এই ক’দিন নভেল করোনা ভাইরাস প্যান্ডেমিকে দেশজুড়ে লকডাউনের সময় নিশ্চয়ই খেয়াল করেছিলেন পরিবেশ কতোটা নির্মল হয়ে গেছে? আমরা সকালে ঝকঝকে নীল আকাশ দেখছি, রাতে ধোঁয়াশাশূন্য মেঘমুক্ত আকাশে দু’চোখ ভরে দেখছি তারার মেলা। কিছুটা হলেও সুস্থিরভাবে নিতে পারছি নিঃশ্বাস। কিন্তু এ যেন ক্ষণস্থায়ী সুখ, কিছুটা যেন স্বপ্নের মতো! নগরজীবন আবার আগের মতো ব্যস্ত হবে, আর তার সাথে হয়তো শেষ হবে এই আপাত স্বস্তির দিনগুলো।
ভারতের মহানগরগুলোতে বায়ুদূষণের মাত্রা আকাশছোঁয়া। তবে শুধুমাত্র ভারত নয়, বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও বায়ুদূষণের সামগ্রিক ছবিটা প্রায় একই রকম। বায়ুদূষণের মারাত্মক প্রভাবে মানুষের দেহের প্রভূত ক্ষতিসাধন হয়- তা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু বায়ুদূষণে মানসিক স্বাস্থ্যেরও যে যথেষ্ট ক্ষতি হয়, তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই। আর কারা সবচেয়ে বেশি এই ক্ষতির শিকার হয় জানেন? ছোট শিশুরা। হ্যাঁ, সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এই চিন্তাজনক তথ্য উঠে এসেছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে সাত লক্ষেরও বেশি মানুষ বায়ুদূষণের প্রভাবে অসুস্থ হয়ে মারা যান। গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুতে মিশে থাকা ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, গ্রাউন্ডলেয়ার ওজোন, কার্বন-মনোঅক্সাইড, গ্যাসোলিন, বিভিন্ন ক্ষতিকারক অ্যারোমেটিক কম্পাউন্ড, অতি সূক্ষ্ম কার্বন এবং অ্যাসবেসটস কণিকার প্রভাবে আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ব্যাপকহারে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সেগুলোর মধ্যে ফুসফুস, চোখ ও ত্বকের মতো মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রধান। ফলস্বরূপ- অ্যালার্জি, অ্যাজমা, ইন্টারস্টিশিয়াল লাং ডিজিজ এমনকি ক্যানসারের মতো ভয়াবহ রোগের সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানীরা সাম্প্রতিককালে আবিষ্কার করেছেন, বায়ুদূষণে মানবদেহের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে নিউরোকোগনিটিভ ডিসঅর্ডারের মতো স্নায়বিক জটিলতার সৃষ্টি করে। আর ক্রমবর্ধমান বায়ুদূষণ ভয়াবহ প্রভাব ফেলে ছোট শিশুদের সবুজ, কোমল, সংবেদনশীল মনে। ইউনিভার্সিটি অফ সিনসিনাটির বিজ্ঞানী ডঃ কোল ব্রোকাম্প এবং ডঃ প্যাট্রিক রায়ান দীর্ঘ গবেষণা করে এই তথ্য সামনে এনেছেন। তাঁদের গবেষণা বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা “এনভায়ারমেণ্টাল হেল্থ পারস্পেকটিভ” গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
বিজ্ঞানীদের মতে, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ঘরে ও বাইরে দুই জায়গাতেই বায়ুদূষণের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। আর্থিকভাবে অনুন্নত জনগোষ্ঠীর বসবাসস্থলে কয়লা-কেরোসিন-কাঠের উনুনের ধোঁয়ায়, চুরুট-বিড়ি-সিগারেটের অস্বাস্থ্যকর ধোঁয়ায় (যেখানে শিশুরা প্যাসিভ স্মোকিং-এর শিকার হয়) শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। এছাড়া, বাড়ির বাইরেও যখন শিশুরা খেলা করে, স্কুলে যায়, সেই যাতায়াতের পথেও গাড়ির ধুলো-ধোঁয়া, কনস্ট্রাকশনের থেকে সৃষ্ট সিমেন্ট, অ্যাসবেসটস, কোয়ার্জ এবং কার্বন পার্টিকলস এর দূষণ তাদের ফুসফুস, ত্বক ও মস্তিষ্কের যথেষ্ট ক্ষতি করে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে সমস্ত শিশুরা বর্ধিত দূষণমাত্রায় দৈনন্দিন ঘরের বাইরে, রাস্তায় দিনের মধ্যে বেশ কিছুটা সময় থাকে এবং গণপরিবহনে যাতায়াত করে, তাদের মধ্যে বিভিন্ন মানসিক জটিলতা ও স্নায়বিক অসুস্থতা দেখা যায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৬ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুরা এবং ১৩ থেকে ১৭ বছরের কিশোরদের মধ্যে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে মানসিক জড়তা, দুশ্চিন্তা, মনঃসংযোগহীনতা, অবসাদ ও আত্মহত্যা প্রবণতার মতো মানসিক অসুস্থতা। ছোট শিশুদের মস্তিষ্কে ‘সাইকোমোটোর ডেভেলপমেন্ট’ প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে, স্বাভাবিক মানসিক বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে উঠছে বায়ুদূষণ। গবেষণায় আরও বিশদে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বলা হয়েছে, যেমন- উন্নতিশীল দেশগুলিতে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে যে সমস্ত পরিবারের শিশু ও কিশোররা ঠিকমতো সুষম খাদ্য ও পরিপোষণ পায় না, বায়ুদূষণের প্রভাবে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য অবনতির ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। দীর্ঘকালীন অপুষ্টি ও অবসাদগ্রস্থ শরীরে, বায়ুদূষণের প্রকোপে কম বয়সে দেখা দিতে পারে- অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার, ডিমেনশিয়া, সিজোফ্রেনিয়া এবং বাইপোলার ডিজঅর্ডার এর মতো মারাত্মক মানসিক অসুস্থতা।
এখন মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, কীভাবে ক্রমবর্ধমান বায়ুদূষণ শিশু ও কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য অবনতির কারণ হয়ে ওঠে?
এর বৈজ্ঞানিক কারণ হচ্ছে, বায়ুতে ভাসমান বিভিন্ন বায়ুদূষক বা এয়ার পলিউট্যান্ট, যেমন- ধুলো, প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্যপদার্থের অসম্পূর্ণ দহনের ফলে উৎপন্ন বিষাক্ত গ্যাসের মিশ্রণ ও যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় উপস্থিত অতি সূক্ষ্ম কনিকা, যাকে ‘স্মল পার্টিকুলেটম্যাটার’ (PM 2.5) বলে, সেগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। এই সমস্ত কণিকাগুলির আকার ২.৫ মাইক্রনের কম হওয়ার জন্যে সহজেই নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে ফুসফুসের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এমনকি এই সূক্ষ্ম কণিকাগুলি রক্তসংবহনের মাধ্যমে মস্তিস্কের ‘ব্লাড-ব্রেন-ব্যারিয়ার’ ভেদ করে স্নায়ুকোষে প্রবেশ করে তাদের দ্রুত নষ্ট করতে থাকে। এই ঘটনার ফলে শুরু হয় স্নায়ুপ্রদাহ জনিত সমস্যা, যার থেকে তৈরি হয় নানা ব্যবহারজনিত অস্বাভাবিকতা, যেমন- মানসিক জড়তা, অবসাদ, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি। দীর্ঘদিনব্যাপী এই স্নায়বিক প্রদাহ চললে ক্রমশঃ অ্যালঝেইমার, পার্কিনসন্স ডিসিসের মতো রোগও হতে পারে।
আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশগুলোতে বায়ুদূষণের মাত্রা ভয়ঙ্কর ভাবে বেড়ে চলেছে। ভারতের বিভিন্ন শহরগুলোতে মাত্রাধিক যানবাহন চলাচলের ফলে তাদের থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়ায় ও বহুতল নির্মাণের কনস্ট্রাকশন সাইটগুলোর কাছাকাছি ভাসমান বায়ুস্তরে দীর্ঘক্ষণ মিশে থাকে অসংখ্য স্মল পার্টিকুলেট ম্যাটার 2.5! চিন্তার বিষয় হলো, মাটিতে এদের অধঃক্ষেপণের হার ভীষণ কম। ফলে, সহজেই নিঃশ্বাসের সাথে শিশুদের শরীরে নির্দ্বিধায় প্রবেশ করছে এই দূষিত বায়ু। এছাড়া, গর্ভবতী মায়েদের উপরেও বায়ুদূষণের প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এই স্মল পার্টিকুলেট ম্যাটার জনিত দূষণে ক্ষতি হতে পারে গর্ভস্থ ভ্রূণের। চিকিৎসকরা দেখেছেন, 2.5 মাইক্রনের সুক্ষ্ম কণিকা গর্ভস্থ শিশুর ফুসফুসে প্রবেশ করে। এতে শিশুর গর্ভাবস্থায় মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়াও, বায়ুদূষণের প্রভাবে গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ও স্নায়বিক জটিলতার সৃষ্টি হয়। এতে জন্মের পর শিশু অপরিণত মনের ও জড়বুদ্ধিসম্পন্ন হতে পারে।
এই বায়ুদূষণ প্রতিহত করতে দরকার ব্যাপক জনসচেতনতা। সারা বিশ্বে এখনো বহু শিশু অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান, অশিক্ষা, দারিদ্র্য, অপুষ্টির মতো বৃহৎ সমস্যাগুলোর সাথে দৈনন্দিন লড়াই করে। এই কোমল, সবুজ মনগুলিকে বাঁচিয়ে রেখে বিকশিত করার দায়িত্ব আমাদের সবার। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মূল্যবান শৈশব দূষণমুক্ত পরিবেশে যত্নে লালিত হোক, এই অঙ্গীকার জাগ্রত থাকুক মানুষের মনে।
ডঃ শুভময় ব্যানার্জি
প্রাক্তন গবেষক (ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়া এবং সিটি অফ হোপ ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট, ইউএসএ)
ও সহ-অধ্যাপক (অ্যামিটি ইউনিভার্সিটি, দিল্লি)
তথ্যসূত্রঃ
- Cole Brokamp, Jeffrey R. Strawn, Andrew F. Beck, Patrick Ryan. Pediatric Psychiatric Emergency Department Utilization and Fine Particulate Matter: A Case-Crossover Study. Environmental Health Perspectives, 2019; 127 (9): 097006
- Costa LG, Cole TB, Dao K, Chang YC, Garrick JM. Developmental impact of air pollution on brain function. Neurochem Int. 2019 Dec;131:104580. doi: 10.1016/j.neuint.2019.104580. Epub 2019 Oct 15. PMID: 31626830; PMCID: PMC6892600.
- Tzivian L, Winkler A, Dlugaj M, Schikowski T, Vossoughi M, Fuks K, Weinmayr G, Hoffmann B. Effect of long-term outdoor air pollution and noise on cognitive and psychological functions in adults. Int J Hyg Environ Health. 2015 Jan;218(1):1-11. doi: 10.1016/j.ijheh.2014.08.002. Epub 2014 Sep 3. PMID: 25242804.
- Kumar P, Druckman A, Gallagher J, Gatersleben B, Allison S, Eisenman TS, Hoang U, Hama S, Tiwari A, Sharma A, Abhijith KV, Adlakha D, McNabola A, Astell-Burt T, Feng X, Skeldon AC, de Lusignan S, Morawska L. The nexus between air pollution, green infrastructure and human health. Environ Int. 2019 Dec;133(Pt A):105181. doi: 10.1016/j.envint.2019.105181. Epub 2019 Oct 29. PMID: 31675531.
- Thomson EM. Air Pollution, Stress, and Allostatic Load: Linking Systemic and Central Nervous System Impacts. J Alzheimers Dis. 2019;69(3):597-614. doi: 10.3233/JAD-190015. PMID: 31127781; PMCID: PMC6598002.
- Buoli M, Grassi S, Caldiroli A, Carnevali GS, Mucci F, Iodice S, Cantone L, Pergoli L, Bollati V. Is there a link between air pollution and mental disorders? Environ Int. 2018 Sep;118:154-168. doi: 10.1016/j.envint.2018.05.044. Epub 2018 Jun 5. PMID: 29883762.
- Hankey S, Marshall JD. Urban Form, Air Pollution, and Health. Curr Environ Health Rep. 2017 Dec;4(4):491-503. doi: 10.1007/s40572-017-0167-7. PMID: 29052114.
- Korten I, Ramsey K, Latzin P. Air pollution during pregnancy and lung development in the child. Paediatr Respir Rev. 2017 Jan;21:38-46. doi: 10.1016/j.prrv.2016.08.008. Epub 2016 Aug 19. PMID: 27665510.
- Grippo A, Zhang J, Chu L, Guo Y, Qiao L, Zhang J, Myneni AA, Mu L. Air pollution exposure during pregnancy and spontaneous abortion and stillbirth. Rev Environ Health. 2018 Sep 25;33(3):247-264. doi: 10.1515/reveh-2017-0033. PMID: 29975668; PMCID: PMC7183911.
লেখক পরিচিতিঃ
ডঃ শুভময় ব্যানার্জী, পি.এইচ.ডি
ডঃ শুভময় ব্যানার্জী দিল্লি-র অ্যামিটি ইউনিভার্সিটি-তে ভাইরোলজি এবং ইমিউনোলজি বিভাগে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে অধ্যাপনা করেছেন। উনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্যান্সার বায়োলজিতে পিএইচডি এবং পরবর্তীকালে ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়া-র স্কুল অফ মেডিসিন-এ এবং সিটি অফ হোপ ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট-এ (ক্যালিফর্নিয়া) ভাইরাল অনকোলজি বিষয়ে পোস্টডক্টরাল গবেষণা করেন। সম্প্রতি লেখক অধ্যাপনা, লেখালেখি, ক্যান্সার গবেষণা ও সচেতনতা প্রসারের কাজে যুক্ত।