কসমস (১৯৮০) সকল এপিসোডের বাংলা সাবটাইটেল.
বিশ্বগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য
২য় ঘণ্টার যাত্রার পর ৩য় ঘণ্টার যাত্রার শুরুটা হলো নক্ষত্রের কিছু ব্যাপার দিয়ে। নক্ষত্রদের আমরা দেখি দুইটাভাবে। এক, আসলেই ওরা দেখতে যেমন; দুই, আমরা ওদেরকে যেভাবে দেখতে চাই।
আসলে ওরা দেখতে কেমন? জ্যোতির্বিদেরা ইয়া বড় বড় মেশিন নিয়ে দিনের পর দিন অংক কষে এক একটা আবিষ্কার করেন। বাস্তবে গ্রহ-নক্ষত্র সূর্য, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতিকে যেভাবে দেখি তেমনই। এখানে আছে অনেক অনেক সম্ভাবনা ও গবেষণার বিষয়। কিন্তু, জ্যোতিষী নামে একদল মজার মানুষ আছে যারা কিনা বেশিই ধান্দাবাজ ও তারা যুক্তির বাঁধা পেরিয়ে অলিক কল্পনা করতেই বেশি ভালোবাসেন। এই দল শনি, মঙ্গল, বৃহস্পতির মতো গ্রহকে মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে মেনে নেন। কিন্তু, একটা সময় এই জ্যোতির্বিদ ও জ্যোতিষী নামের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের মানুষগুলো আলাদা ছিলেন না। ইয়োহানেস কেপলার নামের এক গবেষক পার্থক্য করে দিয়েছিলেন এই দুই ধরনের মানুষদের।
সেগান আমাকে মজা দেখানোর জন্য নিয়ে গেলেন একটা বুকশপে। আমেরিকার দৈনিক পত্রিকা দেখিয়ে আক্ষেপ করে বললেন, “এদের সবারই জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে দৈনিক কলাম থাকলেও জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে সাপ্তাহিক কলামও নেই”। গলার হার, হাতের আংটির সাথে “ডিজাস্টার (দুর্যোগ)”, “ইনফ্লুয়েন্স (প্রভাব)” এর মতো বহুল ব্যবহৃত শব্দও জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রভাব আমাদের নিত্যদিনের জীবনে।
এরপরেই এই জ্যোতিষশাস্ত্রের নাড়ি-নক্ষত্র আমাকে বোঝাতে শুরু করলেন সেগান। আসলে ব্যাপারটা হলো, কারো জন্মের সময়ে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান তার ভাগ্যের উপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলে বলেই ‘বিজ্ঞ’ জ্যোতিষীদের মত। পুরোনো দিনে রাজা-বাদশাহদের আমলে এই রীতিনীতি ভালোই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো! রাজ্যের প্রধান কেউ যখন মারা গিয়েছিলো বা যুদ্ধ হয়েছিলো তখন নক্ষত্র কোন অবস্থানে ছিলো তার উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতের হিসেব-নিকেশ করে ফেলতেন জ্যোতিষীরা। এটা অনেক আরামদায়ক ভণ্ডামি।
এবার সেগান যা করলেন তা দেখে আপনার নিজের উপর রাগই হবে যদি আপনি আপনার দিন শুরু করেন পত্রিকার সেই রাশিফল পড়ে। সেগান দুইটা ভিন্ন পত্রিকা নিলেন ও রাশিফলেই পাতায় গিয়ে পড়ে শোনালেন। স্বাভাবিকভাবেই এই ভণ্ডামির জিনিসপত্র একই কথা দিয়ে ঠাসা নেই! দুই পত্রিকা দুই রকম কথা প্রকাশ করছে। আর, দুইটা পত্রিকাই বলছে ‘কী করতে হবে’; কিন্তু ‘কী ঘটবে’ তা কেউই বলছে না। এরপরেই তিনি একটি জমজ সন্তানের উদাহরণ দিলেন। বললেন, “জমজদের অনেক উদাহরণ আছে যে একজন জন্মের পরপর বা কিছু বছর পর মারা যায়, কিন্তু একজন বেঁচে থাকে বহুবছর। যদি জ্যোতিষশাস্ত্র সত্য হতো তাহলে তাহলে কীভাবে এই নির্দিষ্ট সময়ে জন্ম নেওয়া দুজনের ভাগ্য আলাদা হওয়া সম্ভব? কীভাবেই বা আমার জন্মের সময়ে মঙ্গলের অবস্থান আমার অতীত ও বর্তমান নিয়ন্ত্রণ করবে? একটা উপায়েই প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব, সেটা মহাকর্ষ। কিন্তু, পৃথিবীর মহাকর্ষ তো মঙ্গলের চেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে আমাকে, কারণ এটা অনেক কাছে, মঙ্গলের চেয়ে।” আশা করি এই ছোট্ট প্রশ্নই জ্যোতিষশাস্ত্র বিশ্বাসীদের বিশ্বাস ভেঙ্গে দিতে যথেষ্ট।
আঁটঘাট বেঁধে ফাঁকা মাঠের মধ্যে বসে সারারাত তারা দেখানোর জন্য আদিমযুগীয় প্রস্তুতি আগে কেউ নিয়েছে কিনা জানি না, কিন্তু সেগান সেটা করলেন। বেশ কিছু কাঠ জোগাড় করে মাঠের মধ্যে চলে এলেন নক্ষত্র বোঝাবেন বলে। বসে গেলাম তার সাথে সেই অসাধারণ আড্ডায়। তিনি আমাকে আকাশে শুধু তারাই নয়, কিছু আঁকিবুকিও দেখালেন। যেন আপনি আকাশে যা-ই আঁকবেন, আকাশ আপনাকে তা-ই দেখাবে। যারা ফুলের মধ্যে ফটোশপ করা মানবমুখ দেখতে পান তারা একটু কষ্ট করলে আকাশে চামচ, বাটি, লাঙ্গল থেকে শুরু করে স্বর্গের পরীও দেখে ফেলতে পারেন। যারা কোনো ভাবেই দেখতে পাচ্ছেন না, তারা কসমস দেখুন। দেখে নিন, আপনি না দেখলেও পুরাতন জ্যোতিষি আর অতিকল্পনাপ্রবণ মানুষেরা কতকিছু ভেবে নিতো আকাশে। সেগান মজা করে বলেছিলেন, “আমরা শিকারী ছিলাম তাই লাঙ্গল, চামচ, কুকুর, ঘোড়া বসিয়েছি। এখন হলে হয়তো ফ্রিজ, বাইসাইকেল, গাড়ি, রকেট আকাশে বসিয়ে ফেলতাম”। একে একে তিনি কিছু গোষ্ঠির উদাহরণ দিয়ে প্রশ্ন করলেন, “কেন এরা এতো কষ্ট করে জ্যোতির্বিদ্যা শিখতে গেলো?” উত্তর নিজেই দিলেন, “কারণটা শিকার ও কৃষি, এবং আমাদের জীবন-মরণ প্রশ্ন।“ তিনি এক এক করে বেশ কিছু যন্ত্র দেখালেন সময়, বছর পরিবর্তন হিসাব রাখার। এ কোনো ছোটোখাটো যন্ত্র না। এক একটা বিশাল বিশাল যন্ত্র।
টলেমীর মডেল দেখিয়ে সেগান বলতে লাগলেন সেই সময়ের বিশ্বাস সম্পর্কে। টলেমীর বিশ্বাস ছিলো পৃথিবীই সব কিছুর কেন্দ্র। এই বিশ্বাস ভুগিয়েছিলো অনেক অনেক দিন এই পৃথিবীর সভ্যতাকে। কিন্তু, সেই সময়ে ‘এই সব ঘুরছে কীভাবে’ প্রশ্ন করাটাও তো কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো না। পরে কোপার্নিকাস সৌরকেন্দ্রিক মডেল ব্যাখ্যা করেছিলেন, টলেমীর প্রায় ১৫০০ বছর পর। আজীবন ধরে ধর্মের কাজ যা তা ধর্ম করলো! ওই একটা বইয়ে যা লেখা তার বাইরে তো কিছু মেনে নেওয়া যায় না, তাই না? তাই ক্যাথলিক চার্চ কোপার্নিকাসের বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিলো। পরে লোকে সৌরমডেল মেনে নিলো কবে? কে-ই বা এই বিপ্লব ঘটালো? এর পিছনে ছিলেন কেপলার। যিনি একটা দাবানল তৈরী করেছিলেন বিজ্ঞানের অগ্রগতির। এই ঘণ্টার বাকি পুরোটা সময় কেটেছিলো কেপলারের জীবন নিয়ে। তার আবিষ্কার, আবিষ্কার পরবর্তী কষ্ট, আবিষ্কারের পদ্ধতি খুব ভালোভাবে বুঝতে কসমস একটিবারের জন্য হলেও দেখার কোনো বিকল্প নেই। চলুন বাকি সময়ের কিছু গল্প আপনাদের বলার চেষ্টা করে দেখি-
ঈশ্বরের মন বুঝতে চাওয়া কেপলার প্রথম চেষ্টা করছিলেন একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার। সেটা হলো, “কেন গ্রহ মাত্র ৬টি? (তখন ৬টি গ্রহের কথা জানতো মানুষ) কেন ২০ টি নয় বা ২০০টি নয়? কেন আরো বেশি নয়?” দিনের পর দিন গবেষণার পর ব্যর্থ কেপলার ‘টাইকো ব্রাহী’ নামক একজনের সরনাপন্ন হন। সেই সময়ে কেপলারের এলাকাতে নতুন আইন জারি হয় যেন কেউ ধর্ম বিরোধী বই না রাখে। যারা ধর্ম মানে না তাদেরকে বিতারিত করা হলো দেশ থেকে। কেপলারও মেনে নিলেন নির্বাসন। তাঁর ভাষ্যমতে, “ভণ্ডামি আমি কখোনোই শিখিনি। আমি বিশ্বাসের ব্যাপারে আন্তরিক। এটা কোনো ছেলে খেলা নয় আমার কাছে।“ নির্বাসনের সময়ে তিনি টাইকো ব্রাহীর কাছে যান। টাইকো ব্রাহী ছিলেন জ্ঞানী কিন্তু অহংকারী স্বভাবের মানুষ। কে বড় গণিতবিদ, এই নিয়ে ছাত্রের সাথে বাজি লেগে নিজের নাকটাই খুঁইয়েছিলেন বেচারা। পারস্পারিক সন্দেহের জেরে টাইকো নিজের কাজকর্মগুলো কেপলারকে দিতে চাইতেন না। কিন্তু, মাত্রাতিরিক্ত খাওয়াদাওয়া তার জীবনের ইতি টানার পর কেপলার টাইকোর কাজগুলো দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি নিখুঁত আকারের জ্যামিতিক ব্যাপার স্যাপারে বিশ্বাস রাখতেন। কিন্তু, শেষমেশ বৃত্তীয় কক্ষপথ দিয়ে কাজ হচ্ছিলো না। তিনি বিরক্ত হয়েছিলেন ঈশ্বর নিখুঁত নির্মাতা নন এটা ভেবে। তবুও সত্যের পথে অটল থাকার মানসিকতা তাকে উপবৃত্তীয় কক্ষপথ মেনে নিতেই বাধ্য করেছিলো। অনেক হিসাবের পর কেপলার তাঁর ২য় সূত্র প্রকাশ করেছিলেন, যেটি ছিলো “একটি গ্রহ নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রফল তৈরী করে”। তাঁর ৩য় সূত্র ছিলো, “কক্ষপথে ঘুরতে গ্রহের যে সময় লাগে তার বর্গ সূর্য থেকে গড় দূরত্বের ঘনের সমানুপাতিক”।
যুদ্ধে ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, ও মাকে হারানো কেপলার নিজেকে দোষী মনে করতেন এইসবের জন্য। কেপলার ‘দ্য সমনিয়াম’ নামে একটি কল্পকাহিনী লেখেন যা ছিলো বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন চাঁদে যাওয়ার। পৃথিবী ছাড়ার জন্য তিনি তার মায়ের আওড়ানো মন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন বইটিতে। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন অকুতোভয় ও হার না মানা এক অভিযাত্রীদের। কেপলার গাণিতিক প্রমাণের ভিত্তিতে মেনে নিয়েছিলেন কঠিন ও বাস্তব সত্যকে, কবর দিয়েছিলেন নিজের বিশ্বাস, ভ্রমকে। বিজ্ঞান কাজ করে ঠিক এইভাবে। এগিয়ে চলে এরমকম সত্য সন্ধানীদের হাতে হাত রেখে। বিজ্ঞান একটা নিখুঁত রিলে রেস। এখানে ভণ্ডামির সুযোগ নেই। সত্যই এর প্রাণ। কঠিন বাস্তবতা স্বীকার করে নেওয়াই এর শক্তি। একারণেই বিজ্ঞানের জ্ঞান টিকে আছে মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুর মধ্যে। এটাই এর সৌন্দর্য্য। এটাকে অনায়াসে ভালোবাসা যায়।
“যারা ফুলের মধ্যে ফটোশপ করা মানবমুখ দেখতে পান তারা একটু কষ্ট করলে আকাশে চামচ, বাটি, লাঙ্গল থেকে শুরু করে স্বর্গের পরীও দেখে ফেলতে পারেন।” – এইটা জোস ছিলো! তবে মানুষ মনে হয় আরো এক ধাপ এগিয়ে গেছে সভ্যতার সাথে। এখন আর কয়েকটা তারা মিলিয়ে আঁকতে হয় না, গ্রহ-উপগ্রহের মাঝেই অনেকের চেহারা দেখে ফেলি আমরা টুক করে! 😉