মানুষ যখন অযৌক্তিক কোনো কাজ করে, বা অযৌক্তিক কাজ করে তখন আমরা ধরে নেই তারা বোকা। আসলে কি তাই? আমাদের সবার মধ্যে কিছু বোকামি প্রবণতা আছে। সেটা হতে পারে জ্ঞাত বা অজ্ঞাত, কিন্তু সেটা আছেই। বিজ্ঞানপ্রেমী আর সন্দেহবাদী হিসেবে আমাদের এইসব প্রবণতা থাকা অনুচিত, আমাদের চিন্তা হওয়া উচিত নৈর্ব্যক্তিক, প্রমাণভিত্তিক, পরিষ্কার। সেটা কীভাবে করতে হবে তা জানার আগে আগে জেনে নেই আমাদের কী কী প্রবণতা আছে। দুই পর্বে লেখাটি সাজানোর চেষ্টা করবো- শেষতক আশা করবো পাঠকদের সাহায্যই হবে, স্বচ্ছচিন্তার পথে পাঠকরা একটু এগিয়ে যাবেন।
নোঙ্গর প্রবণতা- আপনি যা আগে জেনেছেন সেটা আপনার পরবর্তী বিবেচনাকে প্রভাবিত করে।
মানুষের মানসিকতা প্রকৃতির সাথে সহযোগী। তাই আমরা যে ক্রমে তথ্য পাই সেই ক্রম আমাদের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম আর দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারিত করে। যেমন- কোনো কিছু কিনতে গেলে আমরা প্রথম যে দাম শুনি সেটা একধরনের নোঙ্গরের কাজ করে, আর সেটার উপর নির্ভর করে আমাদের দরদাম শুরু হয়। যদিও আমরা মনে করতে পারি প্রথম দাম অযৌক্তিক, যৌক্তিকের চেয়ে একটু কম দামও সেই নোঙ্গরের বিবেচনায় যৌক্তিকের মতই মনে হয়। অর্থনৈতিক কাজে এই প্রবণতার কথা মনে রাখবেন। প্রথম মূল্যের একটা প্রভাব ক্রেতার মনে থাকে, সেটা প্রমাণিত।
পিছুটান প্রবণতা-
যেগুলোতে আপনি আবেগ/সময়/টাকা ব্যয় করেছেন, সে ব্যাপারে আপনার বিবেচনাহীনতা বেশি থাকে।
ইংরেজিতে এটাকে বলে Sunk Cost Fallacy. Sunk cost হচ্ছে এমন বিনিয়োগ যা আর উদ্ধার হবার নয়। মানে যে বিষয়ে আপনি একাধিকবার সময়, আবেগ বা টাকা ব্যয় করেছেন, সে জিনিস করে যাবার প্রয়োজন বোধ করা, যদিও সে ব্যয় লাভজনক না- কিন্তু আপনি করেই যাচ্ছেন কারণ “আগেই করে ফেলেছি”। যেমন- আপনি খেতে বসেছেন- আর খাবারটি আপনার পছন্দ হচ্ছে না, এরপরও খেতে থাকা অযৌক্তিক শুধু এই কারণে যে আপনি খাবারটা কিনেছেন, কারণ এই কাজ করতে গিয়ে আপনি আপনার সময় এমন কিছুতে ব্যয় করছেন যা আপনার জন্য কোনো সুফল আনবে না। অনেক iPhone ব্যবহারকারীর ক্ষেত্রে এটা খুবই চোখে পড়ে।
সমাজচিন্তক এবং ইতিহাসবিদ নোয়াহ হারারী লিখেন- “একজন গরীব মানুষ দেবতা জুপিটারকে উৎসর্গ করে একটা ষাঁড় কোরবানি করলে সে মোটামুটি নিশ্চিতই থাকে যে দেবতা জুপিটার আসলেই আছেন, আর না হলে উৎসর্গ করার মত বোকামীকে কেউ থামালো না কেনো? গরীব লোকটি পরে হয়তো আরেকটা ষাঁড় কোরবানি দেবে, এর পরে আরেকটা, এরপর আরো একটা, যাতে তার স্বীকার করা না লাগে যে সে ষাঁড় কোরবানি দিয়ে বোকামী করেছে…এই একই ব্যাপার অর্থনীতিতেও দেখা যায়।”- Homo Deus
এ ক্ষেত্রে বাঁচার একমাত্র উপায়- নিজেকে জিজ্ঞেস করুন- আমি কি ইতোমধ্যে অনেক বেশী ব্যয় করে ফেলেছি? কোনো লাভ কী হয়েছে? এখনো কি আবার ব্যয় করবো? এমন লাভহীন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমি আমার কোনো বন্ধুকে কী উপদেশ দিতাম?
সহজলভ্য উদাহরণ-
সহজে যা আপনার ধারণায় আসে তা দিয়ে আপনার বিবেচনা প্রভাবিত হয়।
খবরে যখন আমরা যানজটে আটকে থাকি তখন আমরা মনে করি আমাদের দেশে প্রধান সমস্যার হচ্ছে যানজট। মূল কথা হচ্ছে এই অভিজ্ঞতা সহজলভ্য, নিত্যদিনের ব্যাপার। আর এই সহজলভ্যতা আপনাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে যে এটাই প্রধান সমস্যা- খবরে আসা খুন, দূর্নীতি আর অন্যান্য অপরাধ না। এই সমস্যা থেকে বাঁচতে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ও পরিসংখ্যানের তথ্যভিত্তিক বিবেচনা নেয়া উচিত।
জ্ঞানের অভিশাপ-
আপনি যখন কিছু বুঝেন, আপনি ধরে নেন এটা সবাই চাইলেই বুঝতে পারে।
যখন আমরা কিছু জানতে বা বুঝতে পারি- আমরা ভুলে যাই সে জিনিস জানা বা বুঝার আগে আমরা কেনো সেটা জানতাম না বা বুঝতাম না। আমরা জ্ঞানের জটিল একটা নেটওয়ার্ক বানিয়ে রেখেছি, আর আমরা ভুলে গেছি জ্ঞানের পথ কতটা কঠিন হতে পারে। যেমন- আমরা যখন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের তত্ত্ব বুঝতে পারি, আমরা তখন ধরেই নেই অন্যরাও পারবে। সবার জন্য সবসময় তা হয়ে ওঠে না। কাউকে শেখানোর সময় ধীরে ধীরে শেখাতে হবে, বুঝাতে হবে এমনভাবে যেন আপনি দশ বছরের কোনো বাচ্চাকে বুঝাচ্ছেন। মূল ব্যাপারগুলো বারবার করে বলে, অধ্যাবসায়ের সাথে তাদের জন্য জ্ঞানের পথ খুলে দিতে হবে।
স্বীকৃতিদায়ী প্রবণতা-
আপনার ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করা তথ্য, যতই ভুল হোক না কেনো, আপনার সেটাকেই সত্য মনে হবে।
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্যই আমাদের কাছে সত্য। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভুল প্রমাণ করা তথ্য অগ্রহণযোগ্য। যেমন- ব্রেডের গায়ে যিশুর চেহারা দেখা। মনস্তত্ত্ববিদ্যার ভাষায় যেটা পারেইডলিয়া- একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য; সেটা যখন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশ্বাসের বিপরীতে যাচ্ছে তখন আমরা (বিশ্বাসীরা) সত্যটা না ধরে বিশ্বাসকেই প্রাধান্য দিচ্ছি।
“প্রথম মূলনীতি হচ্ছে নিজেকে ধোঁকা না দেয়া- নিজেকে ধোঁকা দেয়া সবচেয়ে সহজ কাজ”- রিচার্ড ফাইনম্যান।
দ্যা ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট-
আপনি যত বেশী জানবেন তত কম আত্মবিশ্বাসী হবেন
বিশেষজ্ঞরা যেহেতু তাদের অজানার পরিধি জানেন, তাঁরা নিজেদের ক্ষেত্রের বাইরের ক্ষেত্রে নিজেদের মত দেয়ার যোগ্যতাকে ছোট করে দেখেন। কিন্তু আপনার যদি কোনো বিষয় নিয়ে সাধারণ ধারনা থাকে তখন আপনি আত্মবিশ্বাসী হবেন। যেমন- বিগ ব্যাং কেনো হয়েছিল সেটার উত্তর বিজ্ঞানীরা নিশ্চিতভাবে জানেন না, কিন্তু ধর্মীয় বক্তারা জানেন, যদিও বিজ্ঞানীরা এই ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ, ধর্মীয় বক্তারা না। সাবধানতাকে অজ্ঞতা ধরে নেয়া বোকামী। বিগ ব্যাংয়ের কারণ হিসেবে অনেক ধারণা আছে, কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার আগে সেগুলা না বলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমাদের এই সাবধানতাকে অজ্ঞতা ভাবা উচিত না, যেমন উচিত না ক্ষেত্রের বাইরের লোকের মতামত নিয়ে নিজের ধারণা গঠন করা।
“জগতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বোকা আর ধূর্তরা তাদের ধারণার ব্যাপারে নিশ্চিত আর জ্ঞানীরা সন্দেহে পরিপূর্ণ”।– বার্ট্রান্ড রাসেল
বিশ্বাস প্রবণতা-
যদি কোনো ধারণা আপনার বিশ্বাসকে সমর্থন করে তবে আপনি তার সকল ভুল মাফ করে দিবেন।
সত্যি বলতে কী- বিশ্বাস সরিয়ে নৈর্ব্যক্তিকভাবে চিন্তা করা অনেক কঠিন একটা ব্যাপার। আলোচনা বা ধারণার সারমর্ম জেনেই সেটাকে সত্য বলে ধরে নেয়া, অন্যান্য উপাত্ত না জেনে- কারণ এটা আমাদের বিশ্বাসকে সমর্থন করে। নিজেদের ধারণাকে প্রশ্ন করতে শিখুন- “কবে থেকে আমি এটা বিশ্বাস করছি, আর কেনো” এই প্রশ্ন আমাদের এই প্রবণতা থেকে বাঁচাতে পারে।
স্বার্থান্বেষী প্রবণতা-
নিজের পরাজয়ের জন্য বাহ্যিক কারণকে দায়ী করা, অথচ জয়ের পুরো দায় নিজে নেয়া।
আমরা অনেকে অনেক সময় অনেক সুবিধা নিয়ে জন্মাই।আমরা নিজেদের বুঝিয়ে রাখি যে আমরা এগুলো পাওয়ার যোগ্য বলেই পেয়েছি, আর এই সুবিধাগুলো পাওয়ার পরও ব্যর্থতার দায় আমরা নিজেরা না নিয়ে অন্যান্য কারণকে দেই। নিজের অহংবোধকে রক্ষা করার প্রবণতা আমাদের মনস্তত্ত্বে একটা শক্তিশালী বল। নম্রতা, নিরহঙ্কার আমাদ্র এই প্রবণা থেকে বাঁচাতে পারে, সাথে অন্যদের প্রতি ভালো আচরণও শেখাতে পারে।
উল্টোফল প্রবণতা-
আপনার বিশ্বাসের কোনো বিষয় যখন ভুল প্রমাণিত হয়, তখন আপনি সেই বিশ্বাসকে আরো দৃঢ়ভাবে ধরে রাখেন।
আমাদের ধরে রাখা ধারণা ভুল প্রমাণিত হওয়া আমরা ব্যক্তি আক্রমণ হিসেবে ধরে নেই। যদিও প্রমাণ আমাদের বিপরীতে যায়, আমরা নিজেদের বিশ্বাসকে আরো বেশী বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে- বিশ্বাসের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণে প্রমাণ পাওয়া গেলে আমরা সে বিশ্বাসকে ছেড়ে দেই, তার আগে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে আমরা সে ভুল প্রমাণিত বিষয়গুলোর সাথে নিজেদের বিশ্বাসের খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করি।
It ain’t what you don’t know that gets you into trouble. It’s what you know for sure that just ain’t so.” – Mark Twain
দ্যা বার্নাম ইফেক্ট-
অন্তঃসারশূন্য বক্তব্যে ব্যক্তিগত তথ্য খুঁজে পাওয়া।
আমাদের মস্তিস্ক ঘটনার মিল খুঁজতে পারদর্শী, যে কোনো ধরণের বক্তব্যতে আমরা নিজেদের ব্যাপারে মিল খুঁজে পাই। নিজেদের অহংবোধ আর মস্তিস্কের মিল খোঁজার প্রবণতা মিলে আমরা যে কোনো গল্পে নিজেদের খুঁজে পাই- অমিলগুলো যেন নিজে থেকে নিভে যায়। রাশিফলে এমনটা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু একবার ভাবুন অন্য যারা একই রাশিফল পড়ছে তারাও আপনার মতই মিল খুঁজে পাচ্ছে- যদিও তাদের জীবন আপনার জীবনের চেয়ে ভিন্ন।
পতনবাদ-
অতীত যা ছিল তার চেয়ে ভালো মনে রাখা, ভবিষ্যৎ যা হবে তার চেয়ে খারাপ হবে মনে করা।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-চিকিৎসা-জীবন মানের সেরা সময়টাতে থেকেও আমরা ভাবি আগের দিন-কাল কত ভালো ছিল। খবরে শুধু খারাপ খবর দেখা হয়তো এর পিছনে অন্যতম কারণ। আবার যুদ্ধের ভয়াবহতা চিন্তায় আমরা ভাবি ভবিষ্যৎ সবসময়ই অন্ধকার। এই ধরণের চিন্তার সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটা হচ্ছে সমষ্টিগতভাবে এই চিন্তা ভবিষ্যতকে খারাপ করে দিতে পারে। নষ্টালজিক না হয়ে পরিসংখ্যানে মানুষের আয়ু বৃদ্ধি- চিকিৎসা খাতে উন্নতি- আইনের শাসন খুঁজে সিদ্ধান্ত নিন।