টেট্রাক্রোম্যাট – রঙধনুতে ১০টি রঙ দেখে যারা

সুপারহিরো মুভিতে আমরা দেখে থাকি যে সুপারহিরোদের স্পেশাল এবিলিটি থাকে। কেউ হয়তো বা বিদ্যুতের গতিতে দৌড়াতে পারে (ডিসি কমিক্সের ব্যারি অ্যালান ওরফে ফ্ল্যাশ )। কেউ হয়তো সেল রিজেনারেশন (ক্ষতিগ্রস্থ কোষ খুব দ্রুত প্রতিস্থাপন) করতে পারে (মার্ভেল কমিক্সের লোগান ওরফে উলভেরিন ), আবার কারো চোখের থেকে লেজার বীম বের হয় (স্কট ওরফে সাইক্লোপস)। কিন্তু এসবই তো কমিক্স বা মুভিতে। রিয়েল লাইফে কি এমন সুপার হিউম্যান সত্যি আছে?

কল্পনা করা যায়, এমন মানুষ আছে যে আমাদের চাইতে অনেক বেশি  কিছু দেখছে? এমন কাউকে যে কিনা সাদা মেঘের মধ্যে হাজার রঙের মেলা দেখতে পাচ্ছে? ঘোলা পুকুরের পানিতে বাহারি রঙের খেলা দেখতে পাচ্ছে?

New Bitmap Ixfgjmage (2)

সাধারণ একজন মানুষ যেখানে সর্বোচ্চ ১ মিলিয়ন (১০ লক্ষ) রঙ দেখতে পায় সেখানে এমন কাউকে কি কল্পনা করা যায় যে ১০০ মিলিয়ন (১০ কোটি) রঙ দেখতে পায়?

কত নাম আছে বিভিন্ন রঙের! লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা, পার্পেল, প্রুশিয়ান ব্লু (কেমিস্ট্রি ল্যাবে শেখা নাম) সহ আরো কত আছে; ভার্মিলিওন, মেরুন, ম্যাজেন্টা, লেমন, ল্যাভেন্ডার, বানানা ইয়োলো (মেয়েরা এতো সব নাম ব্যবহার করে। সাধারণত, ছেলেদের এইসব নাম মনে থাকে না। গেইম অব থ্রোনস এর চরিত্রের নামই মনে থাকে না, আবার রঙের নাম!)। আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই এত রঙ আছে যার সবগুলোর নাম দেয়া কোনো ভাষাতেই সম্ভব না।
New Bitmap Image

আমাদের দর্শনের ক্ষমতা আসে প্রধানত রেটিনাতে অবস্থিত কোণ (Cone Cell, উচ্চারণ কৌন। যদিও বিদেশী শব্দে ণ হয় না, তবুও ধরে নিন। পাঠ্যপুস্তকে এটাই লেখা) কোষের মাধ্যমে। তিন ধরনের কোণ কোষ থাকতে মানুষের চোখে। কোণগুলো হল S, M ও L এবং এগুলো যথাক্রমে ৪২০ ন্যানোমিটার, ৫৩০ ন্যানোমিটার এবং ৫৬০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোতে সাড়া দেয় বা তিন রঙের (লাল, নীল ও সবুজ) আলোতে কোণ (Cone) তিনটি সংবেদনশীল। যতক্ষণ আমাদের চোখ খোলা থাকে, কোণ কোষগুলো ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো গ্রহণ করে তার সিগন্যাল আমাদের ব্রেইনে পাঠায় আর আমাদের ব্রেইন সেই সিগন্যাল ৩টা কম্বাইন করে আমাদের বিভিন্ন রঙের অনুভূতি দেয়। এবং দেখা গেছে যে প্রতিটা রঙের জন্য ১০০টা করে শেড পাওয়া যাচ্ছে। ফলে ৩টি রঙের জন্য ১০০x১০০x১০০ = ১ মিলিওন কালার কম্বিনেশন পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের এই দর্শন ব্যবস্থার নাম “ট্রাইক্রোমাসি” এতো এইট-নাইনে পড়া জিনিস।  কিন্তু এইট-নাইন-টেন-ইন্টারে যা পড়ায়নি, তা হলো টেট্রাক্রোমাসি।

New Bitmap Image (2)

ট্রাইক্রোম্যাটদের বা সাধারণ মানুষের কোণ কোষগুলোর ফাংশনের ডায়াগ্রাম

টেট্রাক্রোমাসি হল যখন কোনো প্রাণীর চোখের রেটিনায় চারটি কৌন কোষ থাকে। বিভিন্ন পাখি বা পোকামাকড়দের ক্ষেত্রে টেট্রাক্রোমাসি সাধারণ একটি ঘটনা কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে তা মোটেও স্বাভাবিক না। কারণ, যেখানে ট্রাইক্রোমাসি হলে একজন মানুষ মাত্র ১ মিলিওন রঙ দেখতে পায় সেখানে টেট্রাক্রোমাসি হলে ১০০x১০০x১০০x১০০ = ১০০ মিলিওন কালার কম্বিনেশন দেখতে পায় এবং একই সাথে দর্শনের সূক্ষ্মতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।

New Bitmap Imageো

যেখানে সাধারণ মানুষ রঙধনুতে ৭টা রঙ দেখতে পায় সেখানে টেট্রাক্রোম্যাটরা ১০টা রঙের সমাহার দেখতে পায়।

 রেটিনায় জিনের বৈচিত্রের কারণে মানুষের রেটিনায় চতুর্থ কৌনের ডেভেলপ হয়। তত্ত্ব তো অনেক কপচানো হলো। এবার দৈনন্দিন জীবনে কিছু মজার ঘটনা শোনা যাক।

ছবি আঁকার শিক্ষক, কনসেট্টা এন্টিকো (Concetta Antiko) তার ছাত্রছাত্রীদের প্রকৃতির চিত্র আঁকাবার জন্য একটা পার্কে নিয়ে যায়। সে তার ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন রঙের শেড দেখিয়ে বলছিলো এই শেডে রঙ করো। কিন্তু তার ছাত্রছাত্রীরা কোনভাবেই তার দেখানো রঙের শেডের ধারে কাছেও যেতে পারতেছিলো না। কয়েকবার কয়েকজনকে জিগ্যেস করার পর এন্টিকো বুঝতে পারে যে একমাত্র সেই রঙের শেড গুলো দেখতে পাচ্ছে। এবং এ নিয়ে আরো কয়েকবার কয়েকজন ছাত্র ছাত্রীদের জিজ্ঞাস করলে সে বুঝতে পারে যে আসলে তার ছাত্রছাত্রীরা বিনয়ের বশত তাকে আগে কখনো বলেনি যে তার দেখানো অনেক রঙই তারা (ছাত্রছাত্রীরা) আসলে দেখতে পেত না, সে অনেক রঙ বা শেড দেখতো যা অন্য সকলের কাছে প্রকৃতপক্ষেই অদৃশ্য।

Untitled2

এন্টিকোর দর্শন অনুযায়ী তার আঁকা একটি লেকের রাতের চিত্র; এন্টিকো বলেছেন যে রাতে তার কালারের শেড দেখার পরিমাণ বেড়ে যায়।

কিন্তু এখন এন্টিকো জানে যে সে একজন টেট্রাক্রোম্যাট এবং জেনেটিক লটারীতে ভাগ্যবান বিজয়ীদের একজন যার জিনের ভেরিয়েশন (মিউটেশন ও বলা যেতে পারে) এর কারণে সে এই অসাধারণ দর্শন ক্ষমতা পেয়েছে। “এই যে পাথরগুলো দেখতে পাচ্ছেন?” এক সাংবাদিককে তার বাসায় রাখা কয়েকটি ছোট পাথর পাথর দেখিয়ে বলেন এন্টিকো, “এই পাথর থেকে কমলা, সবুজ, নীল, আর গোলাপি রঙ ঠিকরে আসছে আমার চোখে। প্রথমে আমি এটা জানতে পেরে প্রচণ্ড অবাক হই যে আমি ছাড়া সবাই পাথরগুলো নাকি ধূসর আর কালো দেখতে পায়।”
টেট্রাক্রোম্যাট বেশ দুর্লভ একটি ঘটনা। সেক্ষেত্রে এন্টিকো আরো বেশী উল্লেখ্যযোগ্য কারণ এন্টিকো একজন চিত্রশিল্পী। সে তার দর্শনানুভূতি ছবি আঁকার মাধ্যমে বোঝাতে পারছে।

10801838_846613828728970_3770885941781711360_n

কনসেট্টা এন্টিকো

“এন্টিকোর আঁকা ছবি আমাদের টেট্রোক্রোম্যাটদের দর্শনের বিষয়ে একটা কাঠামো দিতে সাহায্য করেছে যা খুবই প্রশংসনীয়” – কিম্বারলি জেমসন; ক্যালিফোর্নিয়া স্টেইট ইউনিভার্সিটি।

এখন একটা অতি আবশ্যক একটা প্রশ্ন করা যাক, আমরা যারা সাধারণ তারা সবাই কি সব রঙ একই ভাবে দেখি? নাকি আমারাও ভিন্ন ভিন্ন দেখি?? আমি যেটাকে পার্পল দেখি, সেটা হয়তো অন্য একজন সামান্য ভিন্ন দেখে। তার কাছে পার্পল আসলে ভিন্ন কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না বা পারার সম্ভাবনাও কম যে দুইজনে একই ড্রেসের রঙ ভিন্ন দেখছি (কালার ব্লাইন্ড বা টেট্রাক্রোম্যাট না, সাধারণ দর্শন ক্ষমতার অধিকারী মানুষদের কথা বলা হচ্ছে )। এখানে কথা হলো  – একজন সাধারণ মানুষের কালার কনসেপ্ট আরেকজনের সাথে হুবহু মেলার সম্ভাবনা কম, কিন্তু পার্থক্য খুবই সূক্ষ্ম। কারণ, আমাদের চোখের সেনসিটিভিটি অনেক ক্ষেত্রেই একেকজনের জন্য একেকরকম হয়। সেহেতু এক একজনের চোখে রঙের কনসেপ্টের খুবই সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকে। (কালার ব্লাইন্ড বা টেট্রাক্রোম্যাটের ব্যাতিক্রম সাধারণ হিসাবের বাইরে)

টেট্রাক্রোমাসি তে ফিরে আসা যাক। জেব্রা-ফিঞ্চ বা গোল্ডফিশের টেট্রাক্রোমাসি অতি সাধারণ একটি ঘটনা। কিন্তু মানুষেরও যে টেট্রাক্রোম্যাসি হতে পারে তা প্রায় ২০ বছর আগে (১৯৯৫ সালে) নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটির গ্যাব্রিয়েল জর্ডান প্রথম এই মত প্রকাশ করেন।

এখানে মেয়েদের জন্য (হলেও হতে পারে) একটা সুখবর আছে। জর্ডানের মতবাদের ভিত্তি লুকিয়ে আছে আমাদের ক্রোমোসোমে। লাল এবং সবুজ রঙের কোণ কোষের জিন থাকে এক্স (X)  ক্রোমোসোমে। আবার মেয়েদের ২টা করে এক্স ক্রোমোসোম থাকে। সেহেতু ১টা লাল ও একটা সবুজ কোণ কোষের পরও তাদের (নারীদের) জিনের ২টা আলদা ভার্সন বহন করার সুপ্ত সম্ভাবনা থাকে যাদের (এক্সট্রা জিন ২টির) প্রত্যেকে এমন একটা কোণ কোষ তৈরি করে যা বর্ণালীর সামান্য ভিন্ন অংশের সাথে সেনসিটিভ। অন্যদিকে কিন্তু স্বাভাবিক কোণ কোষ ২টা আছেই। তাদের সাথে পরিবর্তিত এই কোণ কোষ ২টি যোগ হয়ে মোট চারটি কোণ কোষ হয়। আর যেটা তাদেরকে টেট্রাক্রোম্যাটে পরিণত করে।
যেহেতু ২টি এক্স ক্রোমোসোম শুধু মাত্র মেয়েদের থাকে তাই সর্বোচ্চ সম্ভাবনা হলো – টেট্রাক্রোম্যাট শুধু মেয়েরাই হয়। যেমনটা বর্ণান্ধতা ছেলেদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়।

p0267pvz

ধারণা করা হয়ে থাকে ছেলেদের পক্ষে টেট্রাক্রোম্যাট হওয়া সম্ভব নয়।

গ্যাব্রিয়েল জর্ডান টেট্রাক্রোম্যাসিজম নিশ্চিত করার জন্য একটা পরীক্ষা বের আবিস্কার করেন। পরীক্ষার নাম “জর্ডান’স এসিড টেস্ট”। এই টেস্টে পিগমেন্টের বিভিন্ন মিশ্রণের তৈরি রঙিন চাকতি (Color Disk) দেখা যায়; যেমন মিশ্রণে নীল ও হলুদের মিশ্রণে তৈরি সবুজ প্রদর্শিত হবে। মিশ্রণটা এতই প্রশমিত থাকে যে সাধারণ মানুষ যারা তারা গাঢ় জলপাই রঙ দেখবে। কিন্তু যাদের চারটি কোণ কোষ আছে তারাই একমাত্র মিশ্রণের ভেতর থেকেও নীল ও হলুদ বর্ণালী পৃথক করে দেখতে পাবে। এই টেস্ট শুরু করার পর বহুদিন পর্যন্ত জর্ডান কোনো সাফল্য পায়নি। কিন্তু ২০১০ সালের দিকে একজন মহিলা এই টেস্টে পজিটিভ রেজাল্ট প্রদর্শন করে (উল্লেখ্য যে একটি না অনেকগুলো মিশ্রণ দিয়ে পরীক্ষা করা হয়, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই রঙের ৩-৪টা মিশ্রণও ব্যবহার করা হয়েছে যেইগুলোর প্রত্যেকের উপাদান আলাদা)। দুর্ভাগ্যবশত জর্ডানের টেস্টের পজিটিভ রেজাল্ট প্রদর্শনকারী মহিলাটি কোনোভাবেই মিডিয়ার সামনে আসতে বা ফটো তুলতে রাজি হয়নি। কিন্তু জর্ডানের টেস্টের বিষয় এবং রেজাল্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়ে যাবার পর অনেকেই স্বেচ্ছায় পরীক্ষা দিতে এগিয়ে আসে এবং তাদের মধ্যে গুটিকয়েকজন (সকলেই মহিলা) পজিটিভ রেজাল্ট শো করে। তাদের মধ্যে একজন ম্যাউরিন সীবার্গ ।

MAUREENSEABERGHEADSHOTCOLOR

ম্যাউরিন সীবার্গ

নিজের দর্শনের অনুভূতি বর্ণনা করতে গিয়ে নিউইয়র্কের সাংবাদিক ও লেখিকা ম্যাউরিন সীবার্গ (Maureen Seaberg) বলেছেন, “ছোটবেলার থেকেই রঙের নির্বাচনের বিষয়ে আমার সাথে অন্য সবার মতবিরোধ হতো। সবার মুখ থেকে যা শুনতাম তাতে আমি বুঝতাম যে রঙ আমি অন্য সবার চাইতে অনেক তীব্র দেখি। বিভিন্ন রঙের আমার উপর ভিন্ন ভিন্ন মানসিক প্রভাব ফেলতো। যেমন সাদা রঙ আমার চোখের বা ব্রেনের জন্য সবচাইতে আরামদায়ক। অন্য দিকে আমার কাছে আতংক হল সব্জির বাজার। সব্জির বাজারে গেলেই মনে হয় আমার দিকে একগাদা বিচ্ছিরি, পচা, দুর্বিষহ রঙ বিভিন্ন শাকসবজির থেকে আমার দিকে ঝাঁপিয়ে পএছাড়া ম্যাচিং করে ড্রেস পরতে গেলে আমার খবর হয়ে যায়। দোকানী আমাকে এমন সব রঙ জোর করে ম্যাচিং বলে চালিয়ে দেয়, যা অন্য সবার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু আমার কাছে অনেক আলাদা শেডের মনে হয়।”

p0267qts

টেট্রাক্রোম্যাট নারীরা যখন রঙবেরঙের  শেড দেখে তখন আমরা হয়তো দেখি এক রঙ।

আর টেট্রাক্রোম্যাটদের উপরে আছে প্রজাপতি। এদের আছে ৫টা কোণ কোষ। এদের বলা হয় পেন্টাক্রোম্যাট। তবে সবচেয়ে উপরে আছে যারা, পৃথিবীর সবচাইতে ক্যুলেস্ট প্রাণীদের মধ্যে একটা, ম্যান্টিস চিংড়ি (Mantis shrimp)। এদের বেশি না, মাত্র ১৬টা কোণ কোষ আছে। এদের দর্শন কেমন, তা বর্ণনা করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এটা জানা গেছে যে, তাদের চোখ থাকলে মানুষ সরাসরি ক্যান্সার কোষ দেখতে পারতো, দেখতে পারতো আল্ট্রাভায়োলেট রে এমনকি পোলারাইজড রে। তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ুন ।

তথ্যসূত্রসমূহঃ
বিবিসিআন্তিকোআন্তিকো ২আন্তিকো উইকিডিসকভার ম্যাগাজিন

Comments

আপনার আরো পছন্দ হতে পারে...

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
জানান আমাকে যখন আসবে -
guest
1 Comment
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
আতিক চৌধুরী
9 বছর পূর্বে

really mindblowing..

1
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x