স্যাটেলাইট কী, কেন, কিভাবে, কোথায়? কী লাভ?

স্যাটেলাইট শব্দটা জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন জোহানেস কেপলার, ১৬১০ সালে, বৃহস্পতিকে ঘিরে ঘূর্ণায়মান চাঁদগুলোকে বুঝানোর জন্য, যে চাঁদগুলো প্রথম দেখেছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি, তার নিজের নির্মিত টেলিস্কোপ দিয়ে।

মনে প্রশ্ন আসছে না, স্যাটেলাইটের নাম কেন “স্যাটেলাইট”? উত্তরটা দেয়া যাক। স্যাটেলাইট শব্দটা আসছে ল্যাটিন থেকে, যেটার ইংরেজি অনুবাদ করলে দাঁড়ায় “অনুসরণ করা”। চাঁদ পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে, চাঁদ একটি স্যাটেলাইট। পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘুরছে, সুতরাং পৃথিবীও একটি স্যাটেলাইট। সূর্য আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সিকে ঘিরে ঘুরছে, সুতরাং সূর্যও একটি স্যাটেলাইট। এগুলা হচ্ছে প্রাকৃতিক স্যাটেলাইট। কিন্তু, “মানুষের তৈরি কোনো যন্ত্র পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে” এই ধরণের কিছু বুঝানোর জন্য “স্যাটেলাইট” শব্দটার ব্যবহার হয় প্রথমে থিওরিটিক্যালি, ১৯৩৬ সালে এবং পরে বৈজ্ঞানিকভাবে গৃহীত হয় ১৯৫৭ সালে, যখন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠায়। স্পুটনিক-১ এর নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। এর পরের বছরই ১৯৫৮ সালে আমেরিকা পাঠায় তাদের বানানো প্রথম স্যাটেলাইট, নাম এক্সপ্লোরার-১।

স্যাটেলাইট জিনিসটা আসলে কী?

জিনিসটা আসলে কী? একটা জিনিস রকেট দিয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে পাঠিয়ে দিলাম, কেন সেটা ছিটকে পড়ছে না বাইরে? বা, আবার পড়ে যাচ্ছে না পৃথিবীতে? এখানেই বিজ্ঞানের সৌন্দর্য। যে কোনো বস্তুই অন্য বস্তুকে নিজের দিকে টানে, যাকে আমরা মহাকর্ষ বলি। আর, সেই বস্তুগুলার একটা যদি পৃথিবী হয়, তখন পৃথিবী যেই বলে অন্য বস্তুটাকে টানে, তাকে বলে অভিকর্ষ (অর্থাৎ, অভিকর্ষ মহাকর্ষের একটি বিশেষ নাম, যেখানে পৃথিবী অন্তর্ভুক্ত)। এই মহাকর্ষ বলের কারণেই আমরা এবং সৌরজগতের অন্যরা সূর্যের চারিদিকে ঘুরছি অবিরাম। তো, পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরে কোনো স্থানে (কক্ষপথে) পৃথিবীর এই আকর্ষণবল এবং পাঠানো বস্তুর গতি, এই দুটোর ভারসাম্য খুঁজে বের করে যদি সেই গতিতে কোন কিছুকে সেখানে পাঠানো হয়, তখন সেটা সেখানে পৃথিবীর আকর্ষণে আটকে গিয়ে ঘুরতে থাকবে পৃথিবীকে ঘিরে। যেহেতু বায়ু বা অন্য কোনো কিছুর বাধা নেই সেখানে, তাই সেই গতিতেই সেটা চলতে থাকে, চলতেই থাকে (নিউটনের গতির প্রথম সূত্র)।

বুঝলাম যে, তারা পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সেখানে তো হাজার হাজার এরকম স্যাটেলাইট ঘুরছে। কিন্তু, তাদের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ হচ্ছে না কেন? সংঘর্ষ হচ্ছে না কারণ তারা প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন কক্ষপথে এবং ভিন্ন ভিন্ন গতিতে প্রদক্ষিণ করছে পৃথিবীকে। এরপরও যে সংঘর্ষ হয় না, তা না। এইতো ২০০৯ এর ফেব্রুয়ারিতেই দুইটা কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইট এর মধ্যে সংঘর্ষ হলো যারা একটি ছিল আমেরিকার, আরেকটি রাশিয়ার। তবে এটিই এখন পর্যন্ত এই ধরনের একমাত্র ঘটনা।

কেন?

হাজার ট্যাকা খরচ করে পাঠায়ে তো দিলাম। লাভ কী? লাভ হইলো, এইযে আপনি ইন্টারনেট ব্যবহার করে ফেসবুকে বসে স্যাটেলাইটের প্রয়োজন নিয়ে মজা করছেন, ট্রল করছেন, সেই আপনি যেন আপনার জীবনটা একটু স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে কাটাতে পারেন সেটা নিশ্চিত করা। সেটা কিভাবে করে? সেটা করে আবহাওয়া সম্পর্কে আগাম পূর্বাভাস দিয়ে, যাতে আপনি আপনার প্র্যাতাহিক জীবনে আবহাওয়া, ঝড় ,জলোচ্ছ্বাস, হ্যারিকেন এসব সম্পর্কিত ঝামেলায় কম পড়েন। এরপর ধরেন, অব্যবহৃত ব্রেইনের অকার্যকারিতার কারণে কখনো কোথাও হারিয়ে গেলে যেন নিজের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে অন্যদেরকে নিখুঁত তথ্য দিতে পারেন সেটা নিশ্চিত করা। যেন ফোনে আপনার বন্ধুর সাথে স্যাটেলাইটের অপ্রয়োজনীয়তা নিয়ে, এটা বানাতে এবং পাঠাতে যে হাজার কোটি টাকার অপচয়, সেটা নিয়ে আরও সহজে এবং ঝামেলামুক্তভাবে ঠাট্টা মশকরা করতে পারেন, সেটার ব্যবস্থা করা। ঠাট্টা মশকরা করা শেষ হলে এরপর একটা টিভি চ্যানেল খুলে যেন আরামসে কিছুক্ষণ কোনো ঝামেলা ছাড়া কোয়ালিটি টাইম পাস করতে পারেন, সেটার ব্যবস্থা করা। আপনার জন্য আপাতত এগুলোই। আরও অনেক কিছুই আছে যেগুলা আসলে আপনার দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় বলে মনে না হওয়াই স্বাভাবিক। যেমন, সূর্য, সৌরঝড়, উল্কাপাত, উল্কাদের গতি-প্রকৃতি এবং সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলো পর্যেবক্ষণ করা। সৌরজগতের বাইরের নক্ষত্র, গ্রহ, গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করা যেসব বিজ্ঞানীদেরকে আমাদের এই মহাজগৎ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে সাহায্য করবে।

কত প্রকার?

অনেক ধরণের স্যাটেলাইটই আছে। তবে, মূলত যে দুটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত সেদুটি হচ্ছে জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট এবং পোলার অরবিটিং স্যাটেলাইট। জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট হচ্ছে সেগুলো যেগুলোর গতি পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির সমান এবং বিষুবরেখা বরাবর পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘুরতে থাকে। ফলে তাদেরকে পৃথিবী থেকে একটা নির্দিষ্ট অবস্থানের সাপেক্ষে স্থির বলে মনে হয়, যেটা এইরূপ নামকরণের কারণ। মূলত রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন, কোন কিছুর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য (GPS – Global Positioning System) – এই ধরণের যোগাযোগের কাজে ব্যবহৃত হয় এই স্যাটেলাইট।

আরেকটি হচ্ছে পোলার অরবিটিং স্যাটেলাইট। নাম থেকেই বুঝা যাচ্ছে, এটার ঘূর্ণনগতি হচ্ছে পোল টু পোল, মানে উত্তর দক্ষিণ বরাবর। যেহেতু পৃথিবী ঘুরে পূর্ব পশ্চিম বরাবর এবং এই স্যাটেলাইট ঘুরে উত্তর দক্ষিণ বরাবর, তাই এটা পৃথিবীর কোনো একটা অবস্থানের সাপেক্ষে কখনোই স্থির থাকে না, বরং একেকবার পৃথিবীর একেক অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রদক্ষিণ করে। এই ধরণের স্যাটেলাইট মূলত ব্যবহার হয় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়া সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য। এটির উচ্চতাও জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট এর তুলনায় অনেক কম। জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের ভূপৃষ্ঠ থেকে দূরত্ব যেখানে প্রায় ২০,০০০ কিলোমিটার, পোলার স্যাটেলাইট এর ক্ষেত্রে এই দূরত্ব মাত্র ৮৫০ কিমি। ফলে এটি আরও অনেক ভালোভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও ভূপৃষ্ঠ স্ক্যান করতে পারে এবং আবহাওয়া সম্পর্কে তথ্য দিতে পারে আরও নিখুঁতভাবে।

ছবিঃ জিওস্টেশনারি এবং পোলার স্যাটেলাইটের অরবিট

বাংলাদেশের জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট

বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট, যা প্রথমে মে ১০, ২০১৮ তারিখে লঞ্চ করার কথা ছিল, যেটা কারিগরি সমস্যার কারণে সম্ভব হয়নি; যে কোনো স্যাটেলাইট পাঠানোর ক্ষেত্রে যেটা খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার। পরের দিন, অর্থাৎ মে ১১, ২০১৮ তারিখে সফলভাবে স্যাটেলাইটটি মহাশূন্যে প্রেরণ করা হয়।

এটা কি বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট? অনেকেই দেখলাম এই ভুলটা করছে। না, এটা বাংলাদেশের পাঠানো প্রথম স্যাটেলাইট না। বাংলাদেশ থেকে পাঠানো প্রথম স্যাটেলাইট হচ্ছে “ব্র্যাক অন্বেষা”, সেটা একটা পোলার ন্যানো-স্যাটেলাইট যেটা পাঠানো হয়েছে ৩ জুন, ২০১৭ তারিখে। তবে বঙ্গবন্ধু-১ হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম জিওস্টেশনারি কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইট। মজার ব্যাপার হচ্ছে, “ব্র্যাক অন্বেষা”এবং বঙ্গবন্ধু-১, দুটোই স্পেস-এক্স নামক সংস্থার মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে।

স্যাটেলাইট দুনিয়ায় আমাদের প্রবেশ আরো আগে হলেও কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইটের জগতে আমরা প্রবেশ করেছি বঙ্গবন্ধু-১ এর মাধ্যমে। এটা কি চমৎকার এবং অসাধারণ অনুভূতির একটা ব্যাপার না যে, নিজের দেশের কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইট জগতে পদার্পণের মুহূর্তের সাক্ষী হতে পেরেছি আমরা?

Comments

আপনার আরো পছন্দ হতে পারে...

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
জানান আমাকে যখন আসবে -
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x