মানবজাতির ইতিহাসের অধিকাংশ সময়েই প্রযুক্তি ছিল আমাদের মস্তিষ্ক, আগুন, এবং বর্শার সমন্বয়। কালের বিবর্তনে আজ আগুন পরিণত হয়েছে পরমাণবিক চুল্লীতে এবং বর্শা পরিণত হয়েছে পরমাণবিক আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রে। একইসাথে আমাদের মস্তিষ্কেরও অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে যুগে যুগে। একারণে বিংশ শতাব্দীতে কম্পিউটার আবিষ্কারের পর হতে এর আকৃতি হ্রাস পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রথমদিকে কম্পিউটার মানে ছিলো ঘরভর্তি যন্ত্রপাতি। আর আজ সেটা আমাদের হাতের মুঠোয় স্মার্টফোন হিসেবে। কিন্তু মানবজাতির এ উদ্ভাবিত প্রযুক্তি আজ তার সর্বোচ্চ সীমানার দ্বারপ্রান্তে। ব্যাপারটি বুঝতে হলে প্রথমেই কিছু বেসিক জিনিস আলোচনা করা প্রয়োজন।
কম্পিউটার কীভাবে কাজ করে?
কম্পিউটারের অভ্যন্তরে রয়েছে কম্পিউটার চিপ। আর এ চীপের ভেতরে রয়েছে বেসিক মডিউল। বেসিক মডিউলগুলো আবার লজিক গেট দ্বারা তৈরী। আর লজিক গেট তৈরি হয় কতিপয় ট্রানজিস্টারের সমন্বয়ে। ট্রানজিস্টার হলো কম্পিউটারের ডেটা প্রসেস করার সাধারণ একক। ট্রানজিস্টার মূলত একটি সুইচ যেটা তথ্য প্রবাহকে বন্ধ এবং চালু করতে পারে। আমরা বাসায় যে ইলেকট্রিক্যাল সুইচ ব্যবহার করি সেরকম, অন এবং অফ। কম্পিউটারের এ তথ্যগুলো তৈরী হয় বিট দিয়ে। একটি বিট দুইটি মানের যেকোনো একটি হতে পারে ০ এবং ১। বিটের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে তথ্যের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা যায় যেমন ৭টি বিট ২^৭ তথা ১২৮ টি মান ধারণ করতে পারে। একইভাবে ৩২ বিট ধারণ করতে পারে দশ লক্ষাধিক মান।
একাধিক ট্রানজিস্টারের সমন্বয়ে গঠিত হয় লজিক গেইট। লজিক গেইট মূলত পাঁচটি – এন্ড, অর, নট, ন্যান্ড, নর। এছাড়াও দুটি এক্সক্লুসিভ লজিক গেইট রয়েছে – এক্স অর এবং এক্স নর। এগুলোও খুব সাধারণ কাজ করে। যেমন: একটি এন্ড গেট এর সকল ইনপুট যদি ১ হয় তবে তার আউটপুট হবে ১, অপরদিকে একটি অর গেটের যেকোনো একটি ইনপুট ১ হলে তার আউটপুট হবে ১। এভাবে কয়েকটি লজিক গেট দিয়ে তৈরি করা হয় বেসিক মডিউল। বেসিক মডিউলের মাধ্যমে আপনি দুটি সংখ্যা যোগ করতে পারবেন, আর যখন আপনি যোগ করতে পারবেন তখন আপনি গুণও করতে পারবেন। আর যখন আপনি গুণ করতে পারবেন তখন আপনি সব ধরনের গাণিতিক হিসেবই করতে পারবেন। অর্থাৎ কম্পিউটারের কার্যক্রমকে আপনি একটি সাত বছর বয়সী শিশুর সাথে তুলনা করতে পারেন যে খুব সাধারণ গাণিতিক সমস্যার সমাধান করছে, কিন্তু এমন অনেকগুলো শিশুর একটি দল পদার্থবিজ্ঞান থেকে শুরু করে জ্যোতির্বিদ্যার যে কোনো ধরনের সমস্যার সমাধান করতে পারবে।
এখনকার কম্পিউটারগুলোতে ব্যবহৃত একটি সাধারণ ট্রানজিস্টারের আকার ১৪ ন্যানোমিটার (এক ন্যানোমিটার = এক মিটারের একশত কোটি ভাগের এক ভাগ) যেটা এইচআইভি ভাইরাস অপেক্ষা আটগুণ ছোট এবং লোহিত রক্তকণিকা অপেক্ষা পাঁচশত গুণ ছোট। অর্থাৎ এটি ক্রমেই পরমাণুর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
কোয়ান্টাম জগতটা আমাদের বাস্তব জগত হতে অনেক আলাদা, সেখানে অনেক আজিব ঘটনা ঘটে থাকে। ট্রানজিস্টারের কাজ হলো ইলেকট্রিসিটির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা। আর ইলেকট্রিসিটি হলো ইলেকট্রনের প্রবাহ। কিন্তু কোয়ান্টাম আকৃতির একটি ট্রানজিস্টার এই কাজটি করতে অক্ষম। কারণ সে ইলেকট্রনের চলার পথে বাধা প্রদান করলে ইলেকট্রন বাধাপ্রাপ্ত না হয়ে বরং এই প্রান্ত থেকে অদৃশ্য হয়ে ট্রানজিস্টারের অপর প্রান্তে আবির্ভূত হবে। অর্থাৎ, প্রবাহে কোনো বাধা কাজ করবে না। এ ঘটনাকে বলা হয় কোয়ান্টাম টানেলিং।
এ সমস্যা হতে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন কোয়ান্টাম কম্পিউটার। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কার্যপদ্ধতি সাধারণ কম্পিউটারের মতো নয়। এটি কাজ করে কোয়ান্টাম স্কেলে।
সাধারণ কম্পিউটারে যেখানে বিট ব্যবহার করা হয় সেখানে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করে কিউবিট। সাধারণ বিটের মতো কিউবিটও দুটি মানের যে কোনো একটি হতে পারে। কিউবিট হিসেবে ব্যবহার করা হয় ফোটন বা ইলেক্ট্রন। ফোটনের উলম্ব বা লম্ব গতিপথকে ১ অথবা ০ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অপরদিকে ইলেক্ট্রনের নিম্নমুখী ঘূর্ণন এবং উচ্চমুখী ঘূর্ণনকে যথাক্রমে ০ এবং ১ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।তবে এখানে একটি টুইস্ট আছে।
বিটের ক্ষেত্রে যেখানে একটি বিট শুধুমাত্র একটি মানেরই হতে পারে (০ অথবা ১), সেখানে একটি কিউবিট একইসাথে দুইটি মানই হতে পারে। একে বলা হয় সুপারপজিশন। কারণ আলোর গতিপথ এবং ইলেক্ট্রনের ঘূর্ণনের দিক আপনি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না অনুমান ব্যতীত। তবে আপনি যখন ফোটনকে একটি ফিল্টারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করবেন অথবা ইলেক্ট্রনের কক্ষপথ পরিবর্তন করবেন তখন এরা যে কোনো একটি মান গ্রহণ করবে। আর কিউবিটের এই সুপারপজিশন বৈশিষ্ট্যটিকেই বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন হিসাবে দ্রুততা বৃদ্ধিতে।সাধারণ কম্পিউটারে যখন চারটি বিট ষোলটি সম্ভাব্য মানের যে কোনো একটি হতে পারে, সেখানে চারটি কিউবিট সেই ষোলটি মানের সবগুলোই হতে পারে একসাথে। ফলস্বরুপ আপনি কিউবিটের সংখ্যা যত বৃদ্ধি করবেন, এর হিসাবের দক্ষতা ততই বৃদ্ধি পাবে। ৩২ টি কিউবিট দশ লক্ষাধিক মানের সবগুলোই হতে পারে একই সময়ে।
কিউবিটের আরেকটি মজার বৈশিষ্ট্য হল Entanglement. পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুটি কিউবিটের একটির অবস্থার পরিবর্তন হলে অপরটিরও পরিবর্তিত হবে ,তাদের মধ্যকার দূরত্ব পৃথিবী হতে চাঁদের দুরত্বের সমান হলেও। তাই আপনি সহজেই একটি কম্বিনেশনের সকল কিউবিটের মান পরিবর্তন না করে একটির মান পরিবর্তন করলেই অটোমেটিক অপরগুলোর মান বদলে যাবে। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় কিউবিট ম্যানিপুলেশন।
লজিক গেট যেখানে ইনপুটকৃত মানের ভিত্তিতে আউটপুট প্রদান করে সেখানে কোয়ান্টাম গেট ইনপুটকৃত কিউবিটের সুপারপজিশনের সম্ভাবনাকে উল্টিয়ে আরেক ধরনের সুপারপজিশন তৈরি করে। অর্থাৎ কতকগুলো কিউবিটকে কোয়ান্টাম গেটের ভেতরে পরিচালনা করার মাধ্যমে আপনি অনেকগুলো ক্যালকুলেশন একইসময়ে করতে পারবেন, যেখানে সাধারণ কম্পিউটার একই সময়ে শুধু একটি ক্যালকুলেশনই করতে পারে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের অন্যতম দুটি সম্ভাব্য ব্যবহার হল – কোয়ান্টাম সার্চিং এবং কোয়ান্টাম ফ্যাক্টরিং।
কোয়ান্টাম সার্চিং ব্যবহার করা হয় ডেটাবেজে। ডেটাবেজের একটি রেকর্ড খুঁজে পেতে হলে সাধারণ কম্পিউটারকে সবগুলো রেকর্ডই চেক করতে হতে পারে। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার এর বর্গমূল (√) সময়ের ভেতরে সেই ডেটা খুঁজে বের করতে সক্ষম।
কোয়ান্টাম ফ্যাক্টরিংকে আপনি কোড ভেঙে ফেলার সাথে তুলনা করতে পারেন। এই মূহুর্তে আপনার সকল ব্রাউজিং ইতিহাস, পাসওয়ার্ড এবং অন্যান্য সকল ভার্চুয়াল উপাদান ইন্টারনেট সার্ভারে জমা আছে, যেখানে আপনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একটি পাবলিক কোড প্রদান করেন সেটা জমা রাখার জন্যে, কিন্তু এসব তথ্য কোডেড থাকায় তারা শুধু সংকেতটি দেখতে পারে। সেটার মর্মোদ্ধার করতে পারে না। আর আপনার কাছে থাকে একটি private key যেটার মাধ্যমে আপনি সংকেতের মান দেখতে ও তার পরিবর্তন করতে পারবেন। এক্ষেত্রে public key টি হলো কয়েকশ ডিজিটের কোড যেটা ক্র্যাক করতে সাধারণ কম্পিউটারের বছরের পর বছর লেগে যাবে। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার মূহুর্তের ভেতরে public key ক্র্যাক করে আপনার private key জানতে পারবে। তাই ইন্টারনেট প্রাইভেসি সিকিউরিটির ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম কম্পিউটার হুমকিস্বরুপ।
তবে এর সবচেয়ে সফল ব্যবহার হতে পারে সিমুলেশন তৈরিতে। কোয়ান্টাম এলগরিদমের সাথে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রোটিন এবং ডিএনএর নিখুঁত সিমুলেশন তৈরি করা সম্ভব যেটা চিকিৎসাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করবে।
ওপরের ছবিতে যে সোনালি রংয়ের যন্ত্রটি দেখতে পারছেন সেটা হল কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কেসিং। আর ভেতরের রঙিন চিপটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার। আর কালো বস্তুটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ধারক চেম্বার। এখানে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। মজার ব্যাপার হলো মহাকাশের তাপমাত্রার চেয়ে ১৫০ গুণ শীতল তাপমাত্রা ব্যতীত কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে শীতল রাখা সম্ভব নয়। এজন্যেই এ চেম্বার এবং এত যন্ত্রপাতি। ডিওয়েভ নামক প্রতিষ্ঠান এটি তৈরি করেছে নাসা ও গুগলের সহায়তায়। বর্তমানে এমন বেশ কয়েকটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার নাসা এবং গুগলের গবেষণাগারে সংরক্ষিত আছে।
তবে এটা শুধু প্রাথমিক কোয়ান্টাম কম্পিউটার, প্র্যাকটিকাল নয়। প্র্যাকটিকাল কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করতে আরো বছর দশেক সময় লাগবে।