ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক ও বিরোধ নিয়ে আলোচনা নতুন নয়। ‘সম্পর্ক’ শব্দটির চাইতে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে ‘ঋণাত্মক যোগসূত্র ‘ কথাটি বেশী উপযুক্ত বলে মনে হয়। ধর্ম ও বিজ্ঞানের সংজ্ঞা আলাদা ভাবে, যার যার অবস্থান থেকে অনেকেই করেছেন। সংজ্ঞার বিশ্লেষণের মতোই এর সমালোচনাও হয়েছে প্রচুর। বিখ্যাত ও জ্ঞানী গুণীদের সংজ্ঞা ও সমালোচনার মধ্যে না যেয়ে আমি খুব সাধারণ অর্থে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে ঋণাত্মক যোগসূত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করবো।
যে কোন ভাবে, যে ধর্মের কথাই বলি না কেন, ধর্মের প্রাথমিক ধারণা হলো মানুষ কোন এক মহাশক্তিশালী স্রষ্টার সৃষ্টি। সেই স্রষ্টাই এই পৃথিবীসহ যাবতীয় সকল কিছুর কারণ। নৈতিকতা ও মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা একমাত্র সম্ভব এই স্রষ্টার হস্তক্ষেপে। এই মূল কথার উপর ভিত্তি করেই ধর্ম সেই প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মন ও সমাজকে প্রভাবিত করে আসছে। ভৌগলিক ও রাজনৈতিক কারণে, আমরা ধর্মের বৈচিত্র্য দেখতে পাই মাত্র, কিন্তু সকল ধর্মের স্বরূপ ও প্রকৃতি প্রায় একই রকম।
ধর্ম মানুষের আচরণ ও সমাজের স্বাভাবিক গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় নানাভাবে। ধর্মগ্রন্থ, মৃত্যু পরবর্তী জীবন ও স্বর্গ নরকের ধারণা এসব ধর্মের নিয়ন্ত্রণ পক্রিয়ার মূল হাতিয়ার। সব বড় ধর্মের মাঝে একটি বিষয়ে মিল পাওয়া যায়, আর তা হলো, নিজেদের ব্যপারে এইসব ধর্ম যুক্তির বিচার বা তাদের ভাষায় কটুকথা শুনতে প্রস্তুত নয়। অতীতে, এর ফল ভোগ করতে হয়েছে সকল প্রগতিশীলদের, আর এখন ধর্মানুসারীরা সেই সমালোচনা বা কটুকথা থেকে বাঁচার জন্য আবিস্কার করেছে ধর্মান্ধ মধ্যশ্রেণী, যাদেরকে তারা নিজেরাই স্বীকার করে না, আবার একই সাথে এই মধ্যশ্রেণীর কোন কর্মকান্ডতেই কোন বাধা প্রদান করে না। ধর্মানুভূতি রক্ষার নামে তাদের পক্ষ নেয় রাষ্ট্র। এই হচ্ছে সার্বিক ধর্মীয় পরিস্থিতি। ভৌগলিক ও রাজনৈতিক কারণে, এর বৈচিত্র্য দেখা যায় মাত্র, স্বরূপ ও প্রকৃতি হিসেবে এই ধর্মসকল সার্বজনীন ও স্থান-কাল-পাত্র বিচার ছাড়াই উপস্থিত। শুধুমাত্র কম-বেশী এই মাত্রার বিচারে ধর্মের প্রভাবকে চিহ্নিত করা যায়।
বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের ঋণাত্মক যোগসূত্র বিচারটি খুব সহজ হয় যদি আমরা ধর্ম ও বিজ্ঞানের আসল স্বরূপ বুঝতে পারি। বিজ্ঞানের স্বরূপ পরিস্কার। আইনষ্টাইনের ভাষায়, মানুষের শতাব্দী পুরোনো পদ্ধতিগত চেষ্টা, যার মাধ্যমে জগতের দৃশ্যমান ঘটনাবলীকে যোগসূত্রের মধ্যে দিয়ে ব্যাখ্যা করে বর্তমানের চিত্রায়ন ও ভবিষ্যৎ এর সম্ভাবনাকে তুলে ধরার নামই বিজ্ঞান। বিজ্ঞান কখনই মানুষকে বা তার কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়নি, বরং চেষ্টা করেছে মানুষের মানবিক সীমাকে বাড়িয়ে নিতে, যেখানে মানুষ তার বর্তমান জ্ঞান ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সম্ভাবনার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে এই পৃথিবী ও এর বাসযোগ্যতাকে আরো উপোযোগী করে তুলতে। বিজ্ঞান এর লক্ষ্য অজানাকে জানা, জানার পথকে রুদ্ধ করা নয়। আর সেই জানার পদ্ধতি কখনই অন্ধের মতো অনুসারী হওয়া নয়, এ পদ্ধতি অনেক কষ্ট আর ত্যাগ এর ফসল।
ধর্ম ও বিজ্ঞানের স্বরূপ, সংজ্ঞা বা এদের মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ধর্ম স্বাভাবিকভাবেই, নিজের স্বরূপগত কারণেই বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। ধর্ম মানবজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিতে ভালো বা খারাপ যে ভূমিকাই পালন করে থাকুক না কেন, বিজ্ঞানকে কখনই এগিয়ে যেতে সাহায্য করেনি। যৌক্তিকভাবে এর কারণগুলিকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়:
১. ধর্মের মূল ভিত্তি হলো বিশ্বাস। বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি হলো অবিশ্বাস। বিজ্ঞান সবকিছুকে অবিশ্বাস করে প্রশ্ন করে বলেই তার উত্তর খুঁজতে পদ্ধতিগত পন্থা অবলম্বন করে এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এর উত্তর খুঁজে বের করে, বহু বছর পরে হলেও করে।
২. ধর্ম মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। নিজ ধর্মের একাত্মবোধই অন্য ধর্ম বিশ্বাসীদের সাথে বিভেদের কারণ। ধর্ম ভুলে যায়, মানুষ সবার আগে মানুষ, তারপর অন্যকিছু। অন্যদিকে, বিজ্ঞান বিভেদ দূর করতে চেষ্টা করে, আবিস্কার ও যৌক্তিক ব্যাখ্যার আলোকে বিভেদের কারণগুলিকে মানুষের সামনে তুলে ধরে।
৩. ধর্ম পদ্ধতিগত পন্থা অবলম্বন করে না। ধর্মের ব্যাখ্যা ও প্রচারণা দেশ-কাল-পাত্র ভেদে ভিন্ন। ধর্মের কোন পরিবর্তন, বিবর্তন নেই। পরিবর্তন আর বিবর্তনে ধর্মের ভয়। যে অন্ধকারে ধর্মের উৎপত্তি, সেই অন্ধকার থেকে ধর্ম বের হতে চায় না, ধর্ম নিজেই এর বিবর্তন ও পরিবর্তনকে নিষিদ্ধ করে। বিজ্ঞান সত্যের সন্ধানী, পরিবর্তন আর বিবর্তনেই এর সাফল্য নিহিত থাকে।
৪. ধর্মের উপকারিতা থাকলেও তা ব্যক্তিনির্ভর। বিজ্ঞানের উপকারিতা সার্বজনীন। বিজ্ঞানের আবিস্কার ও সুফল সবাইকে সন্দেহাতীতভাবে স্পর্শ করে।
৫. ধর্ম মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, ধর্মগ্রন্থ আর ধর্মীয় আচারগুলো এর প্রমাণ। আধুনিক শিক্ষা থেকে যারা যত বেশী দূরে, ধর্ম তাদের ঠিক ততটাই কাছে। একারণেই, ধর্ম সেইসব পরিবেশে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। বিজ্ঞান কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে না, বিজ্ঞান শুধুমাত্র সত্যসন্ধানী ও সত্যের প্রকাশক।
আইনষ্টাইন তাঁর ১৯৪১ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ “Science and Religion” এ ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে বলেছেন- “The situation may be expressed by an image: science without religion is lame, religion without science is blind”. আজকের দিনে ধর্মকে শুধু অন্ধই বলা চলে, বিজ্ঞানের আলো পর্যন্ত ধর্মকে পথ দেখাতে ব্যর্থ। সেই একই প্রবন্ধে আইনষ্টাইন বলেছেন “For a docrine which is able to maintain itself not in clear light but only in the dark, will of necessity lose its effect on mankind, with incalculable harm to human progress”. এই প্রবন্ধেই ধর্মকে তিনি উল্লেখ করেছেন এই বলে যে “religion of fear”, আর তারও অনেক পরে দার্শনিক বাট্রার্ন্ড রাসেল তাঁর “Why I Am Not A Christian” বইতে বলেছেন – “Religion is based, I think, primarily and mainly upon fear”. অন্ধকার, ভয়, এইসব শব্দই ধর্মের স্বরূপকে যথার্থ ব্যাখ্যা করে, অন্যদিকে বিজ্ঞান মানেই আলোর দিকে যাত্রা।
ধর্ম আর বিজ্ঞানের যোগসূত্রকে যেমন ঋণাত্মক বলা যায়, তেমনি বিজ্ঞান আর দর্শনের যোগকে বলা যায় ধনাত্মক। দর্শনের নানা শাখা প্রশাখা মানব সভ্যতার আদি থেকে বিজ্ঞানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করে আসছে। আজকের দিনে যুক্তি ও দর্শনের সাথে মানবসমাজের দূরত্ব অনস্বীকার্য। দর্শন ও যুক্তির সাথে বিজ্ঞানের ধনাত্মক যোগসূত্রের কমতি আর ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের ঋণাত্মক যোগসূত্রের প্রাবল্য – এই দুই এর সম্মিলিত ফল হলো আজকের দিনের অন্ধকার রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ ও মানুষ। ধর্মের উপস্থিতি বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার জন্য শুধু যে প্রতিবন্ধক তাই নয়, ব্যপক ক্ষতিকরও বটে।