বিংশ শতাব্দী শুরুর পর্যন্ত বস্তুজগতকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যেত – কণা আর তরঙ্গ। কণা বলতে সেইসব বস্তুকে বোঝানো হত যাদের ভর আছে তথা ভরবেগ আছে। যেমন – বাস। বাস এর ভর আছে আর চলনশীল অবস্থায় তার ভরবেগও আছে। অন্যদিকে তরঙ্গের সাথে জড়িত তরঙ্গদৈর্ঘ্য। কণার ক্ষেত্রে তরঙ্গদৈর্ঘ্য অথবা তরঙ্গের ক্ষেত্রে ভরবেগ ছিল অর্থহীন। তরঙ্গের ধর্মের মধ্যে ছিল ব্যাতিচার। ধরা যাক, দুইটা সমান কম্পাংকের তরঙ্গ যাদের বিস্তার সমান তারা একইসাথে একটা বিন্দুতে মিলিত হলো। তরঙ্গের উপরিপাতন ধর্ম অনুযায়ী কিছু কিছু জায়গায় লব্ধ তরঙ্গ অনেক তীব্র হবে আবার কিছু কিছু জায়গায় তা অনেক ক্ষীণ হবে। এটাই ব্যাতিচার। কণার ক্ষেত্রে তখন পর্যন্ত ব্যাতিচার বলে কিছু ছিল না।
১৮৯৭ সালে ইলেকট্রন আবিষ্কার হলো এবং তাকে কণা বলেই ধরে নেয়া হয়েছিল। যদি ইলেকট্রন কণা হয়, তবে তার কোন ব্যাতিচার ধর্ম থাকবে না। ইয়ং এর দ্বিচিড় পরীক্ষা দ্বারা তরঙ্গের ব্যাতিচার ধর্ম পরীক্ষা করা হয় আলো এর জন্য। ঠিক একই পরীক্ষাটা ইলেকট্রন এর ক্ষেত্রে করলে দেখা গেল, ইলেকট্রন ও ব্যাতিচার ধর্ম দেখায়! অন্যদিকে দুইটা কণা এর ক্ষেত্রে সংঘর্ষ হতে পারে আর স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষে শক্তি আর ভরবেগ নিত্যতা সুত্র মেনে চলে। কণার সাথে তরঙ্গের সংঘর্ষে তরঙ্গ বা কণার শক্তি অথবা ভরবেগ এর পরিবর্তন হবার কথা না। দেখা যাক কি হয়? একটা ইলেকট্রন এর উপর আলো ফেলা হলো। আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কোন পরিবর্তন হবার কথা না। কিন্তু পরীক্ষা থেকে দেখা গেল ইলেকট্রন এর গতি আর আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিবর্তন হয়েছে! এটাই কম্পটন এফেক্ট।
দুটো পরীক্ষার ফল নিয়ে বিজ্ঞানীরা খুবই আশ্চর্যান্বিত হলেন। কণা তরঙ্গধর্ম আর তরঙ্গ কণার ধর্ম দেখাচ্ছে! তাহলে কোনটা কণা আর কোনটা তরঙ্গ ? ইলেকট্রন কি কণা নাকি তরঙ্গ, আলো কি তরঙ্গ নাকি কণা? এই সব প্রশ্নের উত্তর এর প্রথম ধাপ ডি ব্রগলী এর তরঙ্গ-কনা দ্বৈত-তত্ত্ব। তিনি বললেন, কণার সাথে জড়িত থাকে তরঙ্গ আর তরঙ্গের সাথে কণা। ধরা যাক ইলেকট্রন এর ভরবেগ p, ডি ব্রগলী এর তরঙ্গ-কণা দ্বৈত-তত্ত্ব অনুযায়ী এর সাথে জড়িত তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য h/p এর সমান। h এখানে প্লাংক এর ধ্রুবক যার মান ৬.৬২৬*১০^-৩৪ Js।
কৌতূহল জাগতে পারে তাহলে কেন আমরা প্রতিদিনের জীবনে কোথাও কণার তরঙ্গ ধর্ম দেখি না? উত্তর হলো, বড় বস্তু যেমন বাস এর সাথেও তরঙ্গদৈর্ঘ্য আছে। কিন্তু সে তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক অনেক ছোট। এতই বেশী ছোট যে তা কিছুতেই প্রভাব ফেলে না। যদি এমন কোন জগত থাকে যেখানে প্লাংক এর ধ্রুবক এর মান অনেক বড়, তাহলে সেই জগতে বড় বস্তুর ক্ষেত্রে কণার তরঙ্গধর্ম দেখা যাবার কথা। অন্যদিকে ইলেকট্রন এর সাথে জড়িত তরঙ্গদৈর্ঘ্য এত ছোট না। তাই খুব ক্ষুদ্র জগতে যেতে হলে আমাদের অন্য এক ধরনের বলবিদ্যা ব্যবহার করতে হয় আর তা হলো “কোয়ান্টাম মেকানিক্স”।
ইলেকট্রনের ডিফ্রাকশন আর কম্পটন এফেক্ট ব্যাখ্যা করার জন্য ওয়েভ-পার্টিকেল ডুয়ালিটি প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হলো কিভাবে আমরা একটা কোয়ান্টাম পার্টিকেল এর অবস্থা জানতে পারি? উত্তর হলো কোয়ান্টাম মেকানিক্স। কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর একটা সেন্ট্রাল অবজেক্ট হলো ওয়েভ ফাংশন। এটার নাম দেয়া যাক Ψ(x,t)। সাধারণভাবে এটা একটা অবস্থান আর সময় এর উপর নির্ভরশীল জটিল সংখ্যা। পরবর্তী প্রশ্ন আসে, কিভাবে আমরা এই তরঙ্গ অবস্থা পেতে পারি? উত্তরটা দিয়েছেন বিজ্ঞানী শ্রডিঙ্গার। তিনি বললেন, ধরা যাক একটা একটা কোয়ান্টাম পার্টিকেল একটা পটেনশিয়াল এনার্জি এর মধ্যে আছে। আরও ধরা যাক এই পটেনশিয়াল এনার্জি বা বিভব শক্তি শুধু অবস্থান এর নির্ভরশীল, সময়ের সাথে এর কোনো পরিবর্তন নেই। আবার এই কোয়ান্টাম পার্টিকেল এর কাইনেটিক এনার্জি তথা গতিশক্তি থাকতে পারে। তাহলে মোট শক্তি হলো বিভব শক্তি + গতি শক্তি। এই অবজেক্টটার একটা নাম আছে, তা হলো হ্যামিল্টনিয়ান H।
শ্রডিঙ্গার একটা প্রস্তাবনা দিলেন যা শ্রডিঙ্গার এর সমীকরণ নামে পরিচিত। এই বিখ্যাত সমীকরণটা হলো, -iℏ ∂Ψ/∂t=HΨ । এটা একটা পারশিয়াল ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশন। এটার মানে হলো, আমরা যদি একটা পার্টিকেল এর পটেনশিয়াল এনার্জি তথা হ্যামিল্টনিয়ান জানি, তাহলে শ্রডিঙ্গার এর সমীকরণ সমাধান করে আমরা তত্ত্বীয়ভাবে ওয়েভ ফাংশন পেতে পারি। কিন্তু সমস্যা হলো খুব কম কিছু সিস্টেম যেমন ইনফিনিট পটেনশিয়াল ওয়েল, হারমনিক অসসিলেটর, হাইড্রোজেন পরমাণু ছাড়া আমরা শ্রডিঙ্গার এর সমীকরণ পূর্ণরুপে সমাধান করতে পারি না।
এখন আসা যাক ওয়েভ ফাংশন এর বাস্তব ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে। আগেই বলা হয়েছে ওয়েভ ফাংশন অবস্থান আর সময় এর উপর নির্ভরশীল একটা জটিল সংখ্যা। প্রকৃতিতে জটিল সংখ্যা দেখা যায় না। তাই শুধু ওয়েভ ফাংশন এর বাস্তব কোন ব্যাখ্যা নেই। অন্যদিকে ওয়েভ ফাংশন এর পরম মান এর বর্গের বাস্তব ব্যাখ্যা রয়েছে। |Ψ|2 Δx পার্টিকেলটার অবস্থান x থেকে x + Δx এর মাঝে থাকার সম্ভাবনা দেয়। তার মানে হলো, আমরা যদি ওয়েভ ফাংশন জানি তারপরও আমরা নিখুঁতভাবে বলতে পারি না পার্টিকেল কোথায় আছে। বড়জোর আমরা যেটা বলতে পারি তা হলো সম্ভাব্যতা। এই সম্ভাব্যতাযুক্ত ব্যাখ্যা আইনস্টাইন মেনে নিতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন, “God does not play dice”. আইনস্টাইন এখানে পদার্থবিদ্যার ঈশ্বরকেই বোঝাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রকৃতি আইনস্টাইন এর মেনে নেয়া বা না নেয়া এর উপর নির্ভর করে না। এভাবে God উল্লেখ করে বিভিন্ন উক্তি দেয়ার জন্য নিলস বোর বেশ খাপ্পা ছিলেন আইনস্টাইনের ওপর। তাই, বোর একবার বলেই ফেলেছিলেন, “Can you please stop telling what God would d0?”.