রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। শুনতে পেলেন দূর থেকে একটা এম্বুলেন্স ছুটে আসছে। তীক্ষ্ম সাইরেনের শব্দ কানে আসছে। হুশ করে এম্বুলেন্সটা সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো, আর সাইরেনের শব্দও ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো। যখন এম্বুলেন্স ছুটে আসছিলো, তখন সাইরেনের আওয়াজ তীক্ষ্ম হতে তীক্ষ্মতর হচ্ছিলো। আর যখন এম্বুলেন্স আপনাকে পাশ কাটিয়ে গেলো, তখন সেটা ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকলো। এটাকে বলা হয় ‘ডপলার এফেক্ট’।
একটা স্থির উৎস হতে যখন শব্দ নির্গত হয়, তখন সেই শব্দতরঙ্গ চারপাশের পরিবেশে সুষম গোলক আকৃতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু শব্দ উৎসটা যদি চলমান থাকে, তাহলে ‘ডপলার প্রভাব’ অনুযায়ী, উৎস যেদিকে চলছে সেদিকে তরঙ্গের তীক্ষ্মতা বাড়ে এবং বিপরীতপাশে কমে। কারণ, উৎসটার চলার দিকের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা Wavelength কমে এবং Frequency বাড়ে। একইভাবে চলার পথের বিপরীত দিকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়ে এবং ফ্রিকুয়েন্সি কমে । কোনো শব্দতরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য যতো কমে, অর্থাৎ ফ্রিকুয়েন্সি যতো বাড়ে, শব্দটা শুনতে ততো তীক্ষ্ম হয়। উপরের উদাহরণেও তাই ঘটেছে। অ্যাম্বুলেন্স আপনার দিকে এগিয়ে আসার সময় শব্দ তীক্ষ্ম হয়েছে, পাশ কাটিয়ে যেতেই সেটা ভোঁতা হয়ে ক্রমশ মিলিয়ে গেছে।
এটা তো গেলো শব্দতরঙ্গের ক্ষেত্রে। আলোকতরঙ্গের ক্ষেত্রে কী হয়?
তার আগে বলে নিই, আমরা তরঙ্গের সাগরে ডুবে থাকলেও খুব সামান্য পরিমাণ তরঙ্গই দৃশ্যমান আলো হিসেবে আমাদের চোখে ধরা পড়ে। এর মধ্যে লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি এবং ফ্রিকুয়েন্সি সবচেয়ে কম। আবার বেগুনী আলোর ক্ষেত্রে তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম এবং ফ্রিকুয়েন্সি সবচেয়ে বেশি।
এই কথা মাথায় রেখে এবারে সামনে চলুন। ধরুন, পৃথিবীর দিকে একটা পুরো গ্যালাক্সি ছুটে আসছে। ওটা স্থির থাকলে নিশ্চয়ই সুষম গোলক আকৃতিতে চারপাশে আলোকতরঙ্গ ছড়াতো। এখন যেহেতু মহাবিশ্বে কোনোকিছুই স্থির নয়, সেহেতু গ্যালাক্সিটাও স্থির থাকার কথা নয়। তাই পৃথিবীর দিকে ছুটে আসার দরুণ ওটার বিকিরিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য পৃথিবীর দিকে থাকবে কম এবং বস্তুটার চলার পথের উল্টোপাশে থাকবে বেশি। আর আমাদের দৃশ্যমান আলোর চিত্রটা থেকে জানি, তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কমতে থাকবে বস্তুটার আলো তত বেগুনী রঙের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে এবং বাড়তে থাকলে লাল রঙের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে। তার মানে, গ্যালাক্সিটার বিকিরিত আলো বিকিরণের শুরুতে যা-ই ছিলো, সেখান থেকে সরে বেগুনীর দিকে অগ্রসর হয়ে আমাদের চোখে ধরা পড়ার কথা। এখন গ্যালাক্সিটা যদি পৃথিবীর দিকে না এসে ক্রমাগত দূরে সরে যায়, তাহলে বলা যায়, সেটার আলো বিকিরণের শুরুতে যা-ই ছিলো সেখান থেকে লালের দিকে অগ্রসর হয়ে আমাদের চোখে ধরা পড়ার কথা। এই ব্যাপারটাকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘রেডশিফট (Redshift)’। কোনো মহাজাগতিক বস্তু যদি পৃথিবীর কাছাকাছি আসতে থাকে, তখন সেটা নেগেটিভ রেডশিফট (এটাকে ব্লুশিফট-ও বলা হয়) প্রদর্শন করে। সিরিয়াস (Sirius) নক্ষত্র এবং অ্যান্ড্রোমিডা (Andromeda) গ্যালাক্সি নেগেটিভ রেডশিফট প্রদর্শন করে পৃথিবীতে. আবার কোনো মহাজাগতিক বস্তু যখন পৃথিবী থেকে দূরে সরে যেতে থাকে, সেটা প্রদর্শন করে পজিটিভ রেডশিফট। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধিকাংশ নক্ষত্র এবং ছায়াপথই পৃথিবীতে পজিটিভ রেডশিফট প্রদর্শন করে।
এখন বলতে পারেন, কই ভাই? আমি তো আমার চারপাশে রেডশিফট ঘটতে দেখি না। ঐ যে দেখেন, একটা ট্রাক ছুটে আসছে আমাদের দিকে। ঐটা তো নেগেটিভ রেডশিফট বা ব্লুশিফট হচ্ছে না!
আসলে আমাদের চারপাশের জগতেও ডপলার শিফট হয় খুব সামান্য পরিমাণে হলেও। আমরা শব্দতরঙ্গের ক্ষেত্রে কানে ডপলার শিফট উপলব্ধি করতে পারি, কিন্তু আলোকতরঙ্গের ক্ষেত্রে এই সামান্য ডপলার শিফটটা আমাদের চোখ উপলব্ধি করতে পারে না। তবে আলোকতরঙ্গের এই ডপলার শিফটের উপরে ভিত্তি করে একটা যন্ত্র আমরা ঠিকই বানিয়ে নিয়েছি। উন্নত বিশ্বের রাস্তাঘাটে এটা ব্যবহৃতও হয়। যন্ত্রটার নাম হচ্ছে ‘রাডার গান‘। এটা রাস্তায় কোন গাড়ি কতো বেগে ছুটছে, সেটা মনিটরিং করে। নির্দিষ্ট গতিবেগের কম বা বেশি গতির কোনো গাড়ি পেলেই সেটাকে নোট করে এবং ছবি তুলে রাখে।
এমনকী মহাশূন্যের কোনো বস্তু সরাসরি লাল বা নীল আলো হয়ে আমাদের চোখে ধরা পড়লেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসি না যে, এটা পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কিংবা এর কাছাকাছি আসছে। সেটা নির্ধারণের জন্যেও একটা সিস্টেম আছে। অনেক জায়ান্ট স্টারের রঙ নীল হয়, আবার লাল বামন নক্ষত্রও আছে অনেক।
একটা পদ্ধতি হচ্ছে, প্রথমে একটা গ্যাসের মাঝ দিয়ে আলোকে ছুটে যেতে দেয়া হলো। যেহেতু আমাদের মহাবিশ্বের বেশিরভাগ পদার্থই হচ্ছে হাইড্রোজেন, সেহেতু ধরা যাক, হাইড্রোজেনের মাঝ দিয়ে আলো ছুটে যেতে দেয়া হলো। এর ফলে হাইড্রোজেনের জন্যে একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নের বর্ণালী পাওয়া যাবে। ঐ প্যাটার্নে কিছুদূর পর পর কালো দাগ পাওয়া যাবে। এর মানে হচ্ছে, ঐ ফ্রিকুয়েন্সির তরঙ্গগুলো হাইড্রোজেন শুষে ফেলেছে। এই প্যাটার্নটাকে আমরা স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে রেখে দিলাম আমাদের কাছে।
এবারে একটা নক্ষত্র কিংবা গ্যালাক্সির আলোকে ল্যাবরেটরিতে একটা হাইড্রোজেনের মাঝ দিয়ে যেতে দেয়া হলো। তাতে আবারো একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নের বর্ণালী (Spectrum) পাওয়া যাবে। এই বর্ণালীটাকে এবার মিলানো হবে আগের তৈরি করা স্ট্যান্ডার্ডের সাথে। যদি প্যাটার্নের প্রবণতা হয় নীল আলোর দিকে সরে যাওয়ার, তাহলে সেটা হচ্ছে নেগেটিভ রেডশিফট (বা ব্লুশিফট) – মানে নক্ষত্র কিংবা গ্যালাক্সিটা পৃথিবীর দিকে এগিয়ে আসছে। আর যদি দেখা যায়, প্যাটার্নটা লাল রংয়ের আলোর দিকে সরে যাচ্ছে, তাহলে সেটা হবে পজিটিভ রেডশিফট – মানে নক্ষত্র কিংবা গ্যালাক্সি পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর যদি নক্ষত্রটার রঙই হয় লাল, সেক্ষেত্রে প্যাটার্নটা এক ফোঁটা তার জায়গা থেকে নড়বে না। তার মানে লাল রঙের নক্ষত্রের ক্ষেত্রে প্যাটার্ন এদিক-সেদিক সরে গেলে সেটা হবে রেডশিফটের কারণে, তার নিজের রঙ লাল বলে নয়।
সব পদার্থেরই এমন একটা নিজস্ব প্যাটার্নের বর্ণালী আছে। বিজ্ঞানীরা চাইলে বর্ণালী বিশ্লেষণ করে শুধু রেডশিফট-ব্লুশিফট না, গ্রহ কিংবা নক্ষত্রে কী কী পদার্থ কতো পরিমাণে আছে, সেটাও বের করে দিতে পারবেন। এটাকে বিজ্ঞানীরা তুলনা করেন মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচিংয়ের সাথে।
রেডশিফটকে বাজারে পাওয়া যায় তিনটে ফ্লেভারে-
১। ডপলার রেডশিফট – প্রথম ছবির এম্বুলেন্সের মতো। মহাবিশ্বের কোনো বস্তুর সাপেক্ষে আমাদের চলার গতির দিক অনুযায়ী এই রেডশিফট হয়। এটা পজিটিভ নেগেটিভ দু’টোই হতে পারে।
২। কসমোলজিক্যাল রেডশিফট – মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। তাই এর ভিতরে অবস্থানকারী বস্তুগুলোও একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে ঘটছে রেডশিফট। আগেরটার সাথে তুলনা করে বুঝতেই পারছেন, এই ক্ষেত্রে নেগেটিভ রেডশিফট পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ এই ক্ষেত্রে কেউ কারো কাছে আসছে না, ক্রমাগত দূরেই সরে যাচ্ছে।
৩। গ্র্যাভিটেশনাল রেডশিফট – এটা একটা বিশেষ ক্যাটাগরির রেডশিফট। ব্ল্যাক হোল থেকে যখন ফোটন কণা ছুটে পালাতে চায় এবং সক্ষম হয়, তখন তাকে অনেক এনার্জি হারাতে হয়। ফলে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিস্তার হয় এবং রেডশিফট ঘটে। উচ্চ ভরের কোনো বস্তুর আকর্ষণ থেকে পালাতেও ফোটন কণার কিছু শক্তি খরচ করতে হয়। ফলে তরঙ্গটার রেডশিফট ঘটে।
একটা গ্যালাক্সি থেকে ছুটে আসা আলোতে ডপলার এবং কসমোলজিক্যাল রেডশিফট দুটোই থাকে। এদের কোনটার অংশ কতোটুকু, সেটা আলাদা করার অনেক নিয়মকানুন আছে বিজ্ঞানীদের হাতে। এর মধ্যে ‘ফোটন এজিং (Photon aging)’ একটা। যদিও ধরা হয় ফোটন একটা ভরশূন্য কণা, কিন্তু আধুনিক তথ্য-উপাত্ত থেকে ধারণা করা হয় ফোটনের খুব সামান্য পরিমাণে হলেও ভর আছে। আর ভর থাকলে সময়ের সাথে সাথে সেটার ক্ষয়ও আছে। বিজ্ঞানী Julian Heeck ২০১৩ সালে তাঁর এক বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নালে যা উপস্থাপন করেছিলেন সেটা সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, ফোটনের আয়ুষ্কাল আমাদের মানুষদের টাইমস্কেলে মোটামুটি ১০^১৮ বছর!
আরো জানতে-
=============
১। https://www.space.com/25732-redshift-blueshift.html
২। https://en.wikipedia.org/wiki/Redshift
৩। লাল রঙের নক্ষত্র হতে রেডশিফট কীভাবে আলাদা করা হয় – https://www.quora.com/How-do-astronomers-tell-the-difference-between-stars-that-are-different-amounts-of-red-shift-vs-stars-that-are-just-different-colors
৪। ইউটিউব লিংক – https://www.youtube.com/watch?v=FhfnqboacV0
৫। জুলিয়ান হিকের জার্নাল – https://journals.aps.org/prl/abstract/10.1103/PhysRevLett.111.021801