গ্রীক গণিতবিদ ইউক্লিড (চতুর্থ থেকে তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ) তাঁর জ্যামিতির বই ‘এলিমেন্টস’ এ ৫টি স্বতঃসিদ্ধ বা স্বীকার্য ও ৫টি সাধারণ ধারণাসহ ২৩টি বিভিন্ন প্রকারের সংজ্ঞা (যেমন- বিন্দু, রেখা, বৃত্তের কেন্দ্র, সীমানা ইত্যাদি) অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন যার ভিত্তিতে সমতল স্থানে স্কেল ও কম্পাস দিয়ে সকল প্রকার জ্যামিতিক চিত্র আঁকা যায় এবং প্রমাণ করা যায়। ইউক্লিডের মতে, স্বল্পসংখ্যক স্বতঃসিদ্ধ ও সংজ্ঞা থেকে সমগ্র জ্যামিতিশাস্ত্র গড়ে তোলা সম্ভব। সত্যিকার অর্থেই এই সকল স্বতঃসিদ্ধ ও সংজ্ঞাসমূহ থেকে তিনি সমতল জ্যামিতির বিশাল এক ভান্ডার গড়ে তুলেছিলেন। স্বতঃসিদ্ধ হচ্ছে জ্যামিতির এমন একটি ধারণা বা যুক্তি বা বিবৃতি যার প্রমাণের জন্য অন্য কোনো ধারণার প্রয়োজন পড়ে না, অর্থাৎ এরা নিজেরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সুস্পষ্ট; বরং অন্য সকল জ্যামিতিক প্রতিজ্ঞা বা উপপাদ্য প্রমাণের জন্য এদের দরকার হয়। ইউক্লিড যে পাঁচটি বিবৃতিকে স্বীকার্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন সেগুলো হচ্ছে-
১. যে কোন বিন্দু থেকে অন্য যে কোন বিন্দু পর্যন্ত সরলরেখা আঁকা যায়।
২. সসীম একটি রেখাকে অনির্দিষ্টভাবে বাড়ানো যায়।
৩. যে কোন বিন্দু ও যে কোন দূরত্ব নিয়ে একটি বৃত্ত আঁকা যায়।
৪. প্রত্যেক সমকোণই সমান।
৫. একটি সরলরেখা অপর দুটি সরলরেখাকে ছেদ করলে এর যে পাশে উৎপন্ন অন্তঃস্থ কোণদ্বয়ের সমষ্টি দুই সমকোণ অপেক্ষা ক্ষুদ্রতর হয়, সরলরেখা দুটিকে ঐ পাশে বর্ধিত করলে তারা সেই পাশের একটি বিন্দুতে মিলিত হয়।
প্রথম চারটি স্বতঃসিদ্ধ এদের সংজ্ঞানুসারে সঠিক আচরণ প্রদর্শন করলেও পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধটির বেলায় কিছু সমস্যা দেখা দেয়। ইউক্লিডের ১ এবং ৩ নং স্বতঃসিদ্ধ দুটি স্কেল ও কম্পাসের সাহায্যে কাঠামোনির্ভর যা মানুষের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতার ফসল। ২ নং স্বীকার্যটি মানুষের সাধারণ বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটায় এবং বলে, সরলরেখা অসীমিত দৈর্ঘ্যে বাড়ানো সম্ভব; ফলে স্থান অসীম। ৪ নং স্বীকার্যটি সরাসরি ইউক্লিডের ১০ নং সংজ্ঞা থেকে পাওয়া যায় যেখানে বলা হয়েছে, যখন একটি সরলরেখা অপর একটি সরলরেখার উপর এমনভাবে দন্ডায়মান হয় যে, সন্নিহিত কোণদ্বয় পরস্পর সমান, তখন প্রতিটি কোণকে সমকোণ বলে এবং দন্ডায়মান রেখাটিকে অপর রেখার উপর লম্ব বলে। এভাবে ৪ নং স্বীকার্যটি সমতলের সমজাতীয়তার ধারণা দেয়।, সুতরাং স্বীকার্যের সংজ্ঞানুসারে, এই চারটি স্বতঃসিদ্ধ স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পরিচয় বহন করে যেগুলো যুক্তির সাহায্যে নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কিন্তু পঞ্চম স্বীকার্যটিকে অন্য চারটি স্বীকার্যের তুলনায় একটু ভিন্নধর্মী মনে হয়। প্রথম চারটির ন্যায় এর মধ্যে কোন সরলতা নেই। ২ এবং ৫ নং স্বীকার্যকে বিবেচনা করলে দেখা যায় এদের মাঝে একটি দ্বন্দ্ব তৈরি হয় যেখানে দ্বিতীয় স্বীকার্য বলে, অনির্দিষ্টভাবে একটি রেখাকে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত করা সম্ভব; আবার পঞ্চম স্বীকার্য বলে, একটি শর্ত পূরণ করলে তারা মিলিত হতে পারে। আবার ইউক্লিডের ‘এলিমেন্টস’ গ্রন্থটির প্রথম খন্ডের ১৩ নং প্রতিজ্ঞা এবং ২৭ নং প্রতিজ্ঞার মিলিত রূপকে এভাবে বিবৃত করা যায়-
যদি দুটি সরলরেখার ভেতর দিয়ে কোন একটি সরলরেখা চলে যায় এবং ঐ রেখা দ্বারা সৃষ্ট অন্তঃস্থ কোণদ্বয়ের সমষ্টি ১৮০০ হয় তবে সরলরেখা দুটি পরস্পরের সমান্তরাল হবে।
এটাকে হুবহু ২৭ নং প্রতিজ্ঞার আকারেও লেখা যায়-
যদি একটি সরলরেখা অপর সরলরেখাদ্বয়ের উপর পতিত হয়ে সমান একান্তর কোণসমূহ উৎপন্ন করে, তবে সরলরেখাদ্বয় সমান্তরাল হবে।
বিষয়টি অনেকটা পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ সকল কারণে পঞ্চম স্বীকার্যটিকে অনেক সময় স্বীকার্য হিসেবে না দেখে বরং উপপাদ্য বা প্রতিজ্ঞা হিসেবে দেখা হয়েছে এবং স্বাভাবিক অর্থে প্রমাণ করারও চেষ্টা করা হয়েছে। প্রোক্লাস (৪১২-৪৮৫ খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন, পঞ্চম এই স্বীকার্যটিকে স্বীকার্য হিশেবে না দেখে দেখতে হবে প্রতিজ্ঞারুপে। এছাড়াও আরও বহু নামজাদা গণিতবিদ ও জ্যামিতিবিশারদ এই পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধের অনুরূপ বিবৃতি দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মতে এটিকে উপপাদ্য হিশেবেই গণ্য করতে হবে, যদিও স্বীকার্য হতেও পারে, নাও হতে পারে; তবে এটাকে অবশ্যই ইউক্লিডের অন্যান্য স্বতঃসিদ্ধ বা প্রতিজ্ঞা থেকে প্রমাণ করা যাবে। প্রোক্লাস এটাকে এভাবে বিবৃত করেছিলেন-
যদি কোন সরলরেখা দুটি সমান্তরাল সরলরেখার একটিকে ছেদ করে তবে তা অন্যটিকেও ছেদ করবে।
আরও কিছু বিবৃতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
সামান্তরিকের তিনটি কোণ যদি সমকোণ হয় তবে চতুর্থ কোণটিও সমকোণ হবে।……………………(ক)
একটি সরলরেখা যদি তৃতীয় কোন সরলরেখার সমান্তরাল হয় তবে তিনটি অর্থাৎ দ্বিতীয় সরলরেখাও ঐ দুটির সমান্তরাল হবে। ……………………………(খ)
দুটি সরলরেখা যদি একটি অপরটিকে ছেদ করে তবে তারা কখনই তৃতীয় রেখার সমান্তরাল হবে না। ……………………………(গ)
একটি রেখার বাইরে অবস্থিত বিন্দুর মধ্য দিয়ে ঐ রেখার সমান্তরাল করে একটির বেশি রেখা আঁকা সম্ভব নয়। ……………………(ঘ)
ইউক্লিডের সময়কাল থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত বহু গণিতবিদের চেষ্টা ছিল পঞ্চম স্বীকার্যটির অনুরূপ এমন একটি বিবৃতি দেয়া যাতে করে এই বিবৃতিটি স্বীকার্য হিশেবে থাকুক আর না থাকুক, উপপাদ্য হিশেবে এটাকে অন্য স্বীকার্য থেকে প্রমাণ করা সম্ভব হবে। এই আশায় তাঁরা উপরিউক্ত বিবৃতিগুলো প্রদান করেছিলেন। এখন আমরা জানি, সমান্তরাল স্বীকার্যটি ইউক্লিডের অন্য চারটি স্বীকার্য থেকে প্রমাণ করা কখনই সম্ভব নয়। এতো সব প্রতিভাবান গণিতবিদেরা এই স্বীকার্যটি নিয়ে এতো মাথা খাটালেও তাঁরা আসলে কেউই ইউক্লিডের সীমানার বাইরে এসে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেননি। সকলেই ইউক্লিডীয় গন্ডির মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। পরবর্তীতে কার্ল ফ্রেডরিক গাউস, নিকোলাই লোবাচেভস্কি ও জেনাস বোলাই পৃথকভাবে ব্যর্থতার মূল কারণ ধরতে সক্ষম হন এবং ইউক্লিডীয় গন্ডির বাইরে এসে এটিকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। যদিও সমান্তরাল স্বীকার্যটি আজও প্রমাণিত হয়নি, তবে এরই পথ ধরে তার চেয়েও বড় এক আবিষ্কার ঘটে গেছে। হ্যা, অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির জন্ম হয়েছিল এই পঞ্চম স্বীকার্যের পথ ধরেই!
প্রোক্লাস এর বিবৃতি এবং (ক) বিবৃতিটি লক্ষ্য করা যাক। আমরা যদি ইউক্লিডীয় তলের বাইরে এসে অ-ইউক্লিডীয় কোন তলে বিবৃতি দুটি প্রয়োগ করতে যাই তাহলেই সমস্যাটির গভীরতা বোঝা যাবে। আমাদের আলোচ্য বিবৃতি দুটোকে এক করে দেখলে ব্যাপারটি দাঁড়ায়-
একটি রেখার বাইরে অবস্থিত বিন্দুর মধ্য দিয়ে ঐ সরলরেখার সমান্তরাল করে কেবলমাত্র একটি রেখাই আঁকা সম্ভব এবং ঐ বিন্দু দিয়ে যায় এমন অসংখ্য সরলরেখা যেভাবেই আঁকা হোক না কেন, তা প্রথমোক্ত রেখাকে ছেদ করবেই।
(দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্ত)