আপনি কি জানেন, মানব স্বাস্থ্য সরাসরি আমাদের চারপাশের পরিবেশ, গাছ-পালা ও পশু-পাখির স্বাস্থ্যের উপর নির্ভরশীল? সাম্প্রতিক সময়ে কিছু সংক্রামক রোগের আকস্মিক উত্থান ও বিস্তারের ব্যাপকতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, বিশ্ব মানব স্বাস্থ্য রক্ষায় গৃহীত পদক্ষেপের নানান ফাঁক-ফোকর ও অসারতা। করোনা অতিমারীর তাণ্ডবলীলা স্বচক্ষে দেখার পরও বিশ্ব মানব সমাজ যদি এখনো মনে করে কেবল একক ভাবে জনস্বাস্থ্যকেই সে অটুট রাখবে – তবে সেটি হবে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতই একটি ঘটনা। কেননা মানব স্বাস্থ্য তখনই ভালো থাকবে, যখন বন্য প্রাণী, গৃহপালিত পশুপাখি, খামারের জীবজন্তু, কৃষি জমি, এবং বৃহত্তর প্রতিবেশের স্বাস্থ্যও সমানভাবে অটুট থাকবে।
জুওনেটিক রোগ কী এবং আমরা এ সম্বন্ধে কতটুকু জানি?
কিছু সংক্রামক ব্যধি আছে যেগুলো মানব দেহে বিভিন্ন পশুপাখি, জীবজন্তু বা মানুষ ব্যতীত অন্য কোনো বাহকের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। এই সমস্ত সংক্রামক ব্যধিকেই বলা হয় জুওনেটিক রোগ (Zoonotic Diseases)। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র(CDC)-এর তথ্য মতে, বৈশ্বিকভাবে নতুন যেসব রোগ দেখা যাচ্ছে বা পুরোনো যেসব রোগ নতুন করে আবির্ভূত হচ্ছে, তার ৭৫% আসছে জীবজন্তু বা পশুপাখির মাধ্যমে।
জীবজন্তুর ওপর মানুষের নির্ভরতা, প্রাণী ও পশুপাখির নিবিড় সংস্পর্শে আসার প্রবণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এসব রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির সরাসরি যোগসাজশ আছে। তাছাড়া জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) ও ইন্টারন্যাশনাল লাইভস্টক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ILRI)-এর রিপোর্ট বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশের অবক্ষয় ও বন্যজীবনের অবলুপ্তি, একটি মহামারি সংঘটিত হবার অন্যতম প্রধান একটি কারণ৷ তাই সেগুলিকে বুঝতে পারলেই এই সব এক-একটি সংক্রমণের ধারাবাহিকতা ভাঙা যাবে৷ কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা প্রতিবার এইসব কারণগুলোকে অবহেলাই করে গেছি, যা বিশ্ব মানবস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় রকমের অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি। কারণ যে কোনো একটি রোগ হঠাৎই আবির্ভূত হতে পারে এবং তাতে বহু মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে করোনা অতিমারী এর অন্যতম একটি উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের একটি গবেষণাপত্রের তথ্যমতে, মানুষ আক্রান্ত হয় এমন ১,৪৬১টি সংক্রামক রোগের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশের একাধিক বাহক রয়েছে। অর্থাৎ এরা একই সময়ে মানুষ, জীবজন্তু বা পশুপাখির শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। বিষয়টি এমন যে, কিছু রোগের জীবাণু পাখি থেকে পশুতে, পশু থেকে মানুষে বা পাখি থেকে মানুষের শরীরে বিচরণ করতে পারে এবং তাই প্রতিনিয়ত হচ্ছে।
মানব দেহে কিছু সংক্রমণের প্রাথমিক ঘটনাগুলো নিয়ে যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তবে বুঝতে পারব, মানব দেহে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণে পশুপাখি ও প্রতিবেশের স্বাস্থ্য কতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেমন ধরুন মানব দেহে এইচআইভি (HIV = Human Immunodeficiency Virus) ভাইরাসের সংক্রমণ এর দুটি স্ট্রেইন HIV-1, HIV-2 এর মাধ্যমে হয়ে থাকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেল, এই সংক্রামক ভাইরাসটি শিম্পাঞ্জি নামক প্রাণীর দেহে সংক্রমণ ঘটানো SIV (Symbian Immunodeficiency Virus) ভাইরাসের পরিবর্তিত রুপ।
এমনকি আফ্রিকায় এলাকাভিত্তিক যে তাণ্ডব ইবোলা ভাইরাস চালিয়েছে, তার বাহকও কিন্তু এই শিম্পাঞ্জী। নিপা (Nipah) ভাইরাস, হেন্ড্রা (Hendra) ভাইরাস দ্বারাও বিভিন্ন সময়ে মানব সংক্রমণের নানান ঘটনা বিভিন্ন দেশে ঘটেছে এবং সেগুলোর নানান উপাত্ত আমরা আন্তঃদেশীয় বিভিন্ন সংবাদপত্রগুলোয় দেখতে পাই। এই ভাইরাস দু’টির বাহক আবার বাদুড়। এমনকি বিভিন্ন গবেষণাপত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে করোনা অতিমারীর জন্য দ্বায়ী SARS-CoV-2 ভাইরাসটি প্রথম এই বাদুড় থেকেই মানবশরীরে সংক্রমণ ঘটিয়েছে। এছাড়াও “ওয়েস্ট নাইল”, “এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা” বা “বার্ড ফ্লু” ভাইরাস বিভিন্ন গৃহপালিত ও বন্য পাখির মাধ্যমেই মানবশরীরে বিভিন্ন সময় সংক্রমিত হয়েছে।
এখন যদি আমরা ব্যাক্টেরিয়াল সংক্রমণের দিকে তাকাই, তবে প্রথমেই ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস (Yersinia Pestis) নামক ব্যাকটেরিয়ার কথা উঠে আসবে। এই ব্যাক্টেরিয়া মানব শরীরে প্লেগ রোগ সৃষ্টি করে। যার বাহক আবার ইঁদুর, মতান্তরে মাছি। অতীতে প্লেগ একটি ভয়ানক ব্যধি হিসেবে পরিচিত ছিলো এবং পৃথিবীর বুকে এটি কয়েক বার মহামারীও ঘটিয়েছে। এক্ষেত্রে চতুর্দশ শতাব্দীতে এশিয়া, ইউরোপ, ও আফ্রিকায় ঘটে যাওয়া মহামারীর ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে সময় আনুমানিক প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ এই রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায়, যার ২৫%-৬০% লোকই ছিল ইউরোপ মহাদেশীয়। এই সময়টা ইতিহাসে “ব্ল্যাক ডেথ” হিসেবে হিসেবে পরিচিত। সে সময় বহুসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ মৃত্যুবরণ করায়, ইউরোপে শ্রমিক সঙ্কটও চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল।
এবার কলেরা মহামারীর দিকে একটু তাকানো যাক। মূলত অন্ত্রের রোগ কলেরা। এই রোগে তীব্র বমির সাথে ডায়রিয়া একসময় প্রকট আকার ধারণ করে। সাথে যুক্ত হয় পা কামড়ানো অসহ্য ব্যথা। শরীর থেকে প্রচুর পানি বের করে নিয়ে পানিশূন্যতায় অতি দ্রুত রোগীর মৃত্যু ঘটাতো কলেরা। এটি একটি ব্যাকটেরিয়াল রোগ, যা ভিব্রিও কলেরি (Vibrio cholerae) নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে হয়ে থাকে। যদিও এর প্রধান বাহক দূষিত পানি, তবে ব্যাকটেরিয়াটি মাছি, সামুদ্রিক বিভিন্ন চিংড়ি ও কাঁকড়া মাধ্যমেও মানবশরীরে সংক্রমিত হতে পারে।
কয়েক শতাব্দী পূর্বেও কলেরায় মানবজাতি দেখেছিল মৃত্যুর মিছিল। পরপর বেশ কিছু শতকে কলেরা ছড়ালেও, উনিশ শতকে এসে বিশ্ব দেখেছিল কলেরার ভয়ানক তাণ্ডব। মূলত ভারতীয় উপমহাদেশ এবং বাংলা থেকেই ছড়িয়েছিল পানিবাহিত এই রোগ। যার কারণে এর নাম ছিল ‘বেঙ্গল কলেরা প্যান্ডেমিক’। স্থানীয়ভাবে কলেরা ‘ওলা ওঠা’ বা ‘ওলা বিবি’র আগমন হিসেবে পরিচিত ছিল।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে ১৯টি নতুন ও পুরোনো রোগ নতুনভাবে দেখা দিয়েছে। ১৯৭৭ সালে এ দেশের মানুষ প্রথম ‘জাপানিজ এনসেফালাইটিস’ রোগে আক্রান্ত হয়। তার আগে এই রোগ দেশে ছিল না। এর বাহক মশা। এইচআইভি (HIV) বা এইডস (AIDS), ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, নিপাহ, জিকা—এসব সংক্রামক রোগ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশ থেকেই বাংলাদেশে এসেছে। এই ধারাবাহিকতায় এ দেশে সর্বশেষ নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে।
বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে পশুপাখি থেকে মানুষে রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে। যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা বা ইউরোপের কোনো দেশে দেখা দেওয়া নতুন রোগ কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে চলে আসতে দেখা গেছে। কখনো সময় বেশি নিয়েছে, কখনো কম। যেমন এইচআইভি বা এইডস বৈশ্বিকভাবে আফ্রিকায় শনাক্ত হয়েছিল ১৯৮০ সালে। এর নয় বছর পর, ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম এইচআইভি (HIV) রোগী শনাক্ত করা হয়েছিল। নিপাহ ভাইরাস ১৯৯৮ সালে, মালয়েশিয়ায় প্রথম শনাক্ত হয়েছিল। এর চার বছর পর তা বাংলাদেশে শনাক্ত হয়। করোনাভাইরাস চীনের উহানে প্রথম শনাক্ত হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে। এর আড়াই মাসের মধ্যে অর্থাৎ ২০২০ সালের ৮ মার্চ, এটি দ্বারা বাংলাদেশে প্রথম সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়।
এ ছাড়া অতীতের কিছু রোগ বাংলাদেশে নতুন করে দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে আছে কলেরা, ডেঙ্গু ও অ্যানথ্রাক্সের মতো রোগ। গত বছরও ডেঙ্গুতে দেশে প্রায় ১৯ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৭১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মারা গেছেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বরাবরই বলে আসছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আগামী বছরগুলোতে ডেঙ্গুর মতো রোগের প্রকোপ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
এছাড়াও চলতি বছরে, দেশে কলেরার প্রাদুর্ভাব উদ্বেগজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণত প্রতি বছরের জুন-জুলাইতে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিলেও, এই বছর মার্চ থেকেই উদরাময় বা ডায়রিয়া ভয়াবহ রুপে দেখা দিয়েছে। আইইডিসিআরবি (Institute of Epidemiology Disease Control And Research IEDCR, Bangladesh) তথ্য অনুযায়ী আক্রান্তদের ৮০ শতাংশই কলেরা, ই-কোলাই, বা রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত।
এক্ষেত্রে ২০১৯ সালে স্থানীয় সরকার এবং পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের একটি গবেষণা উল্লেখযোগ্য। যেখানে তারা যাত্রাবাড়ীর বিভিন্ন এলাকায় ওয়াসার পানির নমুনা পরীক্ষা করেছিলেন এবং সেসব নমুনায় উদ্বেগজনক হারে কলিফর্ম ও হেটারোট্রফিক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি শনাক্ত হয়।
এসব এক একটি রোগের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতিও অনেক বড় আকারে দেখা দেয়। এক্ষেত্রে আইইডিসিআরের ২০১১ সালের একটি রিপোর্ট উল্লেখ করা যেতে পারে। সেই রিপোর্টের তথ্য বলছে, ২০০৭ সালে এ দেশে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লু দেখা দেওয়ার পর সেটি দেশের ৫২টি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় প্রায় ২৪ লাখ মুরগি মেরে ফেলা হয়েছিল। ২০০৭-০৮ সালে প্রত্যক্ষ আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিলো ২৫৮ কোটি টাকা। বার্ড ফ্লুর কারণে সার্বিকভাবে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আবার ২০১০ সালে দেশের ১৫টি জেলায় গরু–ছাগল অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়। এই বছর ১২টি জেলায় ৬০৭ জন মানুষ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়েছিল। অ্যানথ্রাক্সের প্রকোপ মাংস ও চামড়ার বাজারেও বিরুপ প্রভাব ফেলেছিল।
“One Health” বা একক স্বাস্থ্যের ধারণা বলতে আমরা কী বুঝি?
কুকুর জলাতঙ্ক রোগ বা রেবিস ছড়ায়। মানুষকে জলাতঙ্ক রোগ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদে রাখা যাবে না, যদি কুকুরকে টিকা দিয়ে রোগমুক্ত করা না যায়। একইভাবে গরু-ছাগল থেকে অ্যানথ্রাক্স মানুষে ছড়ায়। গবাদিপশুকে অ্যানথ্রাক্সমুক্ত করতে না পারলে মানুষে এই রোগের সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাবে। এমনকি সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে এমন ১৫% ছাগলের মাংসে ও ২% গরুর মাংসে উচ্চ মাত্রায় যক্ষ্মার জীবাণু রয়েছে। সুতরাং গরু-ছাগলকে যক্ষ্মা চিকিৎসার আওতায় না আনতে পারলে, মানুষেরও যক্ষ্মায় আক্রান্ত হবার বড় ধরণের একটি শঙ্কা থেকেই যায়।
মানুষের আমিষ চাহিদা মেটানোর সব থেকে সহজ ও তুলনামূলক সস্তা উপায় হচ্ছে ব্রয়লার মুরগীর মাংস। কিন্তু সাম্প্রতিক সাময়ে ব্রয়লার মুরগীর উপর পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণা বলছে, ব্রয়লার মুরগী দিন দিন খাওয়ার অযোগ্য হয়ে উঠছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ আবুল হোসেনের একটি গবেষণা বলছে, মুরগির খাদ্য হিসেবে ট্যানারির চামড়ার উচ্ছিষ্ট ব্যবহারের কথা, যাতে রয়েছে ক্রোমিয়াম ও ক্যাডমিয়াম নামক বিষাক্ত পদার্থ। আমাদের দেশে মুরগিকে এসব খাওয়ানোর ফলে ২৫০ গ্রাম ব্রয়লার মাংসে প্রায় ৮৭ মাইক্রোগ্রাম ক্রোমিয়াম পাওয়া যায়, যেখানে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) বলছে মাত্র ৩৫ মাইক্রোগ্রাম ক্রোমিয়ামই শরীরের পক্ষে সহনশীল। যদিও ক্রোমিয়াম ২৯০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ধ্বংস করা সম্ভব। কিন্তু রান্নায় আমরা বড়জোর ১০০ থেকে ১৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা ব্যবহার করে থাকি। এমন অবস্থায় মুরগীর ভেতরে থাকা ক্রোমিয়াম রান্নার মাধ্যমেও নষ্ট করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এসব আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে, যা মানব শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করে।
আবার, মুরগীর ওজন বৃদ্ধি ও সুস্থতার জন্য চলে বিভিন্ন ঔষধ, স্টেরয়েড ও ভিটামিনের প্রয়োগ। স্টেরয়েড দিয়ে ব্রয়লার মুরগীর কিডনিকে নষ্ট করে দেওয়া হয়, যাতে গায়ে জমতে থাকা পানি এর ওজন বাড়িয়ে দেয়। মুরগির মাংসে আজকাল মাত্রাতিরিক্ত চর্বি বা কোলেস্টেরল থাকে যা দেহের চর্বিজাতীয় উপাদান ২২৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে।
অন্যদিকে প্রতিনিয়ত ব্রয়লার মুরগির উপর এন্টিবায়োটিকের প্রয়োগ, পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, তাদের সংগৃহীত মুরগির নমুনায় মাল্টিড্রাগ রেজিস্টেন্ট Salmonella ব্যাকটেরিয়া, E. coli, এবং S. aureus পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত রেজিস্টেন্সের পরিসীমা ৯৩-১০০ শতাংশ। এই ব্রয়লার মুরগীর মাংস প্রতিনিয়ত গ্রহণের ফলে মানবস্বাস্থ্যে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সের ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে করে ভবিষ্যতে মানুষের দেহে ব্যাকটেরিয়াঘটিত বড় কোনো রোগের ওষুধও অকার্যকর হয়ে যাবে।
এরকম আরও উদাহরণ আছে। তাই পৃথকভাবে না ভেবে মানুষ, পশুপাখি ও আমাদের চারপাশের প্রতিবেশের স্বাস্থ্যকে সমান গুরুত্ব দেয়া উচিত। এটাই One Health বা একক স্বাস্থ্যের ধারণা; যা মানুষ কে সুস্থ্যভাবে বাঁচার পাশাপাশি তার চারপাশের প্রাণী ও পরিবেশের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে সমান তাগিদ দিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (CDC) বলছে, একক স্বাস্থ্য হচ্ছে বহুপক্ষীয় ও বহুখাতভিত্তিক সহযোগিতামূলক (collaborative, multisectoral, and transdisciplinary) কর্মোদ্যোগ। এটি কার্যকর হবে স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে। মানুষ, জীবজন্তু ও উদ্ভিদের মধ্যকার সম্পর্ক এবং তাদের বসবাসের পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সবার স্বাস্থ্য ঠিক রাখাই একক স্বাস্থ্যের উদ্দেশ্য।
বিশ্বে প্রতি বছর ৩ নভেম্বরের দিনটিকে “One Health Day” হিসেবে উদযাপন করা হয়। করোনা অতিমারির তাণ্ডবলীলা স্বচক্ষে দেখার পর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এই একক স্বাস্থ্য নীতির ধারণাটিকে পুরো বিশ্বে জনপ্রিয় করতে ব্যপক প্রচারণা চালাচ্ছে।
ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য One Health বা একক স্বাস্থ্য নীতির ধারণা কতটা গুরুত্ব বহন করে?
বৈশ্বিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন বসতি গড়ে উঠছে। নতুন বসতির জন্য জমি দরকার হচ্ছে। এ কারণে বন উজাড় হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবং কৃষি ও শিল্পের প্রসারের কারণেও বন কমে আসছে। এসব কারণে জীবজন্তুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ বাড়ছে। পশুপাখি মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খাদ্য, চামড়া ও লোম, ভ্রমণ, খেলাধুলা, শিক্ষা, এবং সঙ্গ লাভে পশুপাখির দরকার হয়। পশুপাখি ও তাদের পরিবেশের নিবিড় সংস্পর্শে গেলে তাদের রোগ মানুষে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। আবার পরিবেশ ও আবাসন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে পশুপাখির মধ্যে নতুন রোগ দেখা দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ ও ব্যবসার কারণে মানুষ, জীবজন্তু এবং পশুজ পণ্যের বৈশ্বিক চলাচল বেড়েছে। সেই কারণে যেকোনো সংক্রামক রোগের দ্রুত দেশের সীমান্ত অতিক্রম করার এবং বৈশ্বিকভাবে তা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও বেড়েছে।
আবার এন্টিবায়োটিক ওষুধের সহজলভ্যতা ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের জন্য বর্তমান সময়ে অনেক ব্যাকটেরিয়া আশংকাজনক ভাবে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে উঠেছে। নিকট অতীতে বন্য ও গৃহপালিত পশুপাখি থেকে আসা জীবাণু বা রোগ বিশ্বে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল। সেই তালিকায় আছে: অ্যানথ্রাক্স, জলাতঙ্ক, কিউ ফিবার, চ্যাগাস ফিবার, টাইপ এ ইনফ্লুয়েঞ্জা, রিফট ভ্যালি ফিবার, সার্স, মার্স, ইবোলা এবং এইচআইভি। এই তালিকায় সর্বশেষে যুক্ত হয়েছে করোনা ভাইরাস।
সুতরাং, আমরা যদি বিশ্ব মানব স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় সত্যিই উদ্বিগ্ন হই, তবে বিচ্ছিন্নভাবে কেবল মানুষের দিকে না তাকিয়ে আমাদের চারপাশে বসবাস করা প্রতিটি পশুপাখি ও প্রতিবেশের স্বাস্থ্যের উপর সূক্ষ্ম নজর রাখতে হবে। কারণ মানুষ কেবল তার চারপাশে পরিবেশের একটি অংশ মাত্র। তাই পুরো অংশের সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য রক্ষায় গৃহীত সমন্বিত পদক্ষেপই নিশ্চিত করবে মানুষের টেকসই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও সুখী ভবিষ্যৎ।
তথ্য সূত্রঃ
https://www.healthline.com/health/zoonosis
https://www.cdc.gov/onehealth/basics/index.html
https://www.who.int/news-room/questions-and-answers/item/one-health
https://iedcr.gov.bd/nbph/issue-sections/34b64b19-92f8-459d-a838-d6c420eba511
http://www.onehealthnetwork.asia/sites/bangladeshonehealthhub
https://iedcr.gov.bd/nbph/issue-sections/19a3a15a-b231-48cc-9d8f-dc20d577365b