প্রথম পর্বে আমরা সৌরজগতের শুরুর সময় থেকে এককোষী ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি পর্যন্ত দেখেছিলাম। আসুন, আমরা তখনকার যুগে, অর্থাৎ প্রায় ৩৫০০ মিলিয়ন বছর আগের জগতে চলে যাই।
প্রথম অক্সিজেন উৎসের জন্মঃ
পানির নিচে আজব ধরণের পাথরের কলোনি সৃষ্টি হয় যেগুলোতে ব্যাকটেরিয়া জীবন যাপন করতো। এই কলোনিকে বলা হয় স্ট্রমেটোলাইট (Stromatolite)।
এই ব্যাকটেরিয়া সূর্যের আলোকে খাবারে পরিণত করতো। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় সালোকসংশ্লেষণ (Photosynthesis)। এটা সূর্যের আলোর শক্তিকে ব্যবহার করতো কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং পানিকে গ্লুকোজে রূপান্তরিত করার জন্য (Simple form of Sugar)। এবং এই জাদুকরী রূপান্তরকরণ নির্গত করতো একটা বিশেষ ধরণের গ্যাস – যার নাম অক্সিজেন।
এই স্ট্রমেটোলাইট সম্পূর্ণ সমুদ্রকে ধীরে ধীরে অক্সিজেন দিয়ে পূর্ণ করে ফেললো। এরপর অক্সিজেন লোহাকে মরিচায় (RUST) রূপান্তরিত করতে শুরু করে। এরা সমুদ্রের তলানিতে জমতে থাকে, যার ফলে লৌহসমৃদ্ধ পাথর সৃষ্টি হয়। এই মিনারেলকেই একদিন বিভিন্ন নির্মাণমূলক কাজে ব্যবহার করা আরম্ভ হয়।
এরপর পানির ঢেউয়ের উপরে স্ট্রমেটোলাইট থেকে নির্গত অক্সিজেন তৈরি করলো পৃথিবীতে প্রাণের ব্যাপক বিকাশের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান – বায়ুমণ্ডল। এটা ছাড়া অন্যান্য বড় আকারের জীবিত প্রাণীর অস্তিত্ব সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ, প্রাণই তৈরি করলো প্রাণের উপযুক্ত পরিবেশ। তবে কিছু প্রাণী অবাত শ্বসন প্রক্রিয়ায় (anaerobic respiration, অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে) শ্বাস চালাতো।
এরপরের ২ বিলিয়ন বছরে (প্রায় ১৫০০ মিলিয়ন বছর আগে) ধীরে ধীরে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়তে লাগলো। পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি আরও ধীর হতে শুরু করলো। তখন সম্পূর্ণ দিন ছিল ১৬ ঘণ্টার মত। জন্মের প্রায় ৩ বিলিয়ন বছর পরেও পৃথিবীতে কোনো জটিল (গাছপালা, ডায়নোসর, পাখি) প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায়নি। মানুষ তো অনেক দূরের কথা। কিন্তু পৃথিবী এই সৌরজগতের মাঝে এতটাই অসাধারণ একটা গ্রহ ছিল যে, ওর ক্ষমতা ছিল সকল কিছু পরিবর্তন করার।
প্রথম মহাদেশ রোডিনিয়া
১৫০০ মিলিয়ন বছর আগে এই পৃথিবী ছিল একটা সুন্দর নীল বলের মত, যার ছিল বিন্দু বিন্দু আগ্নেয় দ্বীপ (volcanic island)। মিলিয়নেরও বেশি বছর পর এই পৃথিবীকে আবার পুনরায় সাজানো শুরু করলো। পৃথিবীর ভেতরের আর বাইরের তাপ ও চাপের পার্থক্যের কারণে, সমুদ্রের তলদেশের ভূ-ত্বক ভেঙ্গে পড়লো বিশাল আকারের বিভিন্ন প্লেটে বিভক্ত হয়ে – এদেরকে টেকটোনিক প্লেট বলে। ওই বিন্দু বিন্দু আগ্নেয় দ্বীপগুলোর মধ্যে গতির সঞ্চালন হলো। এরা একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলো এবং মিশে গেলো। তৈরি করলো একটা বিশাল মহাদেশ। একে বলা হয় বলা হয় রোডিনিয়া (Rodinia)।
এভাবে চলে যায় কয়েকশো মিলিয়ন বছর।
সর্বপ্রথম আইস এইজ
প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বছর আগের কথা।
তখন পৃথিবীর তাপমাত্রা ছিল ৮৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সম্পূর্ণ দিন ছিল ১৮ ঘণ্টার মত। তখন আবার শুরু হয় আগ্নেয়গিরির উৎপাত। জায়গায় জায়গায় আগ্নেয়গিরি ফুলে ফেঁপে উঠে। এরা প্রচুর পরিমাণে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত করতে থাকলো। এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড পানির সাথে মিশে এসিড রেইন তৈরি করলো। যখন মহাদেশগুলো পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে গেলো, তখন অনেক পাথর বিস্ফোরিত হলো। এবং এই পাথর এসিড রেইনসহ কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে শোষণ করে নিলো।
এরপর বায়ুমণ্ডলে পর্যাপ্ত পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমে যায়। সূর্যের তাপ ভূ-পৃষ্ঠে পর্যাপ্ত পরিমাণে না পড়াতে কয়েক হাজার বছরের মধ্যেই পুরো পৃথিবী বরফে পরিণত হয়। তখন তাপমাত্রা ছিল -৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। জানা যায়, বরফের স্তরের উচ্চতা ছিল প্রায় ১০,০০০ ফিট। এই বরফের স্তর সমগ্র পৃথিবীকে ঘিরে ফেলে। সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে স্পেসে চলে যেত। ১৫ মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবী এমনি বরফের চাদরে ঢেকে থাকে। আগে এই পৃথিবী ছিল জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডের মত, আর এখন রূপান্তরিত হলো বরফের বলের মত! বিজ্ঞানিরা একে স্নোবল আর্থ বলে থাকেন।
Part 1
Part 2
এরপর আবার শুরু হয় আগ্নেয়গিরির তাণ্ডব। এরা আবার প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত করতে থাকে।
বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়তে থাকে। সূর্যের তাপমাত্রা পৃথিবীতে পৌঁছাতে শুরু করে এবং বরফ গলতে শুরু করে। এর সাথে আরও আগ্নেয়গিরি তৈরি হতে থাকে। এই আগ্নেয়গিরি আরও বেশি পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করতে থাকে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি বরফের পানির অণুর সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড তৈরি করে। বরফ গলে যাওয়ার পরে এই হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ভেঙ্গে বিপুল পরিমাণে অক্সিজেন তৈরি হয়।
তখনকার পৃথিবী ছিল আরও ব্যতিক্রম।
কেম্ব্রিয়ান এক্সপ্লোশন
প্রায় ৫৪০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী আরও উষ্ণ ছিলো। সম্পূর্ণ দিন ছিল ২২ ঘণ্টার। পানি ছিল জীবনের জন্য নিখুঁত উৎস। পৃথিবী তৈরির অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে বিবেচিত “কেম্ব্রিয়ান এক্সপ্লোশন”-এর শুরু হয়েছিল এখান থেকেই। স্নোবল আর্থের আগে আদি ব্যাকটেরিয়া সমুদ্রের পানির সাথে মিশে ছিলো। এদের মাধ্যমেই পরবর্তীতে পানির নিচে সামুদ্রিক উদ্ভিদের জন্ম হয়েছিলো। বিবর্তনের যাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছিলো।
কেম্ব্রিয়ান এক্সপ্লোশন মূলত প্রাণের বিস্ফোরণ। ওয়ার্ম, স্পঞ্জ, ট্রাইলোবাইট – এমন আরও অনেক বহুকোষী প্রাণ জন্ম নিয়েছিলো সেই সময়। মাইক্রোস্কোপিক ব্যাকটেরিয়া দেখতে ছিলো দানবের মত। এটা হল Anomalocaris। প্রায় ২ ফুট লম্বা জীবটির চোখ ছিলো, দাঁত ছিলো, বিশাল আকৃতির মুখ ছিলো।
আরেকটা ক্ষুদ্রাকার প্রাণ ছিল, নাম Pikia। আধা ইঞ্চির মত লম্বা। সম্ভবত এরাই প্রথম বহুকোষী প্রাণী, যাদের মেরুদণ্ড ছিলো।
মহাসমুদ্র প্রাণ দিয়ে ভরে গিয়েছিলো। মহাসমুদ্রে প্রাণ সৃষ্টির উৎসব চলছিলো যেন।
গন্ডওয়ানা
প্রায় ৪৬০ মিলিয়ন বছর আগের কথা।
পৃথিবীর মহাদেশগুলো আবার বিভক্ত হয়। এর নাম Gondwana।
ভিডিও এনিমেশনঃ
সেসময় অক্সিজেনের মাত্রা ছিল বর্তমান পৃথিবীর মতই। এরই মধ্যে উচিৎ ছিল পুরো ভূমি গাছ-পালা দিয়ে ভরে যাওয়া। কিন্তু সেরকম ছিল না। কেন? কারণ হলো সূর্য। সূর্য থেকে ভূ-পৃষ্ঠে মারাত্মক পরিমাণে রেডিয়েশন পড়ত। তাই মহাসমুদ্রে জীবনের উৎসব চললেও ভূমির মধ্যে এর কোনো চিহ্নই ছিল না। বায়ুমণ্ডলের ৩০ মাইল উপরে অক্সিজেন সূর্যের রেডিয়েশনের সাথে মিশ্রিত হয়ে নতুন গ্যাস সৃষ্টি করলো – ওজোন। ১২০ মিলিয়ন বছর ধরে এই ওজোনের স্তর পুরু হতে থাকে এবং সূর্যের রেডিয়েশন থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে থাকে। এই ওজোনের স্তর না থাকলে পৃথিবীর ভূমিতে কোনো প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারতো না।
ওজোন স্তর তৈরি হওয়ার পর ভূমিতে মসিলগ নামের উদ্ভিদ জন্ম নেয়, যা ছিল ভূমিতে জন্মানো সর্বপ্রথম উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদ আরও বেশি করে অক্সিজেন নির্গত করতে থাকলো।
ভূমিতে প্রাণীর আগমনঃ
৩৭৫ মিলিয়ন বছর আগে নতুন ধরনের প্রজাতি পানিতে বসবাস করা শুরু করলো। এরা সাঁতার কাটতে পারতো, ডুব দিতে পারতো। এটা বেশ অদ্ভুত ধরনের মাছ, যার নাম Tiktaalik।
এরা নদীর পাড়ে আসে এবং এর পাখনা পা হিসেবে কাজ করে একে নদীর পাড়ে ভূমিতে আসতে সাহায্য করে। প্রায় ১৫ মিলিয়নেরও বেশি বছর ধরে এরা বিবর্তিত হতে হতে এদের পা গজালো এবং এরা টেট্রাপড প্রজাতিতে রূপান্তরিত হলো।
বিজ্ঞানীদের মতে এই টেট্রাপড থেকেই ডায়নোসর, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, এবং অবশেষে মানুষের উৎপত্তি। তবে সেই কাহিনী আরো পরের।
আপাতত যা দেখলাম, তা হলো – সব জায়গা মস এবং ফার্ন নামক উদ্ভিদে ছেয়ে গেলো। গাছের উচ্চতা ছিল প্রায় ১০০ ফুট লম্বা। বাতাসের সাথে মাইলের পর মাইল উড়ে এসে গাছের বীজ ভূপৃষ্ঠে পড়ত এবং নতুন গাছের জন্ম হতো। এভাবে গাছের সংখ্যা বাড়তে থাকলো আর এরা প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন নির্গত করতে লাগলো।
এই পৃথিবীতে মাছ আছে, গাছ আছে, আছে ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদ। সেই সাথে আরও নতুন প্রজাতি সৃষ্টি হওয়া শুরু করল, যেমন ড্রাগন ফ্লাই। এটাকে মেগানিওরাও বলা হত। এই পতঙ্গের আকার ছিল বর্তমানের ঈগল পাখির মত।
আর্থ্রোপড (Arthropod) প্রজাতিরাও তখন ছিলো। পৃথিবীর ভূমিতে প্রথম চলাচল করে, এমন প্রাণীদের তালিকায় এরা ছিল প্রথম সারির সদস্য। স্করপিওনের সাইজ ছিল নেকড়ের মত। এর কারণ, তখন অক্সিজেন বেশি ছিল। ফলে শ্বসনতন্ত্র (respiratory system) আরও বেশি কার্যকরী হত তাদের শরীরকে বৃহৎ করে গঠন করতে।
ডায়নোসরের আগমন এবং পেরমিয়ান এক্সটিংশন
প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বছর আগেকার কথা।
সাইবেরিয়ার সমতলভূমিতে কিছু প্রাণীর জন্ম হয়। ছোট টিকটিকি থেকে বিবর্তিত হয়ে এরা বৃহৎ সরীসৃপে পরিণত হয়। এদের বলা হত স্কুডোসোর। বিজ্ঞানীদের ধারণা এরা সবাই আদি কচ্ছপের বংশধর।
কার্নিভোরাস প্রজাতির ডায়নোসর ছিল তখনকার স্থলভাগের রাজা। এরা ছোট ছোট ডায়নোসরকে (যেমন স্কুডোসোর) মেরে খেয়ে ফেলত। কিন্তু হঠাৎ করেই আবার ভূমি কেঁপে উঠে, ফেটে যায়। লাভা নির্গত হওয়া শুরু করে। সাইবেরিয়ান অঞ্চলের ডায়নোসরগুলো একারণে মারা যেতে থাকে। এই অগ্ন্যুত্পাতকে বলা হয় পারমিয়ান বিলুপ্তি (Permian Extinction)। এটার আরো প্রচলিত নাম হচ্ছে The Great Dying.
Video Animation Link:
গন্ডওয়ানা (Gondwana) মহাদেশের (super continent এর) অপর পাশে কোন ডায়নোসর না মরলেও এর অবস্থাও ভালো ছিল না। তাপমাত্রা ছিল ৭০ ডিগ্রি। আকাশ থেকে ছাইয়ের মত বস্তু পড়ছিলো। এটা প্রায় ১০,০০০ মাইল দূরের অগ্ন্যুত্পাত থেকে আসছিলো।
অগ্ন্যুত্পাত থেকে সৃষ্ট সালফার-ডাই-অক্সাইড দিয়ে বায়ুমণ্ডল ছেয়ে গিয়েছিলো। যখন বৃষ্টি পড়া শুরু করলো, তখন এটা সালফিউরিক এসিডে পরিণত হলো এবং সবকিছু জ্বালিয়ে ফেলতে লাগলো। এভাবে প্রায় অধিকাংশ তৃণভোজী ডায়নোসোর মারা পড়ে।
এর প্রভাব পড়েছিলো সমুদ্রেও। পানি গোলাপি রঙ ধারণ করেছিলো। জলজ উদ্ভিদ, ট্রাইলোবাইট অদৃশ্য হয়ে যায়। সাইবেরিয়ান অগ্ন্যুত্পাত সমগ্র পৃথিবীকে আবার পরিবর্তিত করে ফেলে। তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি হয়ে যায় (সাইবেরিয়ান অগ্ন্যুত্পাত এর আগের সময় থেকে ১১ গুণ বেশি)। ৯৫% এর মত প্রজাতি মারা যায়। পৃথিবী আবার প্রায় প্রাণীশূন্য হয়ে পড়ে।
(চলবে)
ব্যাকটেরিয়া জন্মের পর নির্গত অক্সিজেনের আগে কী অক্সিজেন ছিল না? যদি তার আগে পানি থেকে থাকে তবে পানিতেই তো অক্সিজেনের অনু থাকার কথা। নাকি তখনকার পানি অন্য অনু দিয়ে তৈরি ছিল?