আমার এই শিরোনামকে ক্যানভাসারদের বিজ্ঞাপন ভেবে এড়িয়ে গেলে দারুণ মিস করবেন। কারণ, সত্যি সত্যিই এবার খুঁজে পাওয়া গেছে চুল সম্পর্কিত অনেক প্রশ্নের উত্তর। ফাটাফাটি বিষয় হলো, এই তথ্যগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে একজন বাঙালির হাত ধরে।
আপনার একমাথা কালো চুলের ভেতর লুকিয়ে থাকা সাদা চুলটাকে ধরে কেউ যখন প্রথমবারের মতো উচ্চারণ করে, “তোর চুল দেখি পেকে যাচ্ছে!”, তখনকার অনুভূতির সাথে কি অন্য কোনো দুঃখের তুলনা হয়? আবার মধ্যবয়সী যারা সাদা চুল কালো করার জন্য মাসে মাসে রঙ কেনেন, তাদের কষ্টকেই বা কম বলি কীভাবে? যারা জোড়া ভ্রু নিয়ে আক্ষেপ করে বলেন, “হোয়াই মি?”, তাদের আক্ষেপও আমরা বুঝি। আর যাদের মাথায় অকালে পড়ে গেছে টাক, তাদের দুঃখ নিয়ে কিছু নাই বললাম! কিন্তু ধামাকা খবর হলো, সবার আক্ষেপ আর ঝামেলা বুঝি শেষ হতে চললো! হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ডঃ কৌস্তুভ অধিকারী এবং তার দল বের করে ফেলেছেন, কী কারণে ঘটছে এইসব ঘটনা। আর “কারণ” শনাক্ত করা মানেই তো প্রতিকারের পথে এক পা আগানো, তাই না?
অবশ্য অনেকে আছেন, পাকা চুল নিয়ে এক প্রকার গর্বই অনুভব করেন। অনেকে পাকা চুলকে অভিজ্ঞতা আর ব্যক্তিত্বের নিদর্শন বলে মানেন। সমস্যা তাদের নিয়ে নয়। সমস্যা যাদের নিয়ে, তারা পাকা চুলকে ভাবেন লজ্জা কিংবা অসৌন্দর্যের বিষয়। তাই তারা হয়ত খুশিই হবেন এই গবেষণার খোঁজ পেয়ে।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষক ডঃ কৌস্তুভ তার গবেষণা সম্পর্কে বলেন, “যদিও চুলের বিভিন্ন রঙ হওয়ার পেছনে এবং টাক পড়ার পেছনে বিভিন্ন জীনের কার্যকারিতা সম্পর্কে আমাদের জানা ছিলো, কিন্তু মানুষের সাদা চুল হওয়ার জন্য দায়ী জীন শনাক্ত করার ঘটনা এটাই প্রথম।” উনার গবেষণার কারণে আমরা আরও জেনেছি, চুলের গঠনের জন্য দায়ী হলো চার ধরনের জীন, টাক মাথার জন্য দুই ধরনের জীন, PAX3 জীন দায়ী জোড়া ভ্রুর জন্য, এবং FOXL2 দায়ী ভ্রু কতটুকু ঘন হবে, সেটার জন্য।
নিচের ছবি থেকে বুঝা যাচ্ছে, দেহের বিভিন্ন অংশের পশমের জন্য কোন জীন দায়ী। এই ফলাফলই বের করেছেন ডঃ কৌস্তুভ।
IRF4 (Interferon Regulatory Factor 4 Gene) জীনটি যে চুলের রঙের সাথে সম্পর্কিত, সেটা আগে থেকেই জানা ছিলো। কিন্তু এবার প্রমাণিত হলো, এই জীন ইউরোপিয় জনগণ এবং ল্যাটিন আমেরিকানদের চুলে ধুসর বা সাদা রঙ সৃষ্টির জন্যও দায়ী।কৌস্তুভের সাক্ষাৎকার থেকেই জানা যায়, অন্য় জাতির সাদা চুলের জন্য দায়ী হবে অন্য় কোনো জিন। আশা করা যায়, অন্য়ান্য় জাতিগোষ্ঠির সাদা চুলের কারণও এভাবে বিজ্ঞানীরা বের করে ফেলবেন।
এই প্রমাণের ফলে চুলের সাদা হওয়াকে বাধা দেওয়া, প্রতিরোধ করা, কিংবা সাদা থেকে আবার কালো করা পর্যন্ত সব সম্ভাবনার কথাই ভেবে ফেলেছেন মানুষজন। তবে কৌস্তুভের মতে, “এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও বিশদভাবে জানার পর আমরা হয়ত এমন ওষুধ আবিষ্কার করতে পারবো, যার মাধ্যমে মানুষ চুলের রঙ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কিংবা চুলের সাদা হওয়াকে প্রতিরোধ করতে পারবে, বা চুল কালো করার জন্য কৃত্রিম রঙ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু চিন্তাগুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারটা তুলে রাখা ভালো সুদূর ভবিষ্যতের জন্য।”
সিডনির ইউনিভার্সিটি অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস-এর প্রফেসর ব্রায়ান মরিসের মতে, চুলের জেনেটিকস নিয়ে গবেষণার জন্য এই পরীক্ষণটা একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার।
গবেষণার শুরু
মানুষের মাথায় কী পরিমাণ চুল গজাবে এবং কী পরিমাণ চুল শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে (প্রতিদিন ঝরে পড়া, টাক পড়া ইত্যাদিসহ), সেটা অনেকাংশেই বংশধারার উপর নির্ভর করে। আবার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য রীতিমত অঞ্চল ভেদে নির্ধারিত হয়। যেমন, পশ্চিম ইউরেশিয়া অঞ্চলের মানুষের চুলের রঙ এবং ধরনে প্রচুর রকমফের দেখা যায়। কিন্তু সাব-সাহারা আফ্রিকার মানুষের মধ্যে সোজা চুল দেখা যায় না বললেই চলে। তবে মজার ব্যাপার হলো, “ইউরোপ” এবং “এশিয়ার” জনগণের মধ্যে সোজা চুলের জন্য দায়ী জীন কিন্তু এক নয়, ভিন্ন! তার মানে চুল সোজা হওয়ার বৈশিষ্ট্যটি দুই অঞ্চলে আলাদাভাবে বিবর্তিত হয়েছে।
মানুষের চুলের এই যে ভিন্নতা, এটা সম্পর্কে আরও বিশদভাবে জানার জন্য ডঃ কৌস্তুভ এবং তার দল একটা গবেষণা করার সিদ্ধান্ত নেন। গবেষণাটির জন্য তারা বেছে নেন মিশ্র ইউরোপীয় জনগণ, আমেরিকার আদিবাসী আর আফ্রিকান বংশোদ্ভূত জনগণকে। কারণ জেনেটিক কারণে এদের চুলের ধরন, ঘনত্ব এবং রঙে প্রচুর পরিমাণে ভিন্নতা দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত এই গবেষণার মাধ্যমে ১০ টি নতুন জীনের সন্ধান পাওয়া গেছে যারা দেহের বিভিন্ন স্থানের পশমের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী।
গবেষণার জন্য দক্ষিণ আমেরিকার পাঁচটি দেশ (ব্রাজিল, কলোম্বিয়া, চিলি, মেক্সিকো, এবং পেরু) থেকে মোট ৬,৬৩০ জন স্বেচ্ছাসেবীকে নির্বাচিত করা হয়েছিলো। স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে পুরুষ এবং মহিলা উভয়েই ছিলেন। তাদের কাছ থেকে সংগৃহীত স্যাম্পলের উপর পরীক্ষা করে যে বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা হয়েছিলো, সেগুলো হলো – চুলের গঠন (কোঁকড়া কিনা), রঙ, টাক, চুলের সাদা হয়ে যাওয়া, পুরুষের দাড়ির ঘনত্ব, জোড়া ভ্রু, এবং ভ্রুর ঘনত্ব।
জোড়া ভ্রুর জন্য দায়ী জীন
জোড়া ভ্রু ব্যাপারটা আমাদের কাছে খুব একটা প্রচলিত নয়। কারণ জোড়া ভ্রু আছে, এমন মানুষের সংখ্যা ভুরি ভুরি নয়। কিন্তু আনকমন বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা বিব্রত ভাব দেখা যায়। ফলে জোড় ভ্রুওয়ালারা অনেকেই তাদের ব্যতিক্রমী সৌন্দর্য নিয়ে সন্তুষ্ট নন। তার উপর মানুষজনের মন্তব্য, হাসাহাসি, বাঁকা চাহনির ব্যাপার তো আছেই! ফলে অনেকেই জোড়া ভ্রু তুলে ফেলেন। অনেকের আবার জোড় ভ্রু না থাকলেও ভ্রু প্লাকের সময় দুই ভ্রুর মাঝের জায়গাটা প্লাক করে নেন, যেন সেখানে একটুও লোম না থাকে।
ইনাদের সবার জন্যেও খুশির খবর হতে পারে ডঃ কৌস্তুভের গবেষণার ফলাফল। কারণ জোড়া ভ্রুর জন্য দায়ী জীনকে শনাক্ত করা গেছে। এই জীনের নাম Paired Box Gene 3, সংক্ষেপে PAX3। PAX3 জীনে দুর্লভ এক ধরনের মিউটেশন ঘটলে Waardenburg syndrome type 1 (WS1) দেখা দেয়। WS1 হলে যেসব বৈশিষ্ট্য দেখা দেয়, তার মধ্যে একটা হলো জোড়া ভ্রু। সেই সময় হয়ত বেশি দূরে নয়, যখন PAX3 জীনের মিউটেশনের উপর জারিজুরি করে জোড়া ভ্রু সমস্যার স্থায়ী সমাধান মিলবে!
ঘন ভ্রুর জন্য দায়ী জীন
ঘন ভ্রুর জন্য দায়ী জীন হলো Forkhead Box L2, বা সংক্ষেপে FOXL2। এই জীনে মিউটেশন ঘটলে Blepharophimosis Syndrome (BPES) ঘটে। এর ফলে অত্যধিক ঘন ভ্রু দেখা যেতে পারে।
টাক পড়ার জন্য দায়ী জীন
টাক পড়ার জন্য দায়ী জীন হলো অ্যান্ড্রোজেন রিসেপ্টর (AR) এবং GRID1। এই আবিষ্কারের ফলে আমরা সবাই খুশিতে নাচলে কুঁদলেও কারো কারো দামামা বেজে গেছে। “বিফোর-আফটার” বিজ্ঞাপন দিয়ে যারা “আর নয় টাক মাথা” কিংবা “মাথার টাক, ঢেকে যাক” বলে এতদিন আপনাকে ধোঁকা দিচ্ছিলো, তারা আর প্রতারণা করার সুযোগ পাবে না। তবে কিনা বাঙালি বুদ্ধি বলে কথা। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সাথে নিজেদের টোটকার গুণগান মিশিয়ে নতুন বিজ্ঞাপন বানাতে কতক্ষণ? সেক্ষেত্রে আপনি সচেতন না হলে ঠকতে হবেই।
দাড়ির ঘনত্বের জন্য দায়ী জীন
যাদের দাড়ি-মোচ একটু কম দেখা যায়, তাদেরকে যে কতো কথা শুনতে হয় আমাদের সমাজে! “মাকুন্দা” বলে আলাদা একটা নামও তৈরি হয়েছে তাদের অপমান করার জন্য। কিন্তু আমরা ভেবে দেখি না, একজন মানুষের জন্য কী পরিমাণ মানসিক অত্যাচার এটা! তবে ডঃ কৌস্তভ এবং তার দল যেহেতু বের করে ফেলেছেন দাড়ির ঘন কিংবা পাতলা হওয়ার পেছনে দায়ী জীন হলো Forkhead Box P2 (FOXP2), Ligand of numb-protein X 1 (LNX1) এবং Prolyl endopeptidase (PREP), তাই কাউকে ক্ষেপাতে দেখলে আপনি এই নামগুলো বলে উত্যক্তকারীদের ভড়কে দিতে পারেন।
সবশেষে আসল জিনিস। এতক্ষণ যা পড়লেন, সে বিষয়ে শুনে নিন ডঃ কৌস্তুভের মুখে। বিবিসি ওয়ার্ল্ডের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আমাদের ডক্টর কথা বলেছেন এই গবেষণা নিয়ে।
তথ্যসূত্রঃ