NASA ২০১৪ সালের শেষদিকে নতুন একটি মহাকাশযান উৎক্ষেপণ ও ‘টেস্ট ফ্লাইট’ এর ঘোষণা দেয়। এর নাম দেয়া হয় ORION. নাসা’র দাবি অনুযায়ী এই মহাকাশযানটি বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে ও হচ্ছে মানুষকে পৃথিবীর চারদিকে কক্ষপথের (Orbit) বাইরে এমন স্থানে পাঠাবার জন্য যেখানে এখনো মানুষ পৌঁছুতে পারেনি। সেটি গ্রহাণু হতে পারে, এমনকি ‘মঙ্গল গ্রহ’ও হতে পারে।
পৃথিবীর দূরতম কক্ষপথ থেকে অভিকর্ষ পেরিয়ে বেরুতে পারলে সেই মহাকাশযান পৌঁছে যেতো সক্ষম মহাশূন্যের দূরবর্তী অঞ্চলে। এর আগে মঙ্গলে Flyby, Lander, Orbiter, Rover ইত্যাদি মহাকাশযান পাঠানো হয়েছে যেগুলো নানাবিধ আধুনিক যন্ত্রসজ্জিত হলেও কোনো মানুষ ছিল না। নাসার এই ওরায়ন মহাকাশযান মানুষকে মঙ্গলে নিয়ে যাবার মহাপরিকল্পনার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে ধরা হয়েছে। ২০১৪ সালের শেষ দিকে এর প্রথম সফল উৎক্ষেপণ ও টেস্ট ফ্লাইট সমাপ্ত হয়েছে। যদিও টেস্ট ফ্লাইটটিতে মানুষ পাঠানো হয়নি, তবুও নভোচারী থাকা অবস্থার সবকিছুই বিবেচিত হয়েছে এই ফ্লাইটে। এরপর এ বছর ওরায়ন এর আরো উন্নতিসাধন করা হয়েছে ও হচ্ছে।
Orion মহাকাশযানের বিভিন্ন অংশ এবং এর প্রথম টেস্ট ফ্লাইটের বর্ণনা
Crew Module
এটি মহাকাশযানের মূল অংশ, যেখানে থাকবেন নভোচারীগণ। এখানে একসাথে চারজন নভোচারী অবস্থান করে যেতে পারবে মহাকাশে।
ক্রু মডিউলের আরো বর্ণনা আসবে ক্রমান্বয়ে।
Delta IV Heavy Rocket
যে কোনো মহাকাশযানকে পৃথিবীর কক্ষপথে নিয়ে যেতে প্রয়োজন রকেট। Orion এর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী Delta IV Heavy Rocket. এটি প্রায় ৬০ হাজার পাউন্ড ভরের একটি যানকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ কক্ষপথে নিয়ে যেতে সক্ষম; যা চারটি পূর্ণবয়স্ক হাতি বা ১৩ টি পিকআপ ট্রাকের ভরের সমান।
এই রকেটের সাহায্যেই ওরায়ন কে নিয়ে যাওয়া হবে পৃথিবীর অরবিটে।
Launch Abort System (LAS)
এটি মূলত জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রকেট উৎক্ষেপনের সময়ে যে কোনো দুর্ঘটনা, যান্ত্রিক ত্রুটি, বা অন্য কোন জরুরি অবস্থা থেকে নভোচারীদের জীবন রক্ষার জন্য এই ব্যবস্থা। এখানে ক্রু মডিউলের উপরের অংশের সাথে লাগানো আছে আরো তিনটি জেট ইঞ্জিন যা জরুরি অবস্থায় রকেটকে আলাদা করে দিয়ে শুধু ক্রু-মডিউলকে মাত্র ২ সেকেন্ডের মধ্যে ঘণ্টায় ৫০০ মাইল গতিতে শূন্যে ছুঁড়ে দেবে ও সেটি প্যারাসুটের সাহায্যে নিরাপদে নেমে আসবে। অর্থাৎ, এর ত্বরণ হবে সাধারণ রোলার কোস্টারের প্রায় ছয় গুণ।
প্রথম টেস্ট ফ্লাইটে এটার ব্যবহারের দরকার হয়নি। রকেট স্বাভাবিকভাবেই Orion কে পৃথিবীর নিকটতম অরবিটে নিয়ে যায়। পৃথিবী থেকে ১০০ মাইল উচ্চতায় সর্বনিম্ন অরবিটে নিয়ে গিয়ে রকেটটি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। সেখানে Orion এর মূল অংশ থেকে রকেটটি আলাদা হয়ে যায় আর প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১৭ হাজার মাইল বেগে অরবিটে পরিভ্রমণ শুরু করে Orion. যে LAS অংশটি দুর্ঘটনা না হওয়ার উড্ডয়নের সময় কাজে লাগেনি, এখানে সেটি কাজে লাগে। এটি রকেট খুলে ফেলার সময় অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘর্ষ এড়িয়ে রকেটের চেয়ে দ্রুতগতিতে Upper stage কে দূরে নিয়ে যায়।
এই গতিতে নিকটতম অরবিটে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে থাকে এবং গতিশক্তি সঞ্চয় করে মহাকাশযান। এই সময় নাসা থেকে প্রাপ্ত সকল তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করে ওরায়নে থাকা কম্পিউটার যা প্রতি সেকেন্ডে ৪৮০ মিলিয়ন অর্থাৎ ৪৮ কোটি নির্দেশনা নিতে সক্ষম।
এভাবে একবার প্রদক্ষিণ করার পর সক্রিয় হয় মহাকাশযানের Upper Stage.
Upper stage এ থাকা জেট অরায়নকে ধাক্কা দেয় যেটি তাঁর নিজস্ব গতিশক্তির সাথে একীভূত হয়ে ওরায়নকে নিয়ে যায় পৃথিবী থেকে ৩৬০০ মাইল দূরে পৃথিবীর সর্বোচ্চ উপবৃত্তাকার অরবিটে। যা পৃথিবী থেকে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন এর চেয়ে ১৫ গুণ দূরে।
পর্যায়ক্রমে ওরায়ন Van Allen Belt অতিক্রম করে পৌঁছে যায় মহাশূন্যের ভয়ংকর রাজ্যে, যেখানে রয়েছে ক্ষতিকর মহাজাগতিক রশ্মি। এই রশ্মি যেমন নভোচারীদের জন্য ক্ষতিকর তেমনি এটি ওরায়নের গাইডিং সিস্টেম, অরায়নের কম্পিউটার সিস্টেম, ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি নষ্ট করে দিতে সক্ষম। কিন্তু ওরায়ন এর জন্যও প্রস্তুত।
Crew Module
ওরায়নের চারপাশ জুড়ে রয়েছে মহাজাগতিক রশ্মি থেকে বাঁচার জন্য আবরণের ব্যবস্থা। এটি রক্ষা করে ভেতরে থাকা নভোচারী ও যন্ত্রপাতিকে। এছাড়া ওরায়নের পৃষ্ঠে সংযুক্ত সেন্সরগুলো সকল মহাজাগতিক রশ্মি সনাক্ত, নির্ণয়, ও বিশ্লেষণ করে, পরবর্তী গবেষণার জন্য।
Environmental Control and Life Support System (ECLSS)
ক্রু মডিউলে নভোচারীদের বেঁচে থাকার উপযুক্ত পরিবেশের জন্য এই সিস্টেম প্রস্তুত করা হয়েছে। ECLSS এর মাধ্যমে নিঃশ্বাস নেয়ার উপযোগী বাতাস ও পানের উপযুক্ত পানি সরবরাহ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করে নভোচারীদের বাঁচিয়ে রাখা যাবে ২১ দিন, যাতে তাঁরা দূরবর্তী কোনো স্থানে যাবার মত পর্যাপ্ত সময় পায়।
Service module
এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে Crew Module এর সাথে সংযুক্ত Service module. সার্ভিস মডিউল সৌরশক্তি ও ব্যাটারি ব্যবহার করে ক্রু-মডিউলের সকল কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে থাকে।
ওরায়নের প্রথম টেস্ট ফ্লাইটে শুধু এই মহাজাগতিক রশ্মির ডাটা সংগ্রহ করা হয়েছে। এবার পৃথিবীতে ফিরে আসার পালা।
ফিরে আসার সময় শুধু ক্রু মডিউলটি ফিরে আসবে। কক্ষপথে থাকা অবস্থায় ক্রু মডিউলের সাথে থাকা সার্ভিস মডিউল এবং Upper Stage আলাদা হয়ে যাবে। ক্রু মডিউলের সাথে থাকা তিনটি ছোট জেট একে নির্ধারিত ওরিয়েন্টেশনে অভিকর্ষ বলয়ে বায়ু মণ্ডলে নিয়ে আসবে।
এটি পৃথিবীর আকর্ষণে তীব্র গতিতে নেমে আসতে থাকবে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৭৫ মাইল দূরে, প্রতি ঘণ্টায় ২০ হাজার মাইলেরও বেশি গতিবেগে ওরায়ন বায়ু মণ্ডলে প্রবেশ করে। এই উচ্চগতিতে বায়ুমণ্ডলের সংঘর্ষে সেখানে মহাকাশযান ঘিরে সৃষ্টি হয়ে অতি উচ্চ তাপমাত্রার ‘প্লাজমা’। এর তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে পেতে 4000° F-এ গিয়ে পৌঁছে যা গলিত লাভার প্রায় দ্বিগুণ তাপমাত্রা। এ অবস্থায় নাসার সাথে মহাকাশযানের সমস্ত যোগাযোগ হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায় প্রত্যাশিত ভাবেই। কারণ প্লাজমা’র স্তর ভেদ করে কোন ডেটা (তথ্য) চলাচল করতে পারে না।
Heat Shield
এই উচ্চতাপমাত্রায় ওরায়নকে টিকিয়ে রাখার জন্য রয়েছে Heat shield. এটি ওরায়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ও অংশ। ওরায়নের নিচের অংশে যেখানে সরাসরি বায়ুর সংঘর্ষ ঘটবে, সেখানে এই বিশেষ তাপসহ ও তাপরোধী আবরণ (shield) থাকবে যা এই অতি উচ্চ তাপ থেকে মহাকাশযানের যন্ত্রপাতি ও নভোচারীদের রক্ষা করবে।
এখন পর্যন্ত এধরনের সর্ববৃহৎ শিল্ডটি অরায়নের জন্য বানানো, এর ব্যাস ১৬.৫ ফুট। ইনজিনিয়ারগণ ওরায়নের হিট শিল্ড তৈরির জন্য সম্পূর্ণ নতুন ধরনের তাপীয় বৈশিষ্ট্যের পদার্থ তৈরি করেছেন যা 6000° F পর্যন্ত তাপ সহ্য ও প্রতিরোধ করতে সক্ষম। ওরায়নের মূল মহাকাশযানের ভরের শতকরা ৫ ভাগ ভর দখল করে নিয়েছে এই হিট শিল্ড। শুধুমাত্র হিট শিল্ডেরই ভর ১০০০ পাউন্ড!
ঘণ্টায় ২০ হাজার মাইল গতিতে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে বায়ুর ঘর্ষণে ভূপৃষ্ঠ থেকে ২৫ হাজার ফুট উচ্চতায় গতি কমে দাঁড়ায় ঘণ্টায় ৩০০ মাইল। নিরাপদ অবতরণের জন্য এই গতিও অনেক বেশি। তাই, গতি কমানোর জন্য প্যারাসুট ব্যবহার করা হয়।
Parachute
এর কার্যকারিতা সাধারণ প্যারাসুটের মতই। তবে, এখানে কোনো মানুষকে নয়, অবতরণ করাতে হবে পুরো একটা মহাকাশযানকে।
চারটি ধাপে মোট এগারোটি প্যারাসুট ওরায়নের গতি কমিয়ে আনে। বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের পর তাপমাত্রা কমে প্যারাসুটের জন্য সহনীয় পর্যায়ে এলে ‘পাইরোটেকনিক’ প্রক্রিয়ায় সবগুলো প্যারাসুটকে ঢেকে রাখা একটি কভার খুলে ফেলা হয় তিনটি প্যারাসুটের সাহায্যে। এতে গতি কিছুটা কমে যায়।
ওরায়নের গতি যখন ঘণ্টায় ৩০০ মাইলে নেমে আসে, তখন আরো দুটো প্যারাসুট খোলে। এগুলো আগেরগুলোর চেয়ে বড়। এগুলো মহাকাশযানের গতি কমিয়ে ঘণ্টায় ১৭৫ মাইল এ নামিয়ে আনে। ক্রমান্বয়ে যখন ওরায়নের গতি ঘণ্টায় ১০০ মাইল হয়, তখন এই দুটি প্যারাসুট বিচ্ছিন্ন হয়, তিনটি ছোট প্যারাসুট মূল প্যারাসুট ঢেকে রাখা কভার খুলে দেয়। এতে তিনটি মূল ও সর্ববৃহৎ প্যারাসুট উন্মুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই তিনটি মূল প্যারাসুট সম্পূর্ণ ছড়ালে যে সাইজ হবে, তা একটি ফুটবল মাঠ ঢেকে দেবার জন্য যথেষ্ট।
এই তিনটি প্যারাসুট মহাকাশযানের গতি কমিয়ে ঘণ্টায় ২০ মাইল এ নিয়ে আসে, যা একটি বাই সাইকেলের গতির কাছাকাছি। এই বেগে ওরায়ন সমুদ্রপৃষ্ঠে নিরাপদে অবতরণ করে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৬০০ মাইল দূরে ভ্রমণ করে এটি প্রশান্ত মহাসাগরের সুনির্দিষ্ট দশ মাইল প্রশস্ত স্থানের মধ্যে অবতরণ করে। তারপর একে নৌবাহিনীর বিশেষ জাহাজের সাহায্যে উদ্ধার করা হয়।
এই হচ্ছে সর্বাধুনিক প্রজন্মের মনুষ্য বহনে সক্ষম মহাকাশযান ORION এবং তাঁর প্রথম টেস্ট ফ্লাইট।
এই টেস্ট ফ্লাইটের উপর নাসা’র তৈরি সাত মিনিটের ভিডিও চিত্রটি থেকে ভালভাবে ধারণা পেতে পারেন পুরো বিষয়টির ব্যাপারে।
তথ্যসূত্র :-
১. NASA Website
২. NASA Youtube Channel