প্রতি সেকেন্ডে, সূর্যের কেন্দ্র থেকে উৎপন্ন ট্রিলিয়ন নিউট্রিনো আমাদের শরীর ভেদ করে যায়। আপনি তা টের পান না, কারণ এসব মৌলিক কণা বস্তুর সাথে প্রায় কখনোই বিক্রিয়া করে না। কিন্তু জ্যোতির্বিদরা মনে করেন এই নিউট্রিনো মহাবিশ্বে ফ্লোরিন সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে- ফ্লোরিন- যা টুথপেস্ট এবং পানিতে যোগ করা হয়- আর তা আপনার দাঁতকে ক্ষয়ের থেকে রক্ষা করে। এবং ফ্লোরিনের মহাজাগতিক উৎস একটি রহস্য।
নক্ষত্ররা প্রায় সকল রাসায়নিক পদার্থ সৃষ্টির কারণ। আণবিক সংখ্যা ৯ হবার কারণে পর্যায় সারণীতে ফ্লোরিনের অবস্থান অক্সিজেন এবং নিয়নের মাঝখানে, তবে উভয়ের তুলনায় এর সহজলভ্যতা অনেক কম। একটি বিরাট নক্ষত্র তার জীবনকালে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন এবং নিয়ন উৎপন্ন করে, এবং যখন এটি বিস্ফোরিত হয় তখন সেই অক্সিজেন এবং নিয়ন মহাশূন্যে ছড়িয়ে দেয়। এ কারণে উভয় মৌলই সহজলভ্যঃ হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের পর অক্সিজেন হচ্ছে মহাবিশ্বে সবচেয়ে বেশী সহজলভ্য মৌলের মধ্যে ৩য়, নিয়নের অবস্থান ৫ম অথবা ৬ষ্ঠ। অন্যদিকে, ফ্লোরিন এতোই দুর্লভ যে এটি প্রথম বিশের মধ্যেও পড়ে না।
দুজন জ্যোতির্বিদ- Indiana University, Bloomington এর Catherine Pilachowski এবং Cedar City এর Southern Utah University এর Cameron Pace -এটা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। Arizona তে অবস্থিত Kitt Peak National Observatory তে ২.১ মিটার টেলিস্কোপ ব্যবহার করে তারা ৭৯টি নক্ষত্রে হাইড্রোজেন ফ্লোরাইড (HF) নামক একটি গ্যাসের অনুসন্ধান চালান, যা ফ্লোরিন সমৃদ্ধ। Pilachowski এর মতে, জিনিসটা ভয়াবহ; এই গ্যাস নিশ্বাসের সাথে গ্রহণ প্রাণনাশক হতে পারে। কিন্তু এটি ইনফ্রারেড রেডিয়েশন শোষণ করে, এবং তা একটি নক্ষত্রের বর্ণালীতে চিহ্ন রেখে যেতে পারে যা জ্যোতির্বিদরা দেখতে পাওয়ার আশা রাখেন।
৭৯টি নক্ষত্রের ৫১টিতে এই গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়, যা এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত রেকর্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ। Astronomical Journal এর সেপ্টেম্বর প্রকাশনায় Pilachowski এবং Pace রিপোর্টের ভিত্তিতে, গবেষণায় প্রাপ্ত ফ্লোরিনের প্রাচুর্য এতোই বেশি যে সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্ট নিউট্রিনোই এদের সৃষ্টির কারণ হতে পারে। যখন একটি অতিকায় নক্ষত্রের বিস্ফোরণ ঘটে তখন তা প্রায় ১০৫৮ (১এর পর ৫৮টা শূণ্য) টি নিউট্রিনো ছড়িয়ে দেয় যা এতোই গতিশক্তি সম্পন্ন হয় যে এটি নিয়নের নিউক্লিয়াই থেকে প্রোটন এবং নিউট্রনকে সরিয়ে দিয়ে ফ্লোরিন উৎপন্ন করে। জ্যোতির্বিদরা উপসংহার টানেন এই বলে যে – ফ্লোরিন অন্য উপায়েও তৈরি হয়, কিন্তু তা এতো বেশী পরিমাণ ফ্লোরিনের অস্তিত্বের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে না।
সুইডেনের Lund Observatory এর জ্যোতির্বিদ Henrik Jӧnsson বলেছিলেন, “এটা অনেক বড় একটা পদক্ষেপ”। তার মতে, Pilachowski এবং Pace এর বিশাল স্যাম্পল সাইজ তাদের সিদ্ধান্তকে আরো দৃঢ়তা প্রদান করে। এটা অনেক বড় একটা আবিষ্কার, কারণ এই নতুন ফলাফল Jӧnsson এর নিজের গবেষণার সাথে সাংঘর্ষিক, যাতে আরো কম সংখ্যক নক্ষত্রে অপেক্ষাকৃত অনেক কম ফ্লোরিন পাওয়া যায়। এই কম প্রাচুর্যের ব্যাপারটা বলছে যে – মৌলগুলো সেই সব নক্ষত্রেও সৃষ্টি হতে পারে যাদের বিস্ফোরণ হয় না। আর এটা ঘটে এমন নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে যাতে নিউট্রিনো থাকে না।
কথিত “Asymptotic” দৈত্যাকার নক্ষত্রগুলো উজ্জল এবং সুপরিণত সূর্যের মত। এরা হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের ফিউশনকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে। জ্যোতির্বিদেরা এদের ফ্লোরিন উৎপাদনের প্রমাণ পেয়েছেন। যখন এইসব নক্ষত্রের মৃত্যু হয়, তারা তাদের বাইরের আবরণ এবং তাদের নতুন বানানো ফ্লোরিন ছায়াপথে ছেড়ে দেয়।
তো, নক্ষত্রে থাকা ফ্লোরিনের পরিমাণ কম নাকি বেশি? উত্তরটা পাওয়া যেতে পারে কে নাক্ষত্রিক তাপমাত্রা সঠিকভাবে মাপতে পারছে, তার ভিত্তিতে। কারণ হাইড্রোজেন ফ্লোরাইড অণু উচ্চ তাপমাত্রায় ভেঙ্গে যায়, উষ্ণ নক্ষত্রের বর্ণালীতে অপেক্ষাকৃত শীতল নক্ষত্রের বর্ণালীর চেয়ে হাইড্রোজেন ফ্লোরাইডের উপস্থিতি কম পাওয়া যায়- এমনকি যদিও উষ্ণতর নক্ষত্রগুলোতে একই পরিমাণ ফ্লোরিন থাকে। তাই ফ্লোরিনের সঠিক পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য জ্যোতির্বিদদের যে কোন নক্ষত্রের সঠিক তাপমাত্রা জানতে হয়। এই গ্রীষ্মে, প্রায় ১০০টি নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের জন্য Jӧnsson একটি ৪ মিটার Kitt Peak টেলিস্কোপ ব্যবহার করেন এবং তাদের সঠিক তাপমাত্রা ও হাইড্রোজেন ফ্লোরাইডের প্রাচুর্য হিসাব করার আশা রাখেন।
আরিজোনার Tucson এর The National Optical Astronomy Observatory এর একজন জ্যোতির্বিদ Verne Smith, যিনি এই গবেষণাগুলোর কোনটিরই অংশ ছিলেন না, মনে করেন- গবেষণা দুটিতেই প্রাপ্ত ফ্লোরিনের উৎসগুলো গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ধারণা মতে, সুপারনোভার নিউট্রনগুলো পৃথিবীর অর্ধেক থেকে দুই তৃতীয়াংশের মত ফ্লোরিন উৎপন্ন করেছে- এ কারণে, যে কণাগুলো সাধারণত কিছুই করে না, তাদের আপনি আপনার কখনোই না হওয়া ক্যাভিটির জন্য ধন্যবাদ দিতেই পারেন।