অতি-বেগুনী বিপর্যয়, Ultraviolet Catastrophe
“কোনো বিষয় যদি আপনি এক ছয় বয়সের বাচ্চাকে বোঝাতে না পারেন, তবে আপনি নিজেই বিষয়টি ঠিকমতো বোঝেননি”
– আলবার্ট আইনস্টাইন।
বিজ্ঞানের ভাষা গণিত। তবে বিজ্ঞানের সূত্রপাত কিন্তু গণিত নয়। প্রতিটি বৈজ্ঞনিক মতবাদ শুরু হয় আমাদের চিন্তাশীলতা (Thought Experiment) থেকে। যখন আমাদের চিন্তাশীল ধারণাগুলো একটি যুক্তিশীল রূপরেখা পায় তখন আমরা তাকে গাণিতিক ভাবে প্রকাশের চেষ্টা করি। এমন যদি হয় যে, আপনি এমন কিছু চিন্তা করলেন যা প্রকাশের জন্য কোনো গাণিতিক পদ্ধতি এখনো তৈরী হয়নি, এর মানে কি এই যে, আপনার ধারণাগুলো ভুল? সম্ভবত না। নিউটন কিন্তু এমন অবস্থাতে নিজেই গণিতে নতুন শাখা আবিস্কার (Calculus) করেছিলেন।
যুক্তিশীল ধারণা —> গাণিতিক বিশ্লেষণ —> পরীক্ষাগত সত্যতা।
চিন্তাশীলতা এক ধরনের আসক্তি, শুধু চিন্তাশীলতা থেকেই কিন্তু বিজ্ঞানের জটিল বিষয়/ধারণা গুলো স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায়। আমি চেষ্টা করবো গণিত ছাড়াই বিজ্ঞানের মাথা ঘুরানো কিছু বিষয় সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করতে।
সমস্যা (পুনশ্চ ১):
ধরুন, একটি উত্তপ্ত কাপড় ইস্ত্রি করার যন্ত্রের কাছাকাছি আপনি আপনার হাতের তালু রাখলেন (স্পর্শ না করে)। আপনি কিন্তু ঠিকই এর উত্তাপ টের পাবেন। এই উত্তাপ হচ্ছে আসলে এক ধরনের বৈদ্যুতিক-চুম্বকীয় তরঙ্গের (অবলোহিত/ইনফ্রারেড) বিকিরণ। এখন আপনি যদি জানতে চান ইস্ত্রির উতপ্ত পৃষ্ট কি পরিমান শক্তি বৈদুতিক-চুম্বকীয় তরঙ্গ আকারে বিকিরণ করছে, তাহলে আপনাকে ক্লাসিকাল পদার্থবিজ্ঞানে দুই বাপ ম্যাক্সওয়েল ও জে জে থম্পসন-এর দ্বারস্থ হতে হবে। ক্লাসিকাল পদার্থবিজ্ঞানে এই সম্পর্কে দুটি উল্লেখযোগ্য শর্ত রয়েছে,
এক) শুধু সেইসব তরঙ্গ গুলোই শক্তি দিতে পারবে যাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ইস্ত্রির পৃষ্ট এবং আপনার হাতের তালুর দূরত্বের গুণিতক। সোজা কথায়, ধরুন এই দূরত্ব তিন সেন্টিমিটার, এবং আপনাকে পাঁচটি তরঙ্গ দেয়া হলো যাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ সেন্টিমিটার। দেখা যাচ্ছে, শুধু দুটি তরঙ্গ যাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য এক এবং তিন সেন্টিমিটার, তারাই শুধু টিকে থাকবে।
দুই) টিকে যাওয়া তরঙ্গ গুলোর প্রতেকেই সমপরিমাণ শক্তি প্রদান করবে। লক্ষ্য করুন, তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সাথে কিন্তু তরঙ্গ কম্পাঙ্গের (Frequency) এর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত লম্বা হবে কম্পাঙ্গ তত কম হবে আর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত ছোট হবে কম্পাংক তত বেশী হবে। ক্লাসিকাল পদার্থবিজ্ঞানে, বিকীর্ণ শক্তি তরঙ্গের কম্পাঙ্গের উপর নির্ভর করে না।
সমস্যার শুরু এক নম্বর শর্তে (আমরা দেখব, সমাধান রয়েছ দুই নম্বর শর্তে)। বাস্তবে, অসীম সংখ্যক তরঙ্গ এক নম্বর শর্ত পূরণ করে। এই অসীম সংখ্যক তরঙ্গগুলোর প্রত্যেকেই যদি সীমিত শক্তি প্রদান করে তাহলে মোট শক্তিও অসীম হয়ে পরে। অন্যভাবে বললে, ক্লাসিকাল পদার্থবিজ্ঞানের মতে, আপনার ইস্ত্রি আপনের হাতের তালুতে যে শক্তি বিকিরণ করে তা সূর্যের চেয়েও বেশী! (যদিও বাস্তবে ইস্ত্রির স্পর্শে সামান্য ছ্যাঁকা খাওয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না আপনার)।
কেন এই নাম?
গামা, X-রে, অতিবেগুনী রশ্মি এদের কম্পাঙ্গ অতিক্ষুদ্র। এবং এরা অতি সহজেই এক নং শর্ত পূরণ করে। এরমানে, ক্লাসিকাল পদার্থবিজ্ঞান অনুযায়ী, আপনের ইস্ত্রি এক পর্যায় ভয়ানক অতিবেগুনী এবং উচ্চতর কম্পাঙ্গের তরঙ্গ বিকিরণ করবে! যদিও এই (অতিবেগুনী) বিপর্যয় বাস্তবে কখনই হয় না।
একটা গল্প :
ধরুন, আপনি একটা রাজ্য আছে। আপনার রাজ্যে প্রজার সংখ্যা অগণিত (অসীম)। আপনি হুকুম জারি করলেন এই বছর সব প্রজাকে এক হাজার টাকা করে খাজনা দিতে হবে। আপনি বেজায় খুশি, অগণিত প্রজার প্রত্যেকে মাত্র এক হাজার করে দিলে আপনার অঢেল অর্থের মালিক হবেন। কিন্তু আপনি এক খেয়ালি মানুষ। আপনার আয়কর আইন বড়ই অদ্ভুত। এর দুটি অনুচ্ছেদ হচ্ছে,
এক) রাজ্যে অগণিত মূল্যমানের মুদ্রা চালু থাকবে, মূদ্রাগুলোর মূল্যমান হচ্ছে যথাক্রমে, এক, দশ, পঞ্চাশ, একশ, পাঁচশ, এক হাজার, পাঁচ হাজার ইত্যাদি।এবং প্রতিটি প্রজা শুধু একটি মানের মুদ্রা বহন করতে পারবে। যেমন ধরুন : করিমের কাছে আছে শুধু এক টাকার নোট, রহিমের কাছে দশ টাকার, রাশিদের কাছে পঞ্চাশ ইত্যাদি।
দুই) রাজ্য ভাংতির কারবার করবে না। সুতরাং, যারা খাজনার টাকা গোটা এক হাজারে দেয় আপনি তাদের খাজনা নেন, আর যারা বেশী মূল্যমানের নোট দেয় (যেমন পাঁচ হাজার ও তার ওপরে) তাদের আপনি ভাংতি দেন না এবং তাদের খাজনাও আপনি গ্রহণ করেন না।
বলুন তো, আপনি সর্বোচ্চ কত খাজনা পাবেন? ধরি, আপনার সব প্রজা সচ্ছল, তাহলে আপনার আয় হবে মোট ছয় হাজার টাকা! (মনে রাখবেন, দুই নং শর্তের কারণে পাঁচ হাজার এবং তার উচ্চমানের টাকার অধিকারীরা কেউই খাজনা দিতে পারবে না। শুধু এক, দশ, পঞ্চাশ, একশ, পাঁচশ, এবং এক হাজার নোটের অধিকারীরাই খাজনা দেবে)। ভেবে দেখুন, কোথায় অঢেল আর কোথায় ছয় হাজার।
সমাধান (পুনশ্চ ২):
ম্যাক্স প্লাঙ্ক ১৮৯৯ সালে “অতি-বেগুনী বিপর্যয়”-এর পূর্ণাঙ্গ সমাধান দেন। প্লাঙ্ক আসলে দুই নং শর্তটি পরিবর্তন করেন। তিনি বলেন প্রতিটি বৈদুতিক-চুম্বকীয় তরঙ্গের (গল্পমতে, প্রতিটি প্রজার) একটি ন্যূনতম শক্তিমাত্রা থাকে (গল্পমতে, মুদ্রার মূল্যমান যেমন, ১০, ৫০, ১০০ টাকা ইত্যাদি), এই ন্যূনতম শক্তি সরাসরি তরঙ্গের কম্পাঙ্গের সাথে জড়িত। প্লাঙ্কের সমীকরণ অনুসারে, তরঙ্গের কম্পাঙ্গ যত বেশী ন্যূনতম শক্তি তত বেশী আর তরঙ্গের কম্পাঙ্গ যত কম, ন্যূনতম শক্তি তত কম। এ অনুযায়ী, অতিবেগুনী রশ্মির নুন্যতম শক্তি অবলোহিত রশ্মির চেয়ে অনেক অনেক বেশী।
ম্যাক্স প্লাঙ্ক-এর মতে, উত্তপ্ত পৃষ্টের বিকীর্ণ শক্তি (গল্পমতে,একহাজার টাকার খাজনা) যদি কোনো তরঙ্গের নুন্যতম শক্তি চেয়ে কম হয় (গল্পমত, সেই প্রজারা যারা পাঁচহাজার ও তার উচ্চমানের মুদ্রার অধিকারী) তবে সেইসব তরঙ্গগুলো অলস থাকবে (অর্থাৎ, তারা বিকীর্ণ হবে না)।
অতএব, আপনি যদি আপনার ইস্ত্রি থেকে অতিবেগুনী বিকিরণ দেখতে চান তবে আপনার যন্ত্রকে অভাবনীয় রকমের উত্তপ্ত করতে হবে।
পুনশ্চ ১:
এই সমস্যাটা ক্লাসিকাল পদার্থবিজ্ঞানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে “কালো বস্তুর বিকিরণ (Black Body Radiation)” পর্যালোচনায়। ক্লাসিকাল পদার্থবিজ্ঞানে “Ultraviolet Catastrophe” ব্যাখ্যা করা হয় “রেলেই-জিন সূত্র/Rayleigh-Jean Law”এর মাধ্যমে। রেলিগ-জিন সূত্র আসলে, এই সমস্যা সমাধানে ক্লাসিকাল পদার্থবিজ্ঞানে শেষ বিফল চেষ্টা মাত্র।
পুনশ্চ ২:
এই অবদানের জন্য ম্যাক্স প্লাঙ্ক ১৯১৮ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পদক পান। বৈদুতিক-চুম্বকীয় তরঙ্গের এই ন্যূনতম শক্তিকে বলা হয় “কোয়ান্টা/Quanta”, এ ধরণার উপরে ভিত্তি করে পরবতীতে “কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান” শুরু। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের দুই বাপ, প্রথম বাপ ম্যাক্স প্লাঙ্ক। ম্যাক্স প্লাঙ্ক বিশ্বাস করতেন তার সমাধান শুধুই গণিতের কারসাজি, প্রকৃতি কখনই শক্তি নিয়ে এমন আচরণ করে না। ১৯০৫ আইনস্টাইনের “আলোর বৈদুতিক প্রভাব/Photoelectric Effect”গবেষণার মাধ্যমে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম প্রাকৃতিক উপযোগিতা প্রমাণ করেন। এজন্য আইনস্টাইন ১৯২১ পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পদক পান এবং তাকে বলা হয় দুই নম্বর বাপ। যদিও দুই নম্বর বাপের সাথে বেটার সম্পর্ক মোটেও ভালো ছিল না (এর উপর লিখার ইচ্ছা রয়েছে পরবর্তীতে)।
তথ্যসূত্র : “Elegant Universe”by Brian Greene, Chapter 4 অবলম্বনে