আলো – সম্ভবতঃ আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ‘সর্বাধিক’ গুরুত্বপূর্ণ শাখা। যোগাযোগ ব্যবস্থা, মহাকাশ কিংবা মৌলিক কণা নিয়ে গবেষণা – সবখানেই রয়েছে এই তরঙ্গের ব্যবহার। খুবই সহজ ভাষায়, আলো একধরনের তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য আমাদের চোখের রেটিনাতে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, এবং যার ফলে আমাদের দৃষ্টির অনুভূতি তৈরি হয়- অর্থাৎ জিনিসটি আমরা দেখতে পাই। কিন্তু এই আলো নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই! সেই ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো দাবি করেছিলেন, বিভিন্ন বস্তু দেখার জন্য আমাদের চোখই নাকি আলো প্রেরণ করে। অবশ্য তার দাবি আমাদের কাছে এখন হাস্যকরই মনে হয়। তবে আলো নিয়ে মাথা ব্যথা সম্ভবত আর কোনো দার্শনিকই করতে চাননি সেই সময়। ১০০০ খ্রিস্টাব্দ এবং তার পর দিকে আরবীয় মুসলিম বিজ্ঞানীরা আলোর ধর্ম নিয়ে অনেক মৌলিক গবেষণা করেন, বিশেষত- ইবনে সাহল লেন্স, প্রতিসারণ, প্রতিফলন নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানের একটি নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন।
আলো কিভাবে সঞ্চালিত হয়, সে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। নিউটনের কণা তত্ত্ব কিংবা হাইগেন্সের তরঙ্গ তত্ত্ব ও ইথার– এ নিয়ে আমাদের সবারই ধারণা আছে। কিন্তু আলোর কিছু বিশেষ ধর্ম যেমন সমাবর্তন (একাধিক আলোকরশ্মির একসাথে আপতিত হয়ে মিলিত তরঙ্গ রুপে সঞ্চালিত হওয়া), অপবর্তন (আলোর গতিপথে যদি বাঁধা থাকে, তাহলে আলোক রশ্মির বেঁকে যাওয়া, একদম সহজ ভাষায়, অন্ধকার ঘরে দরজা আলতো করে লাগিয়ে রাখলেও ঘরে কিছুটা অংশ আলোকিত হয়, এই ঘটাকে অপবর্তন বলা হয়) এই সব তত্তের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় নি। পড়ে ম্যাক্সওয়েলের তাড়িত-চৌম্বক তত্ত্ব এই ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারলেও সমস্যার সৃষ্টি হয়, যখন আরেক জার্মান বিজ্ঞানী কার্শফ ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এর তাড়িতচৌম্বক ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। কারণ, ম্যাক্সওয়েলের তত্তে তাড়িত চৌম্বক তরঙ্গের তাপমাত্রা এবং কম্পাংক নির্ভরশীলতার কথা বলা হলেও, ব্ল্যাকবডির(কৃষ্ণবস্তু) জন্য কোনো হিসাব মিলানো যাচ্ছিলো না।
প্রায় ৪০ বছর পর আরেক জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাঙ্ক দেন ফোটন প্যাকেটের আইডিয়া, যার মাধ্যমে কণা ও তরঙ্গ তত্ত্বকে একীভূত করা হয়। তার মতে, ফোটন কণা প্যাকেট আকারে কোন বস্তু থেকে নির্গত হয় (কোয়ান্টাম), যা তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গরুপে সঞ্চালিত হয়। এখন পর্যন্ত এই তত্ত্বই সর্বজনবিদিত, যা ম্যাক্সপ্লাঙ্ক ১৮৯৯ সালে প্রদান করেন এবং আইন্সটাইন এই তত্ত্ব ব্যবহার করে ১৯০৫ সালে ফটো তড়িৎ ক্রিয়ার ব্যখ্যা প্রদান করেন। এই কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে অধিকতর গবেষণার জন্য ম্যাক্সপ্লাঙ্ক ১৯১৮ সালে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন ।
এই ফোটন কণা নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও, ফোটন কণা কিভাবে স্থানান্তরিত হয়, সেটা চোখে প্রত্যক্ষ করার মত প্রযুক্তি কারো কাছেই ছিলো না এতদিন! তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা তাদের তত্ত পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করতে পারলেও, সর্বাধিক দ্রুতগতি সম্পন্ন কণাকে ‘ধরে ফেলা’র মত অসম্ভব ঘটনা ঘটানো তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বছর চারেক আগেই ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি– MIT এর মিডিয়া ও ইমেজিং ল্যাবের পোস্ট ডক্টরেট গবেষক Andreas Velten এবং ভারতীয় বংশোদ্ভুত এবং একই ল্যাবের সহযোগী অধ্যাপক রমেশ রস্কর এই অসম্ভব ঘটনাকে সম্ভব করে ফেলেন, ২০১১ সালে। তারা মিলে তৈরি করেন বিশ্বের সবচে দ্রুত গতিসম্পন্ন ভিডিও ক্যামেরা, যার মাধ্যমে তারা এক সেকেন্ডে সংযোজন করেন এক ট্রিলিয়ন ফ্রেম! (১ ট্রিলিয়ন = ১×১০১২ অর্থাৎ এক হাজার বিলিয়ন, এক বিলিয়ন = ১০০ কোটি)! সাধারণ যে ভিডিও আমরা দেখে থাকি, তাতে সাধারণতঃ ২৫-৩০ টি ফ্রেম ব্যবহার করা হয় প্রতি সেকেন্ডে! অর্থাৎ ডঃ রমেশ ও ওয়েলটেন এর বানানো ভিডিও ক্যামেরার কাছে “দুনিয়াতে এমন কিছুই নেই যা এই ক্যামেরার চোখে ‘দ্রুতগতি’ সম্পন্ন”। যেই ক্যামেরা একটি আলোক কণিকা ধরে ফেলতে পারে, তার কাছে তো অবশ্য সবকিছুই ‘কচ্ছপ’।
সবচে ধীরগতির এই ক্যামেরাতে ব্যবহৃত হয়েছে ‘স্ট্রিক ক্যামেরা’ প্রযুক্তি, যেখানে প্রথাগত ক্যামেরার কার্যপ্রণালী উপেক্ষিত হয়েছে! সাধারণ ক্যামেরার Aperture (যার মাধ্যমে ক্যামেরা লেন্সে আলো প্রবেশ করে) এর পরিবর্তে এই ক্যামেরাতে ব্যবহার করা হয়েছে অতি সূক্ষ্ম ‘চিড়’ (Slit) যেটার মধ্যে দিয়ে আলোক কণা প্রবেশ করে, যেটাকে ইলেক্ট্রনে রুপান্তর করে একটি তড়িৎক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে প্রেরণ করা হয়। এই তড়িৎ ক্ষেত্র ইলেক্ট্রনগুলোকে চিড়ের সাথে আড়াআড়িভাবে বিচ্যুত করে। এই তড়িৎক্ষেত্রটির কম্পাঙ্ক অনেক বেশী বিধায়, প্রথমে প্রবেশ করা ইলেক্ট্রনের চেয়ে পরবর্তীতে প্রবেশকারী ইলেক্ট্রনগুলোকে বেশী বিচ্যুত করে।
সুতরাং, এই ক্যামেরার দ্বারা প্রবেশকৃত আলোর যেই ইমেজটি এখন পাওয়া গেল, সেটি একমাত্রিক (চিড়ের লম্ব বরাবর)। কিন্তু দ্বিমাত্রিক একটি ছবি পেতে হলে আরেকটি ডাইমেনশনের প্রয়োজন, এই ক্যামেরার জন্য সেটি হলে সময়! কিভাবে সম্ভব? ইলেক্ট্রন ক্যামেরা স্লিটে প্রবেশ করার পর যখন তড়িৎক্ষেত্র দ্বারা বিচ্যুত হয়, সেই অতি ক্ষুদ্র সময়টাকে এই ‘স্ট্রিক ক্যামেরা’তে হিসাব করা হয় সংলগ্ন সুপার কম্পিউটারের সাহায্যে! যেটাকে বলা হয় ‘কম্পিউটেশনাল ইমেজিং’। সুতরাং, এই ক্যামেরার সাহায্যে প্রাপ্ত ছবি আসলে একটি ফোটনগুলার একটি স্লিটে অতিক্রান্ত সময় । সায়েন্স ফিকশন মনে হলেও এটিই বাস্তব! এই একই কাজ বার বার করে একটি সম্পূর্ণ ভিডিও তৈরি করার জন্য পুরো সময় জুড়ে ২ টি বিশেষ ধরনের আয়না ব্যবহার করা হয়েছে।
কিন্তু ১ সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার বেগে চলা আলোক কণা ফোটনের ছবি তোলা কি এত সহজ? কাটিং এজ স্ট্রিক ক্যামেরার পক্ষেও নয়! এই ক্যামেরা দিয়ে এক সেকেন্ডে এক ট্রিলিয়ন ফ্রেম সংযোজন করে উপরের ‘সুপার স্লো-মোশনের’ নিরীহ ভিডিওটি বানাতে ডঃ রমেশ, ডঃ বাওয়েনডি এবং ওয়েলটেনকে একই পরীক্ষা বহুবার (মানে, আসলেই বহুবার) করতে হয়েছে! পরীক্ষাটি হলো – একটি সাধারণ কোকাকোলার বোতলের মধ্যে দিয়ে লাইট পালস হিসেবে লেজার রশ্মি অতিক্রম করতে দেয়া এবং তাদের তৈরি স্ট্রিক ক্যামেরা বারবার রিপজিশন করে একটি ছবি তৈরি করা। এই সাধারন ছবি তোলার কাজটাও কিন্তু সাধারণভাবে করা হয়নি! লেজার, ক্যামেরা এবং বোতলটিকে এমনভাবে সমন্বয় করা হয়েছে যেন প্রতিবার ইমেজিং এর সময় স্ট্রিক ক্যামেরার এক্সপোজার টাইম একই থাকে! এই পুরো কাজটিই করা হয়েছে অতিসূক্ষ্ম মেক্যানিক্যাল কন্ট্রোল সিস্টেম ব্যবহার করে।
১ লিটার সাইজের এই বোতলটি অতিক্রম করতে ফোটনকণার (আলোক কণা) মাত্র এক ন্যানো সেকেন্ড (১ সেকেন্ডের ১০০ কোটিভাগের এক ভাগ) সময় লাগে! কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের এই ভিডিওটি বানাতে রমেশ এবং তার দলকে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ‘ছবি’ তুলতে হয়েছে! যেই কারণেই রমেশ রসিকতা করে বলেছেন, ক্যামেরাটি হল ‘World’s Slowest Fastest’ ক্যামেরা!
রেফারেন্সঃ
[1] MIT
[2] BBC
[3] Science Learn
ক্যামেরা কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকার বিষয়টা অত ভালো করে বুঝিনি।তবে নিঃসন্দেহ ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং।