আধুনিক মানবসভ্যতার সামনে বড় বড় প্রশ্ন তো অনেক আছে। কিন্তু সমাধান করা সবচেয়ে কঠিন এমন প্রশ্ন আসলে কোনটা? কী সেই বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় অজানা রহস্য? “সময় আসলে কী? মহাকর্ষ কীভাবে কাজ করে? ম্যাটার-অ্যান্টি ম্যাটারের অনুপাতের এমন শোচনীয় রকমের দশা কেন? এলিয়েনরা কি আসলেই আছে? ‘গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিওরি’ কি বের করা সম্ভব? নারীদের মন কি আসলেই বুঝা সম্ভব?”
না! মানব সভ্যতার সামনে ভুরি-ভুরি রহস্য থাকলেও এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় এবং দুর্ভেদ্য রকমের কঠিন প্রশ্নটা হচ্ছে- ভাষারা কোথা থেকে এলো? এই এক অতি নিরীহ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়েই বিজ্ঞানীদের মাথার ঘাম পায়ে, আর পায়ের রক্ত মাথায় চলে গেছে। এই প্রশ্নে এমনই ইট-পাটকেল মারামারি, আর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়েছিলো বিজ্ঞানী সমাজে যে আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভাষা গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই ভাষার আদি উৎস নিয়ে গবেষণা করা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো! পরে উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আবার এই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামানো শুরু হয়। হ্যাঁ, আমরা মোটামুটি আন্দাজ করতে পারলেও এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে প্রমাণ করতে পারিনি দুনিয়ার তাবৎ ভাষার উৎস কোন সেই ভাষা এবং কারা সেই ভাষায় কথা বলতো?
আমরা জানি- ফরাসীরা ফ্রান্সে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলে, স্পেনীয়রা স্পেনে বলে স্প্যানিশ ভাষায়, বাঙ্গালীরা বাঙ্গাল মুল্লুকে বলে বাংলা ভাষায়, টাকলারা ফেসবুকে বলে টাকলা ভাষায়। কিন্তু এত সব ভাষার উৎস কী? প্রথম প্রথম মনে হয় উত্তরটা জলের মতো পরিষ্কার। বাংলা ভাষা এসেছে প্রাকৃত হতে। সংস্কৃতও তাই। স্প্যানিশ এসেছে লাতিন হতে, রোমান সাম্রাজ্যের আধিপত্যের মাধ্যমে। প্রাচীন লাতিন ভাষার মাধ্যমে উদ্ভূত হয়েছে রোমীয় ভাষাভাষীর পরিবারের, যেটার সদস্যরা হলো- রুমানিয়ান, ইতালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, কাতালান, স্প্যানিশ, সারডিনিয়ান এবং পর্তুগীজ।
কিন্তু লাতিন, সংস্কৃত, সুমেরীয়, আক্কাদীয়- এসব প্রাচীন ভাষার যত লিখিত প্রমাণই থাক না কেন, সেসব ভাষারও যেসব দাদা-নানারা ছিলো, তাদের লিখিত কোনো প্রমাণ কিন্তু নেই। স্বাভাবিক নিয়মে যেটা হয়, কোনো লিখিত দলিল ও বর্ণমালা ছাড়াই ভাষা মুখে মুখে যাত্রা শুরু করে। পরে সেটার বিভিন্ন সংস্করণ ছড়িয়ে পড়ে আরো অনেক মুখে। আরো ভাষার উদ্ভব হয়। তখন সেই আদি মৌখিক ভাষাটা, যার কোনো লিখিত প্রমাণ নেই, হয়ে যায় বাকী সব ভাষাদের পূর্বসূরি। কীভাবে বললাম? বিভিন্ন ভাষার শব্দের ‘মূল’-এর উপরে নির্ভর করে।
সেটা কেমন? প্রত্যেকটা শব্দের অবশ্যই একটা মূল অংশ থাকে, যেটাকে বলা হয় মূল-ধাতু। ডাক শুনে যেমন বেড়াল আর বাঘ চেনা যায়, তেমনি বিভিন্ন শব্দের মূল-ধাতু নিয়ে চিন্তা করলেও তার দাদা কিংবা নানা কে ছিলো সেটা ধরে ফেলা যায়। শব্দটা পাল্টাতে পাল্টাতে পুরো স্যুট-টাই পরে আধুনিক হয়ে গেলেও ঐ মূলটা কিন্তু প্রায় একই থাকে। যেমন- ধরা যায় ইংরেজি ‘মাউস’ শব্দটাকে। এই শব্দের ইংরেজীতে মূল-ধাতু হলো muus, লাতিন এবং গ্রীকেও muus, রাশিয়ানে mish, সংস্কৃতে ‘মুস (মূষিক = ইঁদুর)’। আবার ধরি ইংরেজি ‘নোজ’ শব্দটাকে। এর লাতিন সংস্করণের মূল-ধাতু হলো naas, রাশিয়ানে nos, ইংরেজিতেও naas, সংস্কৃতেও ‘নাস (নাসারন্ধ্র = নাক)’। তার মানে একটু আগে যে লাতিন আর সংস্কৃতকে দাদা, নানা মেনে বসে ছিলাম- এখন দেখা যাচ্ছে তাদেরও আরেকটা কমন পূর্বসূরি আছে।
কী সেটা? সেটা হলো- ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা। লাতিন, সংস্কৃত এমনিতেই প্রাচীন ভাষা যেগুলোর বয়সের কোনো গাছ-পাথর খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন এলো তাদেরও বড় আব্বা ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা, যেটার গাছ-পাথর পরে, মাটির নীচে ফসিল খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। লে হালুয়া! এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষীর পরিবারের সদস্য সংখ্যা মোটামুটি এক ডজনের মতো। এরা হলো- ইন্ডিক, রোমীয়, জার্মানিয়, স্লাভিক, বাল্টিক, কেল্টিক, ইরানীয়, তোখারীয়, আনাতোলীয়, আর্মেনীয়, গ্রীক এবং আলবেনীয়।
এটাকেই যদি আদি ভাষা বলা যেতো তাহলে দেয়ালে বিজ্ঞানীদের মাথা ঠোকা বহু আগেই বন্ধ হয়ে যেতো। কিন্তু ব্যাপার হলো, এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা আরো বড় একটা পরিবারের সদস্য মাত্র! কী সেই পরিবার? সেই পরিবারের কত্তা-মশাইয়ের নাম কী? তার নাম হলো ‘ইউরেশীয়’ ভাষা। এই ইউরেশীয় ভাষাভাষী পরিবারে জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে ‘ইন্দো ইউরোপীয়’ ভাষা তো আছেই (বর্তমান দুনিয়ার অর্ধেক ভাষা সরাসরি এই ইন্দো ইউরোপীয় ভাষার নাতি-পুতি), সেই সাথে আছে- ইউরালিক ভাষা (ফিনিশীয়, হাঙ্গেরীয়, সামোয়াদ); অলটাইক ভাষা (তুর্কী, মঙ্গোলীয়, কোরীয়, জাপানী); চুকচি-কামচাটকা ভাষা (বেরিং হতে আলাস্কা পর্যন্ত বিস্তৃত) এবং এস্কিমো-অ্যালিউট ভাষা (উত্তর আমেরিকা, আলাস্কা এবং গ্রিনল্যান্ড)।
এই ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারের ভাষাগুলোর একটা দুর্দান্ত বৈশিষ্ট্য কিংবা মিল হচ্ছে- এসব ভাষায় প্রথম পুরুষ সম্বোধনে ‘ম’ নির্ভর শব্দ এবং দ্বিতীয় পুরুষ সম্বোধনে অনেকটা ‘ত’ নির্ভর শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন- ইংরেজীতে me এবং thee, স্প্যানিশে me এবং te, রাশিয়ানে menya এবং tebya, বাংলায় আমি এবং তুমি ইত্যাদি ইত্যাদি। যেসব ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারের নয়, বরং ইউরেশীয় বংশেরই ভিন্ন কোনো পরিবারের, সেসব ভাষায় এই ব্যাপারটা আলাদা। যেমন- ইউরেশীয় পরিবারের আরেক সদস্য অ্যামারিন্ড ভাষায় (যেটার নাতিপুতিরা হচ্ছে নেটিভ আমেরিকান ভাষারা) প্রথম পুরুষে ‘ন’ নির্ভর এবং দ্বিতীয় পুরুষে ‘ম’ নির্ভর শব্দ ব্যবহৃত হয়।
এই ইউরেশীয় ভাষার সম-সাময়িক আরো এক ডজন ভাষা আছে। এরা সবাই সেসময় মাঠে একসাথে ফুটবল খেলতো, দোকানে গিয়ে চা-সিগারেট খেতো। তারা এখন আর নেই। আছে তাদের সব নাতিপুতিরা। তাই ইউরেশীয় ভাষার সেই সব হাফ-প্যান্ট কালের বন্ধুদের কথা আর নাই বা বললাম।
তাহলে বুঝাই যাচ্ছে, এভাবে যেতে যেতে আমরা শুধুমাত্র একটা ভাষায় গিয়ে উপনীত হবো, যেটা হচ্ছে পৃথিবীর এ যাবত কালের সকল ভাষার জননী। কিন্তু কী সেই ভাষা- সেটা কেউ জানে না। ভাষাবিদেরা এই পর্যায়ে এসে গাল চুলকাতে চুলকাতে তাকালেন জীববিজ্ঞানীদের দিকে। ভাষা বিজ্ঞানীদের মুরোদ এখানেই শেষ! তখন জীব বিজ্ঞানীরা নাকের চশমা টেনে নিয়ে মঞ্চে নামলেন। আর দেখলেন- আরে! আধুনিক মানুষ তো এসেছে এখন হতে কম করে হলেও ১,০০,০০০ বছর আগে। কিংবা হয়তো তারও বেশী সময় পূর্বে। তারা যে ভাষায় কথা বলতো সেটাকে নাম দেয়া হলো ‘প্রোটো হিউম্যান ল্যাঙ্গুয়েজ’। এই ভাষার কিছু উদাহরণ হলো- কু (Ku) = কে, মা (Maa) = কী, টিক (Tik) = এক, পাল (Pal) = দুই, আকোয়া (Akwa) = পানি, বোকো (Boko) = বাহু, বুংকু (Bunku) = হাঁটু, সাম (Sum) = চুল ইত্যাদি ইত্যাদি।
জীববিজ্ঞানীদের সহায়তায় সমস্ত ফসিল প্রমাণ হতে জানা গেলো এসব মানুষেরা বসতি গেড়েছিলো আফ্রিকায়। তার মানে ধরে নেয়া যায় আফ্রিকা হতেই সকল ভাষার উৎপত্তি। কিন্তু এরা এতটা বদলে গেলো কীভাবে? কীভাবে একটা শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অনেক সংস্করণ তৈরি হয়? ভাষা বিজ্ঞানীরা অনেক দাঁতভাঙ্গা শব্দ আবিষ্কার করেছেন এই ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। আমরা শুধু প্রধান দুইটার ব্যাপারে জেনে নিই। প্রথমটা হলো ‘অনোম্যাটোপিয়া’ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে এমন কিছু শব্দ তৈরি করে ফেলে মানুষ যেটা বাস্তবেই শুনতে, স্বাদ চেখে দেখতে, কিংবা শুঁকে দেখতে ঐ শব্দটার মতো মনে হয়। যেমন- টিকটিকি। এটা সারাদিন টিক টিক করে বলে মানুষ এটার নাম দিয়েছে টিকটিকি। ব্যাং- সারাদিন করে ঘ্যাং ঘ্যাং। কাক- করে শুধু কা কা।
আরেকটা হলো ‘ট্যাবু’ পদ্ধতি। মানুষ অতি সহজেই তুচ্ছ সব কারণে বিব্রত বোধ করে। একটা সাধারণ শব্দ উচ্চারণেও, যদি সেটা দিয়ে অশ্লীল কিছু বুঝায়। তখন সেই সোজা শব্দটা ব্যবহার না করে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে আরো উদ্ভট সব শব্দ তৈরি করে ফেলে মূল শব্দটাকে বুঝাতে। খেয়াল করলে দেখবেন, সমাজে যে শব্দ যত বেশী অশ্লীল সেই শব্দের তত বেশী সংস্করণ খুঁজে পাওয়া যায়।
বর্তমানকালে অবশ্য ইন্টারনেট এবং টাকলাদের কল্যাণে ভাষা ও শব্দের পুরো ভোল পালটে যাবার দশা হয়েছে। সুতরাং স্ট্রোক করে মারা যাবেন না, যদি দেখেন আজ হতে ৫০০ বছর পরে বাংলা একাডেমীর অভিধানে এমন সব শব্দ যুক্ত হয়েছে যেগুলোর কারণে বর্তমানে ট্রল পেইজে টাকলাদের নিয়ে হাসাহাসি করা হয়। আজকে যেটা গালি, আগামী দিনে সেটা বুলিও হয়ে যেতে পারে। ভাষা এমনই এক রহস্যময় জিনিস!
তথ্যসূত্রঃ
১। https://en.wikipedia.org/wiki/Origin_of_language
২। https://en.wikipedia.org/wiki/Proto-Human_language
৩। https://www.exploratorium.edu/exploring/language/
৪। https://en.wikipedia.org/wiki/Onomatopoeia
৫। http://www.salon.com/2012/10/20/where_does_language_come_from/