[পর্ব ১]
[পর্ব ২]
ছয় মহাজাগতিক (Cosmological) সংখ্যা:
এগুলো ঝাড়ফুঁক মার্কা কিংবা স্বপ্নে পাওয়া কোন সংখ্যা নয়। বরং এদের মান বের করা হয়েছে বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত, ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। অদ্ভুত বিষয়, এরা এতই নিখুঁত যে এদের যে কোন একটির মান যদি একটু এদিক সেদিক হত তবে আজ আমরা যে মহাবিশ্বে বাস করছি তার কোন অস্তিত্বই থাকতো না। আসুন এদের বিস্তারিত জানা যাক।
ε (ঈপসাইলন) -এর মান ০.০০৭
এটা একটা আনুপাতিক সংখ্যা (খেয়াল করুন, এর কোন একক নেই)। আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞান অনুসারে মৌলিক শক্তি চার প্রকার,
১) প্রবল পরমাণবিক শক্তি (Strong Nuclear Force)
২) দুর্বল পরমাণবিক শক্তি (Weak Nuclear Force)
৩) বৈদ্যুতিক-চুম্বকীয় শক্তি (Electro-Magnetic Nuclear Force)
৪) মাধ্যাকর্ষণ (Gravity)
পরমাণবিক বোমা বিস্ফোরণে যে শক্তি তাপ, আলো আকারে নির্গত হয় তা “প্রবল পারমাণবিক শক্তির” অন্য রূপান্তর মাত্র। একটু হালকা ভাবে বললে, কোন পরমাণুর কেন্দ্রে যদি একাধিক প্রোটন বা নিউট্রন বা দুটিই থাকে তবে যে শক্তি এই কণাগুলোকে একত্রে রাখে সেটাই “প্রবল পরমাণবিক শক্তি”। “প্রবল পরমাণবিক শক্তি” প্রকৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী শক্তি। এটি বৈদ্যুতিক-চুম্বকীয় শক্তির চেয়ে অনেক গুণ বেশী শক্তিশালী। তাই পরমানুর কেন্দ্রে সমচার্জযুক্ত প্রোটনগুলো বৈদ্যুতিক-চুম্বকীয় কারণে পরস্পরকে বিকর্ষণ করলেও “প্রবল পরমাণবিক শক্তির” কারণে তারা একসাথে অবস্হান করে।
পারমাণবিক ফিউসন প্রক্রিয়ায়ে হাইড্রোজেন পরমাণু যখন হিলিয়াম গঠন করে তখন যে শক্তি নির্গত হয় সেই শক্তি এবং “প্রবল পরমাণবিক শক্তির” এ দুটি অনুপাতই হচ্ছে ε। অন্যভাবে বললে, ফিউসন প্রক্রিয়ায় “প্রবল পরমাণবিক শক্তির” আপেক্ষিক শক্তিমত্তার নির্দেশক হচ্ছে ε। আমরা জানি, সাধারণ হাইড্রজেনের কেন্দ্রে থাকে শুধু একটি প্রোটন। অন্য দিকে হিলিয়ামের কেন্দ্রে থাকে দুইটি প্রোটন ও দুইটি নিউট্রন। তাই হাইড্রজেন থেকে হিলিয়াম পেতে হলে প্রথমে আমাদেরকে দুটি হাইড্রজেনের কেন্দ্র জোড়া (ফিউস) লাগাতে হবে (proton-proton chain reaction)। এই ধাপে আমরা এমন একটা হাইড্রজেন পাবো যার কেন্দ্রে থাকবে একটা প্রোটন ও একটা নিউট্রন (এ প্রক্রিয়ায় একটি প্রোটন রূপান্তরিত হবে নিউট্রনে)। এই ধরনের হাইড্রোজেনকে বলে ডিউটেরিয়াম (Deuterium), এটি হাইড্রজেনের দ্বিতীয় আইসোটোপ। দ্বিতীয় ধাপে আমাদেরকে দুটি ডিউটেরিয়ামের কেন্দ্রকে জোড়া লাগাতে হবে (deuterium burning), তবেই আমরা পাব কাঙ্ক্ষিত হিলিয়াম।
এখন ধরুন ε-এর একটু কম, যেমন ε = ০.০০৬। তাহলে, “প্রবল পারমাণবিক শক্তি” হবে একটু কম শক্তিশালী এবং এই “একটু কম শক্তিশালী” “প্রবল পরমাণবিক শক্তি” ডিউটেরিয়াম তৈরির জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী না। ফলে, ফিউসন ঘটতো না, আমাদের মহাজগতে গ্রহ নক্ষত্র কিছুই থাকতো না, থাকত শুধুই হাইড্রজেন। অন্যদিকে, যদি ε = ০.০০৮ হতো, “প্রবল পারমাণবিক শক্তি” হতো একটু বেশী শক্তিশালী এবং এই “একটু বেশী শক্তিশালী” “প্রবল পারমাণবিক শক্তি” বিগ বাং-এর উচ্চ তাপে অতি অল্প সময়ে মহাজগতে সমস্ত হাইড্রজেন হিলিয়ামে রূপান্তরিত করতো। ফলে এতো দিনে মহাবিশ্বকে আলো দেয়ার জন্য কোনো নক্ষত্র জীবিত থাকতো না।
শুধু তাই নয়, ε-এর মান যদি ৪% এদিক সেদিক হতো, তবে মহাবিশ্বে কখনও কার্বন সৃষ্টি হতো না। সংক্ষেপে, হাইড্রজেন ফিউস হয়ে হিলিয়াম, আর হিলিয়াম ফিউস হয়ে কার্বন তৈরী হয়। হিলিয়াম ফিউসনের মাঝামাঝি ধাপে তৈরী হয় বেরিলিয়াম (beryllium)। আর এই বেরিলিয়াম ও হিলিয়ামের ফিউসনের হয় কার্বন। বেরিলিয়াম ধাপটি অতি সূক্ষ্ম। “প্রবল পারমাণবিক শক্তি”-এর সামান্য তারতম্যে এই “বেরেলিয়াম ধাপটি” হতো অত্যন্ত ভারসাম্যহীন। ফলে কার্বন সৃষ্টি হতো না। আর আমরা আমাদের আশেপাশে যত প্রাণ দেখি, সবই কার্বনভিত্তিক।
N, এর মান ১০^৩৬
এটি হচ্ছে “বৈদ্যুতিক-চুম্বকীয় শক্তি” মধ্যাকর্ষণের চেয়ে কতো গুণ শক্তিশালী তার নির্দেশক। অন্যভাবে বললে, বৈদ্যুতিক-চুম্বকীয় শক্তি মধ্যাকর্ষণ চেয়ে এক ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গুণ বেশী শক্তিশালী। “প্রবল পারমাণবিক শক্তি”, “দুর্বল পারমাণবিক শক্তি” এবং “বৈদ্যুতিক-চুম্বকীয় শক্তি” এদের শক্তিমত্তা কিছুটা কাছাকাছি। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ বাকিদের চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে। N প্রমাণ করে মাধ্যাকর্ষণ কতো দুর্বল একটা শক্তি।
এই মাধ্যাকর্ষণ যদি সামান্য দুর্বল হতো, তাহলে নক্ষত্রগুলো ঘনীভূত হতে পারতো না। এই অঘনীভূত গ্যাসপিণ্ডে ফিউসন ঘটাতে প্রয়োজন হতো অকল্পনীয় তাপের। ফলে নক্ষত্ররা জ্বলতো না, দিতো না কোনো আলো। এই মহাবিশ্ব হতো অন্ধকার ও প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এক জায়গা। অন্যদিকে, যদি মধ্যাকর্ষণ সামান্য শক্তিশালী হতো, পদার্থের ঘনীভূতকরণ প্রক্রিয়া হতো তীব্রতর, নক্ষত্রের তীব্র ঘনীভূত জ্বালানির ফিউসন হতো অনেক দ্রুত। ফলে, নক্ষত্র গুলো হতো অতি উজ্জ্বল ও অতি উত্তপ্ত, কিন্তু তাদের আয়ুও হতো অতি অল্প। অতি উজ্জ্বল ও অতি উত্তপ্ত সূর্য আমাদের এই পৃথিবীকে অনেক আগেই ছাই বানিয়ে ফেলতো।
? (ওমেগা): এর মান প্রায়* ১
আমাদের মহাবিশ্বে যত পদার্থ আছে, তাদের সব যদি আমরা সমান ভাবে মহাবিশ্বের প্রতিটি অংশে ছড়িয়ে দেই তাহলে প্রতি বর্গ মিটারে আমরা যে পরিমাণ পদার্থ পাবো তা মহাবিশ্বের “গড় ঘনত্ব” (Average Density)। আমরা জানি, আমাদের মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল। এই সম্প্রসারণশীলতা থামাতে দরকার মাধ্যাকর্ষণ। মাধ্যাকর্ষণ নির্ভর করে পদার্থের ভরের ওপর। ভর যত বেশি, মাধ্যাকর্ষণ ততো বেশি। হিসেব করে দেখা গেছে, প্রতি বর্গ মিটারে যদি আমরা ৪টি বা ৫টি হাইড্রোজেন অণু পাই, তবেই আমরা যথেষ্ট মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পাবো মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীলতা থামাতে। মহাবিশ্বের এই পদার্থ ঘনত্বকে বলে “চরম ঘনত্ব” (Critical Density)।
মহাবিশ্বের “গড় ঘনত্ব” এবং “চরম ঘনত্ব” এ দুটির অনুপাত হচ্ছে ?। অন্যভাবে, এটা আমাদের মহাবিশ্বের “আপেক্ষিক ঘনত্ব” বলা হয় । মহাবিশ্বের ঘনত্ব বের করা একটা জটিল বিষয়। এজন্য দৃশ্যমান পদার্থ (Barionic Matter যেমন প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি), অদৃশ্যমান পদার্থ (Dark Matter), ও আপেক্ষিক পদার্থ (Relativistic Matter যেমন ফোটন, নিউট্রিনো ইত্যাদি) সব ধরনের পদার্থ বিবেচনা করতে হয়। এখানে হাইড্রজেন অণুর ব্যবহার করা হয়ছে উদাহরণ হিসেবে।
যদি ?-এর মান একটু বেশি হতো, তবে প্রাণ শুরুর আগেই মধ্যাকর্ষণ মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ থামিয়ে দিতো আর ঠেলে দিতো মহাসংকোচনে (Big Crunch)। আর ?-এর মান যদি একটু কম হতো তবে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ চলতো চিরকাল কিন্তু অদ্ভুতভাবে। মহাবিশ্বের (স্থানকালের) সম্প্রসারণ হতো বাঁকা ভাবে। নীচের চিত্রটি দেখুন। খেয়াল করুন এমন স্থানকালে ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রী চেয়ে কম। সমান্তরাল রেখা গুলো আর সমান্তরাল থাকে না। বৃত্তের আচরণ বড়ই অদ্ভূত। আমরা যেই বিজ্ঞান জানি তা এই বক্র-সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের জন্য প্রযোজ্য নয়।
বলে রাখা ভালো , ?-এর মান (প্রায়) ১ হবার কারণে মহাবিশ্ব চিরসম্প্রসারণশীল, কিন্তু সেটা হয় স্থান-কালকে না বাঁকিয়ে (Flat)। ওপরে আমরা যে আলোচনা করেছি তা ?-র মিলিয়ন বিলিয়ন (১০^১৫) ভাগের এক ভাগ বিচ্যুতির জন্য যথেষ্ট!
আরেকটা ব্যাপার, আমরা জানি প্রতিটি কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা-দিগন্ত (Event Horizon) থাকে। কৃষ্ণগহ্বরগুলোর ঘটনা-দিগন্তের ভেতরে কী ঘটে আমরা কিছুই জানি না। আমাদের মহাবিশ্বেরও কিন্তু ঘটনা-দিগন্ত আছে। দুটির পার্থক্য এই যে, আমাদের বসবাস মহাবিশ্বের ঘটনা-দিগন্তের ভেতর। একে বলে দৃশ্যমান মহাবিশ্ব (Visible Universe)। মহাবিশ্বের ঘটনা-দিগন্তের বাহিরে কী ঘটে আমরা জানি না। প্রশ্ন করতে পারেন, কেন মহাবিশ্বের ঘটনা-দিগন্ত থাকে? সংক্ষেপে, আমরা জানি আমাদের স্থানীয়-গোষ্ঠীর ৩৬টি গ্যালাক্সি (Local Group) বাদে বাকী সব গ্যালাক্সিগুলো আমাদের ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে। এটি প্রথম আবিষ্কার করেন “এডউইন হাবল” তিনি আরো লক্ষ্য করেন, যেই গ্যালাক্সিগুলো আমাদের চেয়ে যত বেশী দূরে তাদের ছুটে চলার গতিও ততো বেশী। কিছু কিছু দূরবর্তী গ্যালাক্সিদের গতি প্রায় আলোর গতির কাছকাছি। মজার বিষয় হচ্ছে, এই সব গ্যালাক্সিদের স্হানীয় গতি (velocity with local point of reference) আলোর গতির তুলনায় অনেক অনেক কম। তাহলে কিভাবে তারা প্রায় আলোর গতিতে আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে ? মনে রাখবেন, আমাদের জানা বিজ্ঞানে শুধু একটি জিনিসই আছে যা আলোর গতি সমান কিংবা তারও দ্রুত বেগে চলতে পারে। আর এই জিনিসটি হচ্ছে “স্থানকাল” নিজেই। আরো ভালোভাবে বললে, স্থানকাল নিজেকে সম্প্রসারণ করতে পারে আলোর গতিতে বা তারও বেশী গতিতে। যতো দূরে যাওয়া যায় স্থানকালের সম্প্রসারণের এই গতিও ততো বেশী। একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে স্থানকালের সম্প্রসারণের গতি আলো গতির সমান, আর এই দূরত্বেই মহাবিশ্বের ঘটনা-দিগন্ত অবস্থিত। এই দূরত্বের বাহিরে স্থানকালের সম্প্রসারণের গতি আলো গতির চেয়ে বেশী। মহাবিশ্বের ঘটনা-দিগন্ত বাহিরে বহু গ্যালাক্সি থাকতে পারে যাদের আমরা কখনই দেখবো না।
আমাদের জানা বিজ্ঞানের কিন্তু সীমানা রয়েছে, এই সীমানা দুটি ধ্রুব (constant) দিয়ে নির্ধারিত। ওপরের সীমা হচ্ছে “C”, যা কিনা শূন্যস্থানে আলোর গতি এবং নিচের সীমা হচ্ছে “h” যা হচ্ছে প্ল্যাংক ধ্রুবক। এই দুইয়ের বাহিরে যা কিছু আছে তা নিশ্চিত করে বলাটা খুবই কঠিন।
যা হোক, ?-এর মান নির্ণয়ে আমরা শুধুমাত্র দৃশ্যমান মহাবিশ্ব বিবেচনা করি।
*WMAP কৃত্রিম উপগ্রহের পাঠানো তথ্য থেকে আমরা জানি ? + ? = ১, যা কিনা মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের “inflation theory“কে সমর্থন করে। ?-এর মানের দিকে খেয়াল করলে বুঝবেন কেনো ?-এর মান প্রায় ১।
? (ল্যামডা) -এর মান ১০^(-১২০)
সংখ্যাটা একটু কল্পনা করার চেষ্টা করুন। দশমিকের পর ১২০টি শূন্য, তারপর ১। ? হচ্ছে মহাজাগতিক ধ্রুব (Cosmological Constant) এর আরো নাম আছে “শূন্যস্থানের শক্তির ঘনত্ব ” (energy density of vacuum) বা “মাধ্যাকর্ষণ বিরোধী শক্তির ঘনত্ব” (energy density of anti-gravity)।
?-এর মান যদি একটু কম হতো তাহলে মাধ্যাকর্ষণ জয়ী হতো। মহাবিশ্ব বিগ ব্যাং থেকে বিগ ক্রাঞ্চের দিকে ছুটে যেতো প্রাণ সৃষ্টির আগেই। ?-এর মান যদি একটু বেশি হতো তাহলে মাধ্যাকর্ষণ বিরোধী শক্তি জয়ী হতো। এতদিনে হয়তো মহাবিশ্বের বেশীরভাগ বস্তু মহাবিশ্বের ঘটনা-দিগন্তের ওপারে চলে যেতো। পরিণতি হতো বিগ ব্যাং থেকে বিগ ফ্রীজ (big freeze) তাও প্রাণ সৃষ্টির আগেই।
Q-এর মান ১০^(-৫)
এটি হচ্ছে “কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড/CMB”-এর অনিয়মিতার/অমসৃণতার মাত্রা (Amplitude of Irregularities)। ধরে নিচ্ছি আপনারা জানেন CMB কী জিনিস। এই CMB কিন্তু মসৃণ নয়। অমসৃণ CMB ইঙ্গিত করে যে আমাদের মহাবিশ্বে পদার্থ দলা পাকানো অবস্হায় (Lumpy) এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
Q-এর মান যদি সামান্য কম হতো। মানে, CMB যদি একটু মসৃণ হতো, তাহলে বিগ ব্যাং-এর গ্যাস ও ধূলিকণা মহাবিশ্বে সমান ভাবে ছড়িয়ে যেতো, যা কোনো ভাবেই ঘনীভূত হয়ে গ্রহ, নক্ষত্র তৈরী করতে পারতো না। Q-এর মান যদি সামান্য বেশি হতো। মানে, CMB যদি একটু বেশী অমসৃণ হতো, তাহলে মহাবিশ্বে পদার্থগুলো এমনই বিশাল দলা পাকিয়ে থাকতো যে, এই বিশাল দলাগুলো অতি মধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে খুব তাড়াতাড়ি কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হতো। এই মহাবিশ্বে থাকতো শুধুই কৃষ্ণগহ্বর।
D (স্থানকালের স্থানমাত্রা ) এর মান ৩
আমরা যে স্থানকালের বাসিন্দা তার মাত্রা ৪। ৩টি স্থানমাত্রা (Space Dimension) ও ১টি কালমাত্রা/সময়মাত্রা (Time Dimension)। D হচ্ছে স্থানমাত্রার সংখ্যা।
D-এর মান যদি হতো ১ (ধরুন শুধু দৈর্ঘ্য), কোয়ান্টাম-তত্ত্ব মতে ১ স্থানমাত্রায় বস্তুর কণাগুলো (যেমন ইলেক্ট্রন , প্রোটন ইত্যাদি ) নিজেদের মধ্যে কোনো ক্রিয়াই করে না। তাই ১ স্থানমাত্রায় কোনো পদার্থই সৃষ্টি হতো না।
D-এর মান যদি হতো ২ (ধরুন শুধু দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ), তাহলে প্রাণ সৃষ্টি হতে পারতো না। খেয়াল করুন, ২ স্থানমাত্রার কোনো বস্তুর মধ্য দিয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছাতে হলে বস্তুটিকে দুই ভাগে ভাগ করতে হবে (যেহেতু উচ্চতা নেই তাই ওপর দিয়ে যেতে পারবেন না)। এবার চিন্তা করুন আপনি ২ স্থানমাত্রার একজন, তাহলে আপনি খাওয়া ও বাথরুম করার সাথে সাথে দুই ভাগ হয়ে যাবেন এবং অক্কা পাবেন।
D-এর মান যদি হতো ৪, আপনারা হয়তো জানেন নিউটনে “সামগ্রিক মাধ্যাকর্ষণ সূত্র” হচ্ছে একটি “বিপরীত বর্গক্ষেত্র সূত্র” (Inverse Square Law), কারণ এই সূত্রে দুরত্ব একটি বর্গ সংখ্যা (Squared Term) যা কিনা সূত্রের ভাজক/হর (denominator)। D = ৪-এর ক্ষেত্রে এই সূত্রটি হতো “বিপরীত ঘনক্ষেত্র সূত্র” (Inverse Cube Law), দূরত্ব হতো একটি ঘন সংখ্যা (Cubed Term)। পল রেনফাস্ট (Paul Ehrenfest) ১৯১৭ “Poisson-Laplace” সমীকরণ ব্যবহার করে ধারণা দেন যে, এক্ষেত্রে আবর্তনশীল যেকোন বস্তুর (কণা, গ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদি) কক্ষপথ হবে ভারসাম্যহীন। এলোমেলো চলাফেরা ও যখন তখন ধাক্কা খাওয়া হতো একটা সাধারণ বিষয়। ফলে, মহাবিশ্বে কোনো স্থিতিশীল বস্তু সৃষ্টি হতো না।
প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে স্ট্রিং-তত্ত্ব কিভাবে ৯ স্থান-মাত্রার (বা ১০ স্থান-মাত্রা) ধারণা দেয়? ব্যাপারটা বলা হয়েছিল দ্বিতীয় পর্বে, তিনের অতিরিক্ত স্থানমাত্রাগুলো ক্লাবিয়া-ওল আকারে থাকে। এবং এই স্থানমাত্রাগুলো প্ল্যাংক দৈর্ঘ্যেরও কম। এরা এতই ছোট যে মৌলিক কণারা পর্যন্ত এদের অস্তিত্ব টের পায় না।
বহুবিশ্ব ” (Multiverse):
এই ছয়টি সংখ্যা অনেকের জন্য মাথা ব্যথার কারণ। কিভাবে বিগ-ব্যাং এর মতো একটি অনিয়ন্ত্রিত ঘটনা একটি না দুটো না একেবারে ছয়টি সংখ্যা নিখুঁতভাবে তৈরি করলো সেটি নিয়ে যে বিতর্ক এখনো চলছে সেটি “Fine Tuned Universe” বা “Universe at Knife Edge” নামে পরিচিত। “Fine Tuned Universe”-এর বিভিন্ন ব্যাখ্যার মধ্যে যেটি এখন গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করেছে সেটি হচ্ছে “বহুবিশ্ব ” বা “Multiverse”। “বহুবিশ্ব”এখনো ধারণার পর্যায়ে রয়েছে। এতে বলা হয় বিগ ব্যাং-এর সময় শুধু একটি মহাবিশ্ব নয় বরং বহু মহাবিশ্ব তৈরী হয়েছিল। এই মহাবিশ্বগুলোর প্রতিটির মহাজাগতিক সংখ্যাগুলোর মান ভিন্ন। যাদের মান ভিন্ন তাদের হয়তো আমাদের মতো প্রাণের অস্তিত্ব নেই, কিন্তু এমনও হতে পারে এক বা একাধিক মহাবিশ্ব আছে যাদের মান আমাদের সমান। সেখানে আমাদের মতো জীব বৈচিত্র্য থাকা বিচিত্র কিছু না। ব্যাপারটা ধরুন, আপনি একটি কাপড়ের গুদামের মধ্যে দাঁড়ানো। আপনার সামনে কাপড়ের স্তূপ। বেশীরভাগ কাপড়ই হয়তো আপনার শরীরে মাপ মতো হবে না কিন্তু যদি ভাগ্যবান হন তবে একটি আর যদি খুব সৌভাগ্যবান হন তবে বেশ কয়েকটি পেয়ে যেতে পারেন একেবারে আপনার মাপ মতো।
বহুবিশ্ব ও স্ট্রিং-তত্ত্ব:
দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করেছিলাম স্ট্রিং-তত্ত্বের ১০ মাত্রার স্থানকাল (এম-তত্ত্বের ক্ষেত্রে ১১ মাত্রা) এবং কুঁচকানো “ক্লাবিয়া-ওল” স্থানমাত্রার কথা। স্টিং-তত্ত্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, স্ট্রিং-তত্ত্বের সমীকরণগুলোর সমাধান অসংখ্য ক্লাবিয়া-ওলের জন্য সত্য। এই অসংখ্য ক্লাবিয়া-ওল গুলোর মধ্যে কোনটা যে আমাদের মহাবিশ্বকে বর্ণনা করে সেটাই এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। অনেক বার চেষ্টা করা হয়েছে সমীকরণগুলোকে বিভিন্ন ভাবে ঢেলে সাজাতে যাতে সমাধানগুলো সীমিত সংখ্যক ক্লাবিয়া-ওল দেয়। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ। তাই অনেকেই মনে করেন , স্ট্রিং-তত্ত্ব প্রকৃতিগত ভাবেই একটি বহুবিশ্ব-তত্ত্ব। যেখানে প্রতিটি ক্লাবিয়া-ওল একটি একক মহাবিশ্ব ইঙ্গিত করে।
সমান্তরাল মহাবিশ্ব (Parallel Universe):
প্রশ্ন করতে পারেন , বহুবিশ্ব যদি সত্যিই থেকে থাকে তবে আমরা তাদের দেখি না কেন? ধারণা করা হয়, মহাবিশ্বগুলো একসাথে পাশাপাশি অবস্থান করে, কিন্তু তাদের প্রত্যেকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থায় (decoherent state) থাকে। ভালো করে বললে, প্রতিটি মহাবিশ্বের পদার্থ ও শক্তির অবস্থায় আলাদা ধরনের। এই কারণে, এক মহাবিশ্বের পদার্থ ও শক্তির আরেক মহাবিশ্বের পদার্থ ও শক্তির সাথে কোনো ক্রিয়া করে না। অনেকটা, আমরা হচ্ছি বেতার আর মহাবিশ্বগুলো হচ্ছে বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র। বেতারকে আপনি যেই তরঙ্গে টিউন করবেন ঠিক সেই তরঙ্গে যে কেন্দ্র সম্প্রচার করছে তার বার্তা আপনি শুনতে পারবেন। আমদের টিউনিং এই মহাবিশ্বের সাথে তাই আমরা এই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি।
এখানেও একটা মজার ধারণা আছে, বলা হয়, মাধ্যাকর্ষণ অতি দুর্বল হবার একটা কারণ হতে পারে, মাধ্যাকর্ষণের পরিব্যাপ্ত সব মহাবিশ্ব জুড়ে। অসংখ্য মহাবিশ্ব মাধ্যাকর্ষণকে নিজেদের মাঝে ভাগাভাগি করে নেয়। তাই আমাদের ভাগের মাধ্যাকর্ষণ এত দুর্বল। এটা যদি সত্য হয় তবে, নিকট ভবিষ্যতে আমরা হয়তো মাধ্যাকর্ষণের মাধ্যমে অন্য মহাবিশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে পারবো।
তথ্যসূত্র:
“Parallel Worlds” by “Michio Kaku” অবলম্বনে