সাপ — চাইনিজ ক্রেট এবং চাইনিজ কেউটে, সদ্য আবিষ্কৃত করোনাভাইরাসের মূল উৎস হতে পারে, যা এই শীতে চিনদেশে এক ভয়াবহ সংক্রামক শ্বাসপ্রশ্বাসের অসুখের প্রাদুর্ভাব ঘটিয়েছে। ডিসেম্বরের শেষের দিকে এই রোগটি প্রথম দেখা যায় মধ্য চীনের অন্যতম প্রধান শহর উহানে এবং এরপর থেকে তা খুব দ্রুত সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। উহান থেকে অসুস্থ ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে চীন, ইতালি, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে সংক্রামিত হয়েছে।
এই ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়। সাধারণ ফ্লু বা ঠাণ্ডা লাগার মতো করেই এ ভাইরাস ছড়ায় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। তবে এর পরিণামে দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া, নিউমোনিয়া এবং মৃত্যু ঘটারও আশঙ্কা রয়েছে।
করোনাভাইরাস শব্দটি ল্যাটিন করোনা থেকে নেওয়া হয়েছে, যার অর্থ মুকুট। কারণ ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ভাইরাসটি দেখতে অনেকটা মুকুটের মত।করোনাভাইরাস ১৯৬০-এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রথমদিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটির প্রথম দেখা মেলে। পরে সাধারণ সর্দিকাশিতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যেও এরকম দুই ধরণের ভাইরাস পাওয়া যায়। রোগীদের কাছ থেকে সংগৃহিত ভাইরাসের নমুনা ব্যবহার করে চীনের বিজ্ঞানীরা ভাইরাসটির জেনেটিক কোড নির্ধারণ করেছেন এবং মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে এর ছবিও তুলেছেন। এই মহামারীটির জন্য দায়ী রোগজীবাণুটি একটি নতুন করোনাভাইরাস। যা গত ১৭ বছরে কয়েকশ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া সিভিয়ার অ্যাকুইট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স) করোনাভাইরাস এবং মিডিল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (মার্স) করোনাভাইরাসের পরিবারভুক্ত।
স্ফটিকের গুহা: সিয়েরা ডি নেইকা, চিহুয়াহুয়া
ভাইরাসের জগতে
মেক্সিকান শহর চিহুয়াহুয়া থেকে পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে ‘সিয়েরা ডি নেইকা’ নামে একটি শুষ্ক উষর পর্বতশ্রেণী রয়েছে। ২০০০ সালের দিকে একদল খনি শ্রমিক ওই পর্বতশ্রেণীর নিম্নস্থ গুহাসমূহের এক জটিল নেটওয়ার্কে নেমে যেতে সক্ষম হন। যখন তারা ভূগর্ভে এক হাজার ফুট অবধি নামলেন, তখন তারা এমন এক জায়গার সন্ধান পেলেন যা দৃশ্যতই যেন অন্য জগতের। তাদের সামনে ছিল ত্রিশ ফুট চওড়া এবং নব্বই ফুট লম্বা একটি কুঠুরি। ছাদ, দেয়াল এবং মেঝেয় জিপসামের স্বচ্ছ স্ফটিকের আস্তরণ। অনেক গুহাতেই স্ফটিক রয়েছে, তবে সিয়েরা ডি নেইকার মতো নয়। একেকটি খণ্ডের আকার ছত্রিশ ফুটের মতো এবং ওজনেও তা পঞ্চান্ন টনের কাছাকাছি। এগুলো গলার নেকলেসে ঝোলার ক্রিস্টাল নয়, পর্বতারোহণ করার মতো বিশাল আকারের স্ফটিকখণ্ড। এটি আবিষ্কারের পর থেকে জনাকয়েক বিজ্ঞানীই এই অসাধারণ কুঠুরিটি দেখার অনুমতি পান, যা বর্তমানে স্ফটিকের গুহা হিসাবে পরিচিত। গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক হুয়ান মানুয়েল গার্সিয়া-রুইজ সেখানে যান এবং আন্দাজ করেন যে, ২৬০ লক্ষ বছর আগে আগ্নেয়গিরিসমূহ যখন পাহাড়গুলিকে গঠন করতে শুরু করে, তখন ওই স্ফটিকগুলি তৈরি হয়েছিলো। ভূগর্ভস্থ কুঠুরিগুলি আকার নেয় এবং গরম খনিজযুক্ত জলে পরিপূর্ণ হয়। আগ্নেয়গিরির ম্যাগমার উত্তাপ জলকে প্রায় ১৩৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রেখেছিলো, যা খনিজদের জল থেকে বেরিয়ে এসে স্ফটিক গঠনের জন্য আদর্শ তাপমাত্রা। কোনোভাবে জল কয়েক হাজার বছর ধরে সেই নিখুঁত তাপমাত্রায় থেকে যায়, স্ফটিকগুলিকে পরাবাস্তব আকারে বাড়তে দিয়ে।
২০০৯ সালে, আরেক বিজ্ঞানী কার্টিস সাটল, স্ফটিকের গুহা দেখতে যান। । সাটল এবং তার সহযোগীরা কুঠুরির ডোবাগুলি থেকে জল বের করে বিশ্লেষণ করার জন্য ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তাদের পরীক্ষাগারে নিয়ে আসেন। সাটলের কাজের লাইন মাথায় রাখলে বলতে হয়, ওর সেই যাত্রা নিছকই এক পণ্ডশ্রম। স্ফটিক কিংবা খনিজ নিয়ে ভদ্রলোকের কোনও পেশাদারী আগ্রহ নেই। শুধু সেগুলো কেন, কোনো ধরণের পাথরেই ওর আগ্রহ নেই। তার পড়শোনা-কাজকর্ম সব হল ভাইরাস নিয়ে।
ভাইরাসদের সংক্রামিত হওয়ার জন্য ওই ক্রিস্টালের গুহায় কোনও লোকজন ছিলো না। এমনকি কোনও মাছও নেই। গুহাটি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বর্হিবিশ্বের জীববিজ্ঞান থেকে কার্যকরভাবে বিচ্ছিন্ন। তাও সাটলের ওই পণ্ডশ্রমটি হয়ে ওঠে এক কাজের কাজ। স্ফটিকজলের নমুনা তৈরি করে তা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় রাখলে তিনি দেখতে পান জিনে পরিপূর্ণ প্রোটিনের খোলস। গুহাটির জলের হরেক ফোঁটায় থাকতে পারে বিশ কোটির মত ভাইরাস!
বিজ্ঞানীরা যেখানেই তাকান — অ্যান্টার্কটিক বরফের মাইল পুরু স্তরগুলির নীচে, সাহারা মরুভূমির গভীর বালুতে — তারা ভাইরাস খুঁজে পান। এমনকী যখন তারা পরিচিত জায়গাগুলোতেও সন্ধান করেন, তখনও আনকোরা নতুন ভাইরাস খুঁজে পেয়ে যান।
২০০৯ সালে সান দিয়েগো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী ‘ডানা উইলনার’ মানবদেহে ভাইরাস শিকারের এক অভিযান চালান। বিজ্ঞানীরা দশজন ব্যক্তিকে একটি করে কাপে কফ ফেলতে বলেন। ওদের মধ্যে পাঁচজন সিস্টিক ফাইব্রোসিসে অসুস্থ এবং বাকি পাঁচজন সম্পূর্ণ নিরোগ। তরলটির মধ্য থেকে, উইনার এবং তার দল ডিএনএর টুকরোসমূহ বেছে নেন এবং সেগুলোকে ইতোমধ্যে চিহ্নিত ও পরিচিত কয়েক মিলিয়ন জিনের ডাটাবেসের সাথে তুলনা করে দেখেন।
উইলনারের এই পরীক্ষার আগে, সুস্থ মানুষের ফুসফুসকে জীবাণুমুক্ত বলে মনে করা হতো। কিন্তুু উইলনার এবং তার সহকর্মীরা আবিষ্কার করেন যে, তাদের গবেষণায় অংশ নেওয়া অসুস্থ এবং সুস্থ, সকলেরই বুকের মধ্যে হেসে-খেলে বেড়াচ্ছে ভাইরাস। গড়ে ওই প্রতিটি মানুষের ফুসফুসে ১৭৪টি প্রজাতির ভাইরাস রয়েছে। এই প্রজাতির মাত্র ১০ শতাংশই এর আগে খুঁজে পাওয়া কোনো ভাইরাসের সঙ্গে মিলযুক্ত। বাদবাকি ৯০ শতাংশ ওই স্ফটিকগুহায় ঘাপটি মেরে থাকা কোনও কিছুর মতোই আনকোরা-অদ্ভুত। ভাইরাস নিয়ে পড়াশুনোর যে বিশেষ শাখা, সেই ভাইরোলজির বিজ্ঞান এখনও তার আদিম, বন্য দিনগুলিতে রয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা ভাইরাসগুলিকে পুরেপুরিভাবে বুঝে ওঠার চেয়েও দ্রুতগতিতে নিত্যনতুন ভাইরাস আবিষ্কার করছেন। তবুও এই জ্ঞান সূচনামাত্রই, কারণ আমরা কয়েক হাজার বছর ধরে ভাইরাস সম্পর্কে জানি। আমরা তাদের চিনতে পেরেছি তাদের প্রভাব থেকে, আমাদের অসুস্থতায় এবং মৃত্যুতে। বহু শতাব্দী ধরে আমরা জানতাম না কীভাবে এর কার্যকারণ মেলানো যায়। ভাইরাস শব্দটিই গোলমেলে, বিতর্কিত। আমরা রোমান সাম্রাজ্যের কাছ থেকে শব্দটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি, যেখানে এর অর্থ একাধারে সাপের বিষ বা মানুষের বীর্য। একই শব্দে সৃষ্টি ও ধ্বংস।
তামাক গাছে টোবাক্যো মোজাইক ভাইরাসের সংক্রমন
কয়েক শতাব্দী ধরে ভাইরাস অন্য অর্থ গ্রহণ করছিল: এটি এমন কোনো সংক্রামক পদার্থ, যা কিনা রোগ ছড়াতে পারে। এটি কোনও ঘা থেকে বেরোনো স্রাবের মতো তরল হতে পারে। এমন একটি পদার্থ হতে পারে, যা বাতাসের মাধ্যমে রহস্যজনকভাবে ভ্রমণ করে। এমনকি এটি কোনও কাগজের টুকরোকে ভেদ করে ছড়িয়ে গিয়ে, আঙুলের ছোঁয়ায় রোগ ছড়িয়ে দিতে পারে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ঘটে যাওয়া এক কৃষি বিপর্যয়ের দৌলতে ভাইরাস তার আধুনিক অর্থ গ্রহণ শুরু করে। নেদারল্যান্ডসে তামাকের খামারগুলোতে এমন এক রোগ ছড়িয়ে পড়েছিলো যে গাছগুলোর বৃদ্ধি থেমে যায়, গোটা দেহে পড়ে থাকে এলোমেলো আকারের মোজাইকের মতো জীবিত এবং মৃত কোষ ও কলার স্তর। এতে ব্যাপক হারে বহু তামাক খামার বন্ধ করে দিতে হয়।
১৮৭৯ সালে, ওলন্দাজ চাষীরা সাহায্যের জন্য এক তরুণ কৃষি রসায়নবিদ অ্যাডলফ মায়ারের শরণাপন্ন হন। মায়ার খুব সতর্কতার সঙ্গে এই বিপর্যয়টিকে খতিয়ে দেখে অসুখটির নাম রাখেন ‘টোবাক্যো মোজাইক রোগ’। যে পরিবেশে গাছগুলো বৃদ্ধি পেয়েছিলো – তিনি সেই মাটি, তাপমাত্রা, সূর্যের আলো সবকিছুর তদন্ত করেছিলেন। তবে রোগগ্রস্ত উদ্ভিদ থেকে স্বাস্থ্যকর উদ্ভিদের মধ্যে আলাদা করার মতো কিছুই খুঁজে পেলেন না। তার ধারণা হলো, গাছগুলো কোনো এক অদৃশ্য সংক্রমণে ভুগছে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা ততদিনে প্রমাণ করেছিলেন যে, ছত্রাক আলু এবং অন্যান্য গাছগুলিতে সংক্রামিত হতে পারে। তাই মায়ারও তামাকের গাছগুলিতে ছত্রাকের সন্ধান করেন, কিন্তু কিছুই পেলেন না। তিনি পরজীবি কৃমির সন্ধান করেছিলেন, যা সম্ভবত পাতাগুলোয় বংশবৃদ্ধি করছে। না, কোথাও কিছু নেই।
অবশেষে মায়ার অসুস্থ গাছগুলো থেকে রস বের করে স্বাস্থ্যকর তামাক গাছের মধ্যে ফোঁটা ফোঁটা ইনজেক্ট করেন। মায়ার দেখলেন, স্বাস্থ্যকর গাছগুলিও এবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিছু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব তাহলে অবশ্যই গাছগুলির অভ্যন্তরে বহুগুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মায়ার অসুস্থ উদ্ভিদের কাছ থেকে যে রস সংগ্রহ করেছিলেন, সেগুলোকে তার পরীক্ষাগারে বিকশিত হতে দেন। ব্যাকটেরিয়ার উপনিবেশ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং তা এমন যথেষ্ট পরিমাণে বড় হয়ে যায় যে মায়ার তাদের খালি চোখে দেখতে পান। মায়ার সুস্থ গাছগুলিতে ওই ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগ করেন এটি তামাক মোজাইক রোগের সৃষ্টি করে কি না, এটা দেখার জন্য। এই পরীক্ষা ব্যর্থ হয় এবং এই ব্যর্থতার সাথে মায়ারের গবেষণায়ও সমাপ্তি ঘটে।
কয়েক বছর পরে, ‘মার্টিনাস বেইজেরিঙ্ক’ নামে আরেক ওলন্দাজ বিজ্ঞানী মায়ার যেখানটায় থেমে গেছিলেন, সেখান থেকে আবার কাজ শুরু করেন। তার ধারণা ছিলো যে, ব্যাকটেরিয়া ছাড়া যদি অন্য কিছু তামাক মোজাইক রোগের জন্য দায়ী হয়, এরা তার থেকেও বহুগুণে ছোট কিছু হবে। তিনি রোগাক্রান্ত গাছপালায় ওই ধরণের তরল একটি সূক্ষ্ম ফিল্টারের মাধ্যমে প্রবেশ করান। ফিল্টারটি গাছের কোষ এবং ব্যাকটেরিয়া দুটোকেই আটকায়। পরে তিনি যখন সুস্থ উদ্ভিদের মধ্যে পরিশোধিত তরলটি ইনজেক্ট করলেন, তারা অসুস্থ হয়ে পড়লো। বেইজেরিঙ্ক নতুন সংক্রামিত গাছ থেকে রস ফিল্টার করে আবিষ্কার করলেন যে, তিনি আরও অনেক তামাক গাছকে সংক্রামিত করতে পারেন। সংক্রামিত গাছের রসে রয়েছে ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে ছোট এমন কিছু — যা নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এবং রোগ ছড়াতে পারে। বেইজেরিঙ্ক একে অভিহিত করেন এক “সংক্রামক জীবিত তরল” হিসেবে।
‘সংক্রামক জীবন্ত তরল’ যা-ই বহন করে না কেন তা জীববিজ্ঞানীদের জানা অন্য যে কোন লাইফ ফর্ম থেকে আলাদা। এটি যে কেবল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তা-ই নয়, বেশ শক্তিধরও বটে। বেইজেরিঙ্ক ফিল্টার করা তরলটিতে অ্যালকোহলের মত জিনিষ মেশালে দেখা যাচ্ছে তাদের ওপর কোনও প্রভাব পড়ছে না। যে পরিমাণ তাপে জল ফুটে, সেই স্ফুটনাঙ্কের কাছাকাছি গরম করলেও তাদের কোনো ক্ষতি হয় না। বেইজেরিঙ্ক ওই সংক্রামক তরলে ফিল্টার কাগজ ভিজিয়ে শুকোতে দিলেন। তিন মাস পর, ওই কাগজটি জলে ডুবিয়ে সেই জল দিয়ে আরও অনেক তামাক গাছকে অসুস্থ করতে পারলেন।
বেইজেরিঙ্ক তার সংক্রামক জীবন্ত তরলটিতে থাকা রহস্যময় এজেন্টকে বর্ণনা করতে ভাইরাস শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। আজকে আমরা যেভাবে শব্দটি যে অর্থে ব্যবহার করেছি, এটি সেই অর্থে প্রথমবার। বেইজেরিঙ্ক কেবল ভাইরাসগুলির সংজ্ঞা দেওয়ার জন্য যে অর্থে এটি ব্যবহার করেছিলেন, তারা ঠিক তা নয়। তারা প্রাণী, উদ্ভিদ, ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া ছিল না। তারা ঠিক কী ছিল, বেইজেরিঙ্ক বলতে পারেননি। উনিশ শতকের বিজ্ঞান যা প্রকাশ করতে পারে, তিনি তার শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়েছিলেন।
ভাইরাসগুলোকে গভীরভাবে বুঝার জন্য আরও ভাল সরঞ্জাম এবং আরও ভাল আইডিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ বিজ্ঞানীদের ভাইরাসগুলো দেখতে দেয়: যা প্রায় ছোট ছোট আকারের কণা। তুলনার জন্য, শেকার (Shaker) থেকে নুনের একটি দানা ঝাঁকিয়ে হাতে ফেলুন। আপনি এর একপাশে প্রায় দশটি ত্বকের কোষ দাঁড় করাতে পারেন। একশোটি ব্যাক্টেরিয়া যার সমান। যদিও ভাইরাসের সাথে তুলনা করলেও, ব্যাকটেরিয়া দৈত্যাকার। আপনি ওই একই লবণের দানার পাশাপাশি এক হাজার ভাইরাস রাখতে পারবেন।
ভাইরাস ছোট আকারের হওয়া সত্ত্বেও, বিজ্ঞানীরা এগুলোকে বিভিন্ন অংশে পৃথক করার এবং ভেতরে সঙ্গীবদ্ধ করার উপায়গুলি আবিষ্কার করেছেন। একটি মানব কোষকে লক্ষ লক্ষ বিভিন্ন অণু দিয়ে ভরাট করা হয়, যা খাদ্য গ্রহণ করে, বেড়ে ওঠে এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে, দুটি অংশে বিভক্ত হবে বা তার সহকোষের ভালোর জন্য নিজেকে হত্যা করবে। ভাইরোলজিস্টরা দেখতে পেয়েছেন যে, তারা যে ভাইরাসগুলোকে অধ্যয়ন করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকগুলি হলো সামান্য কয়েকটি জিনকে ঘিরে রাখা প্রোটিন খোলস। তারা আবিষ্কার করেছেন যে, ভাইরাসগুলি তাদের অতি তুচ্ছ জেনেটিক নির্দেশনাবলী সত্ত্বেও জীবনের অন্যান্য ধরণগুলোকে ছিনতাই করে নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। তারা দেখলেন, ভাইরাসগুলো তাদের জিন এবং প্রোটিনকে তাদের আশ্রয়দাতা কোষে প্রবেশ করায়, যাকে তারা বাধ্য করেছে ভাইরাসের নতুন নতুন কপি বা অনুলিপি তৈরি করতে। হয়তোবা মাত্র একটি ভাইরাসই কোষে প্রবেশ করতে সক্ষম হয় এবং একদিনের মাথায়ই হাজার হাজার ভাইরাস বেরিয়ে আসে।
ভাইরোলজিস্টরা ৫০-এর দশকের মধ্যে এই মৌলিক তথ্যগুলি উপলব্ধি করেছিলেন। তবে ভাইরোলজি স্তব্ধ হয়ে যায়নি। একটি কারণ, ভাইরাসরা আমাদের কী কী আলাদা উপায়ে অসুস্থ করে তুলতে পারে, সে বিষয়ে তারা কিছুই জানতেন না। জানতেন না যে, পেপিলোমাভাইরাস খরগোশের মাথার উপর শিং গজাতে পারে এবং প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ জরায়ুর ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। তারা জানতেন না যে, কী কারণে কিছু ভাইরাস মারাত্মক এবং কিছু ভাইরাস তুলনামূলকভাবে নিরীহ। তাদের এখনো জানা বাকি, ভাইরাসগুলি কীভাবে তাদের হোস্টগুলির প্রতিরক্ষা থেকে রক্ষা পায় এবং এই গ্রহের অন্য যে কোনও কিছুর চেয়ে কীভাবে তারা দ্রুত বিকশিত হয়।১৯৫০ এর দশকে তারা জানতেন না যে, এইচআইভি নামক এক ভাইরাস শিম্পাঞ্জি থেকে ইতিমধ্যে আমাদের নিজস্ব প্রজাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে বা তিরিশ বছর পরে যে এটি ইতিহাসের অন্যতম বড় হত্যাকারী হয়ে উঠবে। পৃথিবীতে যে বিপুলসংখ্যক ভাইরাস রয়েছে, তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি; তারা অনুমান করতে পারেননি যে, জীবনের বেশিরভাগ জিনগত বৈচিত্র্য ভাইরাস জিনে বিদ্যমান। তারা জানতেন না যে, ভাইরাসগুলি আমাদের শ্বাস নেয়ায় প্রয়োজনীয় যে অক্সিজেন, তার অনেকটুকু উৎপাদন করে এবং গ্রহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এবং অবশ্যই তারা কল্পনাও করতে পারেননি যে, আমাদের মানবজিনোম অংশত হাজার হাজার ভাইরাস দিয়ে গঠিত, যা আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের সংক্রমিত করেছিল কিংবা যে জীবনটাকে আমরা চিনি, তা ৪০০ কোটি বছর আগে ভাইরাসদের হাত ধরে শুরু হয়েছিলো। এখনকার বিজ্ঞানীরা এই জিনিসগুলো জানেন। তারা এখন স্বীকার করেন, স্ফটিকের ওই গুহা থেকে শুরু করে মানব দেহের অভ্যন্তরীণ জগত, এটি হলো ভাইরাসদের গ্রহ। তাদের পড়াশোনা এখনও মোটামুটি স্তরের, কিন্তু এটা শুরু। তাহলে আমাদেরও শুরু করা যাক।