ডারউইনের সমালোচকদের জবাব

বিবর্তনতত্ত্বের সমালোচনা আর ডারউইনের সমালোচনা দুইটা ভিন্ন ব্যাপার। যৌথভাবে বিবর্তনতত্ত্বের ব্যাপারে দশটি ভুল ধারণা পড়লে পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন।

চার্লস ডারউইন বোধ করি গত ১৫০ বছরের সর্বাধিক সমালোচিত ব্যক্তি। বর্তমানে জাকির নায়েকের মত টেলিভিশনে ধর্মপ্রচারক আর তৎকালীন ভ্রাম্যমাণ ধর্মযাজকরা বিবর্তনতত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত মিথ্যাচারে নেমে এসেছিলেন। এইসব ভুল ধারণা থেকে জন্ম নেয়া সমালোচনাগুলো এখনও প্রচলিত। আসুন দেখে নিই কী সেই সমালোচনা, আর কেন এগুলো ভুল।

অভিযোগ – ডারউইন নিজের তত্ত্বে নিজেই বিশ্বাসী ছিলেন না

তৎকালীন ধর্মপ্রচারকরা আর বর্তমান টেলিভিশনে ধর্মপ্রচারক প্রায়ই এই অভিযোগ করেন যে চার্লস ডারউইন নিজের তত্ত্ব সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করতেন। তিনি নিজেই নাকি সে তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না।

যদি আমরা এক মূহুর্তের জন্য ভুলেও যাই বিজ্ঞান বিশ্বাস নির্ভর ব্যাপার না, যদি এক মূহুর্তের জন্য ভুলে যাই ডারউইন তাঁর তত্ত্ব বই আকারে প্রকাশ করতে ১০ বছর অপেক্ষা করেছিলেন, তারপরও এই অভিযোগটি ধোপে টেকে না। সমালোচকরা তাদের দাবীর পক্ষে যে প্রমাণ উপস্থাপন করেন সেটা হচ্ছে ডারউইনের “On the Origin of Species” এর ৬ষ্ঠ অধ্যায় ‘Difficulties of the Theory” এর একটি লাইন, যেখানে ডারউইন লিখেন-


To suppose that the eye with all its inimitable contrivances for adjusting the focus to different distances, for admitting different amounts of light, and for the correction of spherical and chromatic aberration, could have been formed by natural selection, seems, I freely confess, absurd in the highest degree.”


এখানে ডারউইন বলেছেন যে, চোখের জটিল গঠন প্রাকৃতিক নিয়মে হয়েছে সেটা ভাবা অবিশ্বাস্য। তারা এই লাইনটি দেখিয়ে বলেন- “দেখলেন? ডারউইন নিজে বলছেন তার থিওরি absurd!” অথচ তারা পরের তিন তিনটি পৃষ্ঠায় ডারউইনের নিজের দেওয়া কারণ বা উদাহরণ দিয়ে নিজের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করাটা দেখেন না? এমনকি এর পরের লাইনটাতেই ডারউইন লিখেছিলেন-


“Yet reason tells me, that if numerous gradations from a perfect and complex eye to one very imperfect and simple, each grade being useful to its possessor, can be shown to exist; if further, the eye does vary ever so slightly, and the variations be inherited, which is certainly the case ; and if any variation or modification in the organ be ever useful to an animal under changing conditions of life, then the difficulty of believing that a perfect and complex eye could be formed by natural selection, though insuperable by our imagination, can hardly be considered real.”


ডারউইন বলছেন- “তারপরেও, যুক্তি কিন্তু বলছে যে, অসংখ্য ধাপ পার হবার পর অপেক্ষাকৃত সরল আর ত্রুটিযুক্ত চোখ থেকে জটিল আর কিছুটা হলেও ত্রুটিমুক্ত চোখ তৈরি হওয়া সম্ভব। যদি প্রত্যেকটা ধাপের চোখই তার মালিকের ব্যবহারের উপযোগী হয়, যদি চোখগুলো প্রত্যেক ধাপে অত্যন্ত সামান্য হারে পরিবর্তিত হতে থাকে, আর এই পরিবর্তনগুলো বংশানুক্রমে চলে আসতে থাকে (যা আসলে ঘটেছে); আর যদি কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন প্রাণীটির জন্য উপকারী সাব্যস্ত হয়, তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ত্রুটিহীন আর জটিল চোখ আসার ঘটনাটা আমাদের কল্পনাকে ছাড়িয়ে গেলেও বিশ্বাস করতে সমস্যা হবার কথা না।”

কোনো কারণে যদি মনে হয় ডারউইনের সমালোচকরা আগের লাইনটি পড়ে আর আগে বাড়েন নি, তবে কি সেটা যৌক্তিক ধারণা হবে?

পরের তিন পৃষ্ঠায় চার্লস ডারউইন উদাহরণ সহ দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে তিনি আপাত অসম্ভব মনে হওয়া একটা অনুসিদ্ধান্ত থেকে একটা উপসংহারে পৌঁছুলেন যেখানে তিনি প্রমাণ সহ দেখিয়েছেন কীভাবে ছোট ছোট পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধাপে ধাপে চোখের বিবর্তন হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে- ইউগ্লিনা নামক অণুজীবের গায়ে একটি ছিদ্র আছে যা আলোক সংবেদী। ইউগ্লিনার কোনো প্রকার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বা মস্তিষ্ক নাই, তবে এটির একটি চোখ আছে যে আলোর দিক বুঝতে পারে। আর এভাবে এরা আলোর দিকে গিয়ে সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে খাবার তৈরি অথবা আলো থেকে সরে গিয়ে অতিরিক্ত অতিবেগুনী রশ্মি থেকে বাঁচে, যা অণুজীবজগতে বাঁচা-মরা নির্ধারণ করতে পারে। যদি আপনারা ২০১৪ এর কসমসঃ এ স্পেস টাইম অডিসি ডকুমেন্টারি সিরিজ দেখে থাকেন, তাহলে চমৎকার একটা দৃষ্টিনন্দন বর্ণোনা দেখতে পাবেন যে বিবর্তনের কোন পর্যায়ের চোখ চারপাশকে কিভাবে দেখতো।

ইউগ্লিনার আলোকসংবেদী “চোখ”

প্ল্যানেরিয়াদের শরীরে একটি অপসিন গহ্বর আছে যা দিয়ে এরা আলোর উৎসের দিক ও কোণ বুঝতে পারে। এছাড়াও স্টারফিশের প্রত্যেকটি “পা”য়ের মাথায় একটি করে আর্থোপডদের জটিল চক্ষুর সমমানের লাল রঙয়ের চোখ আছে, যেখানে আর্থোপডদের চোখ জটিল এবং একাধিক।

তারামাছের চোখ

তারামাছের চোখ

হর্স শু কাঁকড়ার অনেকগুলো চোখ আছে যার মধ্যে একটি তার লেজে।

হর্সশু কাঁকড়ার ৮টি চোখ

হর্সশু কাঁকড়ার  চোখ

পিনহোল চোখ ওয়ালা প্রাণীরা চোখের লেন্স ছাড়াও ফোকাস করতে পারে চোখের ভেতর প্রবেশ করা আলোর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে।

নটিলিসের পিনহোল চোখ

নটিলিসের পিনহোল চোখ

আমাদের চোখ হচ্ছে ক্যামেরা চোখ, যেখানে অপসিনের রেটিনা আছে, আর প্রোটিনের তৈরি লেন্স আছে যা চোখকে নিরাপত্তা দেয়া প্রোটিনের পরত থেকে তৈরি হয়।

বিভিন্ন ধরণের চোখ

বিভিন্ন ধরণের চোখ

আমাদের চোখ যতই উন্নত মনে হোক না কেন আমাদের কাছে, প্রকৃতিতে আমাদের চেয়েও উন্নত চোখ আছে। অক্টোপাসের চোখ প্রায় আমাদের মতই, তবে তাদের চোখে কোনো অন্ধ বিন্দু (blind spot) নাই। আমাদের চোখে অন্ধ বিন্দু আছে যার ক্ষতি আমরা চোখ ঘুরিয়ে কাটাই। ঝিনুকদের চোখও উন্নত। আমাদের চোখের যে প্রোটিন দিয়ে লেন্স তৈরি হয় সে প্রোটিন পুরোটা দিয়ে ঝিনুকের চোখ তৈরি, যার ফলে তার দৃষ্টি অনেক বেশী পরিষ্কার, এবং সে প্রায় ৩৬০ ডিগ্রিই দেখতে পায়।

ঝিনুকের চোখ

তো আমরা দেখি ছোট ছোট পরিবর্তন, সরল চোখ থেকে জটিল চোখ পর্যন্ত, যার প্রত্যেকটি বহনকারীর জন্য উপকারী, বংশানুক্রমে প্রাপ্ত, যা ডারউইন বলে গিয়েছেন। এছাড়াও ড্যান এরিক নীলসন এবং সুজান পেলগারের ১৯৯৪ সালের প্রকাশিত পেপারে তারা কম্পিউটার সিম্যুলেশনের মাধ্যমে দেখিয়েছেন কীভাবে মাত্র ২,০০০টি ধাপে আলোকসংবেদী কোষ থেকে অক্টোপাসের চোখ বিবর্তিত হতে পারে, তাও প্রতি ধাপে মাত্র ১% পরিবর্তনের মাধ্যমে, যা বিবর্তনের মূল ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

নীলসন পেলগারের পরীক্ষা

নীলসন পেলগারের পরীক্ষা

অভিযোগ – ডারউইনের তত্ত্ব নাকি ভুল প্রমাণিত করা হয়েছে

অরিজিন অফ স্পিসিসের ৬ষ্ঠ অধ্যায়েই ডারউইন লিখেছেন:


“If it could be demonstrated that any complex organ existed, which could not possibly have been formed by numerous, successive, slight modifications, my theory would absolutely break down.”


ভাবানুবাদ: “যদি দেখানো যায় যে কোন জটিল প্রাণী আছে যার জটিল কোনো অঙ্গের ব্যাপারে একাধিক, ক্রমান্বয়ে হওয়া, হালকা পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় না, তবে আমার এ তত্ত্ব পুরোপুরিভাবে ভুল প্রমাণিত হবে।”

সৃষ্টিতত্ত্ব বাদীরা মনে করেন তারা ডারউইনের তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করে ফেলেছেন হ্রাস অযোগ্য জটিলতা দিয়ে, যা কি না ভুল। তারা ঠিক পরের লাইনটিই পড়েন না যেখানে ডারউইন লিখেন- “কিন্তু আমি এমনটা পাই নি’’।

সেই ডারউইনের সময় থেকে এখনো পর্যন্ত কেউ এমন একটা প্রাণীর অস্তিত্ব দেখাতে পারেননি যা একাধিক, ক্রমান্বয়ে হওয়া, হালকা পরিবর্তনের  মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় না। হ্রাস অযোগ্য জটিলতা শুধু বৈজ্ঞানিকভাবেই ভুল প্রমাণিত করা হয় নি, ২০০৫ সালে কিটজ মিলার বনাম ডোভার এরিয়া স্কুলের মামলায় আদালতে প্রমাণিত হয়েছে হ্রাস অযোগ্য জটিল কোনো প্রাণী বা প্রত্যঙ্গ নাই। তারপরও সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা এই হ্রাস অযোগ্য জটিলতা দিয়ে বিবর্তনকে ভুল প্রমাণিত করার মিথ্যা আশায় তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন।

ডারউইন মৃত্যুশয্যায় নিজের তত্ত্বকে অস্বীকার করে গেছেন:

এই মিথ্যাচার, এমন কি উপরের তিনটাই প্রচার করেন লেডি হোপ নামের একজন খ্রিষ্টান নারী যাজক। তিনি বলেন তিনি অসুস্থ চার্লস ডারউইনকে দেখতে যান, এবং দেখতে পান ডারউইন বাইবেল পড়ছেন। ডারউইন নাকি তাকে বলেন ডারউইন তার তত্ত্বকে অস্বীকার করছেন, আর যাজক যেন তাকে নরক থেকে বাঁচান। এই মিথ্যাচারের জবাব ডারউইনের মৃত্যুর পর পরই দেয়া হয়, তারপরও যেন মানুষ বুঝতে চায় না। ডারউইনের পুত্র ফ্রান্সিস বলেন এটা “সম্পূর্ণ মিথ্যা” এবং তিনি লেডি হোপকে প্রকাশ্যে মিথ্যাবাদী বলেন, ডারউইনের আরেক পুত্র লিওনার্দো বলেন “লেডি হোপের গল্প বানোয়াট আর না হয় ভ্রম”। ডারউইনের কন্যা হেনরিয়াটা বলেন লেডি হোপ কখনো চার্লস ডারউইনের সাথে দেখা করেন নি, তিনি আরও বলেন তার পিতার মৃত্যুশয্যায় তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন।  লেডি হোপ চার্লস ডারউইনের কোন অসুস্থতার সময়ে উপস্থিত ছিলেন না, ডারউইন তার কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব অস্বীকার করেন নি। হেনরিয়াটা আরো  জানান তারা মনে করেন এই মিথ্যাচারের সূচনা যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে। আন্সারস ইন জেনেসিস নামের খ্রিষ্টান ওয়েবসাইট এই ঘটনাকে মিথ্যাচার বলে স্বীকার করে নিয়েছে।

যখন সৃষ্টিতত্ত্ব বাদীরা ডারউইনের তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক কোন ভুল খুঁজে বের করতে পারলো না তখন তারা ব্যক্তি আক্রমণে নেমে আসলো। তারা বলল-

অভিযোগ – ডারউইন নাকি বর্ণবাদী ছিলেন; তাঁর তত্ত্ব নাকি বর্ণবাদকে আস্কারা দেয়

এই অভিযোগের পিছনের যুক্তি হিসেবে তারা যা উপস্থাপন করেন সেটা হচ্ছে ডারউইনের বইয়ের নাম- “On the Origin of Species by Means of Natural Selection, or the Preservation of Favoured Races in the Struggle for Life.” এই নামে “Favoured Race” শব্দটির জন্য তারা অভিযোগ করেন ডারউইন বর্ণবাদী ছিলেন। Race শব্দটি বর্তমানে জাতি বা বর্ণ বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। তবে ডারউইনের বইয়ে, বা তখনকার সমাজে Race বলতে প্রজাতি বুঝানো হতো। খ্রিষ্টানরা ডারউইনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এনে বিবর্তন অস্বীকার করলেও ইতিহাসের সবচেয়ে মৌলবাদী (আলবৎ বর্ণবাদী) খ্রিষ্টান সংস্থা কু ক্লাক্স ক্ল্যান বিবর্তনকে অস্বীকার করে।

ডারউইনের সময়ে বা তার পূর্বে সবাই ধরে নিয়েছিল ভিন্ন বর্ণের মানুষদের আলাদা সৃষ্টি করা হয়েছে যাদের একে অপরের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নাই। বর্ণবাদ মানব সভ্যতার সকল সময়েই ছিল। ডারউইন বিবর্তনের ধারণা দেয়ার পূর্বে সবাই মনে করতো বিভিন্ন বর্ণের মানুষদের সৃষ্টি ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীদের থেকে হয়েছে বা বিভিন্ন উৎস থেকে হয়েছে। এই ধারণা ডেভিড হিউম, ভলতেয়ারদের মতো দার্শনিকদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল। ভিন্ন ভিন্ন সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণকে ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে। মর্মনরা মনে করে কৃষ্ণাঙ্গ শয়তানের চিহ্ন আর কৃষাঙ্গদের জন্ম হয়েছিল জেনেসিসের কেইনের বংশধর আর কেইন স্ত্রী হিসেবে শিম্পাঞ্জীকে বেছে নিয়েছিলেন। অন্যরা মনে করেন অন্য বর্ণদের অন্যান্য অণু দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। আধুনিক সন্ত্রাসী সংগঠন ক্রিশ্চিয়ান আইডেন্টিটি মনে করে ইহুদীদের জন্ম হয়েছিল যখন ইডেনের বাগানে ইভের সাথে সাপের মিলন হয়, আর যেহেতু সাপটিকে ধারণা করা হয় শয়তানের রূপ হিসেবে, সেহেতু ইহুদীরা শয়তানের জারজ সন্তান মনে করে তারা।

ডারউইন প্রাণবৃক্ষের ধারণা দেন, যেখানে প্রত্যেকটি শাখা-প্রশাখা একেকটি প্রজাতি, আর সবাই সমানভাবে বিবর্তিত, এরিস্টটল প্রাণসিঁড়ির ধারণা দেন যেখানে সর্বোচ্চ ধাপে মানুষের অবস্থান। এ দুই মিলিয়ে একটা জগা খিচুড়ি অবস্থার সৃষ্টি হয়, যেখানে মনে করা হয় একটি প্রজাতি অন্য প্রজাতি থেকে বেশী উন্নত। ডারউইন মনে করতেন না কোনো প্রজাতি কম বিবর্তিত, অথচ তাঁকে বর্ণবাদিতার অপবাদ দেয়া হয়!

ডারউইনের বহু আগে থেকেই বর্ণবাদ চলে আসছিল। ডারউইনের শত বছর আগের ক্যারোলাস লিনিয়াস, একজন সৃষ্টি তত্ত্ববিদ, আর দ্বিপদ নামকরণের জনক, মনে করতেন মানুষের ছয়টি প্রজাতি বিদ্যমান। Homo sapiens Europaenus albenscens বা ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ, Homo sapiens Americanus rebsceus বা আমেরিকান লাল মানুষ, Homo sapiens Asiaticus fuscusens বা এশিয়ান হলুদ মানুষ, Homo sapiens Africanus nigrus বা আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ, Homo troglodyte বা শিম্পাঞ্জী এবং Homo nocturnis বা ওরাংওটাং। তার এই ধারণা শ্বেতাঙ্গদের সর্বোচ্চ স্থান দেয়। লিনিয়াসের অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের কথা জানা ছিল না, পরবর্তীতে মনে করা হতো অস্ট্রেলীয় আদিবাসীরা মানুষের সর্বনিম্ন বর্ণ। তাদের স্থান হয় তখনকার সদ্য প্রাপ্ত গরিলাদের সাথে, কারণ দুইয়ের গায়ের রঙয়ের মিল। লিনিয়াস ডারউইনের প্রায় ১০০ বছর আগে বেঁচে ছিলেন। ডারউইন কখনোই এসবকে আস্কারা দেননি।

লিনিয়াসের ৬ প্রজাতি

লিনিয়াসের ৬ প্রজাতি

ডারউইনের বইগুলোর মধ্যে একটি বইয়ের একটি অনুচ্ছেদকে বর্ণবাদী হিসেবে ধরা যায়। তাঁর শেষ বই “The Descent of Men” এর অধ্যায় ৬ On the Affinities and Genealogy of Man এ ডারউইন লিখেন-


“At some future period, not very distant as measured by centuries, the civilized race of man will almost certainly exterminate, and replace, the savage races throughout the world. At some time the anthropomorphous apes, as Professor Schaffhausen has remarked, will no doubt be exterminated. The break between man and his nearest allies will then be wider, for it will intervene between man in a more civilized state, as we may hope, even the Caucasian, and some apes as low as a baboon, instead of between the Negro or Australian and the gorilla.”


ডারউইন বলছেন ভবিষ্যতে হয়তো এমন একটা সময় আসবে যখন সভ্য জাতিগুলো “অসভ্য” জাতিগুলোকে ধ্বংস এবং প্রতিস্থাপিত করবে। এটা পড়লে মনে হবে ডারউইন হয়তো বর্ণবাদকে উস্কে দিচ্ছেন। এখানে ডারউইন নৃতাত্ত্বিকভাবে সর্বজনগৃহীত একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলেছেন। ডারউইনের সময়কার সবাই এটাই মানতেন, ধর্মযাজক থেকে শুরু করে বৈজ্ঞানিকরাও।

বইটির ধারাবাহিক অগ্রগতিতে ডারউইনের চিন্তার একটি বিবর্তন দেখা যায়। যেমন অধ্যায় ৭ On the Races of Man-এ ডারউইন লিখেন-


“It is not my intention here to describe the several so-called races of men; but I am about to enquire what is the value of the differences between them under an classificatory point of view, and how they have originated.”


ডারউইন বলছেন, তিনি মানুষের তথাকথিত বর্ণ নিয়ে আলোচনা করতে বইটি লিখেননি, তিনি বের করতে চান মানুষদের মধ্যে থাকা অসামঞ্জস্যগুলোর মূল্য আর কীভাবে সেগুলো এসেছে।

তিনি আরো  লিখেন-

…the races of man are not sufficiently distinct to inhabit the same country without fusion; and the absence of fusion affords the usual and best test of specific distinctness.

তিনি বলছেন মানুষের ভিন্ন বর্ণ খুব বেশী আলাদা না যাতে করে তাদের ভিন্ন বর্ণ হিসেবে দেখা যায়। তিনি লিখেন আমাদের বর্ণ বিচার পক্ষপাতদুষ্ট, ভাসা-ভাসা আর ভুল। ডারউইন দেখান কীভাবে বিশেষজ্ঞ নৃতত্ত্ববিদেরা একই বর্ন দুইজন মানুষকে শ্রেনীবিন্যস্ত করতে ভুল করেন। ডারউইন আরো  লিখেন তাঁর সমসাময়িক এবং পূর্ববর্তী বিজ্ঞানীদের বর্ণ বিষয়ক বহুমতের কথা। তিনি লিখেন-

Man has been studied more carefully than any other animal, and yet there is the greatest possible diversity amongst capable judges whether he should be classed as a single species or race, or as two (Virey), as three (Jacquinot), as four (Kant), five (Blumenbach), six (Buffon), seven (Hunter), eight (Agassiz, eleven (Pickering), fifteen (Bory de St. Vincent), sixteen (Desmoilins), twenty-two (Morton), sixty (Crawford) or as sixty-three according to Burke.

ডারউইনের তত্ত্ব বলে মানুষের সকল বর্ণের উৎস একই প্রাণী, এখানে বর্ণবৈষম্যের কোনো সুযোগ নেই, এখানে কেউ কম বা বেশী বিবর্তিত না।

ডারউইন বর্ণবাদকে ঘৃণা করতেন। তিনি তাঁর বিগলের ডায়েরীতে নভেম্বর ১৮৩৫ সালের এক লেখায় তাহিতিয়ানদের সাথে শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের তুলনায় তাহিতিয়ানদের এগিয়ে রাখেন। The Voyage of Beagle এর চতুর্থ অধ্যায় Rio Negro to Bahia Blancaতে ডারউইন লিখেন “…I did not anywhere meet a more civil and obliging man than this negro; it was therefore the more painful to see that he would not sit down and eat with us.”

তিনি এখানে একজন কৃষ্ণাঙ্গের প্রশংসা করছেন, আর দুঃখ প্রকাশ করছেন যে সে তাদের সাথে বসে খেতে পারছে না। (Negro শব্দটি ১৮ শতকে প্রচলিত ছিল, এটাকে তখন স্বাভাবিক বলেই বিবেচনা করা হতো)

The Voyage of Beagle এর ২১তম অধ্যায় Mauritius to Englandএ ডারউইন লিখেন

I shall never again visit a slave-country, To this day, if I hear a distant scream, it recalls…when…I heard the most pitiable moans,… from a tortured slave.”

তিনি আরো  লিখেন- “…nor would I have mentioned the above revolting details, had I not met with several people, so blinded by the constitutional gaiety of the negro as to speak of slavery as a tolerable evil.

ডারউইন বর্ণবাদ আর দাসত্বপ্রথাকে এমনই ঘৃণা করতেন যে তিনি এমন কোনো দেশে না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন যেখানে দাসত্বপ্রথা চালু আছে। আর তিনি সকল মানুষের সাংবিধানিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলেই দাসত্বপ্রথার নামে চলা কৃষ্ণাঙ্গদের উপর হওয়া অমানবিক অত্যাচারের কথা লিখতেন।

তাঁর সময়ে কজন দাসত্ব আর বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে লিখতেন? অথচ তাকেই কিনা দাসত্ব আর বর্ণবাদের উস্কানিদাতা বলা হলো! একই বইয়ের অধ্যায় ২, অধ্যায় ৫এ বিস্তারিত ভাবে ডারউইন বর্ণবাদ আর দাসত্বের বিরুদ্ধে লিখেন। এমনকি তিনি কৃষাঙ্গদের প্রশংসা করেছেন, ইউরোপীয়দের সমালোচনাও করেছেন। এবার ভাবুন, ডারউইন ১৮ শতকের একজন সভ্য ইংরেজ উচ্চবংশীয় পরিবারের সদস্য ছিলেন, যখন যুক্তরাজ্য ছিল একটা বর্ণবাদী সমাজ।

তাঁর বই On the Origin of Species কোথাও বর্ণবাদের পক্ষে কথা বলেনি, উল্টো তিনি বলেছেন বর্ণবাদের কোনো ভিত্তি নেই, কারণ বর্ণভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাস পরিবেশের সাথে পরিবর্তিত হয়।

অভিযোগ – ডারউইনের লেখা নাকি হিটলারকে অনুপ্রাণিত করেছিলো

এই অভিযোগটা আপেক্ষিকভাবে নতুন। ডারউইনের সমালোচকরা বলার চেষ্টা করেন যে হিটলারের করা গণহত্যা ডারউইনবাদ দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়। তারা প্রমাণ হিসেবে তুলে আনেন মাইন ক্যাম্ফের দ্বিতীয় খণ্ডের অধ্যায় চার: Personality and the Conception of the Folkish State এর এই অংশটি-

হিটলারের মাইন ক্যাম্ফ

হিটলারের মাইন ক্যাম্ফ

তবে তারা যে জিনিসটা দেখেও দেখেন না সেটা হচ্ছে হিটলার লিখেছেন “cultural evolution”, তারা আবারো একই অনুচ্ছেদের আরেকটি লাইন দেখান, যদিও সেটা বিবর্তনের পক্ষে না গিয়ে বিবর্তন প্রথমবার কীভাবে শুরু হয়েছিল সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

হিটলার অবশ্য একবার বিবর্তনের মাধ্যমে “শক্তিধররা দুর্বলদের উপর কর্তৃত্ব ফলাবে” এমনটা বলেছেন, যদিও সেটা ডারউইনের বিবর্তনের কোথাও বলা নেই। কারণ ডারউইন একই প্রজাতির মাঝে শক্তিধর আর দুর্বলের ব্যাপারটা তাঁর বইয়ে অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন একই প্রজাতিতে, এমনকি প্রাণীজগতে বেশী বিবর্তিত বা কম বিবর্তিত বলে কিছু নেই।  আবার, হিটলারের আগের কথাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে বোঝা যায় যে হিটলার বলছিলেন সামরিক আর শিল্পক্ষেত্রে শক্তিধর আর দুর্বলের কথা।

হিটলার তার বইয়ের কোথাও ডারউইনের নাম উল্লেখ করেননি, শুধু একবার ডারউইনবাদের কথা উল্লেখ করেছেন। মাইন ক্যাম্ফের ১ম খণ্ডের ১১তম অধ্যায় Nation and Race এ হিটলার পরিষ্কার করে দেন, তিনি বিবর্তনের কিছুই বুঝেন না। হিটলার বলেন – মাইক্রো ইভল্যুশন হতে পারে, তবে প্রজাতি পরিবর্তন করার মতো বিবর্তন অসম্ভব। হিটলার লিখেন যে প্রাণী যা আছে তাই থাকে। সৃষ্টি তত্ত্ববিদরা একই ধরনের যুক্তি ব্যবহার করে থাকেন, তবে এক্ষেত্রে তারা তাদের নিজেদের যুক্তি চিনতে পারলেন না? হিটলার লিখেন-

“…The act which brings about such a development is a sin against the will of the Eternal Creator. And a sin, this act will be avenged.”

তিনি লিখেন বিবর্তনের কথা বলা চিরস্থায়ী স্রষ্টার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘোর পাপ করে, আর এমন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

হিটলারের শাসনামলে ডারউইনের সকল বই নিষিদ্ধ ছিল। এমন কি সেগুলো পুড়িয়েও দেয়া হতো। এমন একজন ব্যক্তি কীভাবে ডারউইনের তত্ত্ব থেকে অনুপ্রেরণা পেতে পারে?

যদি আমরা তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে ডারউইন এইসব করেছেন, তাহলেও সেটা কী তাঁর তত্ত্বের উপর এতটুকু প্রভাব ফেলবে? বিজ্ঞান তো ব্যক্তিনির্ভর জ্ঞান না, বিজ্ঞান হচ্ছে প্রমাণ নির্ভর জ্ঞান। তবে কারো তত্ত্বের কোনো খুঁত না পেয়ে তাঁর চরিত্র সম্পর্কে, তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে মিথ্যাচার করাটা উচিত না। অন্তত, ব্যক্তির প্রতি সম্মান রেখে সেগুলো এড়িয়ে চলা উচিত।

Comments

আপনার আরো পছন্দ হতে পারে...

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
জানান আমাকে যখন আসবে -
guest
2 Comments
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
সাদ্দাম হোসেন সাজু
সাদ্দাম হোসেন সাজু
7 বছর পূর্বে

অসাধারন একটি লেখা অনেক কিছুই জানতে পারলাম।।” বিজ্ঞান তো
ব্যক্তিনির্ভর জ্ঞান না, বিজ্ঞান হচ্ছে প্রমাণ নির্ভর
জ্ঞান। তবে কারো তত্ত্বের কোনো খুঁত না
পেয়ে তাঁর চরিত্র সম্পর্কে, তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে
মিথ্যাচার করাটা উচিত না। অন্তত, ব্যক্তির প্রতি সম্মান
রেখে সেগুলো এড়িয়ে চলা উচিত।” এই একটি কথা মানুষ বুঝে না কেন?????

2
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x