সেন্ট লুইস হলো আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরি অঙ্গরাজ্যের অন্যতম প্রধান শহর। এ শহরে ‘সেন্ট লুইস সায়েন্স সেন্টার’ নামে একটা অসাধারণ প্রতিষ্ঠান আছে। জনসাধারণের কাছে বিজ্ঞানকে পৌঁছে দিতে, কিংবা বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো সহজভাবে উপস্থাপন করতে এর তুলনা নেই! বিভিন্ন তথ্যচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে বিজ্ঞানকে আকর্ষণীয় করে তোলার কাজও এটা করে যাচ্ছে। এ সেন্টারে ঘোরাঘুরি ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতাগুলোর একটা। সে এক জগত বটে! আমেরিকার সায়েন্স সেন্টারগুলোর খ্যাতি আকাশছোঁয়া। কিন্তু কেন এত খ্যাতি, সেটা না দেখলে বুঝা যায় না। ২০১৮ সালের ২৬ আগস্ট সে মোক্ষলাভ ঘটেছিল। আমি আর প্রিন্স গিয়েছিলাম সেন্ট লুইস সায়েন্স সেন্টারে। আমি পড়াশোনা করছি সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে সূত্রে থাকি সেন্ট লুইস শহরে। শহরের যে প্রান্তে থাকি, সেখান থেকে সায়েন্স সেন্টার ত্রিশ মিনিটের রাস্তা। কিছুটা বাসে করে, কিছুটা হেঁটে যেতে হয়। বাস থেকে নেমে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই সেন্টার। হাঁটার পথে পড়ে সেন্ট লুইস ইউনিভার্সিটি হাই স্কুল। এটা শুধুমাত্র ছেলেদের জন্য নির্মিত একটা নামকরা স্কুল। সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের মত এই বিদ্যালয়ও নির্মাণ করেছিলেন জেজুইট সম্প্রদায়ের পাদ্রীগণ, ১৮১৮ সালে। স্কুল পার হয়ে আরেকটু হাঁটলে সেন্টারের গেট। ঐদিন রবিবার ছিল বলে অনেক মানুষকে দেখলাম সেন্টারের দিকে যাচ্ছে। বাবা-মাকে দেখলাম ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছেন। তরুণ তরুণীদের দেখলাম দলবল নিয়ে এসেছে। জমজমাট পরিবেশ। একটা দলের সাথে আমরাও ঢুকে গেলাম ভিতরে। কোনো প্রবেশমূল্য নেই, পুরোটাই ফ্রি। শুধু ডকুমেন্টারি দেখার বেলায় টিকেট কাটতে হবে।
ঢুকে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। বিশাল বড় একটা হলরুমে এসে পড়েছি। ডানে গেলে একটা সেকশন, সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলে আরেকটা, উপরে উঠলে আরেকটা। ঠিক করলাম প্রথমে ডানে যাব। গিয়ে প্রথমেই যে জিনিসটা দেখলাম সেটা একটা প্লাস্টিকের শরীর। এর বিশেষত্ব হল দেহের ভিতরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আর শিরা-ধমনী দেখা যাচ্ছে। বর্ণনা পড়ে বুঝলাম আমি ঐতিহাসিক একটা নমুনার দিকে তাকিয়ে আছি। এর নাম ‘স্বচ্ছ মানবী’ বা ট্রান্সপারেন্ট উওম্যান। ১৯৩০-এর দিকে জার্মানির কোলোন শহরে প্রথম এ ধরনের মডেল তৈরি করা হয়। ত্রিশ বছর গবেষণার পর শারীরবিদরা দেহাভ্যন্তরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঠিক মাপে এবং অবস্থানে রেখে এই মডেল তৈরি করতে সক্ষম হন। মডেলটি নির্মাণ করতে ব্যবহৃত হয়েছে প্লেক্সিগ্লাস, যেটা দিয়ে স্বচ্ছতা আনা হয়েছে; অ্যালুমিনিয়াম ধাতু, যেটা দিয়ে কংকাল বানানো হয়েছে; কয়েক’শ ফুট লাইটিং তার যা দিয়ে শিরা-উপশিরা-ধমনী বানানো হয়েছে; ত্রিশটা ছোট বাতি যেগুলো দিয়ে দেহের অঙ্গ বুঝানো হয়; এবং বিশেষায়িত লাইটিং সিস্টেম যা সমন্বয় করা হয়েছিল একটা রেকর্ড করা বক্তৃতার সাথে যেন বক্তৃতায় নির্দিষ্ট অঙ্গের নাম বলার সাথে সাথে সেখানকার লাইট জ্বলে উঠে। দেহটির ছাঁচ বানানো হয়েছিল পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি লম্বা এবং আঠাশ বছর বয়সী এক নাম না জানা তরুণীর দেহ হতে। আমরা তার নাম না জানি, কিন্তু সে চির অমর হয়ে রইল চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে। মডেলটি শারীরবিদ্যা অনুযায়ী একদম সঠিক। অর্থাৎ এতে স্থাপিত অঙ্গ এবং রক্তনালীর রঙ, আকার-আকৃতি আর অবস্থান সম্পূর্ণ সঠিক। জার্মান শিক্ষাবিদরা শারীরবিদ্যা শেখানোর জন্য ট্রান্সপারেন্ট উওম্যান মডেলটি ব্যবহার করতেন। সেন্ট লুইস সায়েন্স সেন্টার ১৯৬০ সালে ট্রান্সপারেন্ট উওম্যানের একটা মডেল কেনে এবং প্রদর্শনীতে রাখে, যেটা আপনারা দেখছেন।
এরপর দেখলাম কনুই, নিতম্ব আর হাঁটুর সংযোগস্থলের কার্যপ্রণালী। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হওয়া তিনটা যন্ত্রাংশ দিয়ে শরীরের তিনটা সংযোগের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। কী চমৎকার! যেমন, হাঁটুর জয়েন্ট কীভাবে কাজ করে সেটা বুঝানোর জন্য একটা hinge রাখা আছে। এটা কেবল একদিকে ভাঁজ হয়। আপনার হাঁটুও শুধু পেছন দিকে ভাঁজ হয়। তাই না? আবার কনুইয়ের সংযোগ কীভাবে কাজ করে সেটা বুঝানোর জন্য একটা পিভট জয়েন্ট রাখা আছে। এই জয়েন্ট ঘুরিয়ে দেখলে বুঝা যায় আমাদের কনুইয়ের সংযোগস্থল কীভাবে কাজ করে। আমাদের কনুই তিনটা হাড়ের সংযোগে গঠিত। উপরের বাহুর হাড় যার নাম হিউমেরাস, যুক্ত হয় নিচের বাহুর দুটো হাড়ের সাথে যাদের নাম রেডিয়াস এবং আলনা। কনুইও হাঁটুর মত কেবল একদিকে ভাঁজ করা যায়। কেউ কি আছেন কনুই পিছনের দিকেও ভাঁজ করতে পারেন? এবার দুই হাত টান টান করে দু’পাশে ছড়িয়ে দিন। হাতের তালু যেন নিচের দিকে থাকে। এবার শুধু তালু ঘুরিয়ে উপরের দিকে উঠান। কী দেখলেন? উপরের বাহু না নড়িয়ে কেবল নিচের বাহুকে মুচড়ে আপনি তালু উপর-নিচ করতে পারছেন। এটাই পিভট জয়েন্টের কার্যপ্রণালী। এরপর দেখলাম নিতম্বের জারিজুরি। নিতম্বের সংযোগস্থলের গালভরা একটা নাম আছে – বল অ্যান্ড সকেট জয়েন্ট। একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন কেন এমন নামকরণ। নিতম্বের হাড়ে একটা কাপ আকৃতির সকেট আছে (এর নাম অ্যাসেটাবুলাম), যেটার মধ্যে উরুর হাড়ের গোল মাথা প্রবেশ করে। এই হাড়ের নাম আপনাদের খুবই পরিচিত, ফিমার। প্রবেশ করার পর অ্যাসেটাবুলাম আর ফিমার মিলে একটা জয়েন্ট তৈরি করে। এরকম জয়েন্টের কারণে উরুর হাড় অনেকখানি বিস্তৃত হতে পারে। জিমন্যাস্টিকস দেখে থাকলে নিশ্চয় কল্পনা করে ফেলেছেন কীভাবে ওরা দুই পা মাটির সমান্তরালে ছড়িয়ে দেয়? এই বল অ্যান্ড সকেট জয়েন্টের কারণেই এমনটা সম্ভব হয়।
এবার চলুন দেখি যন্ত্রপাতির একাল সেকাল। দারুণ মজার একটা সেকশন এটা। প্রথমে আছে রেডিওর আদি রূপ। সিরিয়ালে একটু ওলট পালট আছে, তবে আমার লেখা অনুসরণ করলে সমস্যা হবে না। শুরুতে ছবি ১-এর পাঁচ নাম্বার যন্ত্রটা দেখুন। এটা ১৯৩৫ সালের নির্মিত রেডিও রিসিভার। চার নাম্বার যন্ত্রটাও একটা রেডিও রিসিভার, তবে তৈরি হয়েছিল দুই বছর পর, ১৯৩৭ সালে। দুই আর তিন নাম্বার যন্ত্র দুইটাও রেডিও রিসিভার যেগুলো তৈরি হয়েছে যথাক্রমে ১৯৩৮ এবং ১৯৩৯ সালে। এক নাম্বারে যে যন্ত্র আছে সেটা ১৯৬১ সালে তৈরি একটা রেডিও রিসিভার। তৈরি করেছিল মটোরোলা কোম্পানি। এখন ছবি ২-এর আট আর নয় নাম্বার যন্ত্রগুলো দেখুন। এগুলো ১৯৬০-এর দশকে তৈরি ট্রানজিস্টর রেডিও। দশ নাম্বারটাও ট্রানজিস্টর রেডিও তবে ১৯৬২ সালে তৈরি। মুক্তিযুদ্ধের উপর বানানো চলচ্চিত্রগুলোয় এ ধরনের ট্রানজিস্টর রেডিও দিয়ে সংবাদ শোনার দৃশ্য দেখা যায়।
ছবি ২-এর এগারো নাম্বার যন্ত্রটা দেখতে টেলিভিশনের মত কারণ এটা ১৯৪৮ সালে নির্মিত একটা টেলিভিশনই বটে! চাপ দিয়ে অন-অফ করার বোতাম আছে এইটায়। কেসিং তৈরি হয়েছে কাঠ দিয়ে। বারো নাম্বারটা মেহগনি কাঠের আবরণ দিয়ে তৈরি রঙিন টিভি। নির্মাণকাল ১৯৫৮। এই টিভি দেখতে অনেকখানিই আধুনিক টিভির মত। ছয় নাম্বার টিভিটা দেখতে অনেক কিউট! কেমন খেলনা খেলনা ভাব। অথচ যারা বানিয়েছিল তাদের কাছে কতই না আশ্চর্যের ছিল এই যন্ত্র! আর যারা ওই আমলের মানুষ, তারা নিশ্চয় হাঁ হয়ে গিয়েছিল এমন অদ্ভুত পণ্য দেখে? আর আমাদের কাছে দূরদর্শন ব্যাপারটা খেলো হয়ে এখন গণনাযন্ত্র পর্যন্ত পুরনো হয়ে যেতে বসেছে। প্রযুক্তি এত দ্রুত ভোল পাল্টাচ্ছে যে, কিছুতেই আমরা আশ্চর্য হই না। স্যামসাং এস৯ ব্যবহার করে কুলাতে পারলাম না, চলে এল স্যামসাং এস১০ প্লাস। কী কাহিনী! যাক, দেখুন সাত নাম্বার টিভিটা। এটা ১৯৬৯ সালে প্যানাসনিক কোম্পানি তৈরি করেছিল। দেখে মনে হয় যেন এলিয়েনদের সসারের কোনো যন্তর। এর আকৃতিকে তাই বলে ইউএফও (আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবেজক্ট) শেইপ।
এরপর দেখলাম টেবিল ফ্যানের আদি ও বর্তমান রূপ। টিভির মত নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে বলা যায় না, তবে কিছু ব্যাপারে ভিন্নতা লক্ষণীয়। যেমন, বামপাশের টেবিল ফ্যানটা ১৯৫০-এর দশকে মিজৌরিতে তৈরি হয়েছিল। এর কোনো অন-অফ বাটন নেই। সরাসরি প্লাগ-ইন করে চালু করতে হয়। এটায় কোনো স্পিড বাটনও নেই। অর্থাৎ একটাই গতি। সাথে ঝাঁঝরি বা তারজালির ফাঁকা অংশগুলো অনেক বড়। দেখে আমার খুব ভয় লেগেছিল। বাচ্চারা তো বটেই, বড়রাও খামখেয়ালে দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে এত বড় ফাঁক দিয়ে। কিন্তু ডানপাশে ২০১০ সালের যে ফ্যানটা দেখা যাচ্ছে, সেটার সবকিছু উন্নতমানের। স্পিড বাটন, ছোট ফাঁকওয়ালা ঝাঁঝরি আর অন-অফ বাটন তো আছেই, আকারেও বড় হয়েছে। আরেকটা ভিন্নতা এসেছে দুটো ফ্যানের উপাদানে। বলুন তো কী? হ্যাঁ, প্রথম ফ্যানটা ধাতব, দ্বিতীয়টা প্লাস্টিকের।
বামপাশের যন্ত্র একটা টোস্টার। ১৯২০-এর শুরুতে এ ধরনের টোস্টার ব্যবহার করা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বেশ সাধারণ ঘটনা ছিল। তবে এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাউরুটির দুই পাশ টোস্ট করতে পারত না। হাত দিয়ে পাউরুটি ঘুরিয়ে দিতে হত। কয়েক বছর পর, ১৯২৫ সালে, সর্বপ্রথম স্বয়ংক্রিয় পপ-আপ টোস্টার তৈরি হয় যেটা রুটির দুইপাশই টোস্ট করতে পারত। মজার ব্যাপার হল, তখনও পর্যন্ত পাউরুটি ফালি ফালি করে কেটে, মোড়কজাত করে বাজারে ছাড়া শুরু হয়নি। অর্থাৎ মানুষের কাছে প্যাকেটকৃত পাউরুটি সহজলভ্য ছিল না। এর আগেই প্রযুক্তিবিদদের টোস্টার তৈরি করা শেষ! অবশ্য তাদের বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৯২৮ সালে বাণিজ্যিকভাবে পাউরুটির প্যাকেট বিক্রি শুরু হয়। ফলে মানুষজনও টোস্টার ব্যবহার করার একটা অজুহাত পায়। ডানপাশে দেখুন ২০১০ সালের একটা আধুনিক টোস্টার। এই টোস্টারে স্লটের পরিধি ইচ্ছেমত ছোট-বড় করে মোটা মোটা বেগল আর পেস্ট্রিও টোস্ট করা যায়।
এরপর আছে বিশাল একটা রেডিও রিসিভারের ছবি, সাথে ছোট্ট একটা আইপড। আগে যেখানে কণ্ঠস্বর শোনার জন্য বিশাল এক যন্ত্র কাঁধে নিয়ে ঘুরতে হত, এখন সেখানে হাতের তালুতে এঁটে যায় এমন আইপড নিয়ে ঘুরি। এরপর খুব মজার একটা জিনিস। ১৯৮০ সালে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির সাথে ২০১০ সালের যন্ত্রপাতির গুণগত পার্থক্য দেখানো হয়েছে। আশি সালে কোন যন্ত্র ব্যবহার করলে এক বছরে কত শক্তি খরচ হত আর কত ডলার বিদ্যুৎ বিল আসত, সেটার সাথে তুলনা করা হয়েছে ২০১০ সালে কোন যন্ত্র ব্যবহার করলে এক বছরে কত শক্তি খরচ হত আর কত ডলার বিদ্যুৎ বিল আসত সেটার। উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে টেলিভিশন আর রেফ্রিজারেটরের ক্ষেত্রে। আশি সালে টিভির বিল আসত পনেরো ডলার, ২০১০ সালে বিল বেড়ে হয়েছে পঁচিশ ডলার। আবার আশি সালে রেফ্রিজারেটরের বিল আসত ১৮১ ডলার, ২০১০ সালে কমে যেটা হয়েছে মাত্র ৮৯ ডলার। ডিশওয়াশারেও এখন আমরা অনেক ডলার বাঁচাতে পারি। আগে যেখানে বছরে ৬৮ ডলার খরচ হত, এখন হয় ২৯ ডলার। মোটামুটি সব পণ্যতেই এখন শক্তি আর খরচ বাঁচে, কেবল ঠকে গিয়েছি টেলিভিশনে। বিংশ শতাব্দী হতে একবিংশ শতাব্দী আসতে আসতে কিছু জিনিসের আকার ছোট হয়েছে, কিছু জিনিসের বড়। টেলিভিশন বাড়তে বাড়তে ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত গড়িয়েছে, টেবিল ফ্যান আর টোস্টারের আকার বেড়েছে, কিন্তু রেডিও ছোট হতে হতে আইপডে নেমে এসেছে। ভবিষ্যতে আর কী দেখব, অপেক্ষায় আছি।
এরপর দেখতে গেলাম ফসিল বা জীবাশ্মের সেকশন। এখানে বিভিন্ন ধরনের জীবাশ্ম রাখা আছে। বই বা অন্তর্জাল থেকে জীবাশ্মের প্রকারভেদ সম্পর্কে জেনেছি। কিন্তু সেটা ছিল শুধুই পুস্তকলব্ধ জ্ঞান। আজ নিজ চোখে দেখে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিলাম। কে না জানে, গ্রন্থগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন। তাই গ্রন্থের বিদ্যাকে মস্তিষ্কের ভেতর পুরে দেওয়ার জন্য দরকার ব্যবহারিক জ্ঞান। আর এ কাজের জন্য সায়েন্স সেন্টারটা কতখানি অসাধারণ, সেটা টের পাচ্ছি পদে পদে। মানুষকে বিজ্ঞানে আগ্রহী করতে কিংবা মৌলিক (বেসিক) জ্ঞান দেওয়ার কত যে ব্যবস্থা এই সেন্টারে আছে! এত সহজ করে সবকিছু ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, আগে থেকে কিছু জানা না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না।
অনেকভাবে ফসিল তৈরি হতে পারে। এর মধ্যে অ্যাডপ্রেশন (adpression), আদল এবং ছাঁচ (Casts and molds), পারমিনারেলাইযেশন (Permineralization), কার্বোনাইযেশন (Carbonization), রিপ্লেস্মেন্ট (Replacement) বা প্রতিস্থাপন, কঠিন অংশের সংরক্ষণ (Preservation of hard parts) ইত্যাদি প্রক্রিয়া উল্লেখযোগ্য। আপনাদের সামনে যে ছবিগুলো আছে সেখানে এই তিন ধরনের প্রক্রিয়ায় পাওয়া জীবাশ্ম দেখা যাচ্ছে। চলুন দেখি কোনটা কী।
প্রথমেই আছে দুটো ফার্নের জীবাশ্ম, যেগুলো তৈরি হয়েছে কার্বোনাইযেশন পদ্ধতির মাধ্যমে। এজন্য এগুলো কালো রঙের। তৃতীয় ছবিটা অ্যাডপ্রেশন পদ্ধতির উদাহরণ।
এরপর আছে ট্রাইলোবাইট নামক অমেরুদণ্ডী সন্ধিপদী (arthropods) প্রাণীর জীবাশ্ম, যারা আজ থেকে ২৫২ মিলিয়ন বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই জীবাশ্ম তৈরি হয়েছে আদল এবং ছাঁচ পদ্ধতিতে। তবে এখানে শুধু আদল দেখা যাচ্ছে। পঞ্চম ছবি থেকে পরপর পাঁচটা ছবিতে হাতে কলমে দেখানো হয়েছে কীভাবে আদল এবং ছাঁচ পদ্ধতিতে ফসিল তৈরি হয়। এখানে একটা ঝিনুক আছে যা পলিমাটিতে আটকে গিয়েছিল। যুগ যুগ ধরে সেটার উপর পলি জমেছে। একসময় ঝিনুকের খোলস আর ভেতরের নরম দেহ নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু ততদিনে মাটির গায়ে ঝিনুকের ছাঁচ তৈরি হয়ে গেছে। একে বলে এক্সটার্নাল মোল্ড বা বাহ্যিক ছাঁচ। আর ঝিনুকের খোলস যেখানে ছিল, সে ফাঁকা অংশে খনিজ পদার্থ জমতে জমতে একদম ঝিনুকের মত দেখতে যে খোলস তৈরি হয়েছে, সেটা হল কাস্ট বা আদল। বাইরের ছাঁচ যেহেতু আছে, আমরা ধরে নিতে পারি ইন্টার্নাল মোল্ড বা অভ্যন্তরীণ ছাঁচ বলেও কিছু আছে। ঝিনুকের খোলসের ভেতরে যে ফাঁপা জায়গা আছে (যেখানে নরম দেহটা থাকত), সেখানে খনিজ পদার্থ বা পলিমাটি জমতে জমতে অভ্যন্তরীণ ছাঁচ তৈরি করেছে।
এরপর আছে প্রতিস্থাপন পদ্ধতিতে তৈরি হওয়া জীবাশ্মের ছবি। এটা একটা প্রস্তরীভূত কাঠের অংশ। প্রস্তর মানে পাথর। অর্থাৎ যে গাছ থেকে কাঠটা কাটা হয়েছে, সে গাছ পাথরে পরিণত হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের ‘আয়নাঘর’ উপন্যাসে আমি প্রথমবারের মত পেট্রিফায়েড ফরেস্টের নাম পড়েছিলাম। এরপর উনার ‘আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই’ আত্মজীবনীতে পেট্রিফায়েড ফরেস্ট নামে একটা গল্প পড়েছিলাম। তখন থেকেই ব্যাপারটার প্রতি আমার গভীর আগ্রহ। এখনো প্রস্তরীভূত অরণ্য দেখার সুযোগ ঘটেনি বটে, সায়েন্স সেন্টার আমাকে সুযোগ করে দিল ওই বন কেমন হতে পারে তার একটা নমুনা দেখার।
কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? আস্ত একটা গাছ পাথর হয়ে যায় কীভাবে? যখন নির্দিষ্ট পরিবেশে বছরের পর বছর ধরে কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের উপর দিয়ে পানি বয়ে যায়, তখন ওই প্রাণী বা উদ্ভিদের শক্ত অংশ ক্ষয়ে পানিতে মিশে যায়। আর পানিতে থাকা খনিজ পদার্থ এসে জায়গা দখল করে শক্ত অংশের। অর্থাৎ খনিজ লবণ দিয়ে প্রকৃত উপাদানগুলো প্রতিস্থাপিত হয়। ছবিতে যে কাঠ দেখা যাচ্ছে, সেটার কোষগুলো প্রতিস্থাপিতহয়েছে খনিজ লবণ দিয়ে। হয়ে এখন পুরোদস্তুর পাথরে পরিণত হয়েছে।
এরপরের ছবিটি প্রবাল জীবাশ্মের। প্রবালটা কোনো এক খনিজ পদার্থ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে এখন পাথরে পরিণত হয়েছে।
এরপর দেখছেন একটা খোলসযুক্ত নরমদেহের প্রাণীর (mollusk) জীবাশ্মের ছবি। এটার নরম অংশ পচে গেলেও খোলস পচে যায়নি, নষ্ট হয়নি। বরং সত্যিকারের খোলসটা এত বছর ধরে সংরক্ষিত আছে। এটা Preservation of hard parts প্রক্রিয়ার নমুনা।
সায়েন্স সেন্টার ঘুরতে ঘুরতে বুঝলাম এতকিছু মাত্র কয়েক ঘণ্টায় দেখা সম্ভব না। টানা আড়াই ঘণ্টা দেখেও অনেক কিছু অদেখা রয়ে গেল। আরেকদিন আসতে হবে সকাল-সন্ধ্যা হাতে নিয়ে। এছাড়া ডাইনোসরের ফসিল আর ডিম, কিংবা মহাকাশ বিভাগ নিয়ে তো কিছু বলাই হল না। সে আরেক কাহিনী। পরের পর্বে সেটা নিয়ে কথা হবে, আশা করি।