রায়হান আর লিখন; দুইজন খুব কাছের বন্ধু। রায়হান ছেলেটা আকার আকৃতিতে বেশ বড়সড়, লম্বায় ৬ ফুট, স্বাস্থ্যটাও খুব ভালো, ওজন প্রায় ৯০ কেজি। কিন্তু বন্ধু লিখন উচ্চতায় সাড়ে ৫ ফুটের খানিকটা বেশি, ওজনটাও বেশ কম, টেনেটুনে ৬০ কেজিও হয় না। দুজনই মাঝেমধ্যে একসাথে এখানে সেখানে খাওয়া দাওয়া করে। লিখন হয়ত এক প্লেট বিরিয়ানী খেতেই অনেকটা সময় নিয়ে নেয়, কখনো কখনো ঐ এক প্লেট বিরিয়ানীও খেয়ে শেষ করতে পারে না। অন্যদিকে বন্ধু রায়হান কখনোই দেড় প্লেটের কমে থেমে যায় না, মাঝেমধ্যে দুই প্লেটও সাবাড় করে দিতে পারে। সাথে তো দুই বোতল কোক পেপসি বা বোরহানি থাকেই।
এইভাবেই দিন কেটে যেতে পারে। আবার এমনটাও হতে পারে যে, দেশে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ লেগে গেল। খাবার সীমিত হয়ে গিয়েছে। সরকার প্রতিদিন সবাইকে সমান পরিমাণ খাবার দিচ্ছে। ততটুক খাবারে লিখনের চলে যাচ্ছে কোনো না কোনোভাবে। কিন্তু রায়হান? সে কিন্তু ঐ পরিমাণ খাবারে দিন চালাতে পারবে না! বেশ ঝামেলা হয়ে যেতে পারে। তবে আমরা আশা করি অমন কিছু কখনো রায়হানের সাথে ঘটবে না। সে আজীবন লিখনকে হিংসায় রেখে খেয়েদেয়ে যাবে পেটপুরে!
উপরে যে ঘটনাটা বলা হয়েছে সেটা কাল্পনিক হলেও কাছাকাছি একটা ঘটনা কিন্তু প্রকৃতিতে ঘটতেই পারে। তেমনটা বিশেষ করে ঘটে কোনো একটা দ্বীপে। ব্যাপারটাকে বলা হয় “Island Dwarfism”। ধরা যাক, কোনো একটা এলাকায় (দ্বীপ অথবা অন্য কিছু) খাদ্যের যোগান যদি সীমিত হয়ে যায় তখন সেখানে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের প্রাণীদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। কারণ তাদের কম খাবারেই চলে যাচ্ছে। বড় প্রাণীদের মধ্যেও দেখা যাবে অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির প্রাণীরা বেঁচে থাকছে, প্রজনন করছে। দীর্ঘদিন তেমনটা চলতে থাকলে ঐ এলাকায় কোন একটা আপাত বড় প্রাণী (ধরা যাক হাতি) যে বাচ্চা জন্ম দিচ্ছে তারা এমনিতেই ছোট হয়ে জন্মাচ্ছে, আগের আকারের চেয়ে খানিকটা ছোট হয়ে বেড়ে উঠছে, আবার প্রজনন করছে। যতদিন যাবে, সেই এলাকায় হাতির আকার ছোট হবার সম্ভাবনা বাড়তেই থাকবে এবং একটা সময় (সময়টা হাজার হাজার কিংবা লাখখানেক বছর) সেই এলাকায় কোনো বড় হাতিই থাকবে না।
এই একবিংশ শতাব্দীতে বসে এমনটা চিন্তা করতে বেশ খানিকটা কষ্ট হতেই পারে, কারণ সবাই তো সব জায়গাতে যেতে পারে। আমাদের যোগাযোগ, যাতায়াত সর্বত্র। শুধু নিজেদের জন্যেই না, বাঘ-ভাল্লুক কিংবা হাতি-ঘোড়া থেকে শুরু করে সাপের জন্যেও আমরা খাবার যোগান করে যেতে পারি। কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন এই শখানেক মাইল দূরের কোনো কিছু সম্পর্কেই কোনো প্রাণীরই ধারণা থাকতো না। সেটা যেমন বাঘ ভাল্লুকের জন্যেও সত্যি ছিল, মানুষের জন্যেও সত্যি ছিল।
২০০৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার পূর্বদিকের একটা ছোট দ্বীপ ফ্লোরসে (প্রায় সাড়ে তের হাজার বর্গকি.মি.) প্রত্নতত্ত্ববিদেরা অভূতপূর্ব এক আবিষ্কার করেন। তারা প্রায় এক লাখ বছর পুরনো একটা মানব প্রজাতির ফসিল খুঁজে পান। সবচাইতে অবাক করার বিষয় ছিল ফসিলটার উচ্চতা, মাত্র সাড়ে তিন ফুট। প্রাপ্তবয়স্ক যে কোন মানব প্রজাতির সদস্যের জন্যেই উচ্চতাটা বেশ অস্বাভাবিক। শুধু একটাই না, আরও নয়টা আলাদা ফসিলের অংশবিশেষ করে খুঁজে পান তারা।
তারা আবিষ্কার করেন যে, ঐখানে যারা বাস করতো তাদের গড় উচ্চতাটাই আসলে এই সাড়ে তিন ফুটের মতন। তাদের মস্তিষ্কও অনেকটা ছোট, চারশ সিসির খানিকটা বেশি, যা আমাদের এক তৃতীয়াংশ! মোটামুটি বলতে গেলে গোটা পৃথিবীতেই সাড়া পড়ে যায় এই আবিষ্কারের পরে। ফ্লোরস দ্বীপে পাওয়া যায় বলে এদের নাম দেয়া হয় Homo floresiensis. হ্যাঁ, একেবারেই আলাদা একটা মানব প্রজাতি।
ধারণা করা হয় যে, সবচাইতে প্রাচীন মানব প্রজাতি Homo erectus যখন আফ্রিকা ছেড়ে বাকি দুনিয়ায় ছড়িয়ে যেতে থাকে, সেই সময়ের শেষদিকেই তারা দক্ষিণ এশিয়া ঘুরে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দিকে যেতে থাকে। একটা সময় সেই অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেশ কম ছিল। Homo erectus রা হয়ত পুরো ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোতে ছড়িয়ে যায়, একই সাথে সেই ফ্লোরস দ্বীপেও। কিন্তু একটা সময় পানি উচ্চতা বেড়ে গেলে তারা সেখানেই বন্দী হয়ে পড়ে, আরও অসংখ্য প্রাণীর সাথে। তখন সেই আইল্যান্ড ডোয়ার্ফিজম থিওরিতে ছোট আকারের ইরেক্টাসরা বেঁচে থাকতে শুরু করলো এবং দীর্ঘদিন এই অবস্থার কারণে একটা সময় একেবারেই নতুন একটা প্রজাতিতে বিবর্তিত হয়ে গেল। শুধু মানব প্রজাতিই কিন্তু না, ঐ দ্বীপে বেশ ছোট আকৃতির হাতির ফসিলও পাওয়া গিয়েছে। সেই H. floresiensis রা একটা সময় বিলুপ্ত হয়ে যায় কোনো একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে এই বিলুপ্তি কিন্তু খুব বেশিদিন আগের কথা না, এই মাত্রই ১২ হাজার বছর আগেও তাদের বেঁচে থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। অর্থাৎ যখন এশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যের বেশ অনেক জায়গাতে মানুষ অর্থাৎ Homo sapiens খুব সামান্য হলেও কৃষিকাজের সূচনা করে ফেলেছিলো। যখন নেকড়ে থেকে কুকুর বিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। যখন মানব সভ্যতার ইতিহাস একেবারেই অন্য একটা মোড় নিচ্ছে পুরোপুরি নতুন এবং অভাবনীয় একটা দিগন্তের দিকে… সেইসব গল্প অন্য একদিন হবে!
1. Sapiens: A Brief History of Humankind
2. Becoming Human: Birth of Humanity (Homo erectus)