বর্তমান পোস্ট-মডার্ন যুগের ভালোবাসায় কখনো লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, ইউসুফ-জোলেখা কিংবা কৃষ্ণকলিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফরাসি বিপ্লব, রেঁনেঁসা কিংবা শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে যে যুগের সূচনা হয়েছে সেখানে ভালোবাসার ধরনেও যে পরিবর্তন আসবে না; এমনটা না ভাবাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আধুনিকতার ধারণাটি যখন থেকে মানব মস্তিষ্কে প্রবেশ করেছে ঠিক তখন থেকেই পারিবারিক জীবন, দাম্পত্য জীবন, প্রেম, ভালোবাসা, বিবাহবিচ্ছেদ সবকিছুর মধ্যেই পরিবর্তন এসেছে। এ নিয়ে বর্তমান যুগের সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে বেশ মাথাব্যথা আছে! ভালোবাসা নিয়ে কথা বলেছেন তাঁর মধ্যে Anthony Giddens, Zygmunt Bauman, এবং Ulrich Beck এর নাম আমি উল্লেখ করছি। কেননা আমি এদের হাত ধরেই এই নোট’টি লেখা শেষ করবো। আমরা এক এক করে দেখি তাহলে কে কিভাবে বর্তমান ভালোবাসাকে ব্যাখ্যা করেছেন।
১। Anthony Giddens & Plastic Sexuality
সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীমাত্রই গিডেন্সের সাথে পরিচিত। কেননা গিডেন্সের হাত ধরেই সমাজবিজ্ঞানের এক অন্যরকম জগতে প্রবেশ করতে হয়। এই ভদ্রলোক বর্তমান সময়ের ভালোবাসাকে ‘প্লাস্টিক সেক্সুয়ালিটি’ বলে সম্মোধন করেছেন। তিনি তাঁর “The Transformation of Intimacy: Sexuality, Love, and Eroticism in Modern Societies” গ্রন্থে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।
তাঁর মতে এই পোস্ট মডার্ন যুগে নারীরা যৌন দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে। পুরুষের মতো নারীরা এখন চাইলেই ‘সেক্স’কে উপভোগের বিষয়ে পরিণত করতে পারছে। বর্তমান প্রযুক্তি নারীকে পূর্বেকার মতো ‘গর্ভধারণ’ কিংবা ‘বাচ্চা লালন’ করার দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি দিয়েছে, এবং সেক্স হয়ে উঠেছে উপভোগের বিষয়। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের গর্ভনিরোধক পিল, কিংবা কনডমের ব্যবহারের ফলে নারীর আর গর্ভবতী হওয়ার ভয় নেই। যদি গর্ভবতী হয়েও যায় তবে প্রযুক্তির কল্যাণে গর্ভপাত করেও নিরাপদ থাকতে পারছে। ঠিক এ কারণে সেক্সের প্রতি নারীর আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা দুই’ই বেড়ে গেছে।
এছাড়াও বর্তমানে একজন নারী কিংবা পুরুষ তাঁর সঙ্গীনীর কাছ থেকে পরিপূর্ণ সুখ পেতে ব্যর্থ হলে সহজেই অন্য আরেকজন পার্টনার খুঁজে নেওয়ার অপশন পাচ্ছে। অতীতের মতো একজনের সাথে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়ার মতো কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে না। যৌনতাকে নিজের মতো করে উপভোগ করার এই শিথিলতা থেকে “প্লাস্টিক সেক্সুয়ালিটি” ধারণাটি এসেছে।
এই বিষয়ে গিডেন্স তাঁর “The Transformation of Intimacy: Sexuality, Love, and Eroticism in Modern Societies” গ্রন্থে বলেছেন,
The emergence of what I term plastic sexuality is crucial to the emancipation implicit in the pure relationship, as well as to women’s claim to sexual pleasure. Plastic sexuality is decentered sexuality, freed from the needs of reproduction. It has its origins in the tendency, initiated somewhere in the late eighteenth century, strictly to limit family size; but it becomes further developed later as the result of the spread of modern contraception and new reproductive technologies. Plastic sexuality can be moulded as a trait of personality and thus is intrinsically bound up with the self. At the same time – in principle – it frees sexuality from the rule of the phallus, from the overweening importance of male sexual experience.
২. Zygmunt Bauman & ‘Liquid Love’
পোল্যান্ডের বাউমান নামক এক সমাজবিজ্ঞানী বর্তমান ভালোবাসাকে ‘তরল ভালোবাসা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। উনার মতে বর্তমান ভালোবাসা হচ্ছে তরল পদার্থের মতো। যখন যে পাত্রে রাখা হয়, তার আকার ধারণ করে। আরেকটু গুছিয়ে বললে বলা যায়, কঠিন পদার্থের বন্ধন আলাদা আলাদা হতে হতে তা যেমন তরলে পরিণত হয়, ঠিক তেমনি বর্তমান সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তাই প্রযোগ্য। এটার ব্যাখ্যার জন্য তিনি ‘Semi-detached’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
বর্তমানে কাছের মানুষগুলো যেন কাছে থেকেও কাছে নেই, কাছের মানুষের প্রতি মানুষের টান নেই, কারো প্রতি কারো কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যে যেখানে যেভাবে সুখ পাচ্ছে সেখানে সেভাবেই চলে যাচ্ছে। বর্তমানে আমরা কাছের মানুষ বাদ দিয়ে অনলাইন জগতের অজানা-অদেখা-অপরিচিত মানুষজনকে আপন করে নিচ্ছি, তাদের কাছে নিজেদের আবেগ ভাগ-বাঁটোয়ারা করছি, বর্তমান সঙ্গী বা সঙ্গিনীর কাছে সুখ না পেলে অন্য সঙ্গীকে খোঁজ করছি; অর্থাৎ সবকিছুই যেন অবস্থার সাথে মানিয়ে নেওয়ায় ব্যস্ত। একজন সঙ্গী চলে যাওয়ার পর আমরা আরেকজনে খুঁজছি, নতুন করে সব শুরু করছি। আমরা একজন আরেকজনের কাছ থেকে ক্রমেই আলাদা হয়ে পড়ছি, এবং এভাবেই চলছে। এজন্যই বাউমান এটাকে ‘তরল ভালোবাসা’ বলেছেন।
এছাড়াও বাউমান বর্তমান ভালোবাসাকে ‘Top Pocket love’ বলেও সম্মোধন করেছেন। আমরা আমাদের শার্টের টপ পকেটে অর্থাৎ বুক পকেটে যেমন খুব বেশি দরকারী কোনো জিনিস রাখি না, এই পকেটে থেকে কোনো জিনিস হারিয়ে গেলে আমরা যেমন খুব সহজেই সেটা পূরণ করতে পারি, বর্তমান ভালোবাসাও ঠিক তেমন।
৩. Ulrich Beck & Chaotic Love
বেক নামক এই সমাজবিজ্ঞানী ১৯৪৪ সালে জার্মানীতে জন্মগ্রহণ করেছেন। উনার খুব জনপ্রিয় কিছু কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে ‘Normal Chaos of Love’ অর্থাৎ ‘সাধারণ গোলমেলে ভালোবাসা’। বর্তমান সময়ের ভালোবাসাকে উনি গোলমেলেভাবেই দেখেছেন, তবে এই গোলমালটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই, এটা সাধারণ গোলমাল। 🙂
বর্তমান সময়ে নারী-পুরুষ উভয়ই ঘরের বাহিরে কাজ করছেন, চাকুরী করছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে ঘরের কাজগুলো শুধুমাত্র একা নারীকেই একা সামলাতে হচ্ছে। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দুজনেই দুজনের গণতান্ত্রিক মনোভাব অর্থাৎ ‘আমার যা খুশি আমি তাই করবো’ ব্যক্ত করে। দ্বন্দ্ব বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে এদের ডিভোর্স হয়।
এখানেই শেষ নয়!
এরপর ডিভোর্সী নারী-পুরুষ দুজনেই আবার নতুন সঙ্গী/সঙ্গিনীকে খুঁজে নেন। আবার কোনো কারণে তাঁদের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, আবার ডিভোর্স হয়। এভাবেই চলতে থাকে আমরণ। বেক’র মতানুযায়ী মডার্ন যুগের ‘Romantic love’ পোস্ট-মডার্ণ যুগে ‘Chaotic Love’ অর্থাৎ গোলমেলে ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে।
প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গোলমেলে ভালোবাসা (chaotic love) দেখা যাচ্ছে। সম্পর্ক স্থাপনের কিছুদিন পরে যখন একজনের সাথে মতের অমিল হচ্ছে, কিংবা কোনো কারণে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে তখন তারা ব্রেক আপ করে। কেউ কেউ এটাকে ‘মিউচুয়াল ব্রেক আপ’ বলেও সম্মোধন করে থাকেন। এছাড়াও দেখা যায় প্রেম করার এক পর্যায়ে তার সঙ্গী বা সঙ্গিনী অন্য কারো সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে সে তখন অন্য কাউকে খুঁজে নেয়, মতের মিল না হলে সেখানেও গোলমাল শুরু হয়, তারপর হয় ব্রেক আপ! এভাবেই চলতে থাকে!
এই হলো মোটামুটি আমাদের ভালোবাসার বিশ্লেষণ। আপাতত আজকের মতোই এখানেই ইতি টানছি। পরে আবার অন্য কোনো বিষয়ে, অন্য কোনো সময় কথা হবে। 🙂