দেখতে দেখতে শুরু হয়ে গেল নতুন বছর, আর তাই আজ আমরা একটু পেছন ফিরে দেখবো। শুধু ২০১৭ সালেই বিজ্ঞানের জগত সমৃদ্ধ হয়েছে নিত্যনতুন আবিষ্কারে আর উদ্ভাবনে। দেশ-বিদেশের নানান স্তরের বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় অভাবনীয় সব কীর্তি নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
ছোট এই পৃথিবী গ্রহে থেকেও অসংখ্য মহাকাশবিজ্ঞানী খুঁজে চলেছেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্যের উত্তর। গত বছরের ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে তেমনই এক অনুসন্ধানে খোঁজ মিললো ট্র্যাপিস্ট-১ নামের এক নক্ষত্রের। এটি আকারে আমাদের সৌরজগতের বৃহস্পতি গ্রহের সমান কিন্তু প্রায় একশগুণ ভারি একটি অতিশীতল লাল বামন নক্ষত্র। অবস্থান সৌরজগত থেকে প্রায় চল্লিশ আলোকবর্ষ দূরে। কী তার বৈশিষ্ট্য? এই নক্ষত্রকে ঘিরে খুব কাছাকাছি কক্ষপথে ঘুরছে সাতটি গ্রহ, যেগুলো আকারে প্রায় পৃথিবীর মতই। সৌরজগতে পৃথিবী সূর্য থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে থাকায় তাতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে। দেখা গেছে, যে কোন নক্ষত্রের কাছাকাছি গ্রহ যদি এমন দূরত্বে থাকে, তাহলে সেখানে প্রাণীরা টিকে থাকতে পারে। আমাদের ভবিষ্যত বংশধরেরা পৃথিবী ছেড়ে যখন মহাশূন্যে বসতির জন্য পাড়ি জমাবে, তখন ট্র্যাপিস্ট-১-এর গ্রহগুলোর মতই কোন গ্রহ খুঁজে নিবে। এখন বিজ্ঞানীরা তাই জোরেশোরে গবেষণা করছেন এমন সব গ্রহকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন তাদের মাঝে কোনটা আমাদের বসবাসের যোগ্য হবে। [1]
এর পাশাপাশি চলছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের গবেষণাও। আমেরিকার নভোগবেষণাকেন্দ্র লাইগোতে (LIGO) ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কারের পর থেকে গত দুই বছরে এমন আরো চারটি ঘটনা বিজ্ঞানীরা শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। দুটো প্রচণ্ড শক্তিশালী কৃষ্ণগহ্বর ঘুরতে ঘুরতে সংঘর্ষ ঘটলে তা থেকে প্রায় দুইশ কোটি সূর্যের সমান শক্তি নির্গত হয়েছিল। সেই শক্তিই মহাবিশ্বের স্থান-কালের ভেতর দিয়ে তরঙ্গের আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। পঞ্চম ও শেষ ঘটনাটি ঘটলো ২০১৭ সালের ১৭ আগস্টে। এবারের বিশেষত্ব হলো সংঘর্ষ ঘটেছে দুটো নিউট্রন নক্ষত্রের ভেতরে। প্রায় তেরো কোটি আলোকবর্ষ দূরের এই দুই নক্ষত্র শত কোটি বছর ধরে একে অপরকে ঘিরে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে একে অপরের উপর আছড়ে পড়েছে। সেই অতীতের সংঘর্ষের ফলে যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিলো, তা আমাদের পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে এই তো সেদিন। আমেরিকার লাইগো কেন্দ্রের পাশাপাশি ইউরোপের ভারগো (VIRGO) নভোগবেষণাকেন্দ্রও একই সময়ে এই তরঙ্গের উপস্থিতি ধরতে পেরেছিল। নিউট্রন তারকার এই সংঘর্ষে প্রচুর পরিমাণে অবলোহিত এবং অতিবেগুনী রশ্মির পাশাপাশি দৃশ্যমান আলোও বিচ্ছুরিত হয়েছিল। রঙবেরঙের এই আলোকরশ্মি এসেছে এই দুটো তারার ভেতরে বিস্ফোরিত ভারী মৌল থেকে। লোহা, সোনা, তামা, প্লাটিনাম, ইউরেনিয়ামের মতো ভারী ভারী ধাতুগুলো এভাবেই মহাবিশ্বে সৃষ্টি হয়েছিল। আর সেসব ধাতুই জমাট বেঁধে আরো লক্ষ লক্ষ বছর পরে গ্রহ সৃষ্টি করে। আমাদের পৃথিবীর কেন্দ্রেও এমন ধাতব মৌলগুলি জমা আছে। অর্থাৎ আমাদের গ্রহ এবং সৌরজগতের সৃষ্টির পেছনেও এমনই কোন নিউট্রন তারার ধ্বংসের ইতিহাস লুকিয়ে আছে। [2]
লাইগোর অর্জন এখানেই শেষ হয়নি। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে এই কেন্দ্রেরই তিনজন বিজ্ঞানীকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হলো। এই বিজ্ঞানীরা হলেন ব্যারি ব্যারিশ, কিপ থর্ন, এবং রাইনার ওয়েইস। তিনজনই নিজ নিজ গবেষণার জন্যে বিখ্যাত। লাইগোর মাধ্যমে প্রথম মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্তের কৃতিত্বস্বরূপ তাদেরকে এই নোবেল পুরষ্কার দেয়া হলো। [3]
২০১৭ এর ফেব্রুয়ারিতে ভারত ১০৪টা ছোটো উপগ্রহ পাঠিয়েছে মহাশুন্যে। একসাথে এতগুলো উপগ্রহ পাঠানোর ঘটনা এর আগে আর ঘটেনি। এর আগের রেকর্ড ছিলো রাশিয়ার, মাত্র ৩৭টা উপগ্রহ পাঠিয়েছিলো ওরা। [4]
আমাদের সৌরজগত কিন্তু গ্রহগুলো আর প্লুটোর সীমানাতেই শেষ হয়ে যায় না। এর বাইরে আরো বিশাল জায়গা আছে, যে জায়গাটা একটা মেঘ দিয়ে ঘেরা, যাকে আমরা ওর্ট ক্লাউড বলে থাকি। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে প্রথমবারের মত, সেই ওর্ট মেঘের বাইরে থেকে, অর্থাৎ গভীর মহাশূন্য থেকে কোনো বস্তু এসে আমাদের সৌরজগতে ঢুকে পড়েছে। নাসা এটাকে প্রথম আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এটার নাম দেয়া হয়েছে A/2017 U1. এটার দৈর্ঘ্য ৪০০ মিটারের মত আর গতি সেকেন্ডে ২৫ কিলোমিটার প্রায়। [5]
একদিকে বিজ্ঞানীরা যেমন মহাশূন্যের বুকে এমন নতুন নতুন ঘটনা আবিষ্কার করছে, তেমনি পৃথিবীর বুকেও তাদের গবেষণা থেমে নেই। ইউরোপে অবস্থিত ভূগর্ভস্থ লার্জ হেড্রন কোলাইডারে (LHC) তীব্রগতিতে পারমাণবিক কণাকে আঘাত করে পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। সেসব সংঘর্ষ থেকেও চমৎকার সব নতুন কণা বা ঘটনার উদ্ভব ঘটে। যেমন গত বছরেই তারা এভাবে আবিষ্কার করেছে পাঁচটি নতুন কণিকাকে। অণু-পরমাণুর চেয়েও অতিক্ষুদ্র এই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জগতেও আরেক মহাবিশ্বের রহস্য লুকিয়ে আছে। এখানে চলে অন্য নিয়ম, অন্য ঘটনা।
যেমন ফোটন মাঝে কণার মত আচরণ করে, আবার মাঝে মাঝে তরঙ্গের মত। ফোটনের বা আলোর এই কণা-তরঙ্গ দ্বৈততার কথা তো সবাই জানেন নিশ্চয়ই। কিন্তু এটার রঙ নিয়ে কোনো বিতর্ক ছিলো না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা একটা ফোটন তৈরি করেছেন যেটার মধ্যে কোনো সন্দেহ ছাড়াই দুটো রঙ আছে, অর্থাৎ দুটো তরঙ্গদৈর্ঘ্য আছে। চমৎকার, তাই না? [6]
আজকাল স্মার্টফোনের কল্যাণে ভিডিও কলের সাথে তো সবাই পরিচিত আছেন। গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বরে চীন এবং অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞান একাডেমির বিজ্ঞানীরা তেমনই এক ভিডিও কল করলেন একে অপরকে। তবে এই ভিডিও কলটি করা হলো কোয়ান্টাম প্রযুক্তি ব্যবহার করে। কোয়ান্টাম জগতের অনিশ্চয়তার কারণে তথ্যগুলো পুরোপুরি সংরক্ষিত অবস্থায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছিল। অর্থাৎ বাইরে থেকে কেউ যতই চেষ্টা করুক না কেন, এই কলের তথ্য চুরি করতে পারবে না। এমন নিরাপদ যোগাযোগই হবে ভবিষ্যতের মামুলি ব্যাপার, যার প্রথম সফলতা এই বিজ্ঞানীদের প্রাপ্য। [7]
কোয়ান্টামের কথা যখন এলোই, তাহলে একটু কম্পিউটারের বিজ্ঞানের গবেষণার দিকে এবার চোখ ফেরানো যাক। বলছি কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর কথা। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে একটি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন ইন্টেলের গর্ডন মুর। তিনি বলেছিলেন একটি নির্দিষ্ট আয়তনের সিলিকন চিপে প্রতি ১৮মাস পর পর ট্রানসিস্টরের সংখ্যা দ্বিগুন হবে।তার কথাটাই একটু অন্যভাবে বললে বলা যায় প্রতি ১৮মাস পর পর কম্পিউটার চিপের কার্যক্ষমতা দ্বিগুণ হবে। এটা মুর’স ল নামে পরিচিত। পার্সোনাল কম্পিউটার বিপ্লবের পেছনে এই মুর’স ল এর ভূমিকা অপরিসীম। এর মাধ্যমেই কম্পিউটার চিপের আয়তন কমে এসেছে। হাতের মুঠোয় জায়গা করে নিয়েছে শক্তিশালী কম্পিউটিং ডিভাইস। কিন্তু প্রশ্ন আসতে পারে এইভাবে কার্যক্ষমতা কি দ্বিগুন হতেই থাকবে? উত্তর হচ্ছে না। কারণ পদার্থবিজ্ঞান অনুযায়ী এভাবে যদি ট্রানসিস্টরের সংখ্যা বাড়তে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে এমন একটা সময় আসবে যখন ট্রানসিস্টরের আয়তনকে হতে হবে পরমাণুর সমান। যা কিনা অসম্ভব। ২০১৭-তে আমরা সেই অসম্ভবের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। ধারণা করা হচ্ছে এই বছরই সিলিকন চিপের বিদায় ঘণ্টা বাজা শুরু হবে।
মুর’স ল-এর বিদায় নিয়ে আসলে বিজ্ঞানীরা এক দশক আগেই ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। এবং তখন থেকেই বিজ্ঞানীরা বিকল্প নিয়ে কাজ করছেন। ইলেক্ট্রনিক্স চিপ উৎপাদনের মূলে ব্যবহার করা হয় সিলিকন। মুর’স ল এর ভবিষ্যৎবাণী সিলিকন নির্মিত চিপের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। তাই বিজ্ঞানীরা সিলিকনের বেশ কিছু বিকল্প নিয়ে চিন্তা করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে এখন পর্যন্ত কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। সিলিকনভিত্তিক চিপের ক্ষেত্রে সব ধরণের হিসাবনিকাশ শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে ০ আর ১ এর মধ্যে। এটাকে বলা হয় বিট। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ক্ষেত্রেও ০ বা ১ দিয়েই হিসেব করা হয় তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের এই ০ বা ১ একই সাথে থাকতে পারে যাকে পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় সুপারপজিশন। তারমানে বিটের হিসেবে আমরা যেখানে ১০ বিট দিয়ে একই সময়ে মাত্র ১টা সংখ্যা রাখতে পারি, কিউবিটের হিসেবে আমরা ১০ কিউবিট দিয়ে ২^১০ অর্থাৎ ১০২৪টা সংখ্যা রাখতে পারি!
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার রয়েছে তা ২০ কিউবিট নিয়ে কাজ করতে সক্ষম। যার নির্মাতা আইবিএম। এবং ২০১৭ এর শেষের দিকে তারা ৪৯ কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সিমুলেশন সফল ভাবে সম্পন্ন করেছে। [8]
অন্যদিকে ২০১৭ এর শেষের দিকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এ আইবিএম এর অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী গুগল ঘোষনা দিয়েছে তারা ৪৯ কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটার নির্মানের কাজ শুরু করবে। [9]
২০১৭ সালে পাওয়া মানুষের সবচেয়ে পুরনো ফসিলটি বদলে দিলো মানব প্রজাতির উৎপত্তির ইতিহাস! এতদিন বিজ্ঞানীদের হাতে যে প্রমাণ ছিলো, তার উপর ভিত্তি করে আমরা জেনেছি, প্রায় ২ লক্ষ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকায় হোমো স্যাপিয়েন্স বা মানব প্রজাতির উৎপত্তি ঘটেছিলো। কিন্তু ২০১৭ সালে আবিষ্কৃত হলো এমন এক ফসিল, যা বদলে দিলো বিজ্ঞানীদের হিসেব নিকেশ। নতুন করে সাজাতে হলো মানুষের উৎপত্তির সময়রেখা। মজার ব্যাপার হলো, ফসিলটি আবিষ্কার করা হয়েছে এমন এক অভাবনীয় জায়গা থেকে, যাকে মানুষের ফসিল ভাণ্ডার হিসেবে কেউ চিন্তাই করেনি।
আটলান্টিক মহাসাগরের কোল ঘেঁষে, Jebel Irhoud (জেবেল ইরহাদ) নামক মরক্কোর এক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে দেখা মিলেছে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীনতম মানবের মাথার খুলির, এবং মুখ আর চোয়ালের হাড়ের, যেগুলো পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এগুলো প্রায় ৩১৫,০০০ বছর আগেকার। অর্থাৎ আমরা এতদিন যা জানতাম, তার থেকেও প্রায় ১ লক্ষ বছর পূর্বে দুনিয়ায় মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিলো। [10]
২০১৭ সালের ২৬ জানুয়ারি বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দিলেন অদ্ভুত এক ঘটনার – তারা তৈরি করেছেন মানুষ-পশুর হাইব্রিড। এক্ষেত্রে পশু হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে শূকরকে। এটা আবার কীভাবে সম্ভব? হ্যাঁ, পৌরাণিক কাহিনীতে বর্ণিত মানুষের সাথে বিভিন্ন প্রাণীর শংকর রূপ এবার বাস্তব জগতেই দেখিয়ে ছেড়েছেন ক্যালিফোর্নিয়ার সাল্ক ইন্সটিটিউটের একদল গবেষক। মানুষের সাথে অন্য প্রাণীর শংকর রূপকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় কাইমেরা (chimera)। দুটো ভিন্ন প্রজাতি থেকে আগত কোষ দিয়ে যে দেহ গঠিত, তাই কাইমেরা। এই কাইমেরা তৈরির ফলে প্রমাণিত হলো, মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর দেহেও মানবকোষকে স্থাপন করা যায়, সেগুলো কোনো সমস্যা ছাড়া টিকে থাকে, এমনকি বৃদ্ধিপ্রাপ্তও হয়। কিন্তু কেন এই ঘটনা এত গুরুত্বপূর্ণ? কারণ এই ঘটনা বদলে দিতে পারে অঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়াকে। বর্তমান জগতে কারও অঙ্গ প্রতিস্থাপনের দরকার পড়লে খুঁজতে হয় আগ্রহী ডোনারকে। অনেক সময় পাওয়া যায়, অনেক সময় ডোনারের অভাবে রোগী মারা যায়। কিন্তু মানুষ-পশুর হাইব্রিড প্রযুক্তিটা ব্যবহার করে গবেষণাগারেই তৈরি করা সম্ভব প্রয়োজনীয় অঙ্গ। অন্য প্রাণীর দেহে মানবকোষ স্থাপন করে প্রয়োজনীয় অঙ্গ গঠন করার কাজ এখন মাত্র কয়েক ধাপ দূরে। ফলে ভবিষ্যতে মানুষকে আর ডোনারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না, অর্ডার মাফিক হয়তো ল্যাব থেকেই চলে আসবে কিডনি, লিভার, হাত, পা! [11]
চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন দিকে প্রতিনিয়তই চমকপ্রদ সব অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে। ২০১৭ সালেও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। আগের বছরগুলোর মতো এই বছরেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপরে বিভিন্ন গবেষণা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্যে আশার আলো বয়ে নিয়ে এসেছে তো বটেই; পাশাপাশি নতুন এবং চমকপ্রদ কিছু পথেরও সন্ধান দিয়েছে, যেগুলো সফলতার মুখ দেখতে পেলে হয়তো চিকিৎসা পদ্ধতির গতানুগতিক ধারাটাই পালটে যাবে।
প্রথমেই বলা যায় Circadian Rhythm-এর কথা। আমরা যখন এক দেশ থেকে বহু দূরের অন্য কোনো দেশে উড়ে যাই তখন জেট ল্যাগ কেন হয়, প্রতিদিন কেন আমাদের নিয়ম করে একটা নির্দিষ্ট সময়েই ঘুম পায়, কেনইবা নির্দিষ্ট সময়ে খিদে পায় – এই সব কিছুর জবাব পাওয়া যায় যদি আমরা Circadian Rhythm-এর ব্যাপারে জানার চেষ্টা করি । বহু বছর ধরেই এই ব্যাপারটা নিয়ে গবেষণা হয়ে আসছিলো। কোন সে কারণ, যেটার প্রভাবে শরীর তার নিজস্ব একটা ঘড়ি অনুসরণ করে চলে? অবশেষে ৩ জন আমেরিকান বিজ্ঞানী মানবশরীরে এই Circadian Rhythm-এর জন্যে দায়ী জিনটাকে শুধু খুঁজেই বের করেননি, বরং জিনটা কোন পদ্ধতিতে তার কার্যসম্পাদন করে সেটাও উদঘাটন করেছেন। এই অনবদ্য আবিষ্কারের জন্যে Jeffrey Hall, Michael Rosbush এবং Michal Young নামক তিনজন আমেরিকান বিজ্ঞানী ২০১৭ সালে জিতে নিয়েছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার। [12]
তারপরেই বলা যায় ‘Organs on a Chip’ কিংবা ‘OOC’ নামক চমকপ্রদ আরেক প্রযুক্তির কথা। বাজারে বিভিন্ন রোগের জন্যে যেসব ঔষধ পাওয়া যায়, সেগুলোর ফর্মুলা প্রথমে ল্যাবে গবেষণা করে বের করে নিতে হয়। মূল কাজ সফলতার সাথে সম্পাদনের পাশাপাশি অন্যান্য কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে কিনা তা নিশ্চিত হবার পরেই সেই ঔষধের ফর্মুলা বাজারে ছাড়া হয়। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে সময় বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়। ফর্মুলা উৎপাদনের বাজেটও লাগে অনেক বেশি। তাছাড়া গতানুগতিক পদ্ধতিতে ড্রাগ ফর্মুলা আবিষ্কারের সবচেয়ে বড় ঝামেলা হলো, বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে এগুলোর প্রয়োগ ঘটানো হয়। এতে ল্যাবরেটরিতে ব্যবহৃত প্রাণীদের মৃত্যু ঝুঁকি তো থাকেই, উপরন্তু মানবশরীরের ভেতরের পরিবেশ সঠিকভাবে সিমুলেট করতে না পারায় দেখা যায় ঔষধগুলো অন্যান্য প্রাণীর শরীরে ভালো কাজ করলেও মানবশরীরে এসে তেমন কার্যদক্ষতা দেখাতে পারছে না। এই সমস্যা মোকাবিলায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘Wyss Institute for Biologically Inspired Engineering’-এর বিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করেছেন চমকপ্রদ এক সমাধান। তাদের তৈরি করা প্রযুক্তিতে মানবশরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপরে নানারকম ড্রাগসের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করে দেখা যাবে মাইক্রোচিপসের ভিতরেই। মাইক্রোচিপসের আকার আমাদের বাসাবাড়ির কম্পিউটারে ব্যবহৃত মাইক্রোচিপের মতোই, কিন্তু এই চিপের ভেতরে ফুসফুস, পাকস্থলী, কিডনি কিংবা হার্টের কোষ কালচার করে সেগুলোর চারপাশে এমন পরিবেশ তৈরি করা যাবে যেটা হবে আমাদের মানবশরীরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের মতোই। পরে সেই চিপে ড্রাগ প্রবেশ করিয়ে দেখা যাবে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোষের উপরে তাদের প্রতিক্রিয়া। এতে গতানুগতিক পদ্ধতিতে ড্রাগ ফর্মুলা উৎপাদনের খরচ যেমন বহুগুণে কমবে, তেমনি ল্যাবরেটরিতে ভবিষ্যতে হয়তো আর প্রয়োজন পড়বে না বিভিন্ন জীবিত প্রাণীর উপরে নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষার। [13]
প্রতিবছর Leukemia এবং Lymphoma-র মতো নানাবিধ ব্লাড ক্যান্সারে মারা যায় বহু ব্যক্তি। কিন্তু এইসব দুরারোগ্য ব্লাড ক্যান্সারকে এখন বশ করার প্রযুক্তি চলে এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয়। নিউইয়র্কের Memorial Sloan Kettering Cancer Center-এর গবেষক Kevin J. Curran এর দেখানো পদ্ধতিতে যেসব শিশু লিউকেমিয়ার মতো ব্লাড ক্যান্সারে ধুঁকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তাদের সারিয়ে তোলা যাবে সহজেই। Cellular Immunotherapy ধরণের এই প্রযুক্তিতে ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বেত রক্তকণিকা সংগ্রহ করে ল্যাবে সেগুলোকে বিশেষ ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে এমনভাবে পরিবর্তিত করা হবে যে, সেগুলো প্রচণ্ড শক্তিশালী রক্তকোষে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। পরে সেই শ্বেত রক্তকণিকাগুলোকে আবার ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তিটির শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিলে সেগুলো ক্যান্সার সেলের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। CAR T-Cell Therapy নামে পরিচিত এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে FDA ২০১৭ সালে অনুমোদন দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই থেরাপি সহজলভ্য হলে ব্লাড ক্যান্সার থেকে ৮৫% মানুষই আবার ফিরে এসে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন। [14, 15]
২০০৬ সাল থেকেই বায়ুমণ্ডলে মিথেনের পরিমাণ বাড়ছে। এই পরিমাণ মিথেন কোত্থেকে আসছে, সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীদের দুটো অনুমান ছিলো- তেল-গ্যাস থেকে নিঃসরণ আর ডোবায় আনুবীক্ষণিক জীবের শারীরিক কার্যক্রম থেকে। তাই, অন্যান্য উৎসের পাশাপাশি এগুলো থেকে আসা মিথেন যোগ করে দেখা গেলো যে, যোগফল মিলছে না, আরো অনেক বেশি দেখাচ্ছে। তাহলে বাকি মিথেন কোথায় গেলো? সেই রহস্য সমাধান হয়েছে গত বছরে। আসল রহস্য লুকিয়ে ছিলো আগুনের মধ্যে। বনের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য মাঝে মাঝে আগুন লাগাতে হয়, আবার কখনো কখনো নিজ থেকেই দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। সেগুলোতে মিথেন পুড়ে কার্বনডাইঅক্সাইডে পরিণত হয়। এই গবেষণাটা নেচার কমিউনিকেশনসে ছাপা হয়েছে। গবেষণাটা জরুরি, কারণ মিথেন খুব উল্লেখযোগ্য একটা গ্রীনহাউজ গ্যাস, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ভূমিকা রাখে। [16]
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কথা যখন উঠলোই, তাহলে জানিয়ে রাখা যাক – ২০১৭ এর নভেম্বর ছিলো গত ১৩৭ বছরের মধ্যে তৃতীয় উষ্ণ নভেম্বর। অর্থাৎ, আমাদের এই পৃথিবীটাকে ক্রমাগত উষ্ণ হয়ে উঠছে। [17]
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের বিশ্বের নেতাদের মধ্যে এখনো এটার বিরুদ্ধে কিছু করার ব্যাপারে কোনো ঐক্য নেই। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বছর ঘোষণা দিয়েছেন যে, জলবায়ু নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিলো, সেই প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজের নাম তুলে নেবে। [18]
তবু বিজ্ঞানীদের চেষ্টা থেমে নেই। জাতিসংঘের ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ২০১৮ এর সেপ্টেম্বর মাসে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নতুন রিপোর্ট প্রকাশ করবে। এটি তাদের ষষ্ঠ রিপোর্ট হতে যাচ্ছে। এর আগে, পঞ্চম রিপোর্টটি ২০১৪ সালে প্রকাশ করা হয়েছিলো। আশা করা যাচ্ছে, নতুন রিপোর্টটিতে আমরা আরো উল্লেখযোগ্য কিছু তথ্য পাবো, যা আমাদেরকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কর্মপন্থা ঠিক করতে সাহায্য করবে। [19]
পৃথিবীটা আমাদের সবার। এই পৃথিবীটাকে বুঝতে হলে, রক্ষা করতে হলে বিজ্ঞান জানার কোনো বিকল্প নেই। ২০১৭ সালে বিজ্ঞান আমাদেরকে নতুন অনেক কিছু দিয়েছে, অনেক তথ্য আর আবিষ্কার দিয়ে সহায়তা করেছে। আশা করছি, ২০১৮ সালেও বিজ্ঞান আমাদেরকে অনেক নতুন নতুন জাদু দেখাবে। এই প্রত্যাশায়, আজকের পর্ব এখানেই শেষ করছি…
[1] https://arxiv.org/abs/1712.01911
[2] https://www.ligo.caltech.edu/page/press-release-gw170817
[3] https://www.ligo.caltech.edu/news/ligo20171003
[4] https://www.theguardian.com/science/2017/feb/15/india-launches-record-breaking-104-satellites-from-single-rocket
[5] https://www.cnn.com/2017/10/27/us/mystery-object-solar-system-trnd/index.html
[6] https://physics.aps.org/articles/v9/151
[7] https://spectrum.ieee.org/tech-talk/telecom/security/china-successfully-demonstrates-quantum-encryption-by-hosting-a-video-call
[8] https://www.ibm.com/blogs/research/2017/10/quantum-computing-barrier/
[9] https://www.newscientist.com/article/2138373-google-on-track-for-quantum-computer-breakthrough-by-end-of-2017/
[10] https://www.nature.com/news/oldest-homo-sapiens-fossil-claim-rewrites-our-species-history-1.22114
[11] http://www.cell.com/cell/fulltext/S0092-8674(16)31752-4
[12] https://www.nobelprize.org/nobel_prizes/medicine/laureates/2017/advanced-medicineprize2017.pdf
[13] https://wyss.harvard.edu/technology/human-organs-on-chips/
[14] https://www.cancer.gov/about-cancer/treatment/research/car-t-cells
[15] https://www.cancer.gov/news-events/cancer-currents-blog/2017/yescarta-fda-lymphoma
[16] https://climate.nasa.gov/news/2668/nasa-led-study-solves-a-methane-puzzle/
[17] https://climate.nasa.gov/news/2666/november-2017-was-the-third-warmest-november-on-record/
[18] https://www.cnn.com/2017/09/16/politics/trump-paris-climate-deal/index.html
[19] https://www.ipcc.ch/news_and_events/PR17-IPCC46_Press.shtml
জোস একটা পোস্ট হয়েছে। ধন্যবাদ।