২০০ মিলিয়ন বছর আগে সুপার কন্টিনেন্ট প্যানজিয়া (Pangea) দুই মেরু বরাবর প্রসারিত হওয়া শুরু করে এবং এই পৃথিবী আবার আরোগ্য লাভ করা শুরু করে।
এর তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়, এসিড রেইন প্রতিরোধ করার ক্ষমতা লাভ করে এবং গাছপালা আবার জন্ম নেয়। এরপর আবার ডায়নোসোরের মধ্যে নতুন প্রজাতির আগমন ঘটে। এদের বলা হত Ammosaurus। এরা ছিল বিশাল আকৃতির এবং তৃণভোজী। এরা হলো সেইসব ডায়নোসোরের প্রজাতি, যারা পার্মিয়ান বিলুপ্তি থেকে বেঁচে আসতে পেরেছিলো।
এদের সাথেই আরেক প্রজাতির ডায়নোসোর ছিলো। এদের বলা হত Dilophosaurus। এরা ছিলো খুব দ্রুতগামী। এরা এমোসরাসদের খেয়ে ফেলত।
১৯০ মিলিয়ন বছর আগের কথাঃ
আবার ভূমিকম্প শুরু হয়। সমুদ্রের তলদেশ থেকে লাভা বের হতে থাকে এবং পৃথিবীর প্লেট আবার সরে যেতে থাকে। গ্রেট সুপার কন্টিনেন্ট অফ প্যানজিয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে সরে যেতে থাকে। পানির নিচের মাছ মরে যায়। মাছ এবং প্লাঙ্কটনের মৃতদেহ সমুদ্রের পৃষ্ঠে জমতে শুরু করে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের পাথরের উত্তাপে ১০ মিলিয়ন বছর পর এই মরা মাছ এবং প্লাঙ্কটন তেল এ রুপান্তরিত হয়। আমাদের গাড়ির জ্বালানী, যে প্লাস্টিক আমরা ব্যবহার করি, দেওয়ালে রঙ করার সামগ্রী, আমাদের পায়ের নিচে যে কার্পেট থাকে, এমনকি আমরা যে সাবান দিয়ে গোসল করি – সব এখান থেকেই তৈরি হয়।
অ্যাটল্যান্টিক মহাসাগর এর জন্ম
১৮০ মিলিয়ন বছর আগে উত্তর আমেরিকার প্লেট, ইউরোপিয়ান এবং এশিয়ান প্লেট থেকে প্রতি বছর ১ ইঞ্চি করে সরে যেতে লাগলো। আমাদের হাতের নখ যেভাবে বড় হয়, ঠিক তেমনি। ফলে আফ্রিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় উত্তর আমেরিকা। এভাবে তৈরি হয় অ্যাটল্যান্টিক মহাসাগর।
সামুদ্রিক ডায়নোসোর
হঠাৎ করেই সমুদ্রে নতুন প্রজাতির জন্ম লক্ষ্য করা যায় – Pliosaurus। বাস থেকে লম্বা, ট্রাক থেকে ভারী এই প্রজাতির চোয়াল শক্তিশালী কোনো দানবীয় হাঙর থেকে ৮ গুণ বেশি। এদের দাঁত ছিলো প্রায় ১২ ইঞ্চি লম্বা। এদেরকে সামুদ্রিক ডায়নোসরও বলা হয়।
ডায়নোসোর যুগের সমাপ্তিঃ ৬৫ মিলিয়ন বছর আগেকার কথা
ডায়নোসোরকে বলা হয় সব থেকে সফল প্রাণী, যারা সাইবেরিয়ান এক্সটিঙ্কশন, ভল্কানিক অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। এরা প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন বছর পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে বিচরণ করেছে। অবশ্য এদের সাথে কিছু সংখ্যক স্তন্যপায়ী প্রাণী (Black-footed ferret) নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলো। এরা আকারে অনেক ছোট ছিলো এবং ডায়নোসোরের ভয়ে মাটিতে লুকিয়ে থাকতো। শুধু রাতে খাবারের অন্বেষণে বের হতো।
কিন্তু হঠাৎ মহাকাশ থেকে বিশাল একটা গ্রহাণু (asteroid) পৃথিবীর দিকে এগিয়ে এলো। মাউন্ট এভারেস্ট থেকেও বিশাল ছিলো এই গ্রহাণু, অবশ্য তখনো মাউন্ট এভারেস্ট বলতে কিছু ছিলো না। খুব দ্রুতগতিতে এটি গালফ অফ মেক্সিকো বরাবর এগিয়ে আসছিলো। যখন এটা পৃথিবীর বুকে পতিত হয়, তখন চারপাশে ৩৫০০০ ফিট গর্ত করে ফেলে এবং সাথে সাথে বাষ্পীভূত হওয়া শুরু করে। ফলে এমন শক্তি উৎপন্ন হয় যা কয়েক মিলিয়ন নিউক্লিয়ার অস্ত্রের সমান।
ফলে এর আশেপাশের সবকিছু ধ্বংস হতে শুরু করে। কয়েক মিনিট পরই আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উল্কাপিণ্ড পৃথিবীতে পড়তে শুরু করে। শুরু হয় সুনামি, ভূমিকম্প। প্রাকৃতিক এসব বিপর্যয়ের কারণেই ডায়নোসোরেরা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
কিন্তু ডায়নোসোর বিলুপ্ত হলেও কিছু সংখ্যক স্তন্যপায়ী প্রাণী বেঁচে যায়। কারণ ওরা গর্তে ছিলো। ডায়নোসোর ধ্বংস হওয়ার পর অন্য স্তন্যপায়ীদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়।
পৃথিবীর নতুন অধ্যায়ের শুরু এখানেই
৪৭ মিলিয়ন বছর আগেকার কথাঃ
ডায়নোসোর বিলুপ্ত হওয়ার পর স্তন্যপায়ীরা বিবর্তিত হয়ে ঈডা (IDA)-তে পরিণত হয়। জার্মানি ছিল সব থেকে পারফেক্ট প্লেস তাদের স্পট করার জন্য। এদের ফসিল আবিষ্কার পরার পর ধারণা করা হয়, এদের থেকেই এইপ এবং এইপদের থেকে বাঁদর আর মানুষদের বিবর্তন ঘটেছে।
হিমালয় পর্বতের জন্মঃ
তখনকার আবহাওয়া ছিলো বর্তমান পৃথিবীর মতই। সম্পূর্ণ দিন ছিলো ২৪ ঘণ্টা থেকে কিছুটা কম। তাপমাত্রা ছিলো ৭৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
আবার পৃথিবীর প্লেট সরে যেতে শুরু করে। ইন্ডিয়ার প্লেট উত্তরের দিকে এশিয়া বরাবর সরে আসতে থাকে এবং পরস্পরের সাথে ধাক্কা লাগে।
ধাক্কা লেগে প্রায় ২৭ হাজার ফুটের মত পাহাড়ের সৃষ্টি করে। যে পাহাড়ের সৃষ্টি হয়, তাকেই আমরা হিমালয় পর্বত নামে চিনি। এটাই হল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পর্বত, আর মাউন্ট এভারেস্ট হল হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া।
হিমালয় পর্বতমালার বরফ গলা পানি বিভিন্ন নদীর সৃষ্টি করে। যেমন গঙ্গা, ইন্দুস, ইয়েলো, ইয়াংজস। হিমালয় ছিলো পানি সরবরাহের অন্যতম মাধ্যম। এখান থেকে সৃষ্ট নদীসমূহের পানি পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানবগোষ্ঠীর পানি সরবরাহ করতে সক্ষম।
৪ মিলিয়ন বছর পরের ঘটনাঃ
আমাদের পৃথিবী জীবন ধারণের জন্য সকল প্রকার উপদান দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেলো। তারপরও কিছু একটার কমতি ছিলো, আর তা হলো মানুষ, অর্থাৎ আমরা। মানুষের জন্য পৃথিবীর কিছু না কিছুর তো পরিবর্তন করা উচিৎ ছিলো। আফ্রিকান উপকূল বরাবর একটা নতুন সূত্র আবিষ্কৃত হল।
বাঁদরের মত প্রাণী পৃথিবী পরিবর্তন করে দিলো। ভারত মহাসাগর থেকে আর্দ্রতা ভূমির দিকে এগুতে থাকলো এবং ক্রমশ উষ্ণ ও শুষ্ক হতে লাগলো। গরম জলবায়ু ওই সকল বাঁদর সদৃশ প্রাণীদের আবাসস্থল পরিবর্তন করতে এবং খাবার অন্বেষণের জন্য দূরে যেতে বাধ্য করলো।
আগে ওরা এইপের মত দুই হাতের আঙ্গুলের উপর ভর দিয়ে চলাফেরা করত।
কিন্তু ওরা তখন তাদের আঙ্গুলের উপর চাপ দিয়ে চলাফেলা করা বাদ দিয়ে দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটা শুরু করলো। এইটাই মানবসভ্যতার প্রারম্ভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
মানব সভ্যতার প্রারম্ভ
১.৫ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর বুকে মানুষের মতই কিছু পায়ের ছাপ ভেসে উঠে।
এরা ছিল হোমো স্যাপিয়েন্স (মানে আমরা)-এর পূর্ববর্তী প্রজন্ম হোমো ইরেকটাস।
কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন সভ্যতা অতিবাহিত হয়, নতুন সভ্যতা আসে। প্রত্যেক সভ্যতাই আবার নতুন উদ্ভাবনী শক্তি নিয়ে পৃথিবীর বুকে পদার্পণ করে।
৭০ হাজার বছর আগে সমুদ্রের পানির স্তর নিচু হয়ে যায়। আফ্রিকা এবং আরবের মধ্যবর্তী গ্যাপ প্রায় ৮ মাইলের মত সংকুচিত হয়ে যায়। লোহিত সাগর সঙ্কীর্ণ এবং অগভীর হয়ে পড়ে। আফ্রিকা থেকে হোমো সেপিয়েন্সের ছোট একটা দল সাগর পার হয়ে অপর পাশে চলে আসে। বিজ্ঞানীরা বলেন যে, প্রায় ২০০ ব্যক্তি আফ্রিকা ছেড়ে এসে পুরো পৃথিবীতে তাদের বংশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে। এই বংশের বিস্তার ইন্ডিয়া, এশিয়া এবং ইউরোপ বরাবর বিস্তৃত হতে থাকে।
যখন মানব সভ্যতা উত্তর দিক বরাবর অগ্রসর হতে থাকে, তখন একটা বিশাল বরফের দেয়াল দক্ষিণ দিক বরাবর অগ্রসর হতে থাকে। পৃথিবীর পরিমণ্ডলের প্রাকৃতিক পরিবর্তন, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের স্তর এবং পৃথিবীর উষ্ণ পানির প্রবাহ হঠাৎ করেই পৃথিবীর তাপমাত্রাকে কমিয়ে ফেলে। আবার আইস এইজ (Ice Age) শুরু হয়। নদী জমাট বেঁধে বরফে পরিণত হয়। নর্দার্ন হেমিস্ফিয়ার প্রায় ১.৫ মাইল পুরু বরফের চাদরে ঢাকা পড়ে যায়। ট্রিলিয়ন গ্যালনের মত পানি যখন বরফের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যায়, তখন সমুদ্রের পানির স্তর হ্রাস পায়। এই বরফ সাইবেরিয়া এবং আলাস্কার মধ্যে সুবিশাল ব্রিজের মত কাঠামো তৈরি করে। মানুষ ওই বরফের উপর দিয়ে এশিয়া থেকে আমেরিকাতে স্থানান্তরিত হয়ে সেখানে তাদের বংশ বৃদ্ধি করা শুরু করে।
১৪ হাজার বছর আগের কথা।
আইস এইজ শেষ হয় এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন নর্দার্ন হেমিস্ফিয়ার অনাবৃত করে। আমেরিকার মধ্যে বিশাল গর্ত ছিলো, যাকে বর্তমানে বলা হয় গ্রেট লেক। সেখানে বরফ গলিত পানি দিয়ে ভরাট হয়ে যায়।
৬০০০ হাজার বছর আগে বরফের গণ্ডি পৃথিবীর দুই মেরু – আর্কটিক এবং এন্টার্কটিকে (এন্টি+আর্কটিক=এন্টার্কটিক) সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।

বর্তমান সময়
এভাবেই ৬০০০ বছর ধরে বিভিন্ন যুগ, বিভিন্ন সভ্যতা, যেমন – প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ, লৌহ যুগ, মায়ান-অ্যাজটেক-সিন্ধু ইত্যাদি সভ্যতা পার হয়ে আমরা পরিণত হয়েছি বর্তমান সমাজের সভ্য জাতিতে। পূর্বপুরুষদের চেয়ে আমরা অনেক বেশি উন্নত এবং পরিণত।
বিজ্ঞানীদের মতে, এভাবেই অর্থাৎ বিভিন্ন উপায়ে পরিবর্তিত হতে হতেই পৃথিবী তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে। অর্থাৎ সভ্যতার পতন হবে, যারা বেঁচে থাকবে তারা নতুন সভ্যতা তৈরি করবে।
আজ আমি সেই পৃথিবীতে আছি, যে পৃথিবীর উপর দিয়ে প্লেন, রকেট চলে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপর দিয়ে স্যাটালাইট ঘুরে। আমি সেই পৃথিবীর বাসিন্দা, যে পৃথিবীর মানুষ শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করার জন্য পারমাণবিক বোমা তৈরি করে। আমি সেই পৃথিবীর বাসিন্দা, যারা তাদের মোবাইল ফোন দিয়ে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে। আমি সেই পৃথিবীর বাসিন্দা, যে পৃথিবীর কোনো এক ক্ষুদ্র অংশে বসে কম্পিউটার নামক কোন যন্ত্র থেকে এই পোস্টটা লিখলাম।
পৃথিবীর এই মহান যাত্রার ইতিহাসের অংশটুকু সম্পন্ন হল। প্রায় আরো ততটুকু সময় এই পৃথিবীর আয়ু আছে। আশা করি, এই পৃথিবীটাকে আমরা বাসের যোগ্য করে রাখতে পারবো; অন্তত ততদিন, যতদিন না আমরা অন্য কোথাও, অন্য কোনো গ্রহে পৌঁছে যাচ্ছি।