পদার্থবিজ্ঞান একটি বৈচিত্রময় বিষয়। এবং এর শাখাপ্রশাখাও সুদূরবিস্তৃত। দৈনন্দিন জীবনে আমাদের ব্যবহার্য এমন খুব কম প্রযুক্তিই আছে যেটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পদার্থবিদ্যার নিয়মকে মেনে চলে না। দানবাকার নক্ষত্রপুঞ্জের গঠন থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রাকার পরমাণু সবকিছুই ব্যাখ্যা করা যায় পদার্থবিদ্যাকে কাজে লাগিয়েই। পুরো বিশ্বজুড়েই পদার্থবিজ্ঞানভিত্তিক নানারকম প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। আমাদের দেশেও গত কয়েক বছর ধরে ফিজিক্স অলিম্পিয়াড স্কুল-কলেজে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং আন্তর্জাতিক ফিজিক্স অলিম্পিয়াডেও আমাদের ছাত্রদের ঈর্ষণীয় সাফল্য রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় তথা আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে তেমন কোন অলিম্পিয়াড না থাকলেও বেশ কিছু আন্তর্জাতিক অনলাইন প্রতিযোগিতা রয়েছে। কিছুটা দেরিতে হলেও আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীদের এগুলোতে অংশগ্রহণ বাড়ছে এবং সাফল্যও আসছে। এই পোস্টে তেমনই কিছু পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অনলাইন প্রতিযোগীতার কথা উল্লেখ করা হলো। এই লেখার মূল উদ্দেশ্য ছাত্রছাত্রীদের পদার্থবিদ্যার এইসব প্রতিযোগিতা সম্পর্কে জানানো। আমার বিশ্বাস এই প্রতিযোগিতাগুলোতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা নিদেনপক্ষে নিজেদের অবস্থানটা বুঝতে পারবে এবং পাশাপাশি কিছু দক্ষতা-অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। আর এই প্রতিযোগিতাগুলোয় অংশগ্রহণের জন্য ফিজিক্সেই পড়তে হবে এমনটা জরুরি নয়, অন্য বিভাগের পদার্থবিদ্যায় আগ্রহীরাও অংশ নিতে পারবে।
দি ইউনিভার্সিটি ফিজিক্স কম্পিটিশন
আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির পৃষ্ঠপোষকতায় গত আট বছর যাবৎ বছরের শেষভাগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্ডারগ্রাজুয়েটদের এই অনলাইন প্রতিযোগিতা হয়ে আসছে। ৪৮ ঘণ্টার ভেতরে দুটি নির্দিষ্ট বিষয়ের যে কোনো একটির উপর গবেষণামূলক প্রবন্ধ মেইলের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে হয় এই প্রতিযোগিতায়। প্রতি দলে তিনজন সদস্য এবং একজন উপদেষ্টা (শিক্ষক) থাকেন। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখার/তৈরি করার একটা ছোটখাটো অভিজ্ঞতা হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশের দলের এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ এই প্রতিযোগিতাকে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ করে তুলেছে। গবেষণা প্রবন্ধের মান অনুযায়ী স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্রোঞ্জ পদক এবং অনারেবল মেনশন (অ্যাকমপ্লিশড কম্পিটিটর) সার্টিফিকেট দেয়া হয়। বাংলাদেশে পেপ্যাল সিস্টেম না থাকায়, বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণে কোনোরূপ খরচ লাগে না। গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৪৮টি দল অংশগ্রহণ করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংশগ্রহণ করা একমাত্র দলটি রৌপ্যপদক অর্জন করে। এছাড়াও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক দল (৩৮টি) দল এতে অংশ নিয়ে ৭টি ব্রোঞ্জ পদক ও বাকি দলগুলো অনারেবল মেনশন (অ্যাকমপ্লিশড কম্পিটিটর) পায়। চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগ থেকেও এবার বেশ কয়েকটি দল অংশগ্রহণ করেছে।
ফিজিক্স ব্রাউল
মূলত রুশ/চেক ভাষাভাষীদের জন্য হলেও ইংরেজি প্রশ্নেও অংশগ্রহণ করা যায়। Brawl শব্দটির অর্থ প্রতিযোগিতামূলক মারামারি; কুস্তি বলা যেতে পারে। ফিজিক্স ব্রল মানে পদার্থবিদ্যা নিয়ে কুস্তি। এই প্রতিযোগিতায় জটিল কিছু গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে দেয়া হয়। গাণিতিক সমস্যাগুলো আসে মূলত পদার্থবিদ্যার অবশ্যপাঠ্য কিছু বিষয় থেকে; যেমন ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স, থার্মোডায়নামিক্স, সাউন্ড, ইলেকট্রনিক্স। অনেকটা প্রোগ্রামিং হ্যাকাথন স্টাইলে একটার পর একটা প্রশ্ন সমাধান করে যেতে হয় এবং নির্ধারিত সময়ের (৩ ঘণ্টার) মধ্যে যে যতটা সমাধান করতে পারে সেই অনুযায়ী মান নির্ণয় করা হয়। অন্য যে কোনো বিভাগের ছাত্রছাত্রীরাও এতে অংশ নিতে পারে, কোন অর্থ লাগে না। অনলাইন সার্টিফিকেশন হয়। এই বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগ এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ থেকে বেশ কয়েকটি দল এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে।
রুডলফ অর্টভে ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশন ইন ফিজিক্স
হাঙ্গেরীর পদার্থবিদ রুডলফ অর্টভের নামানুসারের এই প্রতিযোগিতা প্রায় চল্লিশ বছর ধরেই আঞ্চলিকভাবে হচ্ছে। তবে গত কয়েকবছর ধরে অনলাইনে বিভিন্ন দেশের পদার্থবিদ্যার ছাত্রদের অংশগ্রহণের সুযোগও রাখা হয়েছে। অনেকটাই ফিজিক্স ব্রলের মতই এখানেও গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে হয় এবং সাথে বিশ্লেষণধর্মী জবাবও দিতে হয়। কম্পিটিশনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিজয়ীদের জন্য হাঙ্গেরিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ দেয়া হয়।
ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিয়াড ইন থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স
উপরে উল্লেখিত তিনটির চেয়ে এটা জটিলতর প্রতিযোগিতা বলা চলে। চতুর্থ বর্ষ বা স্নাতক সম্পন্নকারীরাই এতে অংশগ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত ।কারণ, এতে পদার্থবিদ্যার তুলনামূলক জটিল গাণিতিক সমস্যাগুলো বা বিষয়বস্তুগুলো থাকে যেমন টেনসর, ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশন, রিলেটিভিটি, কসমোলজি, কোয়ান্টাম মেকানিক্স ইত্যাদি। এখানেও গাণিতিক ও বিশ্লেষণধর্মী জবাব উপস্থাপন করতে হয়। এই প্রতিযোগিতার মূল উদ্যোক্তা ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিঊট অব টেকনোলজির (এমআইটি) পিএইচডি গবেষকরা। বিজয়ী কিংবা স্ট্যান্ডার্ড মার্ক পাওয়া ছাত্রছাত্রীরা ওই গবেষকদের বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ পান।
এই পোস্ট লেখার পেছনে অনুপ্রেরণা ও তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন নূর মোহাম্মদ ইমরান (পদার্থবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)। এছাড়াও এইসব প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে নিচে কমেন্টবক্স ব্যাবহার করতে পারেন। অথবা মেইল করুন proyashzaman@gmail.com এ।
Helpful information ℹ️