‘বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ/ প্রযুক্তির যুগ/ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ/ তথ্য প্রযুক্তির যুগ’ ইত্যাদি বাক্যগুলো আমরা অহরহ শুনি ও ব্যবহার করে থাকি। এখানে একটি শব্দ বাদ পড়ে যায়, সেটি হচ্ছে ‘প্রকৌশল’। গ্যালিলিওর সময় থেকে আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা। তখন থেকে বর্তমানের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি পর্যন্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটিয়ে আসছে আধুনিক প্রকৌশল। ধরা হয়, আধুনিক প্রকৌশলের সূচনা হয়েছিল শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে।
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ও বর্তমানে বলা চলে পরস্পরের পরিপূরক। কিন্তু কিছু বিষয়ে এদের মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট পার্থক্য। আজকের নিবন্ধ আলোচনা করবে এদের পারস্পারিক সম্পর্ক ও পার্থক্য নিয়ে।
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল – প্রাথমিক ধারণা
বিজ্ঞান
আধুনিক বিজ্ঞানের ধারণা অনুযায়ী, বিজ্ঞান হচ্ছে সুনির্দিষ্ট যৌক্তিক ও প্রামাণ্য পদ্ধতি বা পদ্ধতি সমষ্টি, যা এই মহাবিশ্বের ও প্রকৃতির নিয়মাবলী, নীতিমালা ইত্যাদি অনুসন্ধান করে, উদ্ঘাটন করে, আবিষ্কার করে। প্রকৃতি ও মহাবিশ্ব কিভাবে কাজ করে, কিভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিচালিত হয়, সে নিয়মগুলো প্রামাণ্য উপায়ে উদ্ঘাটন করে মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার প্রক্রিয়াই বিজ্ঞান।
প্রযুক্তি
প্রযুক্তি হচ্ছে বিজ্ঞানের ব্যবহারিক রূপ। বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত তথ্যকে কাজে লাগিয়ে মানুষের নানাবিধ প্রয়োজন মেটানোর জন্য উদ্ভাবিত বিভিন্ন যন্ত্র, উপকরণ এবং ব্যবস্থাই হল প্রযুক্তি। মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে কিংবা জীবনকে সহজতর করার জন্য বিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবিত সকল সরঞ্জাম ও ব্যবস্থা প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্ত।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের জন্যে প্রয়োজন হয় নতুন প্রযুক্তির। বিজ্ঞানের কোনো জটিল সমস্যা সমাধান করে নতুন তথ্য আহরণের জন্য উদ্ভাবিত হয় নতুন প্রযুক্তি। আবার এসব নতুন আহরিত তথ্য কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবন করা যায় আরো নতুন প্রযুক্তি।
প্রকৌশল
সাধারণভাবে বলা যেতে পারে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাঝখানে প্রকৌশলের অবস্থান। বিজ্ঞান হতে প্রাপ্ত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে কোনো একটি সমস্যা সমাধানে অভিনব প্রযুক্তিপণ্য উদ্ভাবনের সামগ্রিক প্রক্রিয়া ও কর্মপন্থাই হচ্ছে প্রকৌশল। প্রকৌশলকে বলা যায় বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের প্রক্রিয়া।
প্রচলিত আছে – “প্রকৌশল ব্যতীত বিজ্ঞান, দর্শনের বেশি কিছু নয়”। “Without Engineering, Science is just Philosophy”.
বিজ্ঞানের কর্মপন্থা
মহাবিশ্বকে চেনার, প্রকৃতিকে জানার ব্যবস্থা হচ্ছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞান সুনির্দিষ্ট পন্থায় এগিয়ে চলে যাতে প্রামাণ্যতার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞানের মাধ্যমে জ্ঞান আহরণের প্রক্রিয়া কয়েকটি ধাপে এগিয়ে চলে।
১. পর্যবেক্ষণ
জ্ঞান আহরণের প্রথম ধাপ – পর্যবেক্ষণ করা। আপনি যে বিষয় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছেন, সে বিষয় সম্পর্কে প্রথমে প্রাকৃতিক ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ঘটনার বিস্তারিত, নিখুঁত, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পর্যবেক্ষণে পক্ষপাত (Bias) থাকলে পরবর্তী প্রতিটি ধাপেই ভুল থেকে যাবে। পর্যবেক্ষণের সামগ্রিক তথ্য সংগ্রহ করে পরের ধাপে যাওয়া হয়।
২. অনুকল্প তৈরি
এ ধাপে পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। তথ্য এবং ঘটনাসমূহ একে অপরের সাথে কিভাবে জড়িতে সে সম্পর্কে ধারণা পাবার চেষ্টা করা হয়। ঘটনা কিভাবে ঘটছে, কোন ঘটনা কাকে কিভাবে প্রভাবিত করছে, সে সম্পর্কে পরীক্ষণযোগ্য অনুমান করা হয়। এসকল অনুমান অবশ্যই যৌক্তিক এবং ঘটনার বিশ্লেষণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এ ধরনের প্রাথমিক অনুমানকে বলা হয় অনুকল্প বা Hypothesis.
৩. অনুকল্প যাচাই
বিজ্ঞানের প্রধান সৌন্দর্যটাই এখানে, যাচাই!
একই ঘটনার একাধিক অনুমান থাকতে পারে। সেখান থেকে পরীক্ষামূলকভাবে নির্ণয় করতে হবে কোন অনুমানটি সঠিক আর কোনটি ভুল, কেন সঠিক আর কেন ভুল। যাচাই যোগ্যতা একটি ভাল অনুকল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। প্রামাণ্য যাচাই বাছাইয়ের মধ্য থেকে বেছে বেছে ভুল অনুমানগুলো বাদ দিয়ে, ত্রুটিপূর্ণ অনুমানগুলোর ত্রুটি সংশোধনের মধ্য দিয়ে যে অনুমানগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষায় টিকে থাকবে, সেটিকে সঠিক হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এই ‘যাচাই’-এর ঊর্ধ্বে কেউ নয়, না কোনো অনুকল্প, না কোনো বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানের প্রত্যেক অনুকল্পকে, প্রত্যেক অনুকল্প প্রণয়নকারীকে এই যাচাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সে যত বড় রথী-মহারথীই হোক। সদ্য প্রয়াত স্টিফেন হকিং হোন আর আপেক্ষিকতার জনক আইনস্টাইনই হোন, যে কারো প্রণীত অনুকল্পকেই যাচাইয়ের মধ্য দিয়ে তার যথার্থতা প্রমাণ করে বিজ্ঞানের পথে এগিয়ে যেতে হবে।
৪. তত্ত্ব আহরণ
বিজ্ঞান এগিয়ে চলে ভুল প্রমাণ করার মধ্য দিয়ে। অনুকল্প যাচাই করে ত্রুটিমুক্ত করতে করতে এমন একটা সুস্থিত অবস্থায় আসে, যখন সেটিকে আর ভুল প্রমাণ করা যায় না। যখন সে নানা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়, বিভিন্ন কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েও সদর্পে তার সঠিকতা ঘোষণা করে। যখন অনুকল্প থেকে প্রাপ্ত প্রতিটি ভবিষ্যৎবাণী সঠিক প্রতিপন্ন হতে থাকে, তখন একটি অনুকল্প, ‘তত্ত্ব’-এর রূপ লাভ করে।
এখানে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, তত্ত্ব রূপ লাভ করলেই তার যাচাই বন্ধ হয়ে যায় না, বরং সংশ্লিষ্ট নতুন কোনো ঘটনা হাজির হলে এই তত্ত্ব সেটির ব্যাখ্যা দিতে ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎবাণী করতে সফল কিনা তা যাচাই করা হয়। এভাবে এক-একটি তত্ত্ব বারবার কঠিন পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিজের যথার্থতা প্রমাণ করে টিকে থাকে, যে পরীক্ষা নিরীক্ষাগুলো করাই হয় তত্ত্বটিকে ভুল প্রমাণ করার জন্য।
প্রকৌশল কর্মপন্থা
প্রকৌশলীরা কোনো একটি ব্যবহারিক সমস্যা সমাধানের জন্য বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত তথ্য, উপাত্ত কাজে লাগিয়ে নতুন প্রযুক্তিপণ্য উদ্ভাবনে প্রায় বিজ্ঞানের কর্মপন্থার মতই কয়েক ধাপে অগ্রসর হন।
১. জিজ্ঞাসা
প্রথমেই সমস্যা সম্পর্কে ভালভাবে জানতে হবে। সমস্যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে হবে। সমস্যা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলে তা সমাধানের চেষ্টা করা বৃথা।
২. চিন্তা ভাবনা
সমস্যার সামগ্রিক তথ্য হাতে আসার পর সে সম্পর্কে ভাবতে হয়। সমস্যার নানা দিকের সাথে সম্পর্ক বিবেচনায় এর সমাধান নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে সমাধানের পথ খুঁজে বের করা হয়। প্রাথমিকভাবে একাধিক সমাধান চিন্তা করা হয়। যেটি সবচেয়ে উপযুক্ত বিবেচিত হবে, পরবর্তী ধাপগুলোতে সেটিই গ্রহণ করা হয়।
৩. পরিকল্পনা তৈরি
সমাধানের ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসা সমাধানের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সাজানো হয়। কোনো যন্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট প্রাথমিক নকশা বা Design প্রণয়ন করা হয়ে থাকে।
৪. নমুনা প্রস্তুতকরণ
নির্দিষ্ট ডিজাইন তৈরি হয়ে গেলে ডিজাইন অনুযায়ী প্রাথমিক মডেল প্রস্তুত করা হয়। এই মডেল পূর্ণ আকারে অথবা ছোট আকারে হতে পারে।
৫. নমুনা নিরীক্ষণ
মডেল প্রস্তুত হয়ে গেলে দেখা হয় যেভাবে সমাধান আশা করা হয়েছিল সেভাবে আসছে কিনা, কোথাও কোনো অপূর্ণতা কিংবা ত্রুটি রয়েছে কিনা। ত্রুটিমুক্ত হলে যাচাই করা হয় যথাযথ কার্যকারিতা ও দক্ষতা পাওয়া যাচ্ছে কিনা।
৬. উৎকর্ষ সাধন
নমুনা নিরীক্ষণ থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সব ঠিকঠাক থাকলে চূড়ান্ত প্রস্তুতির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যদি কোনো ত্রুটি কিংবা অপূর্ণতা থেকে যায়, তবে সেগুলো মেরামত করে পুনরায় নমুনা তৈরি ও নিরীক্ষণ পর্যায় পার করে আসতে হয়। এছাড়া উদ্ভাবিত প্রযুক্তিপণ্য বা ব্যবস্থার দক্ষতা বাড়াতে উৎকর্ষ সাধন প্রক্রিয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে চলতে থাকে।
বিজ্ঞান, প্রকৌশল, ও প্রযুক্তির সম্পর্ক
নিবন্ধের শুরুতে থাকা প্রাথমিক ধারণা থেকে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তির মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বোঝা যায়। এক কথায় বললে – বিজ্ঞান হচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়মাবলী সংক্রান্ত জ্ঞান আহরণের পদ্ধতি, এই আহরিত জ্ঞানকে কাজে লাগানোর প্রক্রিয়া হল প্রকৌশল, আর প্রকৌশলের ফলাফল হিসাবে উদ্ভাবিত পণ্য অথবা ব্যবস্থা যা মানুষের জীবনকে আরো সহজ-সুন্দর করে, সেগুলো হল প্রযুক্তি।
বর্তমানে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে। যেমন, নতুন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজন নতুন নতুন পর্যবেক্ষণ যন্ত্র বা নতুন প্রযুক্তি। বিদ্যমান জ্ঞান ব্যবহার করে এসব নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে প্রকৌশলীদের নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে বলে কখনো কখনো আবিষ্কৃত হচ্ছে কিছু সহপ্রযুক্তি। এ সকল প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে জ্ঞান আহরণের রাস্তা প্রশস্ত হয় যা বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার বয়ে নিয়ে আসে।
বিজ্ঞান, প্রকৌশল, ও প্রযুক্তির পার্থক্য
বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি পারস্পারিক সহযোগিতার উপর ভিত্তি করে পথ চললেও তাদের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। প্রধান পার্থক্য ধরা পড়ে এদের চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে তাকালে।
বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়ম-নীতির উদ্ঘাটন। মহাবিশ্ব কী কী নিয়মের মধ্য দিয়ে চলছে সে সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানার্জনই হচ্ছে বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য। অপরদিকে প্রকৌশল হচ্ছে বিজ্ঞানের অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগানোর প্রক্রিয়া। জানা প্রাকৃতিক নীতিমালার বাস্তব প্রয়োগ ঘটিয়ে মানুষের জীবনকে সহজ ও সুন্দর করে তোলা এবং মানুষের নানা সমস্যা সমাধান করাই হচ্ছে প্রকৌশলের লক্ষ্য। আর প্রকৌশলের ফলাফল হিসেবে উৎপাদিত হয় প্রযুক্তি। বিজ্ঞানের জ্ঞানকে প্রকৌশলের মাধ্যমে কাজে লাগিয়ে উৎপাদিত হয় প্রযুক্তি।
এছাড়া আরো কিছু আনুষঙ্গিক পার্থক্য রয়েছে এদের মধ্যেঃ
- বুৎপত্তি অনুসারে বিজ্ঞান হচ্ছে জ্ঞান, প্রকৌশল হচ্ছে জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ, প্রযুক্তি হচ্ছে প্রকৌশলের ফলাফল।
- বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য প্রকৃতির জ্ঞান আহরণ, এর প্রয়োগ বিজ্ঞানের আওতাভুক্ত নয়। প্রকৌশল জ্ঞান আহরণের দিকে ব্রতী নয়, এর একমাত্র উদ্দেশ্য অর্জিত জ্ঞানকে ব্যবহারিক কাজে লাগানো। প্রযুক্তি মানুষের কাজে ব্যবহৃত হয় ও মানুষের জীবনকে সাচ্ছন্দ্যমণ্ডিত করে তোলে।
- বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান প্রকৃতি সম্বন্ধে অগ্রীম ভবিষ্যৎবাণী করতে সক্ষম। প্রকৌশল বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে কোনো সমস্যা নিরসনের উপায় তৈরি করতে সক্ষম। প্রযুক্তি মানুষের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম।
- বিজ্ঞান জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে, প্রকৃতি যে সকল নিয়মের মধ্য দিয়ে চলে, তা জানার মধ্যে খারাপের কিছু নেই। এটি শুধুই জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়া বিশেষ। প্রকৌশল বিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সমস্যা নিরসন করে থাকে। মানুষের চাহিদা অনুযায়ী বিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন করাই প্রকৌশলের কাজ। এখানেও ভাল বা খারাপের কোনো অবকাশ নেই। প্রযুক্তি হচ্ছে আধুনিক পণ্য বা ব্যবস্থা যা গড়ে ওঠে বিজ্ঞানের জ্ঞানকে প্রকৌশলের মধ্য দিয়ে কাজে লাগিয়ে। প্রযুক্তি ভাল বা খারাপ হতে পারে। মানুষের কল্যাণের জন্য যেমন প্রযুক্তি রয়েছে, তেমনি রয়েছে মানুষের জন্য ক্ষতিকর প্রযুক্তি। আবার একই প্রযুক্তির ভাল ও খারাপ ব্যবহারও রয়েছে, যার দায় বর্তাবে একমাত্র ব্যবহারকারীর উপর।
বিজ্ঞান, প্রকৌশল, ও প্রযুক্তির ‘ভালো’ ‘মন্দ’
আসলে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল দুটো বৃহদায়তন প্রক্রিয়াবিশেষ। এদের ভালো-মন্দের কিছু নেই। এই প্রক্রিয়া দুটি মানুষের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করে, মানুষের প্রয়োজন অনুসারে প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে, মানুষের জীবনযাপনকে সহজ করে। এখানে খারাপের কোনো অবকাশ নেই।
খারাপ হওয়া সম্ভব প্রযুক্তি। মন্দ ব্যক্তি যখন অসৎ উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানের জ্ঞানকে প্রকৌশলের মাধ্যমে কাজে লাগিয়ে তার অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কোনো প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে, তখন আমরা যা দেখতে পাই তাকেই সরলীকরণ করে বলি ‘বিজ্ঞানের মন্দ দিক’। কিন্তু এই বলাটা ভুল। বিজ্ঞান কিংবা প্রকৌশলের কোনো মন্দ দিক নেই। এরা দুটো প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি মাত্র। এর ব্যবহারকারী অসৎ উদ্দেশ্য এর ফলাফলকে খারাপের দিকে নিয়ে যায়। এ বিষয়ে পারমাণবিক শক্তির উদাহরণটি স্পষ্ট ধারণা দিতে সক্ষম।
আইনস্টাইনের ‘ভর-শক্তি তুল্যতা সূত্র’ হচ্ছে বিজ্ঞান। এটি ধারণা দেয় প্রকৃতিতে ভর ও শক্তি দুটি ভিন্ন রূপ মাত্র। ভর রূপান্তরিত হয়ে বিপুল পরিমাণ শক্তিতে পরিণত হতে পারে। এটি একটি নতুন জ্ঞান। এটিকে খারাপ বলার কোনো সুযোগ নেই। এই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের শক্তির সংকট নিরসন করা যায় কিনা, তা নিয়ে গবেষণা চলতে থাকল। গবেষণার ফলাফল হিসেবে আবিষ্কৃত হল নিয়ন্ত্রিত ফিশন বিক্রিয়া ঘটানোর তাত্ত্বিক পদ্ধতি। এই তাত্ত্বিক পদ্ধতিকে ব্যবহারিক রূপে নিয়ে আসল ‘প্রকৌশল’। নানা প্রকৌশল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পর ভারী তেজস্ক্রিয় পদার্থের নিয়ন্ত্রিত ফিশন থেকে শক্তি উৎপাদনের যান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি হল, যা আধুনিক প্রকৌশলের ফল। প্রকৌশলের কাজই হচ্ছে, যেকোনো সমস্যার সমাধান করে মানুষের প্রয়োজন মেটানো। সুতরাং এখানেও ভাল বা খারাপ বিবেচনার সুযোগ নেই।
পরবর্তীতে ‘ভর-শক্তি তুল্যতা’ সূত্রের বিজ্ঞানটি প্রকৌশলের হাত ধরে দুটি ভিন্ন প্রযুক্তিতে পর্যবসিত হল। একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, অন্যটি পারমাণবিক অস্ত্র। এক প্রযুক্তি শক্তি সঙ্কটে আশার আলো দেখাচ্ছে মানব জাতিকে, আরেক প্রযুক্তি মানব সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে দিন দিন। সুতরাং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমরা ভাল কিংবা খারাপ বিবেচনা করতে পারি, যার দায়ভার এর ব্যবহারকারীর, কখনোই বিজ্ঞানের নয়।
আবার কখনো কখনো একই প্রযুক্তিপণ্যের ভাল এবং খারাপ ব্যবহার থাকতে পারে। মোবাইল ও ইন্টারনেট হল সহজ দুটো উদাহরণ। মোবাইল ব্যবহার করে মানুষ যেমন অন্যের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে, তেমনি এই মোবাইলই হয়ে উঠতে পারে সন্ত্রাসীদের দূর নিয়ন্ত্রণের মোক্ষম যন্ত্র। যে ইন্টারনেট ব্যবস্থা সারা বিশ্বকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে, সারা বিশ্বের সাথে সেকেন্ডে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, সেই ইন্টারনেট ব্যবহার করেই গড়ে উঠেছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অবৈধ অস্ত্র, ড্রাগ ও মানব পাচারের বাজার। এই দায় তো মোবাইল বা ইন্টারনেটের নয়, ব্যবহারকারীর। অসৎ জনগণ ব্যবহার করছে বলে তো পুরো প্রযুক্তিকে খারাপ প্রযুক্তি বলা যায় না!
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশলের পারস্পারিক সহাবস্থানের সমসাময়িক উদাহরণ
Large Hadron Collider (LHC)
“দু’টো উচ্চগতিশীল প্রোটনকে সংঘর্ষে লিপ্ত করতে পারলে সেখান থেকে আমরা মৌলিক কণিকার সন্ধান পেতে পারি।”
“চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে যেকোনো আহিত কণাকে (charged particle) গতিশীল করা সম্ভব।”
“পদার্থের ভরের জন্য (হয়ত) দায়ী একটি সম্ভাব্য বস্তুকণা হচ্ছে হিগস বোসন।”
প্রথম ও দ্বিতীয় বাক্যটি বিজ্ঞানের আহরিত জ্ঞান, তৃতীয় বাক্যটি গাণিতিক বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত একটি অনুকল্প। এখন বিজ্ঞানের নিয়মানুসারে পরীক্ষার মাধ্যমে অনুকল্পটির সত্যতা ও সঠিকতা যাচাই করতে হবে। তার জন্য আমাদের প্রয়োজন দুটো প্রোটনকে উচ্চগতিতে গতিশীল করা, যে গতি আলোর গতির সাথে তুলনীয়, এবং তাদের সংঘর্ষ ঘটানো। এই কাজ যথাযথভাবে করার জন্য দ্বিতীয় বাক্যের জ্ঞানের উপর ভর করে প্রকৌশলীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে CERN-এ তৈরি হল LHC, বিশ্বের সর্ববৃহৎ Particle Accelerator যা পার্টিকেল এক্সিলারেটর প্রযুক্তির সর্বাধুনিক সংস্করণ। এটি প্রোটনকে এতটা গতিশক্তি দিতে সক্ষম যে, তাদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে হিগস বোসন তৈরি হতে পারে। এই সর্বাধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে প্রোটনের সংঘর্ষ ঘটিয়ে পাওয়া গেলে কাঙ্ক্ষিত হিগস বোসন। হিগস বোসনের অস্তিত্ব প্রমাণিত হলে তা হয়ে গেল বিজ্ঞানের একটি প্রমাণিত অংশ। হিগস বোসন পদার্থের ভরের জন্য দায়ী।
এখানে বিজ্ঞানের অনুকল্প প্রমাণের জন্য প্রকৌশলের সহায়তায় Particle Accelerator প্রযুক্তি ব্যবহার করে অত্যাধুনিক LHC প্রযুক্তির মাধ্যমে পাওয়া গেল নতুন মৌলিক কণা ‘হিগস বোসন’ যা কণা পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।
Laser Interferometer Gravitational-Wave Observatory (LIGO)
আইনস্টাইনের ফিল্ড থিওরির সমীকরণের সমাধান থেকে গ্র্যাভিটেশনাল ফিল্ডের মধ্য দিয়ে এক ধরনের ‘অ-বিদ্যুতচুম্বকীয়’ তরঙ্গ প্রবাহের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। গাণিতিক বিশ্লেষণ থেকে এই তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য এবং কিভাবে উৎপত্তি হয় ও ছড়িয়ে পড়ে, তার প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু এর যথার্থতা বোঝার জন্য দরকার প্রমাণের। সেই প্রমাণের উদ্দেশ্যে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রকৌশলীরা তৈরি করলেন এমন একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থা, যা দিয়ে গ্র্যাভিটেশনাল তরঙ্গ ‘ধরা যাবে’। অত্যাধুনিক প্রকৌশলবিদ্যার হাত ধরে আবিষ্কৃত হল অত্যাধুনিক প্রযুক্তি LIGO. অবশেষে এই প্রযুক্তির ব্যবহারে দুটো ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষে তৈরি হওয়া Gravitational Wave ধরা পড়ে। সেই সাথে গণিতের গণ্ডি পেরিয়ে প্রামাণ্য বিজ্ঞানের অংশ হিসেবে যায়গা করে নেয় Gravitational Wave.
LHC-এর মত LIGO-এর ক্ষেত্রেও নতুন বৈজ্ঞানিক অনুকল্প প্রমাণের উদ্দেশ্যে প্রকৌশলের হাত ধরে তৈরি হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। সেই প্রযুক্তির হাত ধরেই আবার সেই অনুকল্পের সঠিকতা প্রমাণিত হয়েছে।
বিজ্ঞান, প্রকৌশল আর প্রযুক্তির ক্ষেত্র সহজে বুঝাতে একটি প্রাগৈতিহাসিক কাল্পনিক ঘটনার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি টানছি এই নিবন্ধের।
এমন একটা সময়ের কথা চিন্তা করা যাক, যখন মানুষের পূর্বপুরুষের একটা দল সবেমাত্র গাছ থেকে নেমে বন্য জীবজন্তু শিকার করে বেঁচে থাকছে। তারা শিকারের জন্য হাতিয়ার হিসেবে পাথর খণ্ড আর গাছের ভাঙ্গা ডাল ব্যবহার করতে শিখেছে। বহুদিন শিকার করে করে অভিজ্ঞ এক শিকারি বুঝতে পারল, যেসব পাথর এবড়ো থেবড়ো কিংবা যেসব ডাল ভাঙ্গলে শেষ প্রান্ত সরু হয়ে ভাঙ্গে, সেগুলো দিয়ে শিকার করা সহজ হয়। পাথর যত ধারালো, গাছের ডালের প্রান্ত যত সূঁচালো, শিকার তত সহজে ঘায়েল হয়। তো, এই অভিজ্ঞ শিকারির পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানটি হচ্ছে বিজ্ঞান।
এই বিজ্ঞান সে কাজে লাগাল। ধারালো পাথর আর সরুপ্রান্তের গাছের ডালটাই সে শিকারের জন্য বেছে নিল। একদিন সে লক্ষ্য করল, পাথর দিয়ে ঘষে আরেকটা মসৃণ পাথরকেও ধারালো করা যায়, মসৃণ গাছের ডালকেও করে তোলা যায় সূঁচাগ্র। তখন সে আর এবড়ো থেবড়ো পাথর ও ধারালো গাছের ডাল না খুঁজে যেকোনো পাথর আর গাছের ডালকে ধারালো ‘করে নিতে’ শুরু করল। সে গাছের ডাল ভেঙ্গে পাথর দিয়ে ঘষে সেটিকে সূঁচালো করে নেয়, অন্য পাথরের গায়ে ঘষে মসৃণ পাথরকেও শিকার উপযোগী ধারালো করে নেয়। এই যে পাথর দিয়ে ঘষে মসৃণ পাথর ও গাছের ডালকে কার্যোপযোগী করার প্রক্রিয়া, সেটিই হল প্রকৌশল।
এই আবিষ্কারের পর থেকে সেই অভিজ্ঞ শিকারি আর প্রাকৃতিক অস্ত্রের অপেক্ষায় না থেকে বন্য প্রাণী শিকারের জন্য নিজেই হাতিয়ার তৈরি করে নেয়। এই যে কৃত্রিম উপায়ে প্রস্তুতকৃত হাতিয়ার – ধারালো পাথর ও সূঁচাগ্র গাছের ডাল, এগুলোই তার জন্য প্রযুক্তি।
তথ্যসূত্র
১. The Relationship Between Science And Engineering By Dr. Gano Dunn – SCIENCE MAGAZINE
DOI: 10.1126/science.71.1837.276, PMID: 17790182, BAK link
২. On the Differences between the Engineering and Scientific Methods By Marius Sinclair – The International Journal of Engineering Education
BAK link
৩. Centralized planning of science, technology, and society in the Soviet Union and its impact on educational policy, 1966-1984 – Chapter Two
The Differences Between Science and Technology – Northern Arizona University
BAK link
৪. Engineering Design Process – NASA
৫. Science, Engineering, and Technology – Engineering is Elementary (EIE) Project, National Center for Technological Literacy, Museum of Science, Boston
৬. বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কী? – শুধুই কি কিছু ধারণা, কিছু চিন্তাপ্রসূত অনুমান, নাকি বিজ্ঞান, ভবিষ্যৎ বৈজ্ঞানিক সূত্রের শিশুকাল? – এস. এ. খান, বিজ্ঞানযাত্রা