ভূমিকা
আধুনিক অণুজীববিজ্ঞানের জনক রবার্ট কখ অ্যানথ্রাক্স ও কলেরা রোগের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত। এছাড়া যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসামান্য। ১৯০৫ সালে নোবেল জয়ী এই মহান বিজ্ঞানী ১৮৪৩ সালের ১১ ডিসেম্বরে জার্মানীর হ্যানোভারে জন্মগ্রহণ করেন।
অ্যানথ্রাক্স নিয়ে গবেষণা
১৮৭২ সালে তিনি বার্লিনের কাছের একটি গ্রামে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগ দেন। গবাদি পশুর অ্যানথ্রাক্স রোগ তখন ছিলো বার্লিনের প্রধান সমস্যা। তিনি তাঁর ২৮ তম জন্মদিনে স্ত্রীর থেকে উপহার পাওয়া মাইক্রোস্কোপ নিয়ে নিজ বাড়িতেই গবেষণা শুরু করেন অ্যানথ্রাক্স নিয়ে! কখের উদ্দেশ্য ছিল বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণ করা ফরাসী বিজ্ঞানীদের (ক্যাসিমির দাভাঁন এবং পিয়ের ফ্রাসোয়া) আবিষ্কার করা ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস (Bacillus anthracis) আসলেই অ্যানথ্রাক্স রোগের কারণ। নিজের বানানো কাঠের সরু টুকরা দিয়ে অ্যানথ্রাক্সে মৃত একটি ভেড়ার প্লীহা থেকে সংগৃহীত রক্ত তিনি কিছু ইঁদুরের শরীরের প্রবেশ করালেন, কিছুদিনের মধ্যেই সেই ইঁদুরগুলো মারা যায় অ্যানথ্রাক্সে। অন্য এক গ্রুপ ইঁদুরকে সুস্থ ভেড়ার প্লীহা থেকে সংগৃহীত রক্ত প্রবেশ করানো হলো, তিনি দেখলেন তাদের কোনো সমস্যা হলো না। এই ছোট পরীক্ষা দ্বারা অ্যানথ্রাক্স অসুখটি আক্রান্ত গবাদি পশু যে রক্তের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে, তা নিশ্চিত করলো। কিন্তু, কখ সেখানেই থেমে গেলেন না। তিনি আরো জানতে আগ্রহী হলেন, অ্যানথ্রাক্সের এই ব্যাকটেরিয়া যা কখনোই কোনো প্রাণীর সংস্পর্শে আসেনি, তাদের যদি সুস্থ ইঁদুরে প্রবেশ করানো হয় তাহলে কি তাদের অ্যানথ্রাক্স হবে?
এ জন্য তার দরকার ছিলো বিশুদ্ধ ব্যাক্টেরিয়ার কালচার। সেটা জোগাড় করা খুব কঠিনই বটে। তিনি একটি ষাঁড়ের চোখের ভিতরের তরল (অ্যাকুয়াস হিউমার) সেখানে এই ব্যাক্টেরিয়াটির বিশুদ্ধ কালচার চাষ করলেন! তিনিই প্রথম বারের মত দেখালেন এই কালচারের সময় যদি পরিস্থিতি প্রতিকূল হয় তবে এই ব্যাক্টেরিয়াগুলো খুব দ্রুত গোলাকৃতির স্পোর তৈরি করে এবং অবস্থা অনুকূলে আসলে আবার এই স্পোরগুলো থেকেই ব্যাক্টেরিয়া বেরিয়ে এসে আবার বংশবৃদ্ধি শুরু করে এবং এই ব্যাসিলাইগুলো যা আগে কোনো প্রাণীতে ছিল না, তারা তারপরও সুস্থ ইঁদুরে অ্যানথ্রাক্স রোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম। ব্রেসলাউ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানীর অধ্যাপক ফার্দিনান্ড কন এই বিষয়টি জানার পর এই আবিষ্কারের গুরুত্ব বুঝতে পেরে তার সহকর্মী এবং প্যাথলজির অধ্যাপক কনহাইমকে কখে’র গবেষণা দেখার ব্যবস্থা করে দেন। তাঁরা কখের গবেষণার বিষয়টি তাদের বোটানিক্যাল জার্নালে ১৮৭৬ সালে প্রকাশ করেন। কিছুদিনের ভিতরেই বিজ্ঞানীমহলে এটা ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। ১৮৭৮ সালে অ্যানথ্রাক্স এর কারণ, বিস্তার, প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের যাবতীয় বিষয়গুলো নিয়ে তিনি প্রকাশ করেন তার মূল গবেষণাপত্রটি। এই এনথ্রাক্সের টিকা আবিষ্কারের জন্য লুই পাস্তুর কী করেছিলেন, সেই কাহিনীও পড়তে পারেন বিজ্ঞানযাত্রার ওয়েবসাইটেই।
এছাড়া কখ কোনো ব্যাক্টেরিয়াকে কোনো রোগের কারণ হিসাবে সনাক্ত করতে হলে তার জন্য কিছু শর্ত বেঁধে দেন, যা “কখের স্বীকার্য” (Koch’s postulate) হিসেবে পরিচিত। পরবর্তীতে ভাইরাস আবিষ্কার হলে, শর্তগুলোকে খানিকটা বদলানো হয়, যা পরিচিত Koch-Henle’s Postulate হিসাবে, শর্তগুলো এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে।
যক্ষ্মা নিয়ে গবেষণা
যক্ষ্মার জীবাণু যা এখন Mycobacterium tuberculosis নামে পরিচিত, খুব ধীর গতিতে বংশ বৃদ্ধি করে। ধৈর্য্যহীন কোন গবেষক সহজে যেখানে হাল ছেড়ে দিতেন, সেখানে কখ অপেক্ষা করেছেন তার কালচার মিডিয়ায় ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধির জন্য। রবার্ট কখ ১৮৮২ সালের ২৪শে মার্চ বার্লিন সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির একটি মিটিং এ উপস্থিত সবাইকে বিস্মিত করে ঘোষণা করেন যে, তিনি যক্ষ্মা বা টিউবারক্যুলোসিস (TB) এর জীবাণুটি খুঁজে পেয়েছেন। এরপর দীর্ঘ একটি বক্তৃতায় দর্শকদের বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন তার গবেষণার প্রক্রিয়া, অসংখ্য পরীক্ষার বিবরণ। সম্মেলনে উপস্থিত দর্শকরা মন্ত্রমু্গ্ধ হয়ে কখের সেই ভাষণ শোনেন। এই আবিষ্কারটির মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগকে জয় করার জন্য মানুষের আসল সংগ্রামটির সূচনা করে। প্রতি বছর ২৪ শে মার্চ কখের এই আবিষ্কারের সম্মানে দিনটিকে WHO পরবর্তীতে World TB Day হিসাবে ঘোষণা করে।
ওলা বিবির (কলেরার) গজব নিয়ে গবেষণা ও উল্লেখযোগ্য পুরষ্কার!
১৮৮৩ সালে জার্মান কলেরা কমিশনের প্রধান হয়ে মিশরে যান তিনি, একটি কলেরার মহামারী তদন্ত করতে। এখানেই তিনি কলেরার জীবাণু আবিষ্কার করেন এবং এর একটি বিশুদ্ধ কালচার জার্মানীতে নিয়ে আসেন। কলেরা সংক্রান্ত তার এই গবেষণার জন্য তাকে বিশেষ পুরষ্কার দেয়া হয় ( যার মুল্য সেই সময়ে প্রায় ১ লক্ষ জার্মান মার্ক)। এছাড়া জার্মানী অর্ডার অব দি ক্রাউন এবং গ্র্যান্ড ক্রস অব দি রেড ঈগল (কোন চিকিৎসা বিজ্ঞানীকে সেবারই প্রথম দেয়া হয়), এবং রাশিয়া, তুরস্ক থেকে সর্বোচ্চ বেসামরিক পদকও পেয়েছিলেন। বিশ্বব্যাপী অসংখ্য সোসাইটি এবং একাডেমীর সদস্য ছিলেন তিনি। তাঁর নামে জার্মান সরকার “রবার্ট কখ পুরষ্কার” প্রদান করে। প্রতি বছর বায়োমেডিকেল গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য একক বা যৌথভাবে এই পুরষ্কার দেওয়া হয়। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ব্যস্ত ছিলেন গবেষণায়। কাজ প্রিয় এই মানুষটি পৃথিবীর নানা দেশে ভ্রমণ করতে ভালোবাসতেন।
মৃত্যু ও ব্যস্ত জীবনের পরিসমাপ্তি
১৯১০ সালে মে মাসের ২৭ তারিখ, ৬৬ বছর বয়সে বাডেন-বাডেনে হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এই অসাধারণ বিজ্ঞানী। মানবজাতি তাঁর এই বিশাল অবদান স্মরণ রাখবে সবসময়। জীববিজ্ঞানের ইতিহাসে তিনি এক বিশেষ নক্ষত্র।