নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ

নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার

নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারকে অনেক সময় সংক্ষেপে ফ্যাটি লিভার বা NAFLD (Non alcoholic fatty liver disease) বলা হয়। অতিরিক্ত মদ পানের ফলে লিভারে চর্বি জমে তৈরি করে অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার নামক রোগ। কিন্তু নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার হয় মদ পান ছাড়াই।

মদ পানের জন্যই হোক কিংবা অন্য কোন কারণে হোক, অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ এবং নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ – উভয় ক্ষেত্রে লিভারের পরিবর্তন একই রকম হয়। তবে রোগ দুটোকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয়, কারণ এদের চিকিৎসার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

উল্লেখ্য, গর্ভাবস্থায় মহিলাদের লিভারে চর্বি জমতে পারে। সাধারণত গর্ভধারণের শেষ পর্যায়ে এসে লিভারের চর্বি জমে যাওয়ার সমস্যাটি প্রকাশিত হয়। আর এই গর্ভকালীন ফ্যাটি লিভারের মূলে রয়েছে জিনগত ত্রুটি। এ ধরণের ফ্যাটি লিভার উপরোক্ত দুটো ফ্যাটি লিভার ডিজিজ থেকে আলাদা রোগ হিসেবে বিবেচিত হয়।

নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারের পর্যায়সমূহ

নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এটা পর্যায়ক্রমে ঘটে থাকে। প্রথম পর্যায়ে সাধারণতঃ লিভারের কোষে কোষে চর্বি জমে। এটাকে বলা হয় স্টিয়াটোসিস (steatosis)। একটি সময় পর্যন্ত লিভারে চর্বি জমলেও তা কোনো ক্ষতি করে না, কোনো লক্ষণ-উপসর্গও প্রকাশিত হয় না। সাধারণত লিভারের ওজনের ৫% – এর বেশী চর্বি জমলে তা ফ্যাটি লিভার হিসেবে গণ্য করা হয়। এর চেয়ে বেশি চর্বি জমতে থাকলে জটিলতা শুরু হয়। দু’ ধরনের জটিলতা এখানে উল্লেখযোগ্যঃ

 নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটোহেপাটাইটিসঃ এ পর্যায়ে লিভারে জমা চর্বির প্রতি শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে এবং লিভার কোষে প্রদাহ সৃষ্টি হয়।

•  সিরোসিসঃ এ পর্যায়ে প্রদাহের কারণে লিভারের কোষসমূহ বিনষ্ট হয়ে যায় এবং লিভারের গঠন কাঠামো ভেঙে পড়ে। স্বভাবতই নষ্ট অংশসমূহ শুকিয়ে যায় এবং সেখানে ফাইব্রোসিস হয়ে গুটি তৈরি হয়।

নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারের কারণ এবং ঝুঁকিসমূহ

নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার কেন হয়, তা এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়া বা মেদভুঁড়ি এই রোগের একটি বড় কারণ। আর NAFLD হলে দেহে যেসব ঝুঁকি দেখা দিতে পারে, সেগুলোর মধ্যে আছেঃ
• ডায়াবেটিস
• রক্তের অতিরিক্ত কোলেস্টেরল
• উচ্চ রক্তচাপ

ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল – এই তিনটি সমস্যা একসঙ্গে থাকলে তাকে বলা হয় “মেটাবলিক সিনড্রোম” (metabolic syndrome)। সুতরাং লিভারে চর্বি জমার একটি পর্যায় কিংবা পরিণতি হলো মেটাবলিক সিনড্রোম। এর ফলে রোগীদের ডায়াবেটিসের জটিলতা এবং হৃদরোগ হতে পারে।

বয়স বাড়লেও লিভারে চর্বি জমার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কারণ বয়সের কারণে উপরে উল্লিখিত ঝুঁকিগুলিও বাড়তে থাকে। যারা অধিক পরিমাণে বিড়ি-সিগারেট পান করেন, তাদের লিভারে চর্বি জমার প্রবণতাও বেশী। এটা ঠিক, যাদের লিভারে চর্বি জমেছে তাদের মধ্যে মেদভুঁড়ি থাকার প্রবণতা বেশী। কিন্তু ১০-২০% ফ্যাটি লিভারের রোগী আসলে মোটা নয়। অর্থাৎ কিছু কিছু ক্ষীণকায় মানুষের লিভারেও চর্বি জমতে দেখা যায়।

মেদভুঁড়ি এবং বাড়তি ওজনের সঙ্গে ফ্যাটি লিভারের সম্পর্ক কী?

মেদভুঁড়ি কিংবা ওজন বেশী থাকলেই কিন্তু সকলের লিভারে চর্বি জমে না। আবার সব ফ্যাটি লিভারের রোগীর ওজন বেশী নয় কিংবা সবারই মেদভুঁড়ি নেই। এজন্য মেদভুঁড়ি এবং বাড়তি ওজনের সঙ্গে ফ্যাটি লিভারের প্রকৃত সম্পর্ক পরিষ্কার নয়। তবে একটি বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, ওজন বাড়লে কিংবা মেদভুঁড়ি থাকলে লিভারে চর্বি জমার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যদিও মনে করা হয় নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারের পিছনে জিন বা বংশগতির প্রভাব রয়েছে, কিন্তু শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমলে তার কিছু অংশ লিভারে গিয়ে জমার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

ইদানীং শিশুদের ক্রনিক লিভারের রোগের একটি বড় কারণ ফ্যাটি লিভার। অন্তত ১০-২০% শিশু এ সমস্যায় আক্রান্ত এবং ৫০-৮০% স্থূলকায় শিশুদের ফ্যাটি লিভার আছে।

আজকাল জনগণের মধ্যে মোটা হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে, ফ্যাটি লিভার শনাক্ত করার সংখ্যাও বেড়েছে। এজন্য ফ্যাটি লিভার সম্পর্কে গবেষণা এবং সচেতনতাও বাড়ছে।

নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারের লক্ষণ এবং উপসর্গ

অধিকাংশ ক্ষেত্রে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারের কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ প্রকাশিত হয় না। অনেকেই নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার থাকা সত্ত্বেও এর উপস্থিতি বুঝতে পারেন না। সাধারণত অন্য কোনো রোগ বা ঝুঁকি সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে গিয়ে সহসা এটা শনাক্ত হয়। অনেক সময় পেটের কোনো সমস্যার জন্য আলট্রা সোনোগ্রাম করাতে গিয়ে ফ্যাটি লিভারের উপস্থিতি ধরা পড়ে। তবে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারের কারণে যে সকল লক্ষণ, উপসর্গ দেখা দিতে পারে, সেগুলো হলঃ
• অবসাদ
• ক্লান্তি (সাধারণভাবে পেশী দুর্বল মনে হওয়া এবং কোন কাজে উৎসাহ বোধ না করা)
• পেটের উপরের দিকে চাপ অনুভব করা।

তবে এসকল লক্ষণ-উপসর্গ কোনোটিই সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশ করে না। আরও অনেক কারণেই অবসাদ কিংবা দুর্বলতা অনুভূত হতে পারে। এজন্য নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার শনাক্ত করার জন্য সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে। এ রোগের অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে রয়েছেঃ
• ওজন কমে যাওয়া
• ক্ষুধামন্দা
• বমি বমি ভাব
• পেটে ব্যথা

নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার হলে লিভারের আকার বেড়ে যায়। এটা অভিজ্ঞ চিকিৎসক পেটে হাত দিয়ে পরীক্ষা করেও অনেক সময় বুঝতে পারেন।

নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার শনাক্ত করার উপায়

আগেই বলা হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফ্যাটি লিভারের কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ প্রকাশ পায় না। অন্য কোনো কারণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে গিয়ে এটা ধরা পড়ে। রক্ত পরীক্ষা করেও লিভারের সমস্যা সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা যায়। রক্তে লিভারের এনজাইম বেড়ে গেলে অনেক সময় চিকিৎসকের মনে সন্দেহ জাগে। সেক্ষেত্রে বাড়তি পরীক্ষা করলেই এটা শনাক্ত হতে পারে। তবে এসব ক্ষেত্রে সকল চিকিৎসকই নিশ্চিত হতে চান যে, এরকম অবস্থা অতিরিক্ত মদপানের কারণে হচ্ছে না। কারণ মদ পানের পরিমাণ বেশী হলেও লিভারের পরীক্ষার ফলাফল অস্বাভাবিক হয়ে থাকে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে পেটের আলট্রা সোনোগ্রাম করালে লিভারে অতিরিক্ত চর্বির উপস্থিতি শনাক্ত করা যায়। পেটের সিটি স্ক্যান করালেও এটা দেখা যায়। ফ্যাটি লিভার থেকে জটিলতা হিসেবে সিরোসিস হয়ে গেলে সেটাও শনাক্ত করা সম্ভব। এসব ক্ষেত্রে রোগীর লিভারের পাশাপাশি প্লীহাও বড় হয়ে যায়।

তবে নন- অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো লিভার বায়োপসি করে তা পরীক্ষা করে দেখা। এজন্য লিভারের ভিতরে বিশেষ ধরণের সুঁই ঢুকিয়ে সামান্য পরিমাণ লিভার টিস্যু বের করে নিয়ে হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষা করতে হয়। এটা জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় সবসময় করা সম্ভব হয় না। কিন্তু লিভার বায়োপসি এবং হিস্টোপ্যাথলজির সুবিধা হচ্ছে এটা একটি নিশ্চিত পরীক্ষা। এর মাধ্যমে লিভারে চর্বি জমার অন্য কোনো কারণ থাকলে সেটাও বের করা সম্ভব। তাছাড়া লিভারের প্রদাহ বা স্টিয়াটোহেপাটাইটিস কিংবা সিরোসিস হয়েছে কিনা সে সম্পর্কেও নিশ্চিত হওয়া যায়।

আজকাল ফ্যাটি লিভারের আরও কিছু আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপায় আবিষ্কৃত হয়েছে।

পথ্য এবং চিকিৎসা

নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রধান উপায় হলো ওজন কমানো। আর ওজন কমাতে হলে অবশ্যই সঠিক পরিমাণে সুষম খাদ্য গ্রহণ করা জরুরী। এজন্যঃ
• পরিমিত পরিমাণে সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে
• যথেষ্ট পরিমাণে ফল এবং সবজি খেতে হবে
• চিনি এবং মিষ্টি জাতীয় খাবারের পরিমাণ সীমিত রাখতে হবে
• খাবারে লবণের পরিমাণ কমাতে হবে।


সুষম খাবার খেলে এবং নিয়মিত ব্যায়াম করলে শুধু যে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তা নয়, অন্যান্য রোগ-ব্যাধি এবং ঝুঁকি (ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ) থেকেও পরিত্রাণ পাওয়া যায়। এর ফলে ডায়াবেটিসের জটিলতা এবং হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়।

অনেকেই মনে করেন নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার কোনো গুরুতর সমস্যা নয়। কিন্তু এটা অনেক গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির অগ্রীম বার্তা বহন করে। কিন্তু সময়মত সচেতন হলে ডায়াবেটিসের অনেক জটিলতা এবং হৃদরোগ থেকে আমাদের মুক্ত রাখতে সহায়তা করে। নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার নিরাময় করার কার্যকর কোনো ওষুধ নেই। শুধুমাত্র সুষম খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং লাইফ স্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা এই সমস্যা এবং আনুষঙ্গিক জটিলতা থেকে মুক্ত থাকতে পারি।

Comments

আপনার আরো পছন্দ হতে পারে...

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
জানান আমাকে যখন আসবে -
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x