১
ছুডুবেলায় একবার হইলো কী, ভাজা মাছটা উল্টে খাইতে গিয়ে গলায় কাঁটা বিঁধলো। তারপর আমার সে কী চিৎকার, চেঁচামেচি। কিছুতে কাঁটা সরছে না। গরম ভাত মুঠো করে মুখে ঢুকিয়ে দেয়া হল তরকারি ছাড়া, কাঁটা নামে না। পানি গিলতে গিলতে আটানব্বইর বন্যা ঘটায় ফেললাম পেটের ভেতর। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। শেষে বেড়াল এর পা ধরানো হলো আমাকে যাতে, কাঁটা নেমে যায়। কাঁটা নেমেও গেলো!
২
একদিন আমি আর আমার ছোট ভাই লোড শেডিং এর আধারে রাতের বেলা পলান্তিস খেলতাছি। এমন সময় গেট এর বাইরে যাচ্ছিলাম পালাতে। গেটের পাশে দেখি ইয়া বড় সাদা কী জানি! ভূতের বাচ্চা ভেবে কান্না শুরু করে দৌড় লাগালাম ঘরের ভেতর, ছোটটাও কান্নাকাটি। তারপর, আমার ভয় তাড়াতে দা এর আগায় লবণ রেখে সে লবণ খাওয়ানো হলো। পরদিন কবিরাজ এসে ঝাড়ফুঁক করে, বুটের মত কী জানি খেতে দিলো। দুই একদিন পাতলা পায়খানা, বমি টমি হয়ে সব ঠিক হয়ে গেলো।
৩
তখন ক্লাস টেনে পড়ি। আমার সমবয়সী এক মেয়েকে জ্বিনে ধরেছিলো। তা ধরবেই তো! চুল ছেড়ে গাছের নিচে সাজুগুজু কইরা বসে থাকলে জ্বিন ছাড়বে কেন? জ্বিন এর কি আশা আকাঙ্ক্ষা নেই নাকি?
তারপর খবর দেয়া হলো ওঝা মহাশয়কে। উনি আউলা ঝাউলা চুল আর লাল সালু পইরা এসে এক হুঙ্কার দিলেন। হুঙ্কার এর চোটে আসমান-যমীন এক হবার দশা! তারপর ইয়া বড় ৪/৫টা শুকনা মরিচ পুরে ঐ মেয়ের মুখের সামনে ধরলেন। হাঁচাহাঁচিতে ভূমিকম্প শুরু হলো। ওঝা সাহেব মেয়েটিকে ধমক দিচ্ছিলেন যেন কথা বলে। কিন্তু বলছিলো না। তারপর মেয়েটিকে পিছা দিয়া পিটানো হচ্ছিলো যেন কথা বলে। সবাই এই দৃশ্য উপভোগ করছিলো, মাঝে মাঝে হাততালি দিচ্ছিলো। মারের চোটে এক সময়ে মেয়ে কথা বললো, ওঝা সাহেব সবাইকে বললেন যে এটা জ্বিন কথা বলছে। ওঝার এই থেরাপিতে সবাই খুব খুশি। কারণ, জ্বিন বলেছে সে চলে যাবে। এক সময়ে মেয়ে অজ্ঞান হলো আর ওঝা সাহেবকে সবাই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্মান জানালো। মেয়েটি কয়েক দিন পর সুস্থ হয়ে গেলো।
৪
একজনের কানে কি জানি ঢুকেছে, তাই সেটা বের করতে সবাই পরামর্শ দিলো – কচুর চিকন অগ্রভাগ চুলায় গরম করে কানের ভেতর দিতে। কয়েক দিন দিলো, কিন্তু কাজ হলো না। তাই বাজার থেকে কান পরিষ্কার করা হকারকে নিয়ে আসল বাড়িতে। ঐ “দাক্তুর সাহেব” গুঁতাইয়া গাঁতাইয়া কী জানি বের করলেন। সবাই খুশি। দুদিন না যেতেই সবাই আবিষ্কার করল লোকটি বয়রা/কালা হয়ে গেছে।
৫
এক মহিলার দুই দুইটা বাবু জন্মের পরপরই মারা যায়। জন্মের পরপরই বাবুটা দাত মুখ খেঁচে ভেটকি দেয় আর গাইবি আওয়াজ করে। সবাই বলে এটা ভূতের বাচ্চা। কয়েক দিন পর আগের বাবুর মত এটাও মারা যায়। তারপর জানা যায়, এ মহিলার চরিত্র খারাপ ছিলো। পর পুরুষের সাথে “ঘুমটা” ছাড়া কথা কইতো, পোয়াতি পেট লইয়া ক্ষেত খামারে যাইতো। চন্দগ্রহণ, পূর্ণিমা ইত্যাদি সময়ে ঘর থেকে বাইর হইয়া আলিক্কি (অলক্ষী) লাগাই ফেলসে। তার বাচ্চা আবার না মরে কেমনে? ভূতের বাচ্চা বিয়াইছে, একদম ঠিকই আছে!
—————
বন্ধুরা, এবার আসুন উপরোক্ত ঘটনাগুলোর প্রকৃত এবং সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা দিবার চেষ্টা করি-
১
বিড়ালের পা ধরার কারণে আমার গলা থেকে কাঁটা নামেনি। ওটা বডি ইমিউনিটি মেকানিজম-এর কারণে অটোমেটিক্যালি চলে গিয়েছিলো।
গলায় কাটা বিঁধলে কী করবেন- আস্ত একটা লেবু চুষে খাবেন। লেবুর এসিডিটির কারণে মাছের কাঁটা নরম হয়ে যাবে। এক সময় খাবারের সাথে তা খাদ্যনালীতে চলে যাবে, ফুড ডাইজেশন এর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়।
২
ঐ দিন কোনো ভূত ছিলো না। কোনো আলোর রিফ্লেকশন/প্রতিফলন হতে পারে সেটা। কিন্তু ছোটবেলা থেকে ভূত-প্রেতের গল্প শুনে শুনে অবচেতন মনে এক অজানা ভয় বাসা বেঁধেছিলো ধীরে ধীরে। রাতের আঁধার আর অন্ধবিশ্বাস পুঞ্জীভূত হবার মিলিত ফসল ছিলো সেটা। আর পেট খারাপ এবং বমি হবার কারণ হল, দা এর আগায় অবশ্যই জীবাণু ছিলো। তাছাড়া কবিরাজের বড়ির সাইড ইফেক্টও হতে পারে সেটা।
কী করবেন এমন হলে?
প্রথমেই বাচ্চাদের এসব ভূতপ্রেতের গাঁজাখুরি গল্প বলা বন্ধ করুন। তাদের মাথায় এসব ভয় ঢুকানো একটা মারাত্মক অন্যায়। যদি কেউ ভয় পেয়ে যায়, তাকে সে স্থানে নিয়ে যান। তাকে ঘুরে ঘুরে দেখান সে জায়গাটা এবং বোঝান এসব ভূত-টুত কিছুই নেই দুনিয়ায়। ভূতের চেয়েও এক ভয়ঙ্কর বস্তু আছে এ দুনিয়ায় – তার নাম মানুষ।
৩
ওঝা ব্যাটা ঐদিন যা করেছে তা স্রেফ ফিজিক্যাল এস্যাল্ট (শারীরিক নির্যাতন)। তখন এতো কিছু বুঝতাম না, শুধু বুঝেছিলাম ওঝা যা করছে তা অমানুষিক! বলেছিলাম, ঐ ওঝার মুখ দিয়েও আমি জ্বিনের কথা বলাতে পারুম। শুধু ওঝার পিছাটা তার পশ্চাদ্দেশ দিয়ে ঢুকাতে দেন! দেখেন জ্বিন ক্যামনে কথা কয়! জীবনে প্রথম জানলাম সেদিন, আমি নাকি নাস্তিক!
সত্যিকার অর্থে, মেয়েটি যে সমস্যায় ভুগছিলো তার নাম হিস্টেরিয়া। বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের শারীরিক, মানসিক পরিবর্তন ঘটে ব্যাপক ভাবে। তার চেয়েও বেশি পরিবর্তন ঘটে মেয়ের সাথে তার পরিবার ও সমাজের আচরণের। মেয়ের পায়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সামাজিকতার শেকল। এত পরিবর্তন মেয়েরা অনেক সময় টলারেট করতে পারে না। তাই খেই হারিয়ে ফেলে।
কী করবেন এ অবস্থায়?
বয়ঃসন্ধি কালে মেয়ের সাথে বন্ধুর মত আচরণ করুন। তাকে সবকিছু খোলামেলা ভাবে বোঝান এবং ভাবতে দিন। মনরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করুন সমস্যা বেশি হলে।
৪
কানে ঐসব কচু-ঘেঁচু ঢোকানো এবং পরবর্তীতে কোয়াক (quack – হাতুইড়্যা ডাক্তার) মিয়ার গুঁতাগুঁতির ফলে কানের পর্দা গেছে ফুটা হইয়া। তাই এসব লামছাম বর্জন করুন।
কী করবেন এমন অবস্থায়?
কানে কিছু ঢুকলে প্রথমে লাইট মারুন কানে টর্চ দিয়ে। পোকামাকড় ঢুকলে সেটা আলোর পথ ধরে বেরিয়ে আসতে পারে। নাহলে একটু তেল অথবা পানি দেন কানে। এরপরেও বের না হলে নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করুন যত দ্রুত সম্ভব।
৫
সেটা ভূতের বাচ্চা না, আশরাফুল মাখলুকাত (সৃষ্টির সেরা জীব) এর বাচ্চা। তার দুটি বাচ্চাই জন্ম নিয়েছিলো বাড়িতে ধাত্রীর তত্ত্বাবধানে। অজ্ঞ ধাত্রী বাচ্চার নাড়ী (আম্বিলিকাল কর্ড) কেটেছিলো কঞ্চির ধারালো মাথা দিয়ে, আর সেই কঞ্চি থেকে জীবাণু ( কলস্ট্রিডিয়াম টিটানি) ঢুকে পড়ে বাচ্চার শরীরে। এতে করে বাচ্চাটি ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত হয়। ফলে দাঁত-মুখ খিঁচে থাকে, মুখ হা করতে পারে না, কিছু খেতে পারে না, মুখ দিয়ে গড়গড় শব্দ হয় এবং অন্যান্য ভয়ানক উপসর্গ দেখা দেয়, এবং শেষ পর্যন্ত মারা যায়।
কী করবেন এসব এড়াতে?
গর্ভাবস্থায় মা-কে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান, antenatal check up (অর্থাৎ, জন্ম পূর্ববর্তী পরীক্ষাগুলো) করান। ঝুঁকি এড়াতে হোম ডেলিভারি বর্জন করুন। হাসপাতালে বাচ্চা ডেলিভারি করুন।
কুসংস্কার আর অজ্ঞতা নিপাত যাক। বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়ুক মানবতার তরে। সবাইকে ধন্যবাদ।
ভালো লেগেছে লেখাটা। ধন্যবাদ
চার নাম্বার যে সমাধানটা দিলেন ওটা আমার জীবনে শেখা (সম্ভবত) সবচেয়ে মজার কিছু। তখন ইটিভিতে জাপানের কিছু ডকু অনুবাদ করে দেখাতো। ওখানেই এটা দেখানো হয়েছিল। কত সহজ সমাধান!
কম বেশি এমন অভিজ্ঞতা সবাই আছে।
ভালো পোস্ট। আশা করি অনেকের ভুল ধারণা ভেঙে যাবে।
কানে পোকামাকড় ঢুকলে আরেকটা সমাধানের ব্যাপারে আমি জানি। আঙুল দিয়ে নাক চেপে ধরে রাখতে হবে, আর মুখ বন্ধ রাখতে হবে। অর্থাৎ কোনো পথেই শ্বাস নেওয়া যাবে না। তাহলে অক্সিজেনের অভাবে পোকামাকড় কান থেকে স্বেচ্ছায়ই বেরিয়ে আসবে।
নিজের জীবনে এই পদ্ধতি দু’বার প্রয়োগ করেছি এবং সফলও হয়েছি!
*** বানানটা “ক্লস্ট্রিডিয়াম” হবে।