উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় চলছে নাসার সবচেয়ে গোপনীয় কক্ষে। তুমুল বিতর্ক! পারলে যেন একজন আরেকজনের মুখে কফি ছুঁড়ে মারবে এমন অবস্থা! হওয়ারই কথা। একের পর এক চেষ্টা বিফল হচ্ছে। কোনো সফলতা ছাড়া এত টাকা বারবার চাইবেই বা কীভাবে? এই নিয়ে গত এক দশকে এগারবারের মত ব্যর্থ হলো আলোর গতিকে হারানোর চেষ্টা। আলোর গতিকে সরাসরি হারাতে না পারায়, এখন চলছে হাইপার ডাইভ দেয়ার রাস্তা বের করার চেষ্টা।
নাসা প্রধান ক্যারি-র আগুনে চোখে এখন অসহায় দৃষ্টি। পেছনের হলোগ্রাফিক পর্দায় কয়েক শ’ বছর আগে প্রথমবারের মত খুঁজে পাওয়া এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সেরা ক্যান্ডিডেট কেপলার-৪৫২বি। ১ বা ২ নয়, একেবারে ১৪০০ আলোকবর্ষ দূরে!
কেপলার-৪৫২বি দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কোথায় যেন পর্নস্টার রুডির সাথে ওর মিল পেল ন্যানি! দুই-ই যেন কতদূরে! কত আলোকবর্ষ দূরে! একটা বিরহের কবিতা আবৃত্তি করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, কিন্তু কিছু বললে এখন সবাই মাথায় কফির কাপ ভাঙবে, তাই চুপ মেরে গেল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কেপলার-৪৫২বি এর দিকে, আর গোপন দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে লাগলো। গ্রুমের চোখ পাশেই। যেখানে একের পর এক লাইন ধরে লেখা বিশাল সব ক্যালকুলেশন। এইসবের ভেতর ভুল খুঁজছে ওর চোখ।
সবার দিকে তাকিয়ে ক্যারি যেন চিৎকার করে উঠলো-
“কী করবো আমরা এখন? কী করবো? কারো কিছু বলার আছে?”
কারোরই যেন কিছু বলার নেই। সবাই চুপ। যেন মহাশূণ্যের নীরবতা নেমে এসেছে এই কক্ষে।
হঠাৎ-ই…
“নাচ আমার ময়না তুই পয়সা পাবিরে
এমন রসিক জন মোরা আর পাবো না যে…”
রুমের নীরবতাকে খান খান করে বেজে উঠলো সূর্যের হাতের চামড়ার নিচে বসানো বিশেষ ছোট্ট একটা চিপ। এই মহা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কে বিরক্ত করতে পারে ভাবতে ভাবতেই ভ্রূ কুঁচকে উঠলো সূর্যের, কল দিয়েছে ওর পোষা কুকুরটা! “হারামজাদা, আর টাইম পাইলো না?” আশপাশের মানুষদের বিরক্ত চেহারার দিকে লাজুক হাসি দিয়ে বলে উঠলো, “আমার কিছু বলার আছে।”
“এক মিনিট। তার আগে বলো, এমন জঘন্য রুচির গানকে রিংটোন রাখার কারণ কী?” যেন রাগে চেঁচিয়ে উঠলো ক্যারি।
সবাই জানে সূর্যের পুরনো দিনের ব্যাপারে আগ্রহটা বড্ড বেশী। এই নিয়ে যদিও ওকে কেউ কখনো ঘাটায়নি। কিন্তু আজকের দিনটা আলাদা, আর সবার চিপে অটো-ট্রান্সলেটর থাকায় গানের অর্থ বুঝতেও কারো সমস্যা হয়নি, সবমিলিয়েই যেন এই অগ্ন্যুৎপাত।
“এটা জঘন্য রুচির গান হতে যাবে কেন? নাচলেই যেমন ময়না পয়সা পায়, নইলে পায় না। তেমনি তো আমরাও। আমরাও তো একেকজন ময়না। একের পর এক চেষ্টা চালাচ্ছি, কিছু হচ্ছে না বলে মাথা গরম করছি। এবার সফল না হলে আমরা আর ফান্ডই পাবো না। নাচ নেই, টাকাও নেই! কে জানে, আমাদের এই সম্পূর্ণ প্রজেক্টই বাতিল করে দেয় কিনা…”
একটু যেন শান্ত হয়ে এলো ক্যারি, “কী বলবে, বলো।”
“ভাবছি কিছুদিন ধরেই। কিন্তু বিষয়টা কে কীভাবে নিবে তা বুঝতে পারছি না। তাই আগেই বলে নেই, আমার কথার মাঝে যেন কেউ আমাকে না থামায়। আমি পুরো প্ল্যানটা শেয়ার করবো এর পর যে যা খুশী মত দিতে পারবে। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে গতি। তাই চাইলেও এখন আমরা ১৪০০ আলোকবর্ষ দূরের কেপলার-৪৫২বি তে যেতে পারছি না। গোল্ডিলক্স জোনে থাকার জন্যেই তো ওকে আমাদের এত পছন্দ?”
“শুধু তা-ই না, ভরও আমাদের কাছাকাছি।” বলে উঠলো ন্যানি।
“হ্যাঁ, ভর। পৃথিবীর ভরের কাছাকাছি ভর এটাও আমাদের ওখানে যাওয়ার একটা কারণ। যদি সমস্যা সমাধানে একটু ভিন্ন দিক থেকে তাকাই। কেমন হয়? পৃথিবী মারা যাচ্ছে খুব দ্রুতই। এটাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে বেশ শিগগীরই। অত দূর যখন যেতে পারছি না, তখন আশপাশে চোখ বুলাই। আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র আলফা সেন্টোরাই-ত্রয়। এদের মাঝে আলফা সেন্টোরাই বি কে ঘিরে ঘুরছে আলফা সেন্টারাই বি-বি। পৃথিবী থেকে মাত্র ১.১৩ গুণ বেশি ভরের।”
“কী বলছো এসব? জানো এর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা? ১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস!” বাগড়া দিলো গ্রুম।
“এটা কোনো স্কুলের ক্লাসরুম না, এটা নাসা! এখানে আসার আগে আলফা সেন্টোরাই বি-বি এর তাপমাত্রা আমাকে জেনে আসতে হয়েছে! আমি বলেছিলাম, কেউ যেন আমার কথার মাঝে ডিস্টার্ব না করে। এ-ই শেষ। এরপর আর কেউ একটা কথা বললেও আমি চুপ হয়ে যাবো। রুম ছেড়ে বেরিয়ে যাবো। আলফা সেন্টারাই বি-বি’র এই তাপমাত্রা কেন? কারণ, আসলে সে গোল্ডিলক্স জোনে নেই। থাকলে তার তাপমাত্রা আমাদের উপযোগী হতো। কিন্তু এই গ্রহটা সেই জোন থেকে অনেক অনেক কাছে, এমনকি বুধ সূর্যের যতটা কাছে তার চেয়েও বেশী কাছে আলফা সেন্টারাই বি-বি। নক্ষত্রের থেকে তার দূরত্ব মাত্র ৩৬ লাখ কিলোমিটার। গোল্ডিলক্স জোনে যেতে হলে একে অন্তত ৮১০ লাখ কিলোমিটার দূরে থাকতে হবে। এতটা দূর দিয়েই নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরপাক খেতে হবে। আমি কি বোঝাতে পারছি যে, আমি কী বলতে চাইছি?”
মুখ ফসকেই যেন ক্যারি বলে উঠলো, “মানে…?! কী বলছো!”
“হ্যাঁ, যা ধরেছো ঠিক তা-ই। প্রচণ্ড কোনো মহাজাগতিক বল তৈরিতে কাজ করতে হবে আমাদের। প্রচণ্ড। ভাবো একবার, যদি আমরা এই কাজ করতে পারি তাহলে মাত্র ৪.৩ আলোকবর্ষ দূরেই এই গ্রহ। এতটা পথ পাড়ি দিতে আমাদের এখনকার সর্বোচ্চ গতি সম্পন্ন যানের লাগবে মাত্র ১৬ বছরের মত। এই প্রচণ্ড বিশাল ধাক্কা গ্রহ আর নক্ষত্রের মাঝে কী প্রভাব ফেলবে, কীভাবে তাকে কাটানো যায় সেসব নিয়ে আমি অনেকটুকু কাজ গুছিয়েছি। চলো তোমাদের সেইসব দেখাই। কিছু হিসেব এখনো মিলছে না। আমি তো আর একা না, তোমরা তো আছোই। দেখি কী হয়…”
খানিকক্ষণের জন্য হা হয়ে গেল সকলে। মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে লাগলো সূর্যের পুরোটা প্ল্যান।
***
৪ বছর পরের একটি বিকেল। হাত ঘামছে সূর্যের। এই মাত্র তার আঙুলের আলতো স্পর্শে শুরু হয়ে যাবে অভূতপূর্ব মহাজাগতিক এক ধাক্কা। কী হবে এর পরিণতি! আদৌ কি তা সফল হবে, নাকি বুমেরাং হয়ে দেখা দেবে – তা নিয়েই শুধু অজস্র চিন্তার ঝড় চলছে মাথায়। অনেক পরীক্ষা হয়েছে ল্যাবে, বাইরে। সবই সফল। কিন্তু ল্যাব আর বাস্তব প্রয়োগের মাঝে যে কতটা ফারাক তা তো বিজ্ঞানী আর গবেষক মাত্রই জানে।
কে জানে, এই আলতো স্পর্শের মাঝে কী লুকিয়ে আছে! হাতের ঘামটা মুছে, টাচস্ক্রিনটা স্পর্শ করার জন্য এগিয়ে গেলো সূর্য।
এই গল্প কি আরো এগুবে নাকি এখানে শেষ?
গল্পের বাকিটা ঠিক করবেন পাঠক…
অসাধারন লিখেছেন পড়ে খুব ভাল লাগলো।অনেক অজানা তথ্য জানলাম।