প্রথমবারের মত যখন মানুষ আগুন জ্বালাতে শিখলো, আগুনে ঝলসে খাবার খেতে শিখলো, কেমন ছিল সেই সময়টা? আগুন দিয়ে খাবার ঝলসানোর ( বা খাবার তৈরিতে আগুনের ব্যবহার) শুরু ঠিক কোন ঘটনা থেকে তা হয়তো আমরা একেবারে নির্দিষ্ট করে কখনো জানতে পারবো না। তবে এটা আমাদের কল্পনার চোখে সেইদিনটাকে দেখার একটা প্রচেষ্টা। সেই সময়টাকে কল্পনায় এঁকে গল্পে রূপ দেয়ার প্রচেষ্টা। ভবিষ্যৎ নিয়ে তো অনেক সায়েন্স ফিকশন হলো। এটাকে বলতে পারেন অতীতকে নিয়ে লেখা সায়েন্স ফিকশন। বলতে পারেন বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে অতীতকে নিয়ে রূপকথা লেখার একটা প্রচেষ্টা।
দৃশ্য-১
বেশ বড়সড় সাইজের কয়েকটা মোষ শিকার হয়েছে আজ। ধারালো হাতিয়ার দিয়ে ছাড়ানো হয়েছে চামড়াগুলো। রোদে শুকিয়ে পরে ব্যবহার করা হবে। আর হাড়গুলো আলাদা করে শুকানো হবে পরে হাতিয়ার তৈরির কাজে ব্যবহারের জন্য। মাঝে কয়েকদিনের ক্ষুধার্ত সকলের চোখ যেন আনন্দে চক চক করছে। কিন্তু না, এখনই খাওয়া যাবে না।
আগুন জ্বালানো হয়েছে মাঠের মাঝে। রাতের আঁধারে সেই আগুনে আলোয় দারুণ লাগছে চারিদিক। গোত্রের ছেলে মেয়ে, শিশু বুড়ো সবাই আগুন ঘিরে নাচছে, গান গাইছে। এভাবে খাদ্যের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছে কল্পনার ঈশ্বরকে। পাশে স্তূপ করে রাখা ছোট ছোট করে কাটা মাংস।
সবার সাথে আনন্দ করতে করতে যেন একটু আনমনা হয়ে গেল “ঘ্যাং”! ভাবছে, মহিষগুলোকে আক্রমণের মুহূর্তগুলোর কথা। কী ভয়ানক কষ্ট করে ওদের ধরেছে, মেরেছে! আর এখন? ধন্যবাদটা যেখানে যারা ধরেছে তাদের পাবার কথা সেখানে পাচ্ছে অন্য কেউ। হ্যা, লেজের গোছা দিয়ে মাথার পিছে ঝুঁটি বাঁধানোর সম্মান দেয়ার চেষ্টা হয়েছে ঠিকই; কিন্তু এমন ধন্যবাদ পেলো কই! একটু যেন অভিমান হলো।
অন্যমনস্ক থাকাতেই নাচতে নাচতে হঠাৎ পাশের জনের পায়ে পা লেগে আচমকা পড়ে গেলো। পড়লো তো পড়লো একেবারে মাংসের টুকরোগুলোর ওপর। ওর ভার সামলাতে না পেরে ছড়িয়ে পড়লো টুকরোগুলো। প্রায় সবগুলো মাংসই গিয়ে পড়লো আগুনের মাঝে। মুহূর্তেই বদলে গেল পরিবেশ। আনন্দের মাঝে হঠাৎ চলে এলো আতংক!
নাচ গান ফেলে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। কেউ কেউ চিৎকার করতে লাগলো। কেউ লম্বা কোনো ডালের খোঁজে, যা দিয়ে মাংসগুলোকে আগুন থেকে সরাবে। আর প্রায় সবাইই ঘ্যাংকে গালাগাল করতে লাগলো মাংসগুলোর এই অবস্থা করার জন্য। সবার চোখেই ভয়। এতদিন পর পাওয়া খাবার হাতছাড়া হওয়ার ভয়। আরো অজানা দিন না খেয়ে থাকার ভয়।
ঘ্যাং নিজেও ভয়ে কুঁকড়ে গেলো। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেয়ার এই অনুষ্ঠানে ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হওয়াতেই কি ঈশ্বরের এই শাস্তি?
প্রায় এক ঘণ্টার মত চেষ্টার পর উদ্ধার হল কিছু মাংস। বেশীরভাগই পুড়ে গেছে আগুনে। সামান্য কিছু কাঁচা বাঁচানো গেছে।
কাঁদছে গোত্রের অনেকে। এতগুলো খাবার হারানোর শোক সইতে পারছে না। এমন সময় গোত্রের এক কিশোর কী মনে করে খানিক পর আগুনে ঝলসানো মাংসের একটা টুকরো হাতে তুলে নিলো। মুখে দিতেই আনন্দের আতিশয্যে নেচে উঠলো। গোত্রের অন্যরা তো অবাক! কাহিনী কী?!
একে একে সবাই ছুটলো ঝলসানো মাংসগুলো চেখে দেখতে, খানিক আগেও যেগুলো ওরা বাতিল ভেবেছিলো।
আগুনে পোড়া মাংসের স্বাদ, নরম শরীর, সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। সবাই এবার ঘ্যাং এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর এদিকে ঘ্যাং মনে মনে ভাবতে থাকে, “ঈশ্বরের অভিশাপ! খ্যাঁক খ্যাঁক!”
শুরু হলো খাবারে আগুনের ব্যবহার।
দৃশ্য-২
কেন যেন একা একা ঘুরতে ভাল লাগে গ্যাক-এর। আজ বেরিয়েছে পাহাড়ের ওপরে থাকা খরগোশগুলোকে চেখে দেখবে বলে। পাকা শিকারী যাকে বলে গ্যাক তা-ই। হাতের নিশানা অসাধারণ, তাই একা হলেও সমস্যা হয় না। অনেক সময় হাতিয়ারও ব্যবহার করে না, বিশাল থাবা আর প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে জাপটে মেরে ফেলে শিকারকে! একা থাকা তাই ওর জন্য কোনো সমস্যাই না। শুধু গোত্রের সবাই যখন একসাথে বের হতে বাধ্য করে তখন বিরক্ত লাগলেও বেরুতে হয়, কারণ গোত্রের বাইরে গিয়ে বাঁচা সম্ভব না এই জঙ্গলে। আজ অবশ্য সেই সমস্যা নেই।
হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের মাঝামাঝিতে উঠে এসে দাঁড়ালো গ্যাক। এই জায়গাটা প্রায় সমতল। আশপাশটায় খরগোশের গর্তে ভর্তি।
ঝোপের আড়াল থেকে একটা খরগোশের গায়ে ছুঁড়ে মারে তার তীক্ষ্ম অস্ত্র। কিছুক্ষণ আর্তনাদ করে মারা যায় খরগোশটা।
মৃত খরগোশটাকে তুলে নিয়ে পিঠের ওপর রাখলো। আরো ক’টা ধরার ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু চোখ পড়লো হঠাৎ পাহাড়ের অন্যদিকে। ওদিকটাতে কেমন যেন ছাইয়ের স্তূপ দেখছে, মনে হচ্ছে ধ্বংস হয়ে গেছে বেশ বড় একটা জায়গা …
খরগোশ ধরা বাদ দিয়ে ঐদিকটাতে গেল গ্যাক। গতকাল রাতে একটা আওয়াজ শুনেছিলো অবশ্য। আকাশ থেকে কিছু পড়ার আওয়াজ। এখন মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা এখানেই ঘটেছে। কী যে পড়েছে, এই জায়গাটা দুমড়ে বিরাট গর্ত হয়ে গেছে, আবছা আগুনের তাপ আসছে যেন গর্ত থেকে…
আরেকটু ভাল করে দেখতে যাবে গ্যাক, অমনি ওর পিঠ থেকে পিছলে পড়ে গেল মৃত খরগোশের দেহটা। গ্যাক সবকিছু ছাড়তে পারে, কিন্তু শিকার করা খাবারকে ছাড়তে রাজী না।
দ্রুত বড় একটা ডাল খুঁজে এনে, অনেক কষ্টে খোঁচাতে খোঁচাতে শেষ পর্যন্ত তুলে আনলো দেহটাকে। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে তপ্ত ছাইয়ের নিচে থাকায় এটা বেশ গরম। হালকা ঝলসানো অবস্থা যেন।
নিজের ওপর রাগ হচ্ছিলো গ্যাক এর। কী দরকার ছিল এখানে আসার, এখন খাবারটাই নষ্ট হল!
তবুও কী মনে করে খানিক ঠাণ্ডা হবার পর চামড়াটা ছিলে মাংসটা মুখে দিল গ্যাক। কাঁচা মাংসে অভ্যস্ত গ্যাকের জিব কেমন যেন অদ্ভুত এক স্বাদ পেল। হালকা নরম অনুভূতি পেল তীক্ষ্ম শক্তিশালী দাঁত। “দারুন তো” নিজ মনেই বলে উঠলো গ্যাক। পেট পুরে ঝলসানো খরগোশ খেয়ে ফেরার পর গোত্রের অন্যদের জানালো এই ঘটনা। ব্যস শুরু হল খাবারে আগুনের ব্যবহার…
………
আমি জানিনা, দৃশ্য-১ নাকি দৃশ্য-২ নাকি অন্য কোনো গল্প আছে মানুষের প্রথম কাঁচা খাবার ছেড়ে আগুন ব্যবহার করে খাবার বানানোর পেছনে, পরবর্তীতে যেটা রান্না অবদি গড়ালো।
কিন্তু একটা জিনিস জানি, যদি কখনো টাইম মেশিনে করে অতীতে যেতে পারি তাহলে ঘ্যাং আর গ্যাকদের এই বর্তমান সময়ে নিয়ে এসে রান্নাঘরগুলোতে নিয়ে যাবো, দেখাবো কী অবলীলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্বলতে থাকে গ্যাসের চুলা যেখানে খাবার ঝলসানোর জন্য সামান্য আগুনের ব্যবস্থা করতে কী অমানুষিক খাটুনিই না খাটতে হতো ওদের…
আমি নিশ্চিত, ওদের হাতে থাকা মহিষের পেছনের পায়ের হাড় দিয়ে তৈরি মুগুরের মত হাতিয়ারটা দিয়া ঐ সময়েই এই সব মানুষগোরে ওরা ইচ্ছামত বাইরাইতো, আর আমি সেই দৃশ্য দেইখা মনে শান্তি পাইতাম।
কল্পনায় গেলাম অতীতে! এমন কিছু দেখলাম মনে হলো!!!
প্রচেষ্টা তাইলে কিছুটা সার্থক! কী বলেন?
অনেকটা। তবে, পিপাসা থেকে গেল! ?
ঝলসানো মাংসের স্বাদ কি তখনকার মানুষের আসলেই ভাল লেগেছিল? তখনও তো জিহ্বার taste bud ঝলসানো মাংসের স্বাদ ভাল লাগার জন্য বিবর্তিত হওয়ার কথা না.. 🙂
ভালো লাগার মত লেখা। অসংখ্য ধন্যবাদ লেখককে।