খুব ছোট একটা মঞ্চ আমাদের এই পৃথিবীটা।
ভাবুন তো, সেনাপতি আর দিগ্বিজয়ী বীরের দল কত রক্ত ঝরিয়েছে – ক্ষুদ্র এই বিন্দুর ক্ষুদ্র একটা অংশ জয় করে, মহান হবার আশায়। ভাবুন তো সেই সীমাহীন হিংস্রতার কথা; ছোট্টো এই বিন্দুর আরো ছোটো এক প্রান্তের মানুষ যা ঘটিয়েছে, অন্য প্রান্ত জয় করবে বলে।
কী দ্বন্দ্ব তাদের নিজেদের মাঝে! রক্তের জন্য তাদের কী পিপাসা! কী প্রকট তাদের জিঘাংসা! আমাদের নাক-উঁচু ভাব, আমাদের কাল্পনিক অহমিকা, ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে আমরাই সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছি – সেই বিভ্রম, প্রশ্নবিদ্ধ হয় এই ঝাপসা নীল আলো দিয়ে।
আমাদের এই গ্রহ… মহাজাগতিক অন্ধকারের মধ্যে নিতান্তই ক্ষুদ্র একটা বিন্দু। আমাদের অজ্ঞানতায়, এই বিশালতায়, এমন কোনো ইঙ্গিত নেই যে কেউ আসবে, আমাদেরকে নিজেদের হাত থেকে রক্ষা করতে।
আমাদের জানামতে পৃথিবীই একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহ। অন্য কোথাও, অন্তত নিকট ভবিষ্যতে, আমাদের প্রজাতি আস্তানা গাড়তে পারবেনা।
ভ্রমণ? সম্ভব।
বসতি, এখনো নয়।
ভাল লাগুক আর নাই লাগুক, এই মুহূর্তে পৃথিবীই আমাদের একমাত্র আশ্রয়।
বলা হয়ে থাকে জ্যোতির্বিজ্ঞান আমাদের বিনয়ী করে তোলে, চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। মানুষের অহংকারকে ধূলিস্যাৎ করার জন্য দূর থেকে তোলা ছোট্টো পৃথিবীর এই ছবিটার চেয়ে ভালো উদাহরণ আর হয় না। আমার মতে, এটা মনে করিয়ে দেয়, কতটা জরুরি পরস্পরের প্রতি আরেকটু সহানুভুতিশীল হওয়া; কতটা জরুরি এই ছোট্টো নীল বিন্দুটাকে, আমাদের জানা একমাত্র বাড়িটাকে, সংরক্ষণ আর উপভোগ করা।”
***
এরপর উনি বললেন, “Thank you, New Orleans”. ব্যাপক হাততালির মাধ্যমে শেষ হলো সেমিনার। এরপর প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিলো, সেটা নিয়ে আরেকটা পোস্ট লেখার ইচ্ছে রইলো।
সুস্বাদু রচনা। গপ গপ করে পুরোটা খেয়ে নিলাম। পড়তে গিয়ে বার বার কার্ল সেগানের কসমসের দৃশ্যগুলো ভেসে উঠছিলো।
ভালোই হয়েছে যে, সাধারণ কিছু ব্যাপার সুন্দর করে স্পর্শ করা হয়েছে। নতুন করে পুরনো জ্ঞান ঝালাই হল। আর মুভি নিয়ে টাইসনের অংশটুকু পড়ে খুব হাসলাম।
“এই দ্যাখো, এরা দেখতে আমাদের মতই। পার্থক্য হচ্ছে, এরা কাপড় পরে না।” হা হা হা!
সবশেষে Pale Blue Dot-এর অনুবাদটুকু পড়ে আবার আবেগী হলাম।
পড়তেই এতো ভালো লাগলো… না জানি সামনাসামনি দেখতে আর শুনতে তোর কতো ভালো লেগেছিলো!
যেখানেই সেগানের নাম আসে, যতবারই আসে, ততবারই আমি সহ আরো অনেককে আবেগী হয়ে যেতে দেখেছি। সামনাসামনি অনেক ভালো লেগেছে।
আজ রাতে একটা লম্বা স্বপ্ন দেখবো! যেখানে আমি আজ সেমিনারে থাকবো! ? সুন্দর ও জীবন্ত লেখা। এতটা চমৎকার যে, মনে হচ্ছিলো যেন আমি নিজেই উপস্থিত দর্শক।
এটাই চেয়েছিলাম – যারা ছিলো না, তাদেরকে নিয়ে যেতে পারি।
প্রশ্নোত্তর পর্ব টা ঝটপট লিখে ফেলুন! ?
সময় পেলেই লিখে ফেলবো।
আপনি সেটা যথেষ্ট সফলতার সাথেই করতে পেরেছেন।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।