প্রথম পর্বে ছিল জীবন, মৃত্যু, প্রাণ, চিকিৎসাবিজ্ঞানে মৃত্যুর ধারণা, দ্বিতীয় পর্ব ছিল প্রকৃতিতে অমরত্বের উদাহরণ নিয়ে, তৃতীয় পর্বে ছিল মৃত্যুকে তাড়িয়ে বেড়ানো আবিষ্কার ও গবেষণার আণুবীক্ষণিক দিক ভ্যাকসিন ও অ্যান্টিবায়োটিক এর সফলতার ইতিহাস, চতুর্থ পর্ব সাজানো হয়েছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানের শল্য চিকিৎসা (সার্জারি) বিভাগের বৈপ্লবিক আবিষ্কার অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা অঙ্গ প্রতিস্থাপন বিষয়ে। পঞ্চম পর্বটি তৈরি হচ্ছে ‘মরণব্যাধি ক্যান্সার’ থেকে ‘মরণব্যাধি’ বিশেষণটি দূর করার জন্য চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী মহলে যেসকল কর্মকাণ্ড চলছে ও ইতোমধ্যেই যেসব সফলতা পাওয়া গেছে সেগুলোর তথ্য নিয়ে।
বর্তমান পৃথিবীতে নির্দিষ্ট অসুস্থতাজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে সংখ্যাধিক্যের দিক থেকে দ্বিতীয় হল ‘ক্যান্সার’। অতীতে মানুষ অনেক মরণব্যাধিকে জয় করেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উৎকর্ষ মরণব্যাধির আক্রমণ থেকে সুরক্ষা দিয়েছে মানুষকে, আক্রান্ত ব্যক্তিকে দিয়েছে আরোগ্য। বর্তমানে ‘মরণব্যাধি’ বিশেষণটি যে অল্প ক’টি রোগের আগে ব্যবহার করা হয় তাদের মধ্যে অন্যতম হল ক্যান্সার। ক্যান্সারকে আপাতদৃষ্টিতে নতুন আবির্ভূত মনে করলেও এটি অত্যন্ত প্রাচীন একটি রোগ। খৃষ্টপূর্ব ১৬০০-১৫০০ সালের মমি ও নানান পাণ্ডুলিপি থেকে ক্যান্সার অথবা অন্তত টিউমার জাতীয় রোগের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে। প্রাচীন এই ব্যাধি ক্যান্সারের অত্যাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে জানার আগে ক্যান্সার বিষয়ে কিছু প্রাথমিক ধারণা জেনে নেয়া জরুরি।
ক্যান্সার কী?
এক কথায় ক্যান্সার হচ্ছে ‘অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন’ এর ফল। সাধারণত দেহকোষ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বেঁচে থেকে কোষ বিভাজন ঘটিয়ে তারপর মারা যায়। বিভিন্ন কারণে কোষের DNA ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে তাতে ত্রুটির সৃষ্টি হতে পারে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (Immune System) এই ত্রুটিযুক্ত DNA কে মেরামত করে ক্রটিমুক্ত করে থাকে। কিন্তু কখনো কখনো ইমিউন সিস্টেম ত্রুটি মেরামত করতে ব্যর্থ হয়। তখন এই ত্রুটিযুক্ত DNA সমৃদ্ধ কোষগুলোই ক্যান্সার কোষের আঁতুড় ঘর হিসেবে আবির্ভূত হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত কোষের DNA এর বিভাজন নিয়ন্ত্রণ অংশ নষ্ট হয়ে গেলে তখন সেই কোষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বারবার বিভাজিত হতে থাকে। এদিকে কোষটির নির্দিষ্ট সংখ্যকবার বিভাজিত হবার পর ‘মারা যাবার’ কথা কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ DNA থাকার কারণে কোষটি মারা না গিয়ে বিভাজন ক্রমাগত চালিয়ে যায়। আর ত্রুটিপূর্ণ DNA সমৃদ্ধ ক্যান্সার কোষ থেকে বিভাজিত হয়ে উৎপত্তি হওয়া প্রতিটি কোষই একইরকম ত্রুটিপূর্ণ DNA বহনকারী ক্যান্সার কোষ। এই ক্রমাগত বিভাজনের ফলে প্রাথমিকভাবে যা হয় সেটি হল ‘টিউমার’। তাই টিউমারকে ক্যান্সার এর প্রথম ধাপ বললে অত্যুক্তি হবে না। তবে সব টিউমার ক্যান্সার পর্যন্ত গড়ায় না। ব্লাড ক্যান্সারের মত কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত সিংহভাগ ক্যান্সারের প্রথম উপসর্গ ও প্রথম ধাপ টিউমার।
ক্যান্সারের কারণ
প্রাচীন এই রোগ সম্পর্কে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা অনেকটাই অন্ধকারে পড়ে ছিলেন শতাব্দীর পর শতাব্দী। বিগত শতাব্দীতে জৈব রসায়ন, অনুপ্রাণ বিজ্ঞান, অণুজীব বিজ্ঞান, জিন প্রকৌশল ইত্যাদির সফল আবির্ভাবের পর ক্যান্সার সংক্রান্ত দুর্বোধ্য তথ্যের দুয়ার খুলতে শুরু করেছে। ক্যান্সার সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্যজট খুলতে চিকিৎসা বিজ্ঞান সবচেয়ে বেশি এগিয়ে যেতে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে, DNA Double Helix আবিষ্কার হবার পর থেকে। ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন ক্যান্সার হলে দেহকোষে কী ঘটে। এখন ক্যান্সারের কারণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকার নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত সংশ্লিষ্ট গবেষকেরা। এসব গবেষণা শুধু ক্যান্সার চিকিৎসাকেই নয়, হয়ত পুরো চিকিৎসাবিজ্ঞানকেই নিয়ে যাবে ভিন্ন উচ্চতায়।
কোষের DNA ত্রুটিযুক্ত হবার জন্য কিছু প্রভাবক সম্পর্কে ইতোমধ্যেই ধারণা পাওয়া গেছে। তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে দীর্ঘদিন থাকলে এর প্রভাবে DNA ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা ক্যান্সারের কারণ হিসেবে দেখা দেয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
এছাড়া কিছু বিশেষ বিশেষ রাসায়নিক পদার্থকেও ক্যান্সার উৎপাদক এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। প্রায় ১৫০ বছর আগেই আবিষ্কার হয়েছিল এমন একটি ক্যান্সার উৎপাদক পদার্থ ‘নিকোটিন’। পরবর্তীতে নিকোটিন ক্যান্সার উৎপাদক রাসায়নিকের ভেতরে পড়বে কিনা তা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। কিন্তু নিকোটিন ছাড়াও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান সাধারণত ধূমপানের মাধ্যমে মানবদেহের সংস্পর্শে আসে বিধায় এর প্রভাব ফুসফুসের উপর সবচেয়ে বেশি এবং ধূমপায়ীদের ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি অধূমপায়ীদের তুলনায় বেশি। বর্তমানে জৈব রসায়নের অগ্রগতির সাথে সাথে একশ’র ও বেশি রাসায়নিক পদার্থ শনাক্ত করা হয়েছে যেগুলো ক্যান্সার উৎপাদক হিসেবে কাজ করে থাকে। চলমান গবেষণাগুলোতে উঠে আসছে আরো ক্যান্সার উৎপাদক রাসায়নিকের খোঁজ, বেড়িয়ে আসছে কিভাবে এসব রাসায়নিক DNA ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে সে সম্পর্কিত চমকপ্রদ তথ্য। কখনো কখনো ভাইরাসের সংক্রমণের দরুণ ক্যান্সার হতে পারে। যেমন হেপাটাইটিস বি, সি ভাইরাসের সংক্রমণে লিভার ক্যান্সার, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের সংক্রমণে সারভিক্স ও পেনিস ক্যান্সার হতে পারে। এছাড়া HIV ভাইরাসের সংক্রমণেও কখনো কখনো ক্যান্সার হতে পারে।
ক্যান্সার সম্পর্কিত প্রাথমিক তথ্যাদির পরে এখন আমরা দেখব ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কেমন প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান ক্যান্সারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কতটা শক্তিশালী দুর্গ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে এবং ভবিষ্যতে ক্যান্সার দূরীকরণে আরো কোন ধরণের গবেষণা কার্যক্রম চলবে।
ক্যান্সার শনাক্তকরণ পদ্ধতি
(Cancer Screening & Diagnosis for Detection)
ক্যান্সারের মোকাবেলায় যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্তকরণ এবং তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ। বর্তমান উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে যথাযথ চিকিৎসায় ক্যান্সার প্রাণঘাতী মাত্রায় পৌঁছুতে পারে না এবং অনেক ক্ষেত্রেই ক্যান্সার নিরাময় করা সম্ভব হয়। তাই ক্যান্সার চিকিৎসায় সবার আগে প্রয়োজন ক্যান্সার শনাক্ত করা এবং ক্যান্সার কোন পর্যায়ে আছে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা।
যেসকল ব্যক্তি ক্যান্সার উৎপাদক রাসায়নিক, তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদির সংস্পর্শে থাকেন অথবা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ভাইরাসে আক্রান্ত অর্থাৎ যাদের জীবনধারণ পদ্ধতির কারণে সম্ভাবনা আছে ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার; তাদের জন্য ক্যান্সারের উপসর্গ দেখা দেয়ার আগেই পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করা যেতে পারে তার দেহে এখনো ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে কিনা। এসব উপসর্গ-পূর্ব পরীক্ষানিরীক্ষাকে বলা হয় ক্যান্সার স্ক্রিনিং। এর মাধ্যমে ক্যান্সার ক্ষতিকর এমনকি দৃষ্টিগ্রাহ্য অবস্থায় যাওয়ার পূর্বেই শনাক্ত করা যায় বিধায় এর দ্রুত চিকিৎসা রোগীর প্রাণ বাঁচাতে সহায়ক। অপরদিকে ক্যান্সারের উপসর্গ দেখা দেয়ার পর পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে ক্যান্সার নির্ণয়ের পদ্ধতিকে বলা হয় ক্যান্সার ডায়গনসিস।
দেহের বিভিন্ন অংশে ক্যান্সার হতে পারে। বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার শনাক্তকরণে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। ক্যান্সার নির্ণয়ে উপসর্গ অনুযায়ী নির্ধারিত হয় শনাক্তকরণ পদ্ধতি। কিছু ক্যান্সার শনাক্তকরণ পদ্ধতির সম্পর্কে সংক্ষেপে জানা যাক।
Tumor Marker Test : টিউমার হলে রক্তে কিছু বিশেষ উপাদানের আধিক্য দেখা দেয়। এসব উপাদানের আনুপাতিক পরিমাণ নির্ণয় করে প্রাথমিকভাবে টিউমারের অস্তিত্ব শনাক্ত করা সম্ভব।
আলট্রাসনোগ্রাফি : আলট্রাসাউন্ড ওয়েভ বা শব্দোত্তর তরঙ্গ ব্যবহার করে দেহাভ্যন্তরে দেখার পদ্ধতিটি আলট্রাসনোগ্রাফি নামেই পরিচিত। গর্ভবতী মায়েদের গর্ভে শিশুর অবস্থা পর্যবেক্ষণে অহরহ আল্ট্রাসনোগ্রাফি ব্যবহৃত হওয়ায় এর সাথে অনেকেই পরিচিত। দেহাভ্যন্তরে টিউমারের খোঁজ করতে ও টিউমারের অবস্থা পর্যবেক্ষণেও আলট্রাসনোগ্রাফি ব্যবহৃত হয়।
Endoscopy, Sigmoidoscopy, Colonoscopy : পরিপাক তন্ত্রের অভ্যন্তরীণ সংক্রমণ, আলসার ইত্যাদি নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষায় এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহৃত হয়। তাই এই পদ্ধতিগুলোও অনেকের কাছে কিছুটা পরিচিত। পরিপাক তন্ত্রের অসুস্থ অংশের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে মুখ অথবা মলদ্বার দিয়ে সরু নমনীয় টিউব প্রবেশ করানো হয়। টিউবের শেষ মাথায় ক্যামেরা সংযুক্ত থাকে। এই ক্যামেরার ছবি থেকে সংক্রমণ অথবা টিউমারের অবস্থান শনাক্ত করা হয়। কখনো কখনো অধিক পরীক্ষণের জন্য টিউবের মাথায় সংযুক্ত ছোট্ট ধারালো যন্ত্রের এর সাহায্যে টিউমার বা সংক্রমিত স্থান থেকে কিছু টিস্যু কেটে নিয়ে সংগ্রহ করা হয়।
Pap test : Cervical Cancer নির্ণয়ের জন্য এই টেস্ট করা হয়। Cervix থেকে কিছু কোষ সংগ্রহ করে সেগুলোকে পরীক্ষা করা হয়। সংগৃহীত কোষগুলোর মধ্যে কোন অস্বাভাবিক কোষ আছে কিনা, ক্যান্সার কোষ আছে কিনা তা খুঁজে দেখা হয়।
Human Papilloma Virus (HPV) Test : হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস এর সংক্রমণে সাধারণত Oral, Genital, Anal, Cervix cancer হতে পারে। এই একটি যৌনবাহিত ভাইরাস। সচরাচর Pap test এর সাথে সাথে একই সংগৃহীত কোষ থেকে HPV Test করা যায়।
Mammography : এটি এক্স-রে জাতীয় একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে পাওয়া ছবিকে বলা হয় ম্যামোগ্রাম। এটি সাধারণত স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়। ম্যামোগ্রাফির মাধ্যমে স্তনের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অস্বাভাবিকত্ব, টিউমার ইত্যাদি শনাক্ত করা যায়।
Magnetic Resonance Imaging (MRI) : শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র (Magnetic Field) ও বেতার তরঙ্গ (Radio wave) ব্যবহার করে দেহাংশের পূর্নাঙ্গ ছবি প্রস্তুত করে কোথাও কোন টিউমার ও অস্বাভাবিকত্ব আছে কিনা তা শনাক্ত করা হয়। এছাড়া এ পদ্ধতিতে ব্রেইন, স্পাইনাল কলাম, বুক, পেট ইত্যাদির ছবি প্রস্তুত করেও অন্যান্য পরীক্ষানিরীক্ষা করা যায়। ব্রেস্ট ক্যান্সার শনাক্ত করতে Breast MRI ব্যবহৃত হয়। শুধু ডায়গনসিস নয়, স্ক্রিনিং এর কাজেও MRI ব্যবহৃত হয়। ক্যান্সারের চিকিৎসা চলাকালীন উন্নতি-অবনতি নির্ণয় করতেও MRI ব্যবহৃত হয়। এ পদ্ধতিতে এক্সরে জাতীয় রশ্মি ব্যবহৃত হয় না বিধায় এটি গর্ভবতী নারীর জন্যও নিরাপদ একটি পদ্ধতি।
Computed Tomography Scan (CT scan or CATscan) : এই পদ্ধতিতে এক্স-রে প্রয়োগ এর মাধ্যমে রোগীর দেহাভ্যন্তরের নির্দিষ্ট অংশের অনেকগুলো ছবি বিভিন্ন দিক থেকে তোলা হয়। এইসব ছবি একীভূত করে ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি তৈরি করা হয়। যা থেকে সুনির্দিষ্টভাবে টিউমার কিংবা ক্যান্সার কোষের অবস্থান শনাক্ত করা যায়।
Positron Emission Tomography (PET scan) : এই পদ্ধতিতে বাইরে থেকে রশ্মি ব্যবহার করে দেহের ভেতরের ছবি তোলা হয় না। টেস্টের আগে রোগীর দেহে সহনীয় পর্যায়ে স্বল্প পরিমাণ তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রবেশ করানো হয়। দেহের সুস্থ অংশ অল্প পরিমাণে এসব পদার্থ গ্রহণ করে কিন্তু ক্যান্সার আক্রান্ত অংশ অধিক শক্তি সংগ্রহের জন্য প্রচুর পরিমাণ তেজস্ক্রিয় পদার্থ শোষণ করে। দেহে তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রবেশের নির্দিষ্ট সময় পরে দেহ থেকে নির্গত হওয়া তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ ও অবস্থান নির্ণয় করে ক্যান্সারের সুনির্দিষ্ট অবস্থান শনাক্ত করা হয়। দেহের যে অবস্থান থেকে মাত্রাতিরিক্ত তেজস্ক্রিয়তা নিঃসরণ হতে দেখা যায় সেটিই সম্ভাব্য ক্যান্সার কোষের অবস্থান।
বর্তমানে CT scan এবং PET scan একীভূত করে PET-CT scan করা হয়ে থাকে। সাধারণত ক্যান্সারের উপস্থিতি সুনিশ্চিতভাবে নির্ণয়ের নিমিত্তে Biopsy করার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে ক্যান্সার আক্রান্ত দেহকোষ ও টিস্যুর সঠিক অবস্থান নির্ণয়ের জন্য PET-CT scan করা হয়ে থাকে।
Biopsy : চূড়ান্তভাবে ক্যান্সার নিশ্চিত করার জন্য যে পরীক্ষাটি করা হয়ে থাকে সেটিই Biopsy. উপরের অন্যান্য টেস্ট গুলো প্রাথমিকভাবে ক্যান্সার আছে তার সম্ভাব্য ধারণা দেয়, ঠিক কোথায় সম্ভাব্য ক্যান্সার কোষ তৈরি হচ্ছে সেই অবস্থান নির্দেশ করে থাকে। তারপর সম্ভাব্য অবস্থান থেকে কিছু কোষ বা টিস্যু সংগ্রহ করে সেসব কোষ পরীক্ষাগারে জৈব-রাসায়নিক পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখা হয় সেগুলো ক্যান্সার কোষ কিনা। ক্যান্সার কোষের উপস্থিতি পাওয়া গেলে চিকিৎসকগণ নিশ্চিত হন রোগীর ক্যান্সার হয়েছে। তারপরে কী ধরণের ক্যান্সার হয়েছে, ক্যান্সারের অবস্থা কতটা মারাত্মক সেগুলো অন্যান্য পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে চিকিৎসকগণ চিকিৎসা শুরু করেন।
ক্যান্সারের বিভিন্ন পর্যায়
(Cancer Staging)
ক্যান্সার শনাক্ত হবার পর চিকিৎসা শুরুর জন্য যে তথ্যটা প্রথমেই দরকার হয় সেটি হল ক্যান্সার ঠিক কোন পর্যায়ে আছে। ক্যান্সার কত দিন ধরে আছে, কত বড়, দেহে অন্য কোথাও ছড়িয়েছে কিনা ইত্যাদি তথ্যের সমন্বয়ে ক্যান্সারের পর্যায় বা স্টেজ নির্ধারণ করা হয়। ক্যান্সার স্টেজিং বর্ণনা করা জন্য একাধিক নিয়ম রয়েছে। রোগীকে ব্রিফিংয়ের জন্য তুলনামূলক সরল নিয়মটি ব্যবহার করেন চিকিৎসকগণ। এছাড়া চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র কিংবা বিভিন্ন টেস্ট এর জন্য প্রয়োজনে অন্যান্য নিয়মও ব্যবহার করা হয়।
In Situ : একেবারে প্রথম দিকের অবস্থা। টিউমার বা ক্যান্সারের অল্প কিছু কোষের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কিন্তু সেগুলো কাছাকাছি অন্য টিস্যুতেও ছড়ায়নি। একে Stage Zero দ্বারাও প্রকাশ করা হয়।
Localized : কোন একটি প্রত্যঙ্গে ক্যান্সার উৎপত্তি হয়েছে শুধু। অস্বাভাবিক কোষের পরিমাণ অল্প এবং এটি ঐ প্রত্যঙ্গের সীমানার বাইরে যায়নি। এ পর্যায় পর্যন্ত ক্যান্সার নিরাময়ের সম্ভাবনাই বেশি।
Regional : ক্যান্সার আক্রমণ খারাপের দিকে যাচ্ছে। শুরুর অঙ্গ থেকে পার্শ্ববর্তী অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়েছে ক্যান্সারের আক্রমণ। লোকালাইজড ও রিজিওনাল স্টেজ এর বিভিন্ন পর্যায়কে ক্যান্সার কোষের পরিমাণ ও অবস্থার উপর ভিত্তি করে Stage I, Stage II এবং Stage III দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
Distant : ক্যান্সার প্রায় শেষ ধাপে আছে। প্রাণঘাতী পর্যায়। এ পর্যায় থেকে নিরাময়ের সম্ভাবনা খুবই নগণ্য। ক্যান্সার ছড়িয়ে পরেছে সারাদেহে। দেহের অন্যান্য অংশেও দানা বাঁধতে শুরু করেছে ক্যান্সার কোষ। একে Stage IV বলা হয়ে থাকে।
Unknown : ক্যান্সার কোন অবস্থায় আছে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না এমন অবস্থা।
এছাড়া ক্যান্সার স্টেজিং এ আরেকটি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে যাকে বলা হয় TNM পদ্ধতি। এক্ষেত্রে T দ্বারা টিউমার বোঝায়। লোকালাইজড স্টেজ এর বিভিন্ন অবস্থাকে T0, T1, T2, T3, T4 এবং TX দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। N দ্বারা বোঝায় রিজিওনাল স্টেজ এ Lymph Node এর ক্যান্সার আক্রান্ত অবস্থা। N0, N1, N2, N3 এবং NX দ্বারা রিজিওনাল স্টেজ এর বিভিন্ন পর্যায় নির্ধারণ করা হয়। ডিসট্যান্ট স্টেজ কে MX, M0 এবং M1 দ্বারা প্রকাশ করা হয় Distant Metastasis এর উপর ভিত্তি করে।
বর্তমানে ক্যান্সারের প্রচলিত চিকিৎসা
প্রথমেই জেনেছি ক্যান্সারের আবিষ্কার আধুনিক হলেও ক্যান্সার ও টিউমার রোগটি অনেক পুরোনো। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়েই চিকিৎসকগণ ক্যান্সার ও টিউমার এর চিকিৎসা করতেন সার্জারি করে আক্রান্ত অংশ কেটে বাদ দিয়ে। চেতনানাশক আবিষ্কৃত হবার পর, ক্যান্সার আক্রান্ত অংশ ও সংযুক্ত খানিকটা প্রত্যঙ্গ বাদ দিয়েও চিকিৎসা চলেছে। কিন্তু চিকিৎসকগণ লক্ষ্য করলেন এভাবে সার্জারির পরেও ক্যান্সার আবার ‘ফিরে আসে’ এবং দেহের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের পর সত্তরের দশকে আলট্রাসাউন্ড, রেডিও ও ম্যাগনেটিক ইমেজিং সিস্টেম এর আবির্ভাব ও উন্নতির পর বৃহত্তর পরিসরে প্রত্যঙ্গ কেটে বাদ দেয়ার বদলে ক্যান্সারের অবস্থান নির্দিষ্ট করে আক্রান্ত স্থানে চিকিৎসা প্রয়োগ করার পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটে। এখন আমরা দেখব বর্তমানে ক্যান্সার চিকিৎসায় কী কী ধরণের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয় এবং এদের সফলতা।
সার্জারি (Surgury) : টিউমার ও ক্যান্সারের সবচেয়ে পুরাতন চিকিৎসা হিসেবে চলে আসছে সার্জারি। অর্থাৎ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে দেহ থেকে ক্যান্সার কোষ ও সংলগ্ন কিছু অংশ কেটে বাদ দেয়ার পদ্ধতি। সাধারণত সলিড টিউমার চিকিৎসায় সার্জারি একটি উল্লেখযোগ্য চিকিৎসাপদ্ধতি। সলিড টিউমার লোকালাইজড স্টেজে ধরা পড়লে, দেহের অন্যত্র ছড়িয়ে না পড়লে অনেক ক্ষেত্রে সার্জারির সাহায্যেই পুরো টিউমার অপসারণ করা সম্ভব হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরবর্তীতে ক্যান্সারের ফিরে আসা রোধ করতে সহায়ক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। কখনো কখনো রিজিওনাল স্টেজে গিয়ে ক্যান্সার ধরা পড়লে অন্যান্য উন্নত চিকিৎসার উপযুক্ত অবস্থায় নিয়ে যাবার জন্য সার্জারি করে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়। তারপর অন্যান্য চিকিৎসা শুরু হয়।
কেমোথেরাপি (Chemotherapy) : ক্যান্সার চিকিৎসায় ড্রাগস ব্যবহারের পদ্ধতি কেমোথেরাপি সংক্ষেপে কেমো নামে পরিচিত। তবে অন্যান্য রোগের মত ক্যান্সারের ড্রাগস সবসময় খাবার ঔষধ বা ইনজেকশন হয় না। খাবার ঔষধ ও ইনজেকশন ছাড়াও বিভিন্ন ক্যান্সার কোষ ধ্বংসকারী রাসায়নিক সরাসরি ক্যান্সার আক্রান্ত অংশে প্রয়োগ করা হয় কেমোথেরাপিতে। ক্যান্সার এবং ড্রাগস এর ধরণ এর উপর নির্ভর করে খাবার ঔষধের মাধ্যমে, শিরা ও মাংসপেশিতে ইনজেকশন এর মাধ্যমে, ব্রেইন এবং স্পাইনাল কর্ড আবৃত করে রাখা টিস্যুর স্তরের মাঝে, ফাঁপা প্রত্যঙ্গ যেমন পাকস্থলী, লিভার ইত্যাদির ফাঁপা অংশে সরাসরি, ক্যান্সার আক্রান্ত অংশে রক্ত সরবরাহ করে এমন ধমনীতে ড্রাগস প্রয়োগ করা হয়। বাহ্যিক ক্যান্সারের ক্ষেত্রে কখনো কখনো ক্রিম আকারেও ঔষধ প্রয়োগ করা হয়।
দেহাভ্যন্তরে সরাসরি ড্রাগস প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি মাইনর সার্জারি করে চামড়ার নিচে একটি ছোট ডিস্ক বসানো হয়। একে পোর্ট বলে (Port)। পোর্টের সাথে একটি সরু, নমনীয় টিউব সংযুক্ত হয় যার অপর প্রান্ত সংযুক্ত থাকে একটি বড় শিরার সঙ্গে। টিউবটিকে বলা হয় ক্যাথেটার (Catheter)।
এমন পোর্ট সচরাচর বুকের দিকে বসানো হয়। চিকিৎসকগণ এই পোর্টে ইনজেকশনের মাধ্যমে ড্রাগস প্রয়োগ করে। রক্ত নেয়ার প্রয়োজনেও এটি ব্যবহৃত হয়।
চিকিৎসা কেন্দ্রের বাইরে থাকা অবস্থাতেও ড্রাগস প্রয়োগের প্রয়োজন হলে পোর্টে অথবা ক্যাথেটারে একটি পাম্প বসানো হয়। এই পাম্প নির্ধারণ করে কতটুকু ও কী হারে ড্রাগস ক্যাথেটারে ভেতর দিয়ে গিয়ে শিরায় পৌঁছুবে।
ক্যান্সারের ধরণ ও স্টেজ অনুসারে কেমোথেরাপি ও এর কার্যকারিতা নির্ভর করে। যেমন লোকালাইজড স্টেজে ধরা পড়লে কেমোথেরাপির সাহায্যেই অনেক সময় ক্যান্সার নিরাময় হয়। আবার রিজিওনাল কিংবা ডিসট্যান্ট স্টেজে থাকা ক্যান্সার এর ক্ষেত্রে কখনো কখনো নির্দিষ্ট স্থানে থাকা ক্যান্সার কোষ ধ্বংসের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষের পরিমাণ কমিয়ে তারপর পরবর্তী চিকিৎসা পদক্ষেপ নেয়ার জন্যও কেমোথেরাপি প্রয়োগ করা হয়।
কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দৃষ্টিগ্রাহ্য। মূলত কেমোথেরাপিতে প্রয়োগ করা ড্রাগস ও রাসায়নিকগুলো ক্যান্সার কোষ তথা অতিদ্রুত বিভাজিত হওয়া কোষ গুলো আক্রমণ ও ধ্বংস করে এদের বৃদ্ধিরোধ করে। কিন্তু ক্যান্সার কোষ ছাড়াও দেহের প্রয়োজনীয় ও উপকারী দ্রুত বিভাজনশীল কোষগুলোও এসব ড্রাগস দ্বারা আক্রান্ত হয়। দেহের কিছুকিছু সুস্থ কোষ ধ্বংস হবার ফলেই কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে চুল পরে যাওয়া, মুখে ঘা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি দেখা দেয়; ক্লান্তি, অবসাদ ও জড়তা চলে আসে। কেমোথেরাপি চলমান রোগীকে বিশেষ নিয়মতান্ত্রিকভাবে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়, যেহেতু ড্রাগসের কল্যাণে (!) পরিপাক তন্ত্রের কিছু সুস্থ কোষও মারা পড়ে।
হরমোনাল থেরাপি (Hormonal Therapy) : প্রস্টেট ও ব্রেষ্ট ক্যান্সার চিকিৎসায় হরমোনাল থেরাপি ব্যবহৃত হয়। কারণ এই দুই ধরণের ক্যান্সারেই সংশ্লিষ্ট হরমোন ক্যান্সার কোষের বিভাজন ও ক্যান্সার বৃদ্ধির জন্য বিশেষভাবে কার্যকরী থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সার্জারি, রেডিয়েশন থেরাপি ইত্যাদি অন্যান্য চিকিৎসার সহায়ক ও পূর্ব-চিকিৎসা হিসেবে হরমোনাল থেরাপি দেয়া হয়। হরমোনাল থেরাপিতে দেহে নির্দিষ্ট হরমোন এর উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয় কিংবা দেহে নির্দিষ্ট হরমোনের কার্যকারিতা পরিবর্তন করে দেয়া হয়। এতে ক্যান্সার আর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না অথবা বৃদ্ধির হার কমে আসে। এর পর সার্জারি বা রেডিয়েশন থেরাপি প্রয়োগ করে পরবর্তী ধাপে চিকিৎসা করা হয়। খাবার ঔষধ ও ইনজেকশনের মাধ্যমে হরমোনাল থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। কখনো কখনো গুরুতর অবস্থায় হরমোনের উৎপাদন বন্ধ করতে হরমোন উৎপাদক প্রত্যঙ্গ (যেমন জরায়ু, অণ্ডকোষ) সার্জারি করে অপসারণ করা হয়।
হরমোনাল থেরাপিতে পুরুষ ও নারীদেহে ভিন্ন ধরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। পুরুষের প্রস্টেট ক্যান্সারের হরমোনাল থেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব, অবসাদ, হাড়ের দুর্বলতা, যৌনক্রিয়ায় আগ্রহ অথবা ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি। নারীর ব্রেষ্ট ক্যান্সারের হরমোনাল থেরাপিতে অবসাদ, বমি বমি ভাব, যৌনক্রিয়ায় আগ্রহ হাড়িয়ে ফেলা, ঋতুচক্রের পরিবর্তন, শুষ্কযোনী ইত্যাদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। প্রস্টেট ক্যান্সারের হরমোনাল থেরাপির পর রোগীর ওজন বেড়ে যেতে পারে। এর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিশেষ ডায়েট করা প্রয়োজন হতে পারে।
রেডিয়েশন থেরাপি (Radiation Therapy) : রেডিয়েশন থেরাপিকে সংক্ষেপে রেডিওথেরাপি বলা হয়। এক্ষেত্রে উচ্চ শক্তিসম্পন্ন বিকিরণ ক্যান্সার আক্রান্ত অংশে প্রয়োগ করা হয়। বিকিরণের শক্তি ক্যান্সার কোষগুলোকে মেরে ফেলে, কখনো ক্যান্সার কোষের DNA নষ্ট করে এর বৃদ্ধি রোধ করে। রেডিও থেরাপি প্রয়োগের সাথে সাথেই ক্যান্সার কোষ ধ্বংস হয় না। নিয়মিত বিকিরণ প্রয়োগ করে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় বিকিরণ প্রয়োগের পর কোষের DNA ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও কোষগুলো মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। সাধারণত উচ্চ শক্তি সম্পন্ন X-ray ব্যবহার করা হয় রেডিওথেরাপি তে। প্রায় প্রতিদিন নিয়মিতভাবে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত রেডিওথেরাপি চলে। থেরাপি সম্পন্ন হবার কয়েকদিন, সপ্তাহ কখনো মাসখানেক পরে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলো মারা গিয়ে ক্যান্সারের পরিধি কমতে শুরু করে। কিছুক্ষেত্রে মূল চিকিৎসা হিসেবে রেডিওথেরাপি দিলেও অনেক ক্ষেত্রে সার্জারির পূর্বে ক্যান্সারের পরিধি কমিয়ে আনতে, কখনো সার্জারি ও কেমোথেরাপির পরে অবশিষ্ট ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে রেডিও থেরাপি ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে প্রচলিত ভাষায় ক্যান্সার চিকিৎসায় ‘সেঁক’ দেয়া বলতে এক্সরে রেডিও থেরাপিকেই বোঝানো হয়।
রেডিও থেরাপির উচ্চমাত্রার বিকিরণের ফলে ক্যান্সার কোষের আশেপাশে থাকা কিছু সুস্থ কোষও নষ্ট হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে দেখা দেয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ক্যান্সার ও বিকিরণ প্রয়োগের স্থানের উপর নির্ভর করে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভিন্নতা দেখা যায়। মাথা, ঘাড় ও বুকে রেডিওথেরাপি প্রয়োগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ক্লান্তি ও অবসাদ, চুল পড়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব ইত্যাদি হতে পারে। আবার পরিপাক ও জনন তন্ত্রের দিকে রেডিও থেরাপি প্রয়োগে ডায়রিয়া, চুল পড়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব, যৌনক্ষমতা ও উর্বরতা জনিত সমস্যা ইত্যাদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে।
বর্তমানে X-ray এর পরিবর্তে উচ্চ শক্তি সম্পন্ন পজেটিভ চার্জযুক্ত প্রোটন কণা বিচ্ছুরণ ব্যবহার করেও রেডিওথেরাপি দেয়া হয়। একে Proton Beam Therapy বলা হয়।
এক্সরে রেডিও থেরাপি এবং প্রোটন বীম থেরাপি এক্সটারনাল রেডিও থেরাপির অন্তর্গত। ইন্টারনাল রেডিও থেরাপিতে শস্যদানার আকৃতিবিশিষ্ট তেজস্ক্রিয় ক্যাপসুল টিউমার বা ক্যান্সারের কাছাকাছি দেহাভ্যন্তরে সার্জারির মাধ্যমে স্থাপন করা হয়। প্রতিনিয়ত এই ক্যাপসুল থেকে বিকিরণ নির্গত হয়ে ক্যান্সার কোষে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
উপরিউক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থাগুলো বর্তমানে ক্যান্সার চিকিৎসায় প্রচলিত পদ্ধতি। আধুনিক অণুজীব বিজ্ঞান, অনুপ্রাণ বিজ্ঞান, ন্যানোটেকনোলজি ও জেনেটিক্স এর অগ্রগতির ফলে নতুন ধরণের জৈবনিক চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে আশার আলো দেখছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণ।
ক্যান্সারের অত্যাধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা ও ভবিষ্যৎ
বর্তমানে প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থাগুলোতে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে ক্যান্সারের চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। এতে করে ক্যান্সার কোষ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী সুস্থ কোষও ধ্বংস হয় এবং ফলাফল হিসেবে নানারকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ক্যান্সারকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা সার্জারি ও বাহ্যিক কৃত্রিম চিকিৎসার পাশাপাশি দেহাভ্যন্তরে জৈবনিক উপায়ে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যাপারে নজর দিচ্ছেন। ক্যান্সারকে বধ করার ব্যাপারে আশার আলো দেখাচ্ছে আধুনিক জৈবনিক চিকিৎসাপদ্ধতি। ক্যান্সার ও ক্যান্সার কোষ নিয়ে গবেষণা ও এর গতিপ্রকৃতি সূক্ষ্মভাবে নির্ণয় করে সুনির্দিষ্ট কার্যকরী ঔষধ প্রয়োগের গবেষণা চলমান। ক্যান্সারের জৈবনিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে ইমিউনোথেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি ও প্রিসিশন মেডিসিন ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে চলছে ও প্রাথমিকভাবে আশাব্যঞ্জক সফলতাও পাওয়া গেছে।
ইমিউনোথেরাপি (Immunotherapy) : এ পদ্ধতিতে ক্যান্সার কোষের উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ না করে বরঞ্চ দেহের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে (Immune system) ক্যান্সারের বিরুদ্ধে অধিক শক্তিশালী ও কার্যকর করার ব্যবস্থা করা হয়। এই পদ্ধতিতে নানারকম জৈব কোষ ও অণুজীবের ব্যবহার করে দেহের অতন্দ্র প্রহরী শ্বেত রক্তকণিকাকে (মূলত T-Lymphocyte বা T cell) ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে সক্রিয় করা হয়।
Adoptive cell transfer প্রক্রিয়ায় রোগীর দেহ থেকে T cell সংগ্রহ করা হয়। সেখান থেকে রোগীর দেহে আক্রান্ত ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী T cell গুলো পৃথক করা হয়; কখনো T cell এর জিনগত পরিবর্তন করে ঐ ক্যান্সারের বিরুদ্ধে অধিক কার্যকরী করা হয়। তারপর এই শক্তিশালী T cell গুলোকে ল্যাবে কৃত্রিম উপায়ে বিভাজিত করে প্রচুর পরিমাণ শক্তিশালী T cell উৎপাদন করা হয় এবং সেগুলো রোগীর শিরার মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করানো হয়। এভাবে দেহের ইমিউন সিস্টেমকে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সবল করে তোলা হয়।
এছাড়া বর্তমানে ল্যাবে T cell উৎপাদন এর বদলে অন্য কোনো শক্তিশালী T cell সমৃদ্ধ ব্যক্তির দেহ থেকে T cell সংগ্রহ করা যায় কিনা, ন্যানোটেকনোলজি প্রয়োগের মাধ্যমে দেহের ভেতরেই শক্তিশালী T cell উৎপাদন করা যায় কিনা এসব দিক নিয়ে গবেষণা চলছে। অন্যান্য প্রচলিত থেরাপির তুলনায় রিজিওনাল ও ডিসট্যান্ট স্টেজে থাকা ক্যান্সারের ক্ষেত্রে Adoptive cell transfer পদ্ধতি অভূতপূর্ব কার্যকারিতা প্রদর্শন করেছে।
রক্ত নামক তরল যোজক কলা বা লিকুইড কানেকটিভ টিস্যু তে টিউমার বিহীন ক্যান্সার হিসেবে ‘ব্লাড ক্যান্সার’ কে যখন রেডিওথেরাপি জাতীয় চিকিৎসায় ঠিক পাকড়াও করা সম্ভব হচ্ছিল না তখন ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসায় যেন আলোকবর্তিকা নিয়ে উদ্ভব ঘটল Adoptive cell transfer পদ্ধতির CAR T-cell therapy. এই থেরাপির উদ্ভাবন ব্লাড ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।
ইমিউনোথেরাপির একটি ধারা হচ্ছে Cytokines এর প্রয়োগ। এটি একধরণের প্রোটিন যা ইমিউন সিস্টেমকে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠতে সহায়তা করে। ইমিউনোথেরাপিতে সাধারণত দু’প্রকার Cytokines ব্যবহৃত হয়। Interferons এবং Interleukins.
Bacillus Calmette-Guérin (BCG) নামক ইমিউনোথেরাপি ব্লাডার (মূত্রথলি) ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এই প্রক্রিয়ায় টিউবারকুলেসিস ব্যাকটেরিয়াকে দুর্বল করে সরাসরি মূত্রথলিতে প্রয়োগ করা হয়। এই ব্যাকটেরিয়া ক্যান্সারের বিরুদ্ধে ইমিউন রেসপন্স তৈরি ও দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ব্লাডার ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই পদ্ধতি অন্যান্য ক্যান্সারের জন্য প্রয়োগ করা যায় কিনা তা নিয়ে গবেষণা চলছে।
ইতোমধ্যেই কিছু ক্যান্সার ভ্যাকসিন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিছু ভ্যাকসিন ব্যবহৃত হয় ক্যান্সার নিরাময়ে, কিছু ভ্যাকসিন পূর্ব-প্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে। ক্যান্সার ভ্যাকসিন গুলো মূলত দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সক্রিয় ও শক্তিশালী করে থাকে।
Oncolytic Virus Therapy প্রক্রিয়ায় জেনেটিক্যালি মডিফাইড ভাইরাস দেহের ক্যান্সারাক্রান্ত অংশে প্রয়োগ করা হয়। এই ভাইরাসগুলো এমনভাবে প্রস্তুত করা হয় যেন তা শুধু ক্যান্সার কোষকেই আক্রমণ করে ও সুস্থ কোষকে আক্রমণ না করে। ভাইরাস দেহে প্রয়োগের পর এটি ক্যান্সারাক্রান্ত কোষে প্রবেশ করে ও নিজের প্রতিলিপি তৈরি করে। এতে ক্যান্সার কোষ নষ্ট হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। আবার ভাইরাসাক্রান্ত মৃত ক্যান্সার কোষের ধ্বংসাবশেষে থাকে ‘এন্টিজেন’ যা ইমিউন রেসপন্স এর জন্য দায়ী। এসব এন্টিজেন ছড়িয়ে পড়লে দেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ক্যান্সার আক্রান্ত অংশে ঐ এন্টিজেন সমৃদ্ধ ক্যান্সার কোষগুলোকে শনাক্ত করে ধ্বংস করে।
২০১৫ সালে প্রথমবারের মত Melanoma (এক প্রকার স্কিন ক্যান্সার) চিকিৎসায় Oncolytic Virus Therapy প্রয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে Talimogene Laherparepvec ভাইরাসের মডিফাইড ভার্সন ব্যবহার করা হয়।
টার্গেটেড থেরাপি (Targeted Therapy) : টার্গেটেড থেরাপিতে ক্যান্সার কোষের কোষীয় পরিবর্তন চিহ্নিত করে সেগুলোকে লক্ষ্য করে ঔষধ প্রয়োগ করা হয়। এসকল ঔষধ ক্যান্সার কোষের ক্ষতিকর পরিবর্তন গুলোকে মেরামত করার চেষ্টা করে, কখনো এসব পরিবর্তনের জন্য ঘটা অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়া আটকে দেয়।
Monoclonal Antibody ল্যাবরেটরিতে বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত একপ্রকার প্রোটিন। এই প্রোটিন এমনভাবে প্রস্তুত করা হয় যেন তা ক্যান্সার কোষের বাইরের গায়ের নির্দিষ্ট উপাদানের সাথে গিয়ে মিলিত হয় এবং ক্যান্সার কোষের অনিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া আটকে দেয়। এছাড়া এই এন্টিবডির সাথে বিষাক্ত পদার্থও জুড়ে দেয়া যায়। যখন এটি ক্যান্সার কোষের গায়ে যুক্ত হবে তখন এই বিষাক্ত পদার্থ ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলবে। কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন থেরাপির সাথে সহযোগী হিসেবে এধরনের টার্গেটেড থেরাপি দেয়া হয়। সরাসরি শিরায় এই এন্টিবডি প্রয়োগ করা হয়।
Small-molecule drugs আরেক প্রকার অতিসূক্ষ্ম টার্গেটেড থেরাপি প্রক্রিয়া। Monoclonal Antibody এর আকার বড় হওয়ায় এগুলো কোষাভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে না ও কোষের বাইরের গায়ে যুক্ত হয়। কিন্তু Small-molecule drugs অত্যন্ত ক্ষুদ্রকায় হওয়ায় এটি কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। তাই এই প্রক্রিয়ায় কোষের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন কে টার্গেট করা হয়। এই ড্রাগ ক্যান্সার কোষের ভেতরে প্রবেশ করে কোষের বিভাজন ও ছড়িয়ে পরা প্রতিরোধ করে।
Angiogenesis Inhibitors একটি বিশেষ টার্গেটেড থেরাপি। যে প্রক্রিয়ায় নতুন রক্তনালী তৈরি হয় তাকে Angiogenesis বলে। টিউমার ও ক্যান্সারের দ্রুতবর্ধনশীল কোষের জন্য দরকার অতিরিক্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি যা রক্তের মাধ্যমে কোষে পৌঁছে। এই থেরাপিতে ক্যান্সার আক্রান্ত অংশে Anti-Angiogenesis ড্রাগ প্রয়োগ করা হয়। এসব ড্রাগ ক্যান্সার কোষ শনাক্ত করে সেখানে নতুন রক্তনালী তৈরি হওয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে ক্যান্সার কোষ বিভাজন ও ছড়িয়ে পড়ার জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না। এটি বেশ কিছু প্রত্যঙ্গ যেমন কিডনি, লিভার, ফুসফুস ইত্যাদির ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
প্রিসিশন মেডিসিন (Precision Medicine) পদ্ধতির ধারণা একেবারে নতুন নয় তবে এই পদ্ধতি এখনো কার্যকরীভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসেবে প্রয়োগ করা হয়নি। ইমিউনোথেরাপি ও টার্গেটেড থেরাপির বেশ কিছু পদ্ধতি এখনই চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহৃত হলেও প্রিসিশন মেডিসিন এখনো গবেষণা পর্যায়েই রয়েছে। তবে বর্তমানে জেনেটিক্সের অগ্রগতির ফলে এ পদ্ধতির গবেষণায় উত্তর উত্তর উন্নতি সাধিত হচ্ছে। সাধারণত একই উপসর্গ ও একই স্টেজ এর ক্যান্সারের জন্য সকল রোগীকে একই ধরণের চিকিৎসা দেয়া হয়। কিন্তু একেক রোগীর ক্ষেত্রে তা একেকভাবে কাজ করে। কারণ একইরকম উপসর্গ হবার পরেও বিভিন্ন রোগীর ক্যান্সার কোষের DNA Damage ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। আর এই অবস্থা থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা হিসেবেই চিন্তা করা হচ্ছে প্রিসিশন মেডিসিনের।
এ পদ্ধতির মূলনীতি হচ্ছে রোগীর ক্যান্সার কোষের ডিএনএ সিকুয়েন্সিং, জিনোমিক টেস্টিং, মলিকুলার প্রোফাইলিং ইত্যাদির মাধ্যমে ঠিক কী জিনগত পরিবর্তনের জন্য ক্যান্সারটির উৎপত্তি তা নির্ণয় করে সে সমস্যা সমাধানকল্পে সুনির্দিষ্ট ঔষধ আবিষ্কার, নির্ণয়, নির্ধারণ ও প্রয়োগ করে ক্যান্সারের চিকিৎসা করা।
সফলতা পরিসংখ্যান
ক্যান্সারের শনাক্তকরণ থেকে শুরু করে নানাবিধ চিকিৎসা পদ্ধতির বর্ণনা, ক্যান্সার কোষ শনাক্ত করে ধ্বংস করার পদ্ধতি থেকে দেহে জৈবনিক উপায়ে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি ও প্রতিরোধ পর্যন্ত আধুনিক চিকিৎসা সম্পর্কে ধারণা এবং শেষে ন্যানোটেকনোলজির ও জেনেটিক্সের জাদুর ছোঁয়ায় ক্যান্সারের বিরুদ্ধে পরীক্ষাগারে জেনেটিক্যালি মডিফাইড ভাইরাস দ্বারা ক্যান্সার প্রতিরোধ করার মত অবিশ্বাস্য পদ্ধতির কথাও আমরা জানলাম। এখন দেখা যাক এসব পদ্ধতির সফলতার পরিমাণ। এসব অত্যাধুনিক পদ্ধতি আসলে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কতটা শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে। ক্যান্সার চিকিৎসায় কতটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছে এসব আধুনিক জৈব প্রযুক্তি ও অন্যান্য প্রচলিত পদ্ধতি।
American Cancer Society কর্তৃক প্রকাশিত Cancer Treatment & Survivorship Facts & Figures 2016-2017 পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত শুধুমাত্র USA তেই প্রায় ১৫.৫ মিলিয়ন অর্থাৎ প্রায় দেড় কোটি জীবিত ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তি রয়েছেন যাদের কেউ কেউ চিকিৎসাধীন, কেউ আবার ক্যান্সারকে জয় করে সুস্থ জীবনযাপন করছেন।
এই পরিসংখ্যান বোঝার জন্য ছোট্ট একটি হিসেবে জেনে নেয়া দরকার। সেটি হল ‘রিলেটিভ সারভাইভাল রেট’। রিলেটিভ সারভাইভাল রেট বলতে বোঝায় – কোনো নির্দিষ্ট স্টেজের ক্যান্সার শনাক্তকরণের পর যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করা রোগীর মধ্যে কত শতাংশ কমপক্ষে একটা ন্যূনতম সময় বেঁচে থাকছে। একটি উদাহরণের সাহায্যে দেখা যাক।
রিজিওনাল স্টেজে ধরা পড়া ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগীর ‘5 year relative survival rate’ ৮৫% বলতে বোঝায় – রিজিওনাল স্টেজে ধরা পড়া ব্রেস্ট ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করা রোগীদের শতকরা ৮৫ ভাগ রোগীই কমপক্ষে ৫ বছর বেঁচে থাকে ক্যান্সার ধরা পড়ার পর।
এর অর্থ এই নয় যে রোগী ৫ বছরই বেঁচে থাকছে। কখনো ক্যান্সার নিরাময় হয় ও রোগী সুস্থ জীবন যাপন করে, কখনো নিয়মিত চিকিৎসায় রোগ আর বাড়তে পারে না ও চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোগী ১০ বছর বা আরো বেশি সময় স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে।
উক্ত পরিসংখ্যানে ২০০৫-২০১১ সাল পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন স্টেজে ধরা পড়া বিভিন্ন ক্যান্সার এর জন্য Five-year relative survival rate এর একটি উপাত্ত-লিপি তুলে ধরা হয়েছে।
এই চার্ট অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে ফুসফুস ও ব্রংকাস ক্যান্সার এর সারভাইভাল রেট সবচেয়ে কম। লোকালাইজড স্টেজে ধরা পড়ার পরেও ৬০ শতাংশের নিচে। এছাড়া কিছু লিম্ফ ক্যান্সার বাদে এখানে দেখানো বাকি প্রায় সকল ক্যান্সারের ক্ষেত্রেই লোকালাইজড স্টেজে ধরা পড়লে সারভাইভাল রেট ৯০ শতাংশের ঊর্ধ্বে। কোলন ও রেক্টাম ক্যান্সার বাদে বাকি সব ক্যান্সারে লোকালাইজড স্টেজ এর ক্ষেত্রে সারভাইভাল রেট ৯৫ শতাংশের উপরে, কখনো তা শতকরা ৯৯ ভাগেরও বেশি। তাহলে দেখা যাচ্ছে এখনো প্রাণঘাতী হিসেবে ফুসফুস ও ব্রংকাস এবং কিছু মারাত্মক সংবেদনশীল অঙ্গের ক্যান্সারকে দেখা যেতে পারে। অন্যান্য ক্যান্সার এর ক্ষেত্রে লোকালাইজড স্টেজে ধরা পড়লে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ক্যান্সারের নিরাময়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি। যত খারাপ অবস্থায় গিয়ে, যত পরবর্তী স্টেজে ক্যান্সার ধরা পড়ে আরোগ্য হবার সম্ভাবনা তত কমে যায় ও মৃত্যুঝুঁকি তত বেড়ে যায়। তাই ক্যান্সারকে রুখতে অবশ্যই সর্বাগ্রে নজর দিতে হবে যত দ্রুত ক্যান্সার শনাক্ত করা যায় তার দিকে।
Cancer Facts & Figures 2017 পরিসংখ্যান থেকে ১৯৭৫-১৯৭৭, ১৯৮৭-১৯৮৯ এবং ২০০৬-২০১২ সাল সময়ে Five-Year relative survival rate এর তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যায়।
এখানে থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে হাতে গোনা গুটি কয়েক সংবেদনশীল প্রত্যঙ্গ বাদে বাদবাকি ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলশ্রুতিতে রিলেটিভ সারভাইভাল রেট দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশ কিছু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে রিলেটিভ সারভাইভাল রেট বৃদ্ধি পেয়েছে ১০-১৫ শতাংশ, কিছু ক্ষেত্রে বৃদ্ধির পরিমাণ ২০-৩০ শতাংশ। আর এটাও মনে রাখতে হবে এই পরিসংখ্যান গুলো যেসব রোগীর উপর করা হয়েছে তারা চিকিৎসা নিয়েছে আরো ৫-১০ বছর আগে। অর্থাৎ প্রায় এক যুগ আগের চিকিৎসা পদ্ধতিতে। এই এক যুগে চিকিৎসাবিজ্ঞান এগিয়েছে আরো অনেকখানি।
ক্যান্সারের উৎপত্তি হয় DNA Damage এর ফলে, আর DNA Double Helix আবিষ্কৃত হয় বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝি। মাত্র অর্ধশতাব্দিতে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে চিকিৎসাবিজ্ঞান যতটা অগ্রসর হয়েছে তা পূর্বের যেকোনো সময়ে যেকোনো মহামারীর তুলনায় অভূতপূর্ব। তথাপি জৈবনিক চিকিৎসা ব্যবস্থাগুলোর দ্বার সবে উন্মোচিত হওয়া শুরু হয়েছে ন্যানোটেকনোলজি ও জেনেটিক্সের অগ্রগতির সাথে সাথে। ইতোমধ্যেই চিকিৎসা ব্যবস্থা লোকালাইজড স্টেজে থাকা ক্যান্সারকে প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। টার্গেটেড থেরাপি ও প্রিসিশন মেডিসিন সফলভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হলে পূর্ববর্তী অন্যান্য মহামারীর মত হয়ত ভবিষ্যতে ক্যান্সারকেও হাতের মুঠোয় আনা সম্ভব হবে।
সবশেষে যে বিষয়টি বলা প্রয়োজন বোধ করছি সেটি হল; ক্যান্সার কোষ হচ্ছে সেই কোষ যেগুলোতে জেনেটিক পরিবর্তনের ফলে ‘বার্ধক্য ও মৃত্যু’ অংশটি DNA থেকে হারিয়ে যায়। তখন কোষ বার্ধক্য ও মৃত্যুর বদলে অবিরাম কোষের বিভাজন ঘটিয়ে চলে যার ফলাফল ক্যান্সার। ক্যান্সার কোষের জৈবিক বিশ্লেষণ ও জেনেটিক গবেষণার মধ্য দিয়ে হয়ত বার্ধক্যের কোনো জটিল সূত্র উদ্ভাবন হয়েও যেতে পারে। মরণব্যাধি হতে উত্তরণের গবেষণা থেকেই হয়ত অঙ্কিত হতে পারে অমরত্বের পথে কোন নতুন পদচিহ্ন।
তথ্যসূত্র : –
১. History of Cancer, Ancient and Modern Treatment Methods – Journal of Cancer Science and Therapy, (Via – NCBI)
DOI: 10.4172/1948-5956.100000e2, PMCID: PMC2927383, NIHMSID: NIHMS226784
৩. The future of cancer treatment: immunomodulation, CARs and combination immunotherapy – The Nature Journal
NCBI, DOI: 10.1038/nrclinonc.2016.25, PMCID: PMC5551685, NIHMSID: NIHMS886588
৪. Discovery of DNA Structure and Function: Watson and Crick – The Nature Journal
৮. Cancer Staging – National Cancer Institute, USA
৯. Summary Staging – SEER Training Module, National Cancer Institute, USA
১০. Relative Survival – SEER Training Module, National Cancer Institute, USA
১১. National Cancer Institute, USA
১২. American Society of Clinical Oncology (ASCO)
১৪. Cancer Treatment & Survivorship Facts & Figures – American Cancer Society
১৫. Cancer Treatment & Survivorship Facts & Figures 2016-2017 – American Cancer Society
১৬. Cancer Facts & Figures 2017 – American Cancer Society