শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলে বিজ্ঞানমেলাঃ একটি বিজ্ঞানময় দিন আর কিছু মজার স্মৃতি

বিজ্ঞানযাত্রার শুরুটা হয়েছিলো অনলাইনে। একদম প্রথমে, ২০১৩ সালে ফেসবুকে ‘বিজ্ঞানের মায়েরে বাপ‘ নামক জনপ্রিয় একটা পেইজ খুলেছিলেন বিজ্ঞানযাত্রার প্রতিষ্ঠাতা ফরহাদ হোসেন মাসুম। এই পেইজের সুবাদে আমাদের অনেকের সাথে পরিচয় ঘটে ফরহাদের। সমমনা এবং বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা থাকায় বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। এরপর সমমনাদের একত্র করতে তৈরি হয় ফেসবুক গ্রুপ ‘বিজ্ঞানযাত্রা’, যেখানে এখন সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার। কিন্তু শুধু গ্রুপ খুলেই আমরা সন্তুষ্ট থাকিনি। বিজ্ঞানকে সর্বস্তরের মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছি। এর মধ্যে একটি হল বিজ্ঞানভিত্তিক ব্লগ ‘বিজ্ঞানযাত্রা‘ চালু করা। তরুণ লেখকরা এখানে সুযোগ পেয়েছেন বিজ্ঞান নিয়ে লেখার। এই ব্লগের ফেসবুক পেইজও খোলা হয়েছে ‘বিজ্ঞানযাত্রা‘ নামে। এরপরে উদ্যোগ নিয়েছি স্কুলে স্কুলে গিয়ে বিজ্ঞানমেলা করার, কারণ বাল্যকাল থেকে বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক তৈরি করাটা খুব জরুরি। সে সূত্র ধরে ২০১৭ সালের মে মাসের ১২ তারিখে মুন্সিগঞ্জের শ্রীপুরে অনুষ্ঠিত হল বিজ্ঞানযাত্রা আয়োজিত প্রথম বিজ্ঞানমেলা। এরপর একে একে চট্টগ্রামের রাউজান আর লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে করেছি দ্বিতীয় আর তৃতীয় বিজ্ঞানমেলা। এরপর সুযোগ পেয়েছি সিলেটে আসার। ৮ মে ২০১৮ তারিখে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অবস্থিত শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলে আয়োজন করেছি বিজ্ঞানযাত্রার চতুর্থ মেলার।

এবারের মেলায় আমাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত আড়াই শতাধিক ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে একটি বিজ্ঞানময় দিন কাটানো। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিলো সকাল সাড়ে দশটায়, আর শেষ হয়েছিলো বিকেল পাঁচটায়। অনুষ্ঠানে ছিল মজার মজার ভিডিওসহ লেকচার, চোখ ধাঁধানো পোস্টার, বিস্ময়কর নিরীক্ষা, ছাত্রছাত্রীদের তৈরি করা দারুণ সব প্রজেক্ট, যেমন খুশি তেমন প্রশ্ন করার পর্ব, আর ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবালের বক্তৃতা। আয়োজনে ছিলাম ঢাকা (১৩ জন), সিলেট (১৫ জন) এবং চট্টগ্রাম (৯ জন) বিজ্ঞানযাত্রার দল।

                                                           শুরুর কথা

ঢাকা থেকে ৭ মে দুপুর বারোটার ট্রেনে করে রওনা দিয়েছিলেন সবার বড় ভাই আর বড় আপু অনীক আন্দালিব আর তানজিলা আফরিন। সাথে ছিল তাদের কন্যা এবং সর্বকনিষ্ঠ বিজ্ঞানযাত্রী অনহিতা অরোরা। ৭ তারিখেই রাত এগারোটার বাসে করে রওনা দিয়েছিলাম বাকি ১০ জন। ইউনিক বাসের ইউনিক টানে ৬ ঘণ্টায় পৌঁছলাম সিলেটের কদমতলী বাসস্ট্যান্ডে। এরকম ওভারটেক মার্কা চালানো দেখে আমার হার্ট এটাক হতে হতেও হয়নি। তবে বেপরোয়া হিসেবে খ্যাত এনা বাসের সাথে টক্কর মেরে আমাদের ইউনিক বাসের প্রথম হওয়ার ঘটনা সবাইকেই আবুল বানিয়ে দিলো।

সকাল ৬ টায় নেমে বাসস্ট্যান্ডেই অতি অখাদ্য খিচুড়ি আর পরোটা দিয়ে সকালের নাস্তা সারলাম। তারপর সিএনজিতে করে সোজা চলে এলাম শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি)। এর আগে সিলেটে ঘুরতে এসে শাবিপ্রবির ক্যাম্পাসটা ঘুরতে পারিনি। ফলে মনে একটা আক্ষেপ ছিল। কিন্তু ভবিষ্যতে যে একটা মেলার আয়োজক হয়ে ক্যাম্পাসে আসা হবে, এটা কস্মিনকালেও চিন্তা করিনি। তাই মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলাটা আবশ্যক হয়ে দাঁড়ালো।

ফোটোসেশন শেষে পা দিলাম ক্যাম্পাসের ভেতর। পিচ ঢালা পথ চলে গেছে বহুদূর। এত ক্লান্ত শরীরে এতটা পথ হাঁটতে পারবো কিনা, চিন্তা হচ্ছিলো। কিন্তু সকাল আটটার মেঘলা আকাশ আর ঠাণ্ডা হাওয়া শরীরকে একদম চাঙ্গা করে দিলো। চারপাশের সবুজে ছাওয়া প্রকৃতি দেখতে দেখতে আমরা বঙ্গবন্ধুর মুরাল সম্বলিত গোল চত্বর পর্যন্ত চলে এলাম। পরে শুনেছিলাম, এক কিলোমিটার লম্বা এই ওয়াকওয়েটা শাবিপ্রবির খুবই বিখ্যাত একটি প্রতীক। গোল চত্বর থেকে আমি চলে যাবো ছাত্রী হলে, ছেলেরা চলে যাবে ছাত্র হলে। সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে আমরা মিলিত হবো সাস্টের মিনি অডিটোরিয়ামে। সেখানেই আয়োজিত হবে বিজ্ঞানযাত্রার বিজ্ঞানমেলা।

গোল চত্বর থেকে ‘সেকেন্ড হল’ নামে পরিচিত ছাত্রী হলে যেতে যেতে মনে হল, আরেক কি.মি. পাড়ি দিয়ে দিলাম। শেষমেশ যখন সিঁড়ি ভেঙ্গে পাঁচতলার নির্ধারিত রুমে পৌঁছলাম, আমি আর আমি নেই। গোসল সেরে বিছানায় বসতেই আপনাতে গা এলিয়ে পড়লো। ঘুমিয়েই পড়লাম একদম। মাঝে হঠাৎ ঘুম ভাঙার পর খোঁজ নিয়ে জানলাম, ছেলেরা এখনো ঘুমুচ্ছে। কেউ অডিটোরিয়ামে যায়নি। যেহেতু অনুষ্ঠান শুরু দশটায়, তাই সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ঘুমানো যাবে। সাড়ে নয়টার দিকে অনীক ভাইয়ের ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙল। দ্রুত উঠে প্রস্তুত হয়ে প্রিন্সকেও ফোন দিয়ে উঠালাম। বাকিরা ঘুমুচ্ছে, ঘুমাক। কারণ বাইরে চলছে তুমুল বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে বাচ্চাকাচ্চারা মেলা দেখতে আসবে না। তাই আমরা কয়েকজন মিলে মিলনায়তন সাজাতে থাকি, বৃষ্টি থামলে বাকিরা এসে যোগ দিবে।

এইবেলা চট্টগ্রামের বিজ্ঞানযাত্রীদের কথা কিছু বলি। তারা ৭ তারিখ রাত সাড়ে নয়টার ট্রেনে করে চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিয়েছে। কিন্তু ৮ মে ভোর ছয়টায় শুনি, অশৈলী ঝড়ের তাণ্ডবে লাউয়াছড়া এসে তাদের ট্রেনের ইঞ্জিনের উপর গাছ ভেঙ্গে পড়েছে। ফলে আসতে আরও ঘণ্টা দু’য়েক দেরি হবে। যাই হোক, দশটার আগে এলেই হল। ওদের কাছে প্রজেক্টর আছে। আমাদের যত ভিডিও লেকচার আছে, সব ঐ প্রজেক্টরের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু দশটার দিকে খবর পেলাম, চট্টগ্রাম পার্টির আসতে দুপুর বারোটা বাজবে। ঠিক আছে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, প্রজেক্টর ছাড়া যেসব লেকচার দেওয়া সম্ভব, সেগুলো দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করবো। ফলে সকাল দশটার দিকে যখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের সম্মানিত প্রধান শিক্ষক জিতেন্দ্র ভট্টাচার্যসহ ছাত্রছাত্রীরা এসে জড়ো হল অডিটোরিয়ামে, আমরা দেরি না করে অনুষ্ঠান শুরু করে দিলাম। আড়াইশো দর্শক নিয়ে এই প্রথম আমাদের কোনো মেলা হচ্ছে। হই হট্টগোলে কান পাতা দায়। স্কুলের চারজন শিক্ষকও এসেছিলেন মেলায়। তারা বাচ্চাকাচ্চাদের নীরব রাখতে সাহায্য করছিলেন।

                                                                         অনুষ্ঠান হল শুরু

অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন বিজ্ঞানযাত্রার সুদর্শন সঞ্চালক হিসেবে খ্যাত রিজওয়ানুর রহমান প্রিন্স। প্রথমে তিনি স্কুল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দিলেন মেলা আয়োজন করার অনুমতি দেওয়ার জন্য, এরপর ছাত্রছাত্রীদের ধন্যবাদ দিলেন অংশগ্রহণের জন্য। তারপর জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু করার জন্য আহ্বান জানালেন। সাথে সাথে সবাই সটান দাঁড়িয়ে গেলো। মোবাইলে ডাউনলোড করে রাখা গানের সাথে সবাই গলা মেলালাম। আমার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন স্যার। গান যখন শেষের দিকে, তখন দেখলাম উনি খুব সাবধানে চোখ মুছছেন। আরে, কী মুশকিল! “মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি” চরণটা গাইতে গিয়ে তো আমারও প্রতিবার কণ্ঠ আটকে আসে। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। আর স্যারের কাণ্ড দেখে যেন বেশি আবেগী হয়ে পড়লাম।

জাতীয় সংগীত শেষ হলে প্রিন্স মঞ্চে ডেকে নিয়ে এলেন অনীক ভাইকে, যেন তিনি বিজ্ঞানযাত্রা সংগঠনটির সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেন, আমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে সংক্ষেপে বলেন। অনীক ভাই শিক্ষক মানুষ। ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ির ফাঁকে এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে, অল্প কথায় চমৎকারভাবে তিনি উপস্থাপন করলেন বিজ্ঞানযাত্রা কী, কাদের নিয়ে গঠিত, আমরা কী করছি, এখন পর্যন্ত কয়টা বিজ্ঞানমেলা করেছি, আর কী কী করতে যাচ্ছি ইত্যাদি। এরপর প্রিন্স মঞ্চে আহ্বান জানালেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের প্রধান শিক্ষককে। তিনি বিজ্ঞান কী, কেন বিজ্ঞান চর্চা করা উচিৎ ইত্যাদি বিষয়ে সুন্দর একটি বক্তৃতা রাখলেন। তবে সুকুমার রায়ের “বিষম চিন্তা” ছড়া আবৃত্তি করে উনি ভাষণকে নিয়ে গেলেন অন্য উচ্চতায়। মন্ত্রমুগ্ধের মত পুরো ছড়াটা শুনলাম আমরা। আসলেই তো! এরচেয়ে সহজে আর কীভাবে আমাদের সমাজে বিজ্ঞানচর্চার প্রতি বাধাকে প্রকাশ করা যায়? প্রশ্ন করতে গেলেই, “ফালতু কথা বলবে না / বেশি কথা বলবে না / বেশি পেকে গিয়েছিস?” ইত্যাদি শুনতে হয়। কৌতূহলী মনটাকে প্রথমেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়, যেন প্রশ্ন করাটা বেয়াদবির লক্ষণ। অথচ বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার, বিজ্ঞানী হওয়ার প্রথম শর্তই প্রশ্ন করা, সেটা বোকার মত হলেও। প্রশ্ন না করলে জানবো কীভাবে?

মেলায় অংশ নেওয়া ছাত্রছাত্রীদের একাংশ

এরপর প্রিন্সের আহবানে একে একে মঞ্চে উঠে এলেন স্কুলের বিজ্ঞান স্যার, বাংলা স্যার, আর সবশেষে এলেন অডিটোরিয়ামে উপস্থিত একমাত্র ম্যাডাম। প্রিন্সের ভাষায়, বিজ্ঞানযাত্রীদের মনে উদ্দীপনা তৈরি করার জন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে দু’য়েক লাইন শোনা দরকার। সে হিসেবে চারজন শিক্ষকের অনুপ্রেরণা পেয়ে আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমাদের পরবর্তী কার্যক্রমে।

প্রথমে মঞ্চে উঠে এলেন রুবেল রানা, মঙ্গলে বসতির উপর বক্তৃতা নিয়ে। মঙ্গলকে কেন বসতি স্থাপনের জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে, পৃথিবীর সাথে কী কী ব্যাপারে মঙ্গলের মিল পাওয়া গেছে, কে মঙ্গলে বসতি স্থাপনের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, কেন মঙ্গলে ঘাঁটি গাড়া মানুষের জন্য এত প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করলেন তিনি। এরপর এই বিষয়ে শ্রোতাদের কারো প্রশ্ন আছে কিনা জানতে চাইলেন। প্রশ্ন নেই জেনে নিজেই কিছু প্রশ্ন করে বসলেন। কেউ উত্তর দিতে পারলো, কেউ পারলো না। অর্থাৎ সবার মনোযোগ সমান ছিল না।

মনোযোগ আকর্ষণের জন্য আমরা সুশান্ত বিশ্বাসকে মঞ্চে উঠিয়ে দিলাম তার “পড়ন্ত বস্তুর সূত্র” নিরীক্ষা দেখানোর জন্য। চটপটে এই তরুণ দারুণভাবে দর্শকদের মাতিয়ে তুললেন তার এক্সপেরিমেন্ট প্রদর্শন করে। এক হাতে মানিব্যাগ, আরেক হাতে পাতলা কাগজ ধরে রেখে তিনি যখন জিজ্ঞেস করলেন, “কোনটা আগে মাটিতে পড়বে?”, বেশিরভাগ দর্শকই জবাব দিলো ‘মানিব্যাগ’। কেউ কেউ বলল, কাগজ। যারা মানিব্যাগ, যারা কাগজ, আর যারা দুটোই একসাথে পড়বে গোত্রের, সুশান্ত তাদের পৃথকভাবে হাত তুলতে বললেন। বেশ অবাক হলাম যখন দেখলাম পিচ্চি একটা ছেলে হাত তুলে বলছে, “দুটোই একসাথে পড়বে।” ‘কেন?’ জিজ্ঞেস করাতে বলল, বাতাসের বাধা না থাকলে সব বস্তু একসাথে মাটিতে পড়বে। বেশ চমৎকৃত হলাম!

সুশান্ত বললেন, যেখানে বাতাস নেই, এমন জায়গায় যেকোনো ভরের বস্তু একসাথে পড়বে। কিন্তু বাতাসের বাধা আছে এমন জায়গায়? প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য তিনি একটা কাগজকে দলা পাকালেন। একহাতে দলা, আরেক হাতে সমান আকৃতির ভাঁজ খোলা কাগজ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোনটা আগে পড়বে? বেশিরভাগ হৈহৈ করে উঠলো, কাগজের দলা আগে পড়বে। সুশান্ত প্রশ্ন করলেন, কেন? দলার কাগজ আর স্বাভাবিক কাগজের ভর তো একই! দর্শকরা ধাঁধাঁয় পড়ে গেলো। বক্তা ধাঁধাঁ পরিষ্কার করে দিলেন। দুটো জিনিসকে একইসাথে ছেড়ে দেখালেন, দলা আগে পড়েছে। কারণ কাগজকে দলা করার পরে এর সারফেস এরিয়া কমে গেছে। ফলে এটি কম জায়গা জুড়ে বাতাসের বাধা পাবে। বাধা কমে যাওয়ায় ভাঁজ খোলা কাগজের চেয়ে দলাটা দ্রুত পড়বে। কিন্তু খোলা কাগজ অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাধা পেতে পেতে পড়বে। ফলে সময় বেশি লাগবে। এরপর দুই হাতে দুটো সমান ভরের মোবাইল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোনটা আগে পড়বে? দর্শকরা চিৎকার করে উঠলো, না না স্যার, আর যাই করেন মোবাইল ফেলায়েন না! দামী জিনিস। শুনে প্রথমে অবাক, পরক্ষণে হেসে গড়াগড়ি খেলাম সবাই। কিন্তু সুশান্ত মোবাইল ফেলবেনই। সমান ভর এবং আকৃতির আর কিছু নেই তার কাছে। একইসাথে দুটো মোবাইল ফেলার পর দেখা গেলো সেগুলো একইসাথে মাটিতে পড়লো। প্রমাণ হয়ে গেলো পড়ন্ত বস্তুর প্রথম সূত্র!

তুমুল করতালির মাধ্যমে সুশান্ত বিদায় নিলেন মঞ্চ থেকে। প্রিন্স দর্শকের উদ্দেশ্যে কিছু ফলোআপ প্রশ্ন করলেন। ছেলেমেয়েরা ভালোই জবাব দিলো। বুঝা গেলো, তারা নিরীক্ষাটা দেখে মজা পেয়েছে। আসলে এভাবেই তো বিজ্ঞান শেখানোর কথা! আমি যখন প্রথমবারের মত পাঠ্যবইয়ে এই সূত্র পড়েছিলাম, কেউ হাতে কলমে দেখায়নি ব্যাপারটা। দেখালে কনসেপ্টটা আরও কতো স্পষ্ট হতো, সেটা ভেবে আফসোস হয় এখন। যা হোক, প্রিন্স এরপর আমাকে ডাকলেন মঞ্চে। গেলাম “পুষ্টি বিষয়ক কিছু ভুল ধারণা” ভাঙাতে। ‘রোদে কি ভিটামিন ডি আছে? চিনি খেলে কি ডায়াবেটিস হয়? সয়াবিন তেলে কোলেস্টেরল আছে কি নেই? কোলেস্টেরল শরীরের জন্য খারাপ কিনা? সাদা ডিম কি বাদামী ডিমের চেয়ে বেশি পুষ্টিকর?‘ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বললাম। দেখলাম, অনেকের ভেতরেই বিষয়গুলো নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা আছে। তাই সেগুলো ভাঙিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

আমার বক্তৃতা শেষে এক পিচ্চি ছাত্র জিজ্ঞেস করলো, ‘মুরগির জাত কেন ভিন্ন হয়?’ প্রশ্নের উৎপত্তি সাদা ডিম আর বাদামী ডিম নিয়ে আমার আলোচনা থেকে। সেখানে বলেছিলাম, ডিমের খোসার রঙের কারণে পুষ্টির হেরফের হয় না। ডিমের খোসার রঙ বিভিন্ন হয় মুরগির জাত বিভিন্ন হলে। আর ডিমের পুষ্টি নির্ভর করে মুর্গি কী ধরনের খাবার খাচ্ছে, তার উপর। তো, ছাত্রটির প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে অবধারিতভাবে চলে এলো বিবর্তনের প্রসঙ্গ। যথাসম্ভব সরল করে বলার চেষ্টা করলাম, মুরগিগুলো প্রথমে একইরকম ছিল। কিন্তু তাদের জিনে মিউটেশন বা পরিবর্তনের কারণে তারা ধীরে ধীরে বিভিন্ন রকম হয়ে গেছে। এজন্যেই এখন মুরগির মধ্যে এত ধরনের জাত!

মুরগির জাত কেন ভিন্ন, সেই প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি আমি

আমার পরে ঠিক হল স্কুলের স্টুডেন্টদের প্রজেক্টগুলো দেখানো হবে। ওরা তুমুল উত্তেজিত নিজেদের চিন্তাভাবনা প্রদর্শন করার জন্য। সে অনুযায়ী এক এক করে মঞ্চে আমন্ত্রণ জানানো হল মোট ৮টি দলকে। কেউ পরিচয় করিয়ে দিল ট্রাফিক জ্যামমুক্ত সবুজ নগরীর সাথে, কেউ তৈরি করেছে লোডশেডিং কমানোর বিকল্প উপায় (বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট), কেউ পরিকল্পনা করেছে বন্যার আগাম সংকেত কীভাবে পাওয়া যাবে সে বিষয়ে, কেউ কাজ করেছে কম খরচে প্রজেক্টর বানানোর উপায় নিয়ে। প্রতিটা দলের প্রজেক্ট ছিল প্রশংসা করার মত। ছেলেমেয়ে উভয়েরই অংশগ্রহণ ছিল প্রজেক্টে। মেয়েদের প্রজেক্ট দেখে মন ভরে গেলো। দেশ এখন আর ‘মেয়েরা বিজ্ঞান পড়তে আগ্রহী নয় / মেয়েরা বিজ্ঞান পারে না / মেয়েদের জন্য বিজ্ঞান নয়’ ধরনের ক্লিশে চিন্তাধারায় আটকে নেই।

ট্রাফিক জ্যামমুক্ত সবুজ নগরীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে একটি দল

বৃষ্টির পানি কীভাবে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যায়, সে প্রজেক্ট দেখাচ্ছে একটি দল

প্রদর্শনী চলার মাঝে অনীক ভাই ডেকে বললেন, চলো জাফর স্যারকে নিয়ে আসি। উনি এখন আসতে চাচ্ছেন। ঘড়িতে বাজে তখন দুপুর বারোটা। দুরুদুরু বুক নিয়ে আমি, অনীক ভাই আর সিলেটের বিজ্ঞানযাত্রী কাম সাস্টের ছাত্র উজ্জ্বল চললাম জাফর স্যারের অফিরের দিকে। উজ্জ্বল জাফর স্যারের সরাসরি ছাত্র, আর অনীক ভাই এর আগেও স্যারকে দেখেছেন। কিন্তু আমি এই প্রথম সামনাসামনি দেখবো আমার ছোটবেলার নায়ক সুহান, রাজু কিংবা প্রিয় খলনায়ক শ্যালক্স গ্রুন, কিংবা প্রিয় চরিত্র নিতুর স্রষ্টাকে। এই মানুষের লেখা পড়ে শৈশব, কৈশোর কাটিয়েছি। ত্রিশোর্ধ্ব বয়সে এসে উনার সাদাসিধে কথা পড়ছি। একজন মানুষের কিংবদন্তী হতে আর কী লাগে? জীবন্ত সেই কিংবদন্তীকে আমাদের বিজ্ঞানমেলায় নিয়ে আসার জন্য যাচ্ছি আমরা থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। কেমন যেন ঘোর লাগা অবস্থা!

স্যারের অফিসের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম। এত পুলিশ উনাকে ঘিরে থাকে, ভাবিনি। দরজার বাইরে চারজন পোশাকি পুলিশ এবং দুজন সাদা পোশাকের পুলিশ দাঁড়ানো। পুলিশদের হাতে বিশাল বিশাল সব অস্ত্র। আড়চোখে বারবার অস্ত্রগুলো দেখছিলাম। এর আগে শুধু সিনেমায়ই দেখেছি। স্যার ভেতরে ডাকলে তিনজন ঢুকলাম। ঢুকে আমি হাঁ করে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সাদা দাড়ি মোছ, পাকা চুল, আর চিকন স্বাস্থ্যের এই লোকটিই এত ক্ষমতাবান লেখক? শিশু সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল? বাংলাদেশের বিজ্ঞান জগতের এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত? এদেশে গণিত অলিম্পিয়াডের প্রবর্তক?

আমি কিছুই বলতে পারলাম না, যা বলার উজ্জ্বলই বলল। আমাদের মেলা সম্পর্কে সংক্ষেপে জানালো। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, স্কুলেই কেন মেলাটা আয়োজন করা হল না? উজ্জ্বল উত্তর দিলো, মেলা আয়োজন করার মত সুযোগ সুবিধা স্কুলে একটু কম। তাই মিনি অডিটোরিয়ামকে বেছে নেওয়া হয়েছে। স্যার যখন সিএসই বিল্ডিংয়ের বাইরে পা রাখলেন, তখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। আমরা ভেবেছিলাম, উনি গাড়িতে করে যাবেন। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে উনি বিশাল একটা লাল ছাতা মেলে ধরলেন মাথার উপর, তারপর হাঁটা শুরু করলেন। পুরোটা রাস্তা তিনি বাম হাতে ছাতা আর ডান কানে মোবাইল চেপে চললেন। উনার সামনে দুজন পুলিশ, পিছে বাকি পুলিশসহ আমরা ছোটখাট মিছিল বানিয়ে চললাম। একজন স্বাধীন লেখকের জন্য পুলিশি প্রহরায় দিনানিপাত করা কতটা কষ্টকর হতে পারে, ভাবা যায় না।

স্যার যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, সাস্টের ছাত্রছাত্রীরা উচ্ছ্বাস ভরে তাকাচ্ছিল। কেউ কেউ পিছন ফিরে দেখছিল বিস্মিত চোখে, স্যার যাচ্ছেন কোথায়? অনুভব করলাম, জাফর স্যার অধিকাংশ তরুণের কাছেই একটা ক্রেজের নাম। হোক সেটা তাঁর সাস্ট, হোক বাকি বাংলাদেশ। স্যার মিলনায়তনে পৌঁছালে আড়াইশো স্টুডেন্ট বিকট চিৎকার করে উঠলো। হাততালির বন্যা বয়ে গেলো পুরো হল জুড়ে। সেই বন্যা তিস্তার বাঁধ দিয়েও থামানো গেলো না। মোট কথা, স্যার যে অভিবাদনটা সব জায়গায় পান, সেটা মাত্র একবার পেতে পারাই হয়তো অনেকের সারাজীবনের স্বপ্ন! আর যে মানুষের জন্য সবার এত ভালোবাসা, সে মানুষটার পাশে দাঁড়িয়ে আমার গায়ের লোম হড়হড় করে দাঁড়িয়ে গেলো।

করতালির ভেতরেই স্যারকে নিয়ে বসালাম প্রধান শিক্ষকের সাথে। এরপর প্রিন্স মাইকে ঘোষণা দিয়ে দিয়ে হাততালি থামালেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, স্যারের সামনে এখন প্রজেক্ট প্রদর্শন করা হবে। এজন্য ডাকা হল তিনটা দলকে, যারা একটু আগেই প্রজেক্ট দেখিয়ে গেছে। প্রথম দলের বক্তা স্যারকে দেখে এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়লো যে, কিছুতেই বর্ণনা দিতে পারলো না। শেষে বিব্রত হয়ে বলল, ‘আপনাকে এই প্রথম এত কাছ থেকে দেখে আমি সব ভুলে গেছি, স্যার।’ আমরা হাসবো না হাসবো না করেও হেসে ফেললাম। নিজের হিরোকে সামনাসামনি দেখলে বুঝি এমনই অনুভূতি হয়! স্যারও হেসে দিলেন। পরের দুটো দল ভালোয় ভালোয় তাদের কাজ দেখাল। স্যারের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। প্রতিটা প্রজেক্ট তিনি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে দেখছিলেন।

কী মুগ্ধ হয়েই না জাফর স্যার দেখছেন প্রজেক্টগুলো!

আমাদের মধ্যে অনেকে আছে, যারা সাধারণ কিছু দেখলে অবাক হয় না, প্রশংসা করে না। বরং যে করেছে, তাকে তাচ্ছিল্য করে বলে, ‘এই জিনিস তো সবাই পারে! এটা একটা ব্যাপার হল?’ কিন্তু এখানেই সে মানুষগুলোর সাথে স্যারের পার্থক্য। স্যার দেখছেন, বাচ্চাকাচ্চারা কী আগ্রহ নিয়ে তাদের প্রজেক্টগুলো বানিয়েছে। তিনি বাচ্চাদের সমকক্ষ হয়ে বুঝছেন, তাদের ওইটুকু মস্তিষ্কের তুলনায় এই প্রজেক্টগুলো অনেক বড় অর্জন। হয়তো এই চিন্তাভাবনা আগেও কেউ করেছে, কিন্তু এরা যে আবার সেগুলো নিজেদের মত করে উপস্থাপন করছে, সেটা খুব প্রশংসনীয়। এজন্য তাদের বাহবা প্রাপ্য।

প্রজেক্ট দেখানো শেষ হলে সকলের উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্য স্যারকে মঞ্চে আহ্বান করা হল। প্রিন্সের অত্যন্ত পছন্দের মানুষ জাফর স্যার। উনাকে আমন্ত্রণ জানানোর ব্যাপারে তার অনুভূতি, ‘সিলেটে স্যারের ক্যাম্পাসে গিয়ে স্যারের মতো তুখোড় বক্তার পাশে মঞ্চে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান উপস্থাপনার দুঃসাহস কীভাবে দেখিয়েছিলাম, এখন সুস্থ মস্তিষ্কে আর বুঝতে পারছি না। হয়তো তখন আমি ঘুমে ছিলাম, আমার হিসাব ছিলো না।’ প্রিন্সের হিসেব না থাকলেও আলোকচিত্রী সুদীপ্ত রায়ের ছিলো। তিনি সময়মতো ক্যামেরায় ক্লিক করে প্রিন্সের জীবনের সবচেয়ে দামী মুহূর্তগুলোর একটা ধরে রেখেছিলেন।

রিজওয়ানুর রহমান প্রিন্স ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবালকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন সকলের উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্য

জাফর স্যার বক্তৃতা শুরু করার পর বুঝলাম, মানুষ কেন উনার কথা মোহিত হয়ে শুনে। সবাইকে এত আপন করে নিয়ে উনি কথা বলেন যে, মুহূর্তে আমরা উনার ভীষণ কাছের মানুষ হয়ে যাই। আর কাছের মানুষের কথা তো আমরা মনোযোগ দিয়েই শুনি, তাই না? স্যার বললেন, ছাত্রছাত্রীদের গোল গোল কৌতূহলী চোখ দেখলে তার শরীরের ব্যাটারি চার্জ হয়ে যায়। তাহলে আমরা যখন আমাদের মেলার প্রতি স্যারের গোল গোল কৌতূহলী চোখের দৃষ্টি দেখছিলাম, আমাদের ব্যাটারি ওভারচার্জ হয়ে ফাটার উপক্রম হয়েছিলো কিনা, বলুন?

কথায় কথায় স্যার বললেন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলটা উনার আর ইয়াসমিন হক ম্যাডামের হাতে গড়া। তাহলে কেন স্কুলের ছেলেমেয়েরা তাঁকে দেখে নার্ভাস হয়ে যাবে? তারা তো ইচ্ছে করলেই একশো হাত দূরে স্যারের অফিসে এসে দেখা করতে পারে! অটোগ্রাফ নেওয়ার ইচ্ছে হলে, কোনোকিছু শেয়ার করার প্রয়োজন মনে করলে, বিজ্ঞানের কথা শুনতে চাইলে যখন খুশি তখন হানা দিতে পারে স্যারের রুমে। শুনে এমন হিংসে হচ্ছিলো যে, কী আর বলবো! এরপর স্যার বললেন তার প্রিয় বিজ্ঞানী এলবার্ট আইন্সটাইনের গল্প, যেখানে এই মহান বিজ্ঞানী পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ফোন করে নিজের বাসার ঠিকানা জানতে চেয়েছিলেন। তিনি অপ্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে মাথা ভর্তি করতে চাইতেন না বলে বাসার ঠিকানা কিংবা কারো ফোন নাম্বার মুখস্ত রাখতেন না। পুরো মাথাই তিনি খাটাতেন বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা করার জন্য। আমাদেরকেও স্যার মুখস্ত না করে, মাথা খাটিয়ে সব বিষয় বুঝার জন্য আহ্বান করলেন। মুখস্ত করলে দু’ঘণ্টা বাদেই সব ভুলে যাবো। কিন্তু বুঝলে সেটা আজীবন মন থাকবে। হয়ত এই চিন্তা থেকেই তিনি সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করতে চেয়েছিলেন! কিন্তু আমরা এই পদ্ধতির জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে পারিনি বলে পদ্ধতিটা তার সুফল দেখাতে পারেনি।

স্যারের বাম পাশে আমার তৈরি করা পোস্টারের ছবি দেখে দারুণ মজা পেয়েছি। ফটোগ্রাফারকে ধন্যবাদ!

স্যার জোর দিলেন কল্পনা করার প্রতি, কারণ আইনস্টাইন বলেছেন, “জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা শক্তি বড়”। এই কল্পনা শক্তি কীভাবে বাড়ানো যায় সে উপায়ও জাফর ইকবাল বাৎলে দিলেন – গল্পের বই পড়ে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের তিনি অনুরোধ করলেন যেন তারা তাদের বাবা-মাকে গিয়ে বুঝায়, আউট বই পড়া মোটেই খারাপ কাজ নয়। আউট বই পড়ার জন্য যেন তাদের বকাঝকা না করা হয়। জাফর স্যারের বক্তৃতার পুরো ভিডিওটি দেখতে পারেন এখান থেকে

বক্তৃতা শেষ করে স্যার মঞ্চ থেকে নামলেন। কিছু জরুরি মিটিং থাকার দরুন চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন। কিন্তু স্যার দরজার দিকে এগুতেই হুড়মুড় করে ছাত্রছাত্রীর ঢল নেমে এলো তাঁর চারপাশে। সবাই স্যারের সাথে সেলফি আর ছবি তুলতে চায়। অবশ্য ততক্ষণে পৌনে একটা বেজে গেছে। দুপুরের খাবারের বিরতি দেওয়ার সময় চলে এসেছে। তাই মাইকে ঘোষণা দিয়ে দিলাম, লাঞ্চ শেষে দেড়টার দিকে আবারও যেন আগ্রহী দর্শকেরা চলে আসে অডিটোরিয়ামে। তখন তাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মজার সব ভিডিও, সাথে ব্যাখ্যা করা হবে দেওয়ালে টাঙানো সব পোস্টার।

ফিরে আসি চট্টলা দলের গল্পে। ৯ জন বেচারা দুপুর একটার দিকেও ট্রেনের ভেতর বসে আছে। তাদের কাছে থাকা প্রজেক্টরের আশা বাদ দিয়ে আমাদের বিকল্প চিন্তা করতে হল। ডঃ ইয়াসমিন হকের ফিজিক্স অনুষদ থেকে নিয়ে এসেছিলাম প্রজেক্টরের স্ক্রিন। এখন বাইরে থেকে ভাড়া করে আনলাম ছোট্ট একটা প্রজেক্টর। আমাদের প্রজেক্টরের মত সুন্দর প্রেজেন্টেশন না হলেও অন্তত ভিডিওগুলো দেখানোর মত ব্যবস্থা করা গেলো। এদিকে পাক্কা ১৬ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে দুইটার দিকে চাঁটগাঁবাসী ফোন দিয়ে জানালো, তারা ট্রেন স্টেশনে পা রেখেছে। এখন সিএনজিতে করে ছুটে আসছে সাস্টের দিকে, ঠিক যেভাবে আজ ভোরে ফ্যাল্কন নাইনে চড়ে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট ছুটে চলেছিল মহাশূন্যের দিকে।

মজার ব্যাপার হল, ৮ মে ছিল আমাদের অন্যতম সংগঠক সাজেদুল ওয়াহিদ নিটোলের জন্মদিন। চট্টলা পার্টি ট্রেনের ভেতরে রাত বারোটার দিকে ধুমিয়ে পালন করে ফেললো উৎসবটা। আমরা ঢাকা পার্টি তখন বাসের ভেতর ঘুমানোর চেষ্টায় ব্যস্ত, আর ফেসবুকে কেকের ছবি দেখে আফসোস করায় মত্ত। কে জানে, আমাদের আফসোসের কারণেই কি না, চট্টলাবাসী বাড়তি ৬ ঘণ্টার শাস্তি পেলো (সার্কাজম এলার্ট)! প্রথম দুই ঘণ্টা বেশ ধৈর্য ধরে বসে রইলো দলটা। ঠাট্টা মশকরা করে সময় কাটাতে লাগলো। কিন্তু যতই সময় যেতে লাগলো, ততই আশংকা চেপে ধরলো সবাইকে। আবার থেমে থাকা ট্রেনে মানুষের হাঁটাহাঁটি, টয়লেট করাকরি মিলিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। গন্ধে টেকা দায়। রকি চৌধুরী স্বভাবসুলভ রসিকতা করে বললেন, ‘বাইরে চলছে বজ্রপাত, ভিতরে বর্জ্যপাত।’

অবশেষে আড়াইটার দিকে অডিটোরিয়ামে এলেন চট্টগ্রামের বিজ্ঞানযাত্রীরা। একেকজনের মুখ ভচকানো, শরীর অবসন্ন অথচ আগ্রহের কমতি নেই! এসেই অনুষ্ঠান সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিলেন। এদিকে দুপুরের বিরতির পর শুরু হয়েছে পোস্টার প্রদর্শনী। মঞ্চের দেওয়ালে ঝুলানো পোস্টারের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দেখে ভালো লাগলো। একেকটা পোস্টারের সামনে একেকজন বিজ্ঞানযাত্রী দাঁড়িয়ে আছেন, আর কেউ বুঝতে চাইলে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিচ্ছেন পুরো চিত্রটা। মোট ১৩ টা পোস্টার ছিল মেলায়ঃ

★ পানি চক্র
★ সূর্য গ্রহণ কীভাবে হয়?
★ সাদা মানে কী রঙহীন? আসলে সাদাতেই আছে সবচেয়ে বেশি রঙ
★ দিন রাত্রি কীভাবে হয়?
★ ভেতরে নয়, বাইরে থাকি! কেমন করে ঝুলছি দেখি!
★ ঋতু পরিবর্তন কীভাবে হয়?
★ মহাজাগতিক বর্ষপঞ্জি
★ বিশাল সব নক্ষত্রের ভিড়ে কত ক্ষুদ্র আমরা!
★ গ্রীনহাউস প্রতিক্রিয়া
★ সবার চোখেই আছে অন্ধবিন্দু, আসুন পরীক্ষা করি
★ বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে?
★ করিওলিস প্রভাব, পৃথিবী যে গোল এবং এটা যে ঘুরছে, তার অন্যতম প্রমাণ
★ খাবারের রঙ, রঙের খাবার

“সাদা মানে কী রঙহীন? আসলে সাদাতেই আছে সবচেয়ে বেশি রঙ” পোস্টারের সামনে তুষার রঞ্জন মিত্র

“করিওলিস প্রভাব, পৃথিবী যে গোল এবং এটা যে ঘুরছে, তার অন্যতম প্রমাণ” বুঝিয়ে দিচ্ছেন অর্ণব অন্তর

 

মহাজাগতিক বর্ষপুঞ্জি বুঝাচ্ছেন মইনুল হক

পানি চক্র ব্যাখ্যা করছেন নিলয় বড়ুয়া

বিশাল সব নক্ষত্রের ভিড়ে কত ক্ষুদ্র আমরা! – বিশ্লেষণে সুশান্ত বিশ্বাস

পোস্টার প্রদর্শনী শেষে দুপুর দুইটার দিকে ফরহাদ হোসেন মাসুমের ধারণকৃত ভিডিওটা দেখানো হল। সুদূর আমেরিকা থেকে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে তৈরি করা ভিডিওটিতে ফরহাদ খুব সহজ ভাষায় “বিজ্ঞান কেন? প্রশ্ন করা দরকার কেন? কেন কৌতূহলী হওয়া প্রয়োজন?” ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেন। সবার ভেতরেই যে একজন বিজ্ঞানী বাস করে, সেটাও তিনি মনে করিয়ে দিলেন। কীভাবে সেই বিজ্ঞানমনস্কতাকে লালন করতে হবে, ধরে রাখতে হবে, সেটাই ছিল ফরহাদের মূল কথা।

এরপর ফরহাদেরই অনুবাদ করা আর কণ্ঠ দেওয়া ভিডিও ‘মলিন নীল বিন্দু (Pale Blue Dot)‘ দেখানো হল। কার্ল সেগানের মূল ভিডিও থেকে ডাবিং করে বাংলা ভিডিওটা তৈরি করা হয়েছে। দর্শকেরা বেশ আগ্রহ নিয়ে নীল রঙের ছোট একটা গ্রহ আর তার সম্পর্কে কিছু কথা শুনল। কীভাবে আমরা পৃথিবীকে আমাদের অজ্ঞানতা দিয়ে ধ্বংস করে চলেছি, কীভাবে এখন অব্দি পাওয়া একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহকে নষ্ট করে চলেছি, মারমারি-কাটাকাটি করে স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছি…। অথচ এই পৃথিবীতেই আছে আমাদের আপনজনেরা, আছে মানুষসহ সকল প্রাণের বসতি। আমরা কি পারি না, ছোট্ট এই নীল বিন্দুকে ভালোবেসে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলতে? হানাহানি বন্ধ করে একে অন্যের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে?

১০ মিনিটের ভিডিওটি শেষ হলে অনীক ভাই এলেন ‘মহাকাশ যাত্রা’ নিয়ে তার প্রেজেন্টেশন দিতে। ভীষণ চমকপ্রদ ছিল এই ভিডিও লেকচারটা। ভাইয়া যখন শুধালেন, ‘মহাকাশে পাঠানো সর্বপ্রথম প্রাণীর নাম কী?’, তখন সবার সাথে আমিও বলেছিলাম, লাইকা নামের কুকুর। কিন্তু নাহ, উত্তরটি সঠিক নয়। সঠিক উত্তর হল, মাছি! ফ্রুট ফ্লাই। এরকম আরও অনেক মজার তথ্য দিয়ে সাজানো ছিল পুরো লেকচার। যেমন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যখন স্নায়ুযুদ্ধ চলছে, তখন ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত দুটো দেশই পরস্পরকে টেক্কা দেওয়ার জন্য পরপর অনেকগুলো (আমেরিকা ৩০ টা, সোভিয়েত ৮ টা) স্যাটেলাইট আর স্পেস প্রোব পাঠিয়েছিল। তবে মহাশূন্য জয়ের ক্ষেত্রে আমেরিকা এগিয়ে যায় ১৯৬৯ সালে চাঁদে মানুষ পাঠানোর মাধ্যমে।

মহাকাশ যাত্রার বয়ানে অনীক আন্দালিব

এরপর চট্টগ্রাম থেকে আসা প্রজেক্টরটা সেট করা হল। নতুন প্রজেক্টর উদ্বোধন করলেন সৌরেন সেন তার ‘মহাজাগতিক ঠিকানা’ উপস্থাপনের মাধ্যমে। ছবির মাধ্যমে তিনি দেখালেন, আমরা এই মহাবিশ্বের ঠিক কোথায় আছি। আমাদের বাস আকাশগঙ্গা (মিল্কিওয়ে) নামক ছায়াপথে (গ্যালাক্সি)। একটা ছায়াপথের ভেতর অসংখ্য সৌরজগৎ পাওয়া যায়। অর্থাৎ সূর্য নামক নক্ষত্রকে ঘিরে যেমন পৃথিবীসহ আটটা গ্রহ ঘুরছে, সেরকম অন্যান্য সৌর বা সূর্যকে ঘিরেও অন্যান্য গ্রহ ঘুরছে। আবার এই ধরনের অসংখ্য ছায়াপথ মিলে তৈরি করে এক একটা ক্লাস্টার। অনেকগুলো ক্লাস্টার মিলে তৈরি হয় বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড। আমাদের চোখে এখন পর্যন্ত ব্রহ্মাণ্ডের যে অংশটুকু ধরা পড়েছে, তাকে আমরা বলি পর্যবেক্ষণযোগ্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডের অনেক অংশই এখনো আমাদের দেখার বাইরে রয়ে গেছে। তাই আসলে অনুমানও করা যায় না, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড কতো বড়! তার উপর এটা শুধু সম্প্রসারিতই হচ্ছে, অর্থাৎ ছড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে আমরা কখনোই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড দেখতে পারবো না।

এরপর সিলেট কাম ঢাকা বিজ্ঞানযাত্রার সদস্য শোভন রেজা এলেন ‘নেকড়ে থেকে কুকুর’ শীর্ষক আলোচনা নিয়ে। পৃথিবীতে প্রায় ৭০০ ধরনের কুকুর আছে। প্রত্যেকের আকার-আকৃতি, আচরণ-অভ্যাস, শক্তিমত্তা ভিন্ন। বলা হয় এরা নাকি নেকড়ে থেকে এসেছে। কীভাবে আসলো? সে গল্প আর তার প্রমাণ নিয়ে ছিল এই উপস্থাপনা।

এরপর কৌশিক রায় এলেন ‘ভূমিকম্প কথন’ নিয়ে। ঘড়িতে তখন বাজে বিকেল চারটা। আমাদের পরিকল্পনা ছিল জাফর স্যার এবং জিতেন্দ্র স্যারকে একটা করে স্মারক দেওয়ার। তাই একটা দলকে অডিটোরিয়ামে প্রেজেন্টেশন সামলানোর দায়িত্ব দিয়ে আরেকটা দল চলে গেলাম জাফর স্যারের অফিসে। একটু পর স্যার বেরিয়ে গেলে উনাকে পাওয়া যাবে না। তাই তড়িঘড়ি করেই স্মারকটা দেওয়ার জন্য ছুটলাম। কিন্তু স্যার তখন মিটিং করছেন অন্য আরেক জায়গায়।  আমরা সিএসই ডিপার্টমেন্টে স্যারের রুমের বাইরে ওঁত পেতে রইলাম। স্যার মিটিং শেষ করে বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ ফিরে এলেন তাঁর চেম্বারে। দেখেই বুঝা যায় ক্লান্ত-বিধ্বস্ত। তারপরও উনাকে আরেকটু অত্যাচারের আশায় ঘিরে ধরে ফেললাম আমরা সবাই। অনুরোধ করলাম, আমাদের হাত থেকে একটা সম্মাননাসূচক ক্রেস্ট নিয়ে আমাদের জীবনটাকে ধন্য করে দিতে হবে।

মানুষটা যতোই ক্লান্ত থাকুক, কখনো না করেন না উনার ভক্তদের এসব পাগলামীতে। অন্যান্য বিখ্যাতদের থেকে এখানেই উনি আলাদা। লাজুক লাজুক হাসি দিয়ে চশমার উপর দিয়ে তাকালেন আমার দিকে। বললেন, কোথায় দেবে? এখানেই দাঁড়িয়ে নিয়ে নেবো?
“অবশ্যই না, স্যার। আপনার চেম্বারে চলুন প্লিজ!”
“ঠিক আছে চলো”, বলে এগোলেন উনার চেম্বারের দিকে। তালা খুলে ঢুকলেন। পিছনে সুড়সুড় করে ঢুকে পড়লাম আমরা সবাই। ক্রেস্ট প্রদান পর্ব শেষ করে জীবনটাকে আগের চেয়ে অনেক বেশি অর্থবহ মনে হতে লাগলো। উনার সাথে খাজুরে আলাপ শুরু করে দিলাম। আমাদের ‘বিজ্ঞানযাত্রা’ সংগঠনের ইতিহাস-পাতিহাঁস শোনানো শুরু করলাম। উনি ধৈর্য ধরে শুনলেন।

মুহম্মদ জাফর ইকবালের হাতে ক্রেস্ট তুলে দিচ্ছি আমরা কয়েকজন

বিদায় নিলাম “স্যার ভালো থাকবেন, সাবধানে থাকবেন” বলে। উনি নিচের দিকে তাকিয়ে আপন মনেই বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, একটু বেশিই সতর্ক থাকা হচ্ছে!” উনার কণ্ঠস্বরে এমন বিরক্তি ছিল যে খারাপ লাগলো আমাদের। উনি যেখানেই যান, পুলিশও সেখানে যায়। এমন প্রোটোকলে স্যার রীতিমতো বিরক্ত, বুঝাই যাচ্ছে। নিজের কোনো স্বাধীনতা নেই। কিন্তু উনি মুখ বুজে সয়ে নিচ্ছেন ব্যাপারটা। উনার নিজেকে নিয়ে কোনো টেনশন নেই। কিন্তু উনার প্রিয়জন আর পাগল ভক্তদের জ্বালায় এই বিড়ম্বনাটুকু মাথা পেতে নিচ্ছেন।

প্রিন্স উনাকে একপ্রকার অনুনয় করেই বললেন, “স্যার, আমরা জানি, আপনার নিজেকে নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু আমাদের জন্যে হলেও নিজের দিকে একটু খেয়াল রাখবেন প্লিজ! আরেকটু সতর্ক থাকবেন।” উনি সায় দিয়ে মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন।

আমরা ফিরে এলাম অডিটোরিয়ামে। ইতোমধ্যে এখানেও স্মারক প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা হয়ে গেছে। আমরা যখন স্যারের কাছে, তখন এখানে নিলয় বড়ুয়া স্মারক তুলে দিচ্ছেন জনাব আবুল কালাম আজাদের হাতে। উনি উজ্জ্বলের আব্বু এবং আমাদের কাছ থেকে বিশেষ ধন্যবাদ পাওয়ার দাবীদার। অডিটোরিয়াম বুকিং, বিজ্ঞানমেলা করার অনুমতি, এমনকি জাফর স্যারের বক্তৃতা দেওয়ার শিডিউল –  সব উনি ম্যানেজ করেছেন। ঐ সময় জিতেন্দ্র স্যারকে পাওয়া যায়নি বলে জনাব আজাদের হাতেই আমরা স্যারের জন্য নিয়ে আসা সম্মাননাসূচক স্মারক তুলে দিলাম। 

জনাব আবুল কালাম আজাদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দিচ্ছেন নিলয় বড়ুয়া। ছবির ডানে দাঁড়ানো এসএ খান, বামে শোভন রেজা

অবশ্য এই আনুষ্ঠানিকতার আগেই ছাত্রছাত্রীদের বিদায় জানানো হয়ে গেছে। বিকেল পাঁচটার দিকে, নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আমরা বিজ্ঞানমেলার সমাপ্তি ঘোষণা করি। যারা প্রজেক্ট জমা দিয়েছিলো, তাদের মধ্য থেকে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থান নির্ধারণ করে পুরষ্কার পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও নেওয়া হল। আর শেষ পর্যন্ত যারা ছিল, তারা একটা করে কলম স্মারক হিসেবে পেলো।

বলবো না, আমরা ১০০% পারফেক্ট মেলা করেছি। কিন্তু আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি বিজ্ঞানকে আনন্দময় করে উপস্থাপন করার জন্য। আমাদের আয়োজনে খামতি ছিল, আর সেখান থেকে আমরা শিখেছি। পরবর্তী বিজ্ঞানমেলাগুলো যেন আরও সুন্দর, আরও আকর্ষণীয় হয়, সে চেষ্টাই বলবত থাকবে। আপাতত এখানেই শেষ করছি, সবাইকে ধন্যবাদ বিশাল এই লেখা পড়ার জন্য! ওহ আচ্ছা, শেষ করার আগে সঞ্চালক প্রিন্স সাহেবকে ধন্যবাদ না দিলে অকৃতজ্ঞতা হবে। তিনি যেভাবে পুরো অনুষ্ঠানকে টেনে নিয়ে গেছেন, আকর্ষণীয় কথাবার্তার মাধ্যমে দর্শককে মনোযোগী করে রেখেছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে দিন শেষে উনার গলা দিয়ে চিঁচিঁ আওয়াজ ছাড়া কিছু বের হচ্ছিলো না… এটাই যা সমস্যা।

বিজ্ঞানযাত্রার পক্ষ থেকে সফলভাবে আরেকটা বিজ্ঞানমেলা শেষ করার পর আয়োজকবৃন্দ

বিজ্ঞানমেলার কিছু ছবি

দুপুরের বিরতিতে অলস যাত্রীদের একাংশ

প্রশ্ন করার জন্য হাত তোলায় ব্যস্ত কয়েকজন শিক্ষার্থী

নীলে নীলাচ্ছন্ন সাস্টের মিনি অডিটোরিয়াম

দলের সর্বজ্যোষ্ঠ দুজন বিজ্ঞানযাত্রী এবং সর্বকনিষ্ঠ বিজ্ঞানযাত্রীর সাথে জাফর স্যার

নিটোলের জন্মদিনের কেক কাটা হচ্ছে ট্রেনের ভিতর

এক ফাঁকে শোভন রেজা সংগ্রহ করে ফেললো স্যারের অটোগ্রাফ

মেলা শেষে বিকেলের দিকে বড় অডিটোরিয়ামের সিঁড়িতে বসে আড্ডা চলছে। কিন্তু চায়ের তৃষ্ণায় মুখ শুকিয়ে গেছে সৌরেন সেন (বামে) আর রকি চৌধুরীর (ডানে)।

“খাবারের রঙ লাল, হলুদ, কমলা, সবুজ, নীল, বেগুনী কেন হয়?” বুঝিয়ে দিচ্ছি আমি

বিঃ দ্রঃ আপনাদের সবার জন্য ‘বিষম চিন্তা’ ছড়াটা দিলাম। মিলিয়ে দেখুন তো, এমন কখনো ঘটেছে কিনা!

বিষম চিন্তা – সুকুমার রায়

মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার –
সবাই বলে, ”মিথ্যে বাজে বকিসনে আর খবরদার!”
অমন ধারা ধমক দিলে কেমন করে শিখব সব?
বলবে সবাই ”মুখ্য ছেলে”, বলবে আমায় ”গো গর্দভ!”
কেউ কি জানে দিনের বেলায় কোথায় পালায় ঘুমের ঘোর?
বর্ষা হলেই ব্যাঙের গলায় কোত্থেকে হয় এমন জোর?
গাধার কেন শিং থাকে না, হাতির কেন পালক নেই?
গরম তেলে ফোড়ন দিলে লাফায় কেন তা ধেই ধেই/
সোডার বোতল খুললে কেন ফসফসিয়ে রাগ করে?
কেমন করে রাখবে টিকি মাথার যাদের টাক পড়ে?
ভূত যদি না থাকবে তবে কোত্থেকে হয় ভূতের ভয়?
মাথায় যাদের গোল বেঁধেছে তাদের কেন ”পাগোল” কয়?
কতই ভাবি এসব কথার জবাব দেবার মানুষ কই?
বয়স হলে কেতাব খুলে জানতে পাব সমস্তই।

Comments

আপনার আরো পছন্দ হতে পারে...

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
জানান আমাকে যখন আসবে -
guest
1 Comment
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
ফরহাদ হোসেন মাসুম
এডমিন
6 বছর পূর্বে

দারুণ হয়েছে। সবকিছু ডিটেইলসে ছবিসহ জানানোতে মনে হচ্ছিলো যেন ঐখানেই ছিলাম।

1
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x