মানুষের মৃত্যুর বড় একটি কারণ নানা রকম রোগ। চিকিৎসাবিজ্ঞান এই রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিকার নিয়েই কাজ করে। বলতে গেলে মৃত্যুর বড় কারণগুলোর একটির সামনে রীতিমত যমদূতের মত বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় চিকিৎসাবিজ্ঞান। দেহের অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক সমন্বয়হীনতাজনিত রোগ, বাহ্যিক পরজীবী ঘটিত রোগ; নানারকম রোগের চিকিৎসা চিকিৎসাবিজ্ঞানের আওতার মধ্যে পরে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতিটি নতুন আবিষ্কার মানুষকে দিচ্ছে নতুন জীবন, মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে অমরত্বের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে। বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাথে ন্যানো-টেকনোলজি, জিন প্রকৌশল ও কম্পিউটার প্রকৌশল মিলে যেন উৎপত্তি হয়েছে এক পরাশক্তির যা মানুষের সকল জৈবনিক সমস্যার সমাধানকল্পে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
প্রথম পর্ব ছিল জীবন ও মৃত্যুর প্রাথমিক ধারণা নিয়ে, দ্বিতীয় পর্বে ছিল প্রকৃতিতে প্রাপ্ত অমরত্বের উদাহরণ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উত্তর উত্তর উন্নতির সাথে সাথে যেসকল অবিশ্বাস্য আবিষ্কার ও গবেষণা মানুষের মৃত্যুকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সেগুলো নিয়েই থাকবে এই পর্ব সহ পরবর্তী একাধিক পর্ব।
অণুবীক্ষণ যন্ত্র
চতুর্দশ শতাব্দীতে ঘষা কাঁচের লেন্স উদ্ভাবিত হবার পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর অত্যাধুনিক ত্রিমাত্রিক ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র পর্যন্ত প্রায় ৬০০ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে উন্নত হতে হতে আবিষ্কৃত হয়েছে অণুবীক্ষণ যন্ত্র। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের কার্যপরিধি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানা শাখায়। বিংশ শতাব্দীতে শুধু আধুনিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারকে ঘিরেই চারজন বিজ্ঞানী নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন পদার্থ ও রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগে।
অণুবীক্ষণ যন্ত্রের আবির্ভাব চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন যুগের সূচনা ঘটায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে সাধারণ আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্র (Simple Optical Microscope) আবিষ্কারের পর চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের চোখে একের পর এক ধরা পড়তে থাকে তৎকালীন মহামারীর জন্য দায়ী দুষ্ট জীবাণুর দল। মানুষ জানতে পারে মহামারীর কারণ কোন কর্মফল, অভিসম্পাত বা দৈব শক্তির রুষ্ট হবার ফল নয়; বরং অতি ক্ষুদ্র কিছু পরজীবীর সংক্রমণ।
Anton van Leeuwenhoek এর উদ্ভাবিত অণুবীক্ষণ যন্ত্রে সর্বনিম্ন ১ মাইক্রোমিটার (১ মাইক্রো মিটার = ১০–৬ মিটার = এক মিলিমিটারের এক হাজার ভাগের এক ভাগ) পর্যন্ত বস্তু পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হতো। তাই তখন পর্যন্ত আণুবীক্ষণিক পরজীবী হিসেবে শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়াকেই শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। সাধারণত ব্যাকটেরিয়ার আকার ১-৫ মাইক্রোমিটার হয়ে থাকে। ভাইরাস তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। কারণ আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের বিবর্ধন ক্ষমতায় ন্যানোমিটার ক্ষুদ্রতায় দেখা সম্ভব নয়। ব্যাকটেরিয়ার তুলনায় ভাইরাস এতটাই ছোট যে একটা ব্যাকটেরিয়াও তার পিঠে বয়ে বেড়াতে পারে এক পাল ভাইরাস। এমনকি কখনো কখনো কিছু ব্যাকটেরিয়াও ভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়।
পরবর্তীকালে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জীবাণুর জগতে নতুন এক ধরণের জীবাণুর অস্তিত্ব থাকার ধারণার উৎপত্তি ঘটে যা ব্যাকটেরিয়ার চেয়েও ছোট ও আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কারের পর স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু যাকে আমরা বর্তমানে বলছি ভাইরাস। সাধারণত ভাইরাসের আকার ২০-৫০০ ন্যানোমিটার (১ ন্যানোমিটার = ১০-৯ মিটার = ১ মিলিমিটারের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ) পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে কিছু কিছু দৈত্যাকৃতি ও জটিল ভাইরাস লম্বায় প্রায় ব্যাকটেরিয়ার সমান, ২০০০ ন্যানোমিটার বা প্রায় ২ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের দেখার সীমানা দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট কোনো বস্তু আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখা সম্ভব নয়। ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে আলোর বদলে ইলেকট্রন বীম ব্যবহার করা হয়। ফলে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের বিবর্ধন ক্ষমতা বেড়ে গেল হাজার গুণ। ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে প্রায় কয়েক অ্যাংস্ট্রম (১ অ্যাংস্ট্রম = ১০-১০ মিটার = এক মিলিমিটারের এক কোটিভাগের এক ভাগ) দৈর্ঘ্যের বস্তুও দেখা সম্ভব হয়। ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কারের পরে এসব পরজীবী ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস সহজে শনাক্ত করা সম্ভব হল। বর্তমানে Scanning Tunneling Microscope এর সাহায্যে শুধুমাত্র দ্বিমাত্রিক ছবিই নয় এসব পরজীবীর ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবিও তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে অবলীলায়। এক কথায় বললে আণুবীক্ষণিক পরজীবী ঘটিত রোগের সাথে যুদ্ধের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন ছিল পরজীবী শনাক্ত করা, আর সেই কাজটিই সফলতার সাথে করা সম্ভব হচ্ছে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে।
বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে অণুবীক্ষণ যন্ত্র। জীবাণু শনাক্তকরণ, অ্যান্টিবায়োটিক ও ভ্যাকসিন গবেষণা, শল্য চিকিৎসা (সার্জারি) ইত্যাদি চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানাবিধ অংশের কাজ এখন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের অনুপস্থিতিতে চিন্তাই করা যায় না। এছাড়া অনুপ্রাণ বিজ্ঞান (Molecular Biology), অনুজীব বিজ্ঞান (Micro Biology), জেনেটিক্স ও জিন প্রকৌশল (Genetic Engineering), ন্যানোটেকনোলজির মত অতিক্ষুদ্র জগতের সকল আবিষ্কার ও গবেষণায় আধিপত্য ধরে আছে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের ভূমিকা। অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যতীত বিজ্ঞানের এই শাখাগুলোর আবির্ভাবই সম্ভব হত না। আজকে আমরা যে উন্নত চিকিৎসা সেবা পাচ্ছি তার কৃতিত্বের বৃহৎ একটা অংশের দাবিদার অণুবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কার ও আধুনিকায়ন।
ভ্যাকসিন (টিকা) ও অ্যান্টিবায়োটিক
অণুবীক্ষণ যন্ত্রের লেন্সের নিচে জীবাণুর যে সুবৃহৎ জগতের খোঁজ পাওয়া গেল, যে অতিক্ষুদ্র পরজীবীকুলের কাছে এতদিন ধরাশায়ী ছিল মানুষ, যে পরজীবীদের সংক্রমণে রাজ্যবিস্তৃত মহামারী লেগে যেত; তাদের খোঁজ পাবার পর শুরু হল তাদের দমনের জন্য গবেষণা। সে গবেষণার ফলস্বরূপ এই ক্ষুদ্র সত্ত্বার আক্রমণ থেকে মানবদেহকে সুরক্ষা দিতে আবিষ্কৃত হল দুই স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। জীবাণুর আক্রমণ প্রতিহত করতে দুর্ভেদ্য দুর্গ যাকে আমরা ভ্যাকসিন বা টিকা বলে জানি, আর শক্তিশালী জীবাণু যদি দুর্গ ভেদ করে প্রবেশ করেও থাকে তাহলে তাকে পরাস্ত করার জন্য সৈন্যবাহিনী যাকে আমরা বলি অ্যান্টিবায়োটিক। ভ্যাকসিন বা টিকা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সাথে একীভূত হয়ে জীবাণুর সংক্রমণে বাধা দেয়। দেহে জীবাণু প্রবেশ করার সাথে সাথে সেটিকে ঘিরে ধরে ও ধ্বংস করে, ফলে দেহে রোগের আবির্ভাব ঘটতে পারে না।
অন্যদিকে যখন দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জীবাণুর সংক্রমণকে আটকাতে ব্যর্থ হয়ে, যখন শক্তিশালী জীবাণু দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে হারিয়ে সদম্ভে টিকে থাকে শরীরে তখনই রোগ দেখা দেয় মানুষের শরীরে। তখন সেই জীবাণুকে ধ্বংস করে সুস্থ হবার জন্য প্রয়োগ করা হয় অ্যান্টিবায়োটিক; যেটি দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে দুষ্ট জীবাণুদের খুঁজে বের করে আক্রমণ করে ও তাদের ধ্বংস করে রোগীকে ফিরিয়ে দেয় সুস্থ জীবনধারায়।
অ্যান্টিবায়োটিক সর্বদা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়। ভাইরাস সংক্রমিত রোগের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক প্রযোজ্য নয়। সেসবের জন্য রয়েছে অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ। তবে অ্যান্টিবায়োটিক যেমন বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকরী অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ গুলো তেমন নয়। নির্দিষ্ট ভাইরাসের বিস্তার রোধে নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ ব্যবহৃত হয়। আর ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে দ্রুত বিবর্তিত হয়ে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে ফলে অ্যান্টিভাইরাল ঔষধগুলোও নিয়মিত উন্নত ও উপযোগী করার প্রয়োজন হয়।
এবার তাহলে দেখা যাক এককালের দুরারোগ্য ও মহামারী আকারে ঘটে থাকা পরজীবীঘটিত মরণব্যাধির ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাছে বধ’ হবার ইতিহাস; ভ্যাকসিন ও অ্যান্টিবায়োটিকের সফলতার বিবরণ।
কলেরা
একটা সময় ছিল যখন কলেরায় গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। কলেরা কে ‘ওলা ওঠা’ বলা হত। কলেরাকে ‘ওলা’ নামক অশুভ আত্মার ক্রোধান্বিত আচরণ হিসেবে বিবেচনা করা হত। গ্রামের এক প্রান্তে কলেরা হলে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত সবাই আতঙ্কিত হয়ে উঠত।
কিন্তু আজ আমরা জানি কোনো অশুভ আত্মার ক্রোধ নয় বরং Vibrio cholerae ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে কলেরা হয়ে থাকে। বর্তমানে মহামারী তো দূরে থাক, কলেরা প্রাণঘাতী কোনো রোগই নয় বলতে গেলে। যথাযথ অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের মাধ্যমেই কলেরা রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। বর্তমানে শুধু অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের মাধ্যমে কলেরার চিকিৎসাকেই উৎসাহিত করা হয়। তবে মারাত্মকভাবে সংক্রমিত হয়ে পরা এলাকার জন্য পূর্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসবে তিন ধরণের সেবনযোগ্য টীকা রয়েছে। দুই সপ্তাহ ব্যবধানে এর দুই ডোজ মোটামুটি তিন বছরের জন্য কলেরা থেকে সুরক্ষা দেয়। এক ডোজ টীকা (Vaccine) স্বল্প সময়ের জন্য (প্রায় ছয় মাস) প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। কলেরাকে প্রাণঘাতী ব্যাধি বলার সুযোগ এখন আর একেবারেই নেই।
গুটি বসন্ত (Small Pox)
গুটি বসন্ত একটা সময় প্রাণঘাতী মারাত্মক রোগ ছিল যা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ত গ্রামান্তরে। কারো গুটি বসন্ত হয়েছে শুনলে আশেপাশে কয়েক গ্রাম পর্যন্ত মানুষ তটস্থ থাকত। গুটি বসন্তকেও অশুভ আত্মা, কখনো পাপের ফল হিসেবে বিবেচনা করা হত। গুটি বসন্তের হাত থেকে কেউ প্রাণে বেঁচে গেলেও অঙ্গহানি ছিল প্রায় নিশ্চিত।
কিন্তু কোনো পাপের ফল নয় বরং Variola virus এর সংক্রমণে গুটি বসন্ত হয়। বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে পৃথিবী গুটিবসন্ত মুক্ত। ১৯৮০ সালের ৮ মে World Health Organization (WHO) এর ৩৩ তম অধিবেশনে পৃথিবীকে Variola virus তথা গুটিবসন্ত মুক্ত ঘোষণা করা হয়। পৃথিবীর উন্মুক্ত পরিবেশে এখন আর গুটি বসন্তের জীবাণু বিচরণ করে না, তারা এখন মাত্র দুটো কারাগারে বন্দী। যুক্তরাষ্ট্রের Centers for Disease Control and Prevention (CDC) এর ল্যাবরেটরি এবং রাশিয়ার Research Center of Virology and Biotechnology (VECTOR Institute) এর ল্যাবরেটরিতে WHO এর তত্ত্বাবধায়নে কিছু সংখ্যক Variola virus সংরক্ষিত আছে গবেষণার কাজে।
বিলুপ্ত হলেও জরুরী অবস্থা মোকাবেলায় ও অনাকাঙ্ক্ষিত সংক্রমণ থেকে নিরাপত্তা দিতে শুধুমাত্র সুইজারল্যান্ডে WHO এর হেডকোয়ার্টারেই মজুদ আছে ২.৪ মিলিয়ন ডোজ টীকা। এছাড়া ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, নিউজিল্যান্ড ও ইউনাইটেড স্টেটস এ মজুদ রয়েছে প্রায় ৩১ মিলিয়ন ডোজ গুটিবসন্তের টিকা। ১ম প্রজন্মের টিকার আঘাতেই বেঘোরে মারা পরেছিল Variola virus এর দল। বর্তমানে মজুদ টিকার মধ্যে রয়েছে ২য় ও ৩য় প্রজন্মের উন্নত টিকা যা আধুনিক ‘Cell Culture’ পদ্ধতির অবদান।
যক্ষ্মা (Tuberculosis – TB)
‘যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই’ অথবা ‘যার হয় যক্ষ্মা, তাঁর নাই রক্ষা’ এ জাতীয় প্রচলিত প্রবচন আমাদের বাবা-দাদার প্রজন্মই শুনেছে। ছোটবেলায় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনে আমরা শুনেছি ‘যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই, এই কথার ভিত্তি নাই’ এই কথা। এখন তাও বন্ধ। ব্যাপারটা এমন হয়ে গেছে যে এটাও আর ফলাও করে প্রচারের প্রয়োজনীয়তা শেষ। অদূর অতীতেই একটা সময় ছিল যখন যক্ষ্মা ছিল প্রাণঘাতী। আর সর্বদাই আপাত-প্রাণঘাতী রোগের পেছনে সেই একই অব্যর্থ কারণ বিবেচিত হয়; কর্মফল, অভিশাপ, পাপের ফল আর অতিপ্রাকৃতিক শক্তির নাখোশ হওয়া। যখনই প্রাণঘাতী রোগের চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়ে মানুষ তার ফলাফল পেতে শুরু করে তখন কোথায় যেন মিলিয়ে যায় এসব অতিপ্রাকৃত শক্তির অভিসম্পাত।
বর্তমানে যক্ষ্মা প্রাণঘাতী রোগ নয় এমনকি দুরারোগ্য রোগও নয়। নিয়মতান্ত্রিক যথাযথ দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসায় যক্ষ্মা পুরোপুরি নিরাময় হয়। ফুসফুসে Mycobacterium tuberculosis নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ফলে যক্ষ্মা হয়। এই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (Immune system) এর বংশবৃদ্ধি রোধ করতে সচেষ্ট হয় এবং সংক্রমণকে ব্যাধিতে পরিণত হতে দেয় না। অনেক মানুষের ক্ষেত্রে সংক্রমিত হবার পরেও সারাজীবন ব্যাকটেরিয়া তাকে অসুস্থ করতে পারে না এবং তাঁর থেকে অন্যের দেহে ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পরতে পারে না। অর্থাৎ যক্ষ্মার জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া দেহে থাকার পরেও যক্ষ্মা হয় না শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেমের কল্যাণে। যাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল থাকে তাদের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ থেকে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
Bacille Calmette-Guérin (BCG) হচ্ছে যক্ষ্মার প্রতিরোধী ভ্যাকসিন বা টিকা। সাধারণত যেসব অঞ্চলে যক্ষ্মার প্রকোপ বেশি থাকে সেখানে শিশুদের এই টিকা দেয়া হয়। এই টিকা যক্ষ্মা থেকে নিশ্চিতভাবে সুরক্ষা দিতে না পারলেও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের পর যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়া থেকে সুরক্ষা দিতে ইমিউন সিস্টেমকে সহায়তা করে থাকে যা যক্ষ্মার আক্রমণ থেকে অনেক ক্ষেত্রে রক্ষা করে। শিশু ছাড়াও প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রকারের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে কখনো কখনো এই টিকা প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
যক্ষ্মা নিরাময়ে ১০ টি বিশেষায়িত ঔষধ রয়েছে। ব্যাকটেরিয়ার ধরন ও রোগের অবস্থার উপর নির্ভর করে প্রয়োজনীয় ঔষধ নির্ধারণ করা হয়। রোগের ব্যাপ্তি, রোগীর অবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট আনুষাঙ্গিক বিষয়াদি বিবেচনা করে ৬ থেকে ৯ মাসের দীর্ঘমেয়াদে ৬২ থেকে ১৮২ টি পর্যন্ত ঔষধের ডোজ দিয়ে যক্ষ্মার চিকিৎসা সম্পন্ন হয়।
যক্ষ্মার চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে চিকিৎসা চলাকালীন কোনোভাবেই ঔষধের একটি ডোজও বাদ দেয়া যাবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ যথাযথভাবে মেনে ঔষধ সেবন করতে হবে। যদি চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ঔষধ সেবন না করা হয়, সাময়িকভাবে নির্দেশনার বাইরে গিয়ে ঔষধ সেবন বন্ধ করা হয় কিংবা কোনোভাবে একটি ডোজও বাদ পরে তাহলে রোগী আবার অসুস্থ হয়ে পরবে। আর সবচেয়ে বড় ক্ষতি যা হবে তা হল – তখন পর্যন্ত জীবিত ব্যাকটেরিয়াগুলো আবার কার্যকরী হয়ে উঠবে, ছড়িয়ে পরবে এবং সেগুলো ঐ ঔষধ প্রতিরোধী (Drug Resistant) হয়ে উঠবে। আর যক্ষ্মার ব্যাকটেরিয়া দেহাভ্যন্তরে একবার ঔষধ প্রতিরোধী হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে রোগীকে সুস্থ করে তোলা যথেষ্ট কঠিন ও আরো বেশি ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে ওঠে। যক্ষ্মার চিকিৎসায় ছোট্ট অবহেলাই রোগীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে।
ঔষধ সেবনে অনিয়মের কারণে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েই পরলে রোগীকে যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞের নিবিড় তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। সাধারণত ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া দু-এক ধরণের প্রাথমিক ধাপের ঔষধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠে যাদের বলা হয় Multidrug-resistant (MDR) ব্যাকটেরিয়া। সেক্ষেত্রে আরো শক্তিশালী ঔষধ সেবন করতে হয়। খুব কম সংখ্যক ক্ষেত্রেই একাধিক ও উচ্চ মাত্রার ঔষধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া দেখা যায়। এদেরকে বলা হয় Extensively drug-resistant (XDR)। সেক্ষেত্রে চিকিৎসা হয়ে ওঠে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং। Fluoroquinolone Antibacterial Drugs এর খুবই নিয়ন্ত্রিত মাত্রার সেবনের মধ্য দিয়ে XDR সংক্রমিত যক্ষ্মার চিকিৎসা করা হয়। তবে এই অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ঔষধের নানা বিধিনিষেধ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকায় দুর্বল ইমিউন সিস্টেম সম্পন্ন মানুষ ও ইমিউন সিস্টেমের সাথে জড়িত অন্যান্য রোগ যেমন ডায়াবেটিস, এইডস এ আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে এই ঔষধের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে যা রোগীর প্রাণসংশয়কারী অবস্থা হিসেবে দেখা দিতে পারে। তাই যক্ষ্মার চিকিৎসায় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে যথাযথ নিয়মে ঔষধ সেবন করে প্রাথমিক পর্যায়েই রোগ নিরাময় করা উচিৎ।
প্লেগ (Plague)
এশিয়া অঞ্চলে যেমন কলেরা, গুটিবসন্ত, যক্ষ্মার মহামারি ছিল প্রাণঘাতী তেমনি ইউরোপ অঞ্চলে সুদূর অতীত থেকেই প্রাণঘাতী মহামারী ছিল ‘প্লেগ’। Yersinia pestis ব্যাকটেরিয়া প্লেগ রোগের জন্য দায়ী। সাধারণত স্তন্যপায়ী প্রাণী এই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়। প্লেগ প্রধানত ইঁদুর বাহিত রোগ। Yersinia pestis ব্যাকটেরিয়া বাহিত ইঁদুরের পরজীবী মাছির সংস্পর্শে আসলে মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী প্লেগে আক্রান্ত হয়। সংক্রমিত পোষা প্রাণী থেকেও মানুষে প্লেগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত প্রাণী ও মাছির কামড় থেকেও প্লেগ হতে পারে।
এখন পর্যন্ত জানা ইতিহাসে খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে প্লেগের প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এবং প্লেগের মহামারির দৌরাত্ম চলে পরবর্তী প্রায় দু’শ বছর। এ দু’শ বছরে প্রায় ২৫ মিলিয়ন মানুষ প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। চতুর্দশ শতাব্দীতে প্লেগের মহামারি ছড়িয়ে পরে সারা ইউরোপে। এই মহামারিতে ইউরোপে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে যায়। একে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ কখনো কখনো ‘গ্রেট প্লেগ’ ও বলা হয়ে থাকে। উনবিংশ শতাব্দীতে চীনের সমুদ্রবন্দর এলাকায় বাণিজ্যিক জাহাজে করে চলে আসা ইঁদুর থেকে প্লেগ ছড়িয়ে পরে। ২০ বছর ধরে চলা মহামারিতে প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
আধুনিক অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারাই প্লেগ নিরাময় করা সম্ভব। দেরি হয়ে যাবার আগেই রোগীকে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে এলে প্লেগ আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়। বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু অঞ্চল ও মাদাগাস্কার দীপপুঞ্জ ছাড়া অন্যত্র প্লেগের প্রাদুর্ভাব নেই বললেই চলে। এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকাতেই শতকরা ৯৫ ভাগ সংক্রমণ দেখা যায়।
তো এই হলো এককালের কিছু নামকরা দুর্ধর্ষ মহামারী সৃষ্টিকারী জীবাণুর ‘মহামারী’ তে আক্রান্ত হয়ে বিলুপ্ত প্রায় ও ভগ্নদশা প্রাপ্ত হবার ইতিহাসের সংক্ষিপ্তসার। পরবর্তী পর্বে থাকবে অত্যাধুনিক শল্য চিকিৎসা ব্যবস্থার কিছু সফলতার কথা, যেসব সফলতার ফলে মানুষকে প্রায় নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকেও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে।
তথ্যসূত্র : –
১. The Official Web Site of the Nobel Prize – Nobelprize.org
২. National Center for Biotechnology Information (NCBI), U.S. National Library of Medicine
৩. World Health Organization (WHO)
৪. Centers for Disease Control and Prevention (CDC), Atlanta, U.S.
৫. Book: What You Need to Know About Infectious Disease – Madeline Drexler; Institute of Medicine (US)