বিবিসিতে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ব্রায়ান কক্সের দারুণ উপভোগ্য একটা টিভি ডকুমেন্টারী অনুষ্ঠান “ ওয়ান্ডার্স অব দ্যা ইউনিভার্সের” প্রতিটা পর্বের সূচনাটা হতো তারই কণ্ঠের একটা মনোলগ (Monologue) দিয়েঃ-
“আমরা এখানে কেন? আমরা কোথা থেকে আসলাম? এই প্রশ্নগুলো আমাদের সবচেয়ে বেশি তাড়িত করে এসেছে এবং এই অজানাকে জানার নেশা আমাদের রক্তেই মিশে আছে। আমাদের গল্পের শুরুটা হয়তো করা যেতে পারে আমাদের মানবসভ্যতার সূচনাপর্ব থেকে, কিন্ত আসলে আমাদের যাত্রার শুরু ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে এক মহাবিষ্ফোরণের মধ্য দিয়ে। যার কারণে সৃষ্টি হয়েছে অগণিত গ্যালাক্সি আর তাদের মাঝের ভেসে থাকা বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র আর গ্রহ-উপগ্রহ। তাই কার্যত মহাবিষ্ফোরণের পরের প্রতিটা গল্পই আসলে আমাদের গল্প। আর আমি সেই গল্পটাই বলতে এসেছি।”
আমার লেখাটার শিরোনামে লেখা “পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার ২০১৯”, তাহলে বিজ্ঞানী ব্রায়ান কক্সের ডকুমেন্টারীর কথা লিখলাম কেন?
কারণটা একেবারেই সহজ, এবারে যারা নোবেল পেয়েছেন তারা সবাই জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং তারা ওই যে একটা বহুল আলোচিত প্রশ্ন, “আমরা কোথা থেকে আসলাম?” তার উত্তর খুঁজতে এবং তার পাশাপাশি “পৃথিবীর বাইরে আমরা ভবিষ্যতে কোথায় যাব?” কিংবা “এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডে আমরা কি একা?” এইরকম প্রশ্নগুলোর সমাধানের জন্যই তাদের প্রায় পুরোটা জীবনটাই উৎসর্গ করে দিয়েছেন।
এবছর পদার্থে নোবেল পেয়েছেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার ইমিরেটাস অধ্যাপক (আইনস্টাইন অধ্যাপকও) জেমস পীবলস এবং সুইজারল্যান্ডের জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক মাইকেল মেয়র ও ডিডিয়ের ক্যেলো। এর মধ্যে ডক্টর জেমস পীবলস পেয়েছেন বিশ্বব্রম্মাণ্ডের প্রাথমিক গঠনশৈলি ব্যাখ্যায় অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য আর বাকি দুজন পেয়েছেন সৌরজগতের বাইরে একটা এক্সোপ্ল্যানেট বা গ্রহ পরোক্ষভাবে আবিষ্কারের কারণে।

পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল ২০১৯
প্রথমে ডক্টর জেমস পীবলসের কথাটায় আসি। ১৯৩৫ সালে জন্মানো ৮৪ বছর বয়সী প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষকের বিগ ব্যাং বা মহাবিষ্ফোরণের পরবর্তী সময়কাল ও এর প্রভাবে ব্রহ্মাণ্ডের গঠনশৈলীর ওপর অবদান এক কথায় অবিস্মরণীয়।

Dr. James Peebles taking classes at Princeton University
ডক্টর পীবলসের অবদান বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে আরো কিছুটা সময় আগে, আমাদের জানতে হবে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন সম্পর্কে। ১৯৪৮ সালে দুইজন বিজ্ঞানী ডক্টর র্যালফ আলফার এবং ডক্টর জর্জ গ্যামো গাণিতিকভাবে দেখান যে যদি বিশ্বব্রম্মাণ্ডের সূচনা বিগ ব্যাং থেকে হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তা থেকে সৃষ্ট তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের খুব সামান্য একটা অংশ এখনো রয়ে যাওয়ার কথা এবং সেটা পাওয়া গেলেই বোঝা যাবে যে বিগ ব্যাং আসলে সত্যিই ঘটেছিলো। ১৯৬৪ সালে অনেকটা আকস্মীকভাবেই ডক্টর আর্ণো পেনজিয়াস এবং ডক্টর রবার্ট উইলসন “হর্ন” নামের একটা দানবাকার অ্যান্টেনায় প্রথমবারের মত কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন শনাক্ত করতে সক্ষম হন (*এটার তরঙ্গদৈর্ঘ্য মাইক্রোওয়েভের রেঞ্জে থাকে)। এই তরঙ্গ শনাক্তকরণের মাধ্যমে বিগ ব্যাং মডেলের সত্যতা প্রমাণের স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেলও জিতে নেন ১৯৭৮ সালে।
Allan Penzias and Robert Woodrow Wilson, Nobel-1978

Microwave Cosmic Background Radiation
কিন্তু মাইক্রোওয়েভ কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন খুবই ক্ষীণ ছিলো এবং তখনকার প্রযুক্তি তত উন্নত না হওয়ায় এটা নিখুতও ছিলো না। এই দারুন আবিষ্কারের পরেও বিশ্বব্রম্মাণ্ডের প্রাথমিক পর্যায়ের অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়। বিশেষ করে মাইক্রোওয়েভ কসমিক ব্যাকগ্রাঊণ্ড রেডিয়েশন এবং তখনকার প্রস্তাবিত বিভিন্ন কসমোলজিক্যাল মডেল দিয়ে বড় পরিসরে (যেমন গ্যালাক্সি ) অনেক কিছুকে ব্যাখ্যা করতে পারলেও যখন অপেক্ষাকৃত ছোট স্কেলের কিছু যেমন কোন ক্ষুদ্রতর কণার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে কিভাবে কোন কিছু তৈরি হল বা কোন একটা গ্যালাক্সির তৈরির প্রাথমিক অবস্থা এইসব বিষয়বস্তু ব্যাখা করাটা কঠিন ছিলো (ফ্ল্যাকচুয়েশন)।
১৯৬৪ সালে ডক্টর জেমস পীবলস তার গবেষণা শুরু করেন। ১৯৭০ সালে পদার্থবিদ্যার অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ “ফিজিকাল রিভিউ ডি” জার্নালে তার তাত্ত্বিক গবেষণালব্ধ (থিওরেটিক্যাল) ফলাফল প্রকাশ করেন। এই গবেষণাপত্রে উনি “স্ট্রাকচার ফর্মেশন” বা গ্যালাক্সি সৃষ্টির প্রারম্ভিক অবস্থার নানা দিক নিয়ে তার প্রস্তাবনা এবং ফলাফল উপস্থাপন করেন। ওই একই বছরই জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ “অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল” জার্নালে তার আরেকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় যেটাতে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের বহুল আলোচিত ফ্রিডম্যান-লেমিত্রি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মডেলের সীমাবদ্ধতা দেখানোর পাশাপাশি তার ও তার সহকর্মীদের করা ব্রহ্মাণ্ডের প্লাজমা রিকম্বিনেশনের উপর বিষদ তত্ত্বীয় ফলাফল প্রকাশ করেন। এবং সেটা দ্বারা যে অনেক ধরনের গ্যালাক্সির সূচনাপর্যায় ব্যাখ্যা করা যায় সেটাও দেখান।
এখানেই তার অবদান শেষ হুয়নি। ১৯৮৭ সালে জেমস পিবলস বিশ্বব্রম্মাণ্ডের প্রাথমিক অবস্থা ব্যাখ্যার জন্য “প্রিমর্ডীয়াল আইসোকার্ভেচার ব্যারিয়ন মডেল (premordial isocurvature Barryon Model) ” প্রস্তাব করেন। এটা কেবলমাত্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কিভাবে আজকের এই অবস্থায় পৌঁছুলো সেটাই নয়, সার্বিক অর্থে কোন গ্রহ-নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি কোথায়-কেন-কিভাবে গড়ে উঠবে গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। শুধু তাই নয় এই বিজ্ঞানীর অবদান আছে ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও, যেটা পুরো ব্রহ্মাণ্ডের ৯৫ শতাংশ!
কার্ল সেগান বলেছিলেন যে জ্যোর্তিবিজ্ঞান আমাদের নিরহংকারী করে, জেমস পীবলসও তারই প্রতিচ্ছবি। প্রথম অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেছেন, “এটা আসলে আমার একার কাজ নয়, আরো অনেকেরই অবদান আছে (Collaborative)”।
পরের দুইজন নোবেল পেয়েছেন তাদের এক্সপেরিমেন্টাল বা পরীক্ষালব্ধ গবেষণার ফলাফলের কারণে। এবং তাদের এই আবিষ্কার আমাদের মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ এবং ভবিষ্যৎ বসতি স্থাপনের সাথে সরাসরিভাবে জড়িত। তাদের আবিষ্কার আমাদের একটু একটু করে নিয়ে যাচ্ছে একটা পরম আকাঙ্খিত প্রশ্নের উত্তরের দিকে, “আমরা কি একা?”।

Michel Mayor and Didier Queloz.
সুইজারল্যান্ডের ডক্টর মাইকেল মেয়র ও ডক্টর ডিডিয়ের ক্যেলো নোবেল পেয়েছেন এক্সোপ্ল্যানেট নিয়ে গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ। আরো ভালোভাবে বললে ১৯৯৫ সালে পৃথিবী থেকে ৫০ আলোকবর্ষ দূরে ৫১-পেগাসি-বি নামের একটা গ্যাসীয় গ্রহের আবিষ্কারের কারণে এদের নোবেল দেয়া হয়েছে। এই গ্রহটা অনেকটাই আমাদের সৌরজগতের বৃহস্পতির মতো মানে গ্যাস জায়ান্ট। তারা যে পদ্ধতিতে (রেডিয়াল ভেলোসিটি মেথড) কাজ করেছেন বা গ্রহ শনাক্ত করেছেন সেটা এক্সোপ্লানেট আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক সাফল্য নিয়ে এসেছে।

শিল্পীর চোঁখে ৫১-পেগাসী বি গ্রহ
এক্সোপ্ল্যানেট মানে হলো আমাদের সৌরজগতের বাইরের কোন গ্রহ যেটা অন্য কোন নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এটা নতুন কিছু নয়। ১৯১৭ সালে প্রথম এক্সোপ্ল্যানেট খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে কথা উঠেছিলো। ১৯৯৫ পর্যন্ত পাওয়া এক্সোপ্ল্যানেটগুলো কোনটিই আমাদের সূর্যের মত কোন নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করত এমনটা ছিল না। সবই ছিলো সুর্যের চেয়েও বড় নক্ষত্র, অধিকাংশই পালসার। এরকম একটা আইডিয়া ভেসে ওঠার সম্ভাবনা ছিলো যে আমাদের সৌরজগত সৃষ্টি হয়তো নেহায়াতই একটা দূর্ঘটনা।
কিন্তু মেয়র এবং ক্যুয়েলোজের আবিষ্কার করা গ্রহটি এই ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটালো। তাদের আবিষ্কার দেখাতে সক্ষম হলো যে আমাদের সূর্যের মত নক্ষত্রকে নিয়েও প্রায় আমাদের সৌরজগতের মত কম্বিনেশন সম্ভব। মানে আমাদের সূর্যের মত নক্ষত্রগুলোরও আশপাশে হুবহু আমাদের সৌরজগতের মত গ্রহ থাকতে পারে।
৫১ পেগাসি বি অনেকটা আমাদের সূর্যের মত নক্ষত্রকেই কেন্দ্র করে ঘুরছে। এটি বলতে গেলে ওই নক্ষত্রের (Pegasi B) বেশ কাছেই এবং মাত্র ৪ দিনে তার সূর্যকে প্রদক্ষীণ করে, তাপমাত্রাও প্রচুর। এইধরণের গ্রহকে হট জুপিটারও বলা হয়। । এবং এটার একটা ঘন বায়ুমন্ডল আছে। ২০১৭ সালে এই গ্রহে পানির অস্তিত্ত্বও আবিষ্কার হয়। নিচের ছবিটা দেখুন ।এখানে আমাদের সূর্য এবং ওই নক্ষত্রের একটা তুলনা দেখানো হয়েছে।

Comparison between our Sun and Pegasi B star.
তাদের এই আবিষ্কারের পর প্রায় তাদের পদ্ধতি ও আরো নিত্যনতুন গবেষণা-প্রযুক্তির মাধ্যমে আজ পর্যন্ত ৮০০০ এরও বেশি এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কৃত হয়েছে। যাদের অনেকগুলোই পৃথিবীর মতো বা এর কাছাকাছি। যেটার কোন একটি হবে আমাদের ভবিষ্যতের বাড়ি। আমাদের পৃথিবীর দ্বিতীয় সংস্করণ বা আর্থ-২। হয়তো আমরাও একদিন প্যাসেঞ্জার্স মুভির মতো বিশাল মহাকাশযানে চড়ে বেরিয়ে পড়ব ওই পৃথিবীর টানে।
উনাদের বর্ণাঢ্য গবেষণা-জীবন, তাদের পেপার, সাইটেশন ইত্যাদি নিয়েও লিখতে ইচ্ছে করছিলো। কতটা পরিশ্রমী আর কাজপাগল মানুষ হওয়া সম্ভব সেটা তাদের দেখলেই বোঝা যায়৷ কিন্তু সেটা তোলা থাক আরেকদিনের জন্য।
শেষ করছি নোবেল বিজয়ী তিনজন বিজ্ঞানীকে অনেক অভিনন্দন জানিয়ে আর পরম শ্রদ্ধায়।