মঙ্গলবাসী!
কেন এতো অনুমান, এতো কল্পনা, শুধু মঙ্গলকে ঘিরে? কেন শনিবাসী নয়? বা প্লুটোবাসী নয়? কারণ মঙ্গলকে প্রথম দেখাতে, অনেকটা পৃথিবীর মত মনে হয়। এটাই সবচে কাছের গ্রহ, এটার ভূ-পৃষ্ঠ আমরা দেখতে পাই। এখানে মেরুতে বরফ আছে, ভাসমান সাদা মেঘ আছে, উন্মত্ত ধূলিঝড়, ঋতু পরিবর্তন, এমনকি ২৪ ঘণ্টার দিনও আছে।
ধারণাটা আকর্ষণীয় যে, এটা একটা প্রাণসমৃদ্ধ গ্রহ। মঙ্গল পরিণত হয়েছে একটি পৌরাণিক ক্ষেত্রে…যেখানে আমরা আমাদের আশা ও ভয়কে সঞ্চারিত করেছি। সবচেয়ে সাড়া জাগানো ধারণাগুলো ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাই কেউ কেউ একদম উল্টো সুর গাইছেন। বলছেন যে, এই গ্রহ নিয়ে মাতামাতির কিছু নেই। তারা বলছেন, মঙ্গল থাকুক মঙ্গলের মত।
কিন্তু আসলে মঙ্গল গ্রহ কিন্তু এক বিস্ময়ের জগত। এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অনেক বেশি চমৎকার! আগে যা ভেবেছি, তার চেয়েও বেশি! আমাদের প্রজন্ম মঙ্গলের বালিতে পদচিহ্ন রেখেছে…আমাদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে…পূরণ করেছে অনেক শতাব্দীর স্বপ্ন।
এই কথাগুলো দিয়ে শুরু হয়েছিলো ১৯৮০ সালে কার্ল সেগানের কসমসের পঞ্চম এপিসোড Blues for a red planet. আর শেষ হয়েছিলো আমরাই মঙ্গলবাসী হবো একদিন, সেই কামনা ব্যক্ত করে। সেই স্বপ্ন এখন সত্যির পথে। এখন আমরা পরিকল্পনা করছি মঙ্গলে যাবো, সেখানে থাকবো। নাসার মার্স মিশন আছে, আবার Mars One তো ২০২৫ সালের মধ্যে মঙ্গলে প্রথম মানববসতি গড়ার ঘোষণা দিয়েছে। চিন্তা করা যায়, আর মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই কিন্তু! আজকের আলোচ্য মুভি The Martian এরকম নিকট ভবিষ্যতের গল্প বলে। অবশ্য এই সিনেমার গল্প আরেকটু দূরের। Mars One তো একমুখী যাত্রার কথা বলে। কিন্তু এই সিনেমাতে যাত্রীদেরকে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনাও আছে। কিন্তু চাইলেই কি সব পরিকল্পনা সফল হয়?
Ares 3 মিশন, মঙ্গলে অবস্থানরত ৬ জনের একটা টীম – যাদের মধ্যে দুইজন মিলিটারি (একজনের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা ভালো, আরেকজনের সামরিক টেকনিক্যাল জ্ঞান ভালো), একজন রসায়নবিদ, একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী, একজন যোগাযোগ ব্যবস্থায় দক্ষ, আরেকজন খুব সম্ভবত পদার্থবিদ। গবেষণা চলাকালে ভয়াবহ ঝড়ের মুখোমুখি হয়ে তাদেরকে মিশন ত্যাগ করে রওনা দিতে হয় পৃথিবীর দিকে। কিন্তু সেই ঝড়েই উদ্ভিদবিজ্ঞানীটি পেছনে রয়ে যায়। সবার ধারণা, সে মৃত। কিন্তু আসলে সেই উদ্ভিদবিজ্ঞানীটি আমাদের মঙ্গলবাসী, The Martian.
খুব জলদি হলেও পরবর্তী উদ্ধার মিশন আসতে আসতে লাগবে ৪ বছর। এদিকে এন্টেনা ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই, আর আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হচ্ছে – এতোদিনের খাবারও নেই। টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নভোচারী উদ্ভিদবিজ্ঞানী Mark Watney কে বেঁচে থাকতে হবে এমন এক গ্রহে যেখানে আর কোনো প্রাণ নেই। তাকে খাবার জন্মাতে হবে এমন এক গ্রহে, যেখানে কিছুই জন্মায় না।
মুভিটাকে স্পেস মুভি বলতে পারছি না, কারণ স্পেসের চেয়ে মঙ্গলেই প্রায় পুরো কাহিনীটুকু। অবশ্য মহাশূন্যের বেশ কিছু দৃশ্য আছে, আর সেই কারণে যদি এটাকে স্পেস মুভির জনরাতে ফেলতেই হয়, তাহলে এটাও বলবো – এখন পর্যন্ত বানানো সবচেয়ে চমৎকার স্পেস মুভিগুলোর মধ্যে The Martian অবশ্যই স্থান করে নেবে। এই সিনেমাটা বিজ্ঞান নিয়ে অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে মানুষদের ক্ষুধা যেমন মেটাবে, তেমনি বিজ্ঞানের চেয়ে মুভির কাহিনী আর আবেগের প্রতি আগ্রহী দর্শকের চাহিদাও পূরণ করবে এটা। আমি মোটামুটি দুই দলেই পড়ি। এবং বলতে বাধ্য হচ্ছি, এটার বিজ্ঞানকে যতটুকু সম্ভব নিখুঁত করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। আর এমনটাই প্রত্যাশিত, কারণ এটা যে বই থেকে নিয়ে বানানো হয়েছে, তার লেখক Andy Weir এর জন্ম পার্টিক্যাল ফিজিসিস্ট (কণা পদার্থবিদ) বাবা আর ইলেকট্রিক্যাল ইনজিনিয়ার মায়ের ঘরে। আর তিনি নিজে ১৫ বছর বয়স থেকে প্রফেশনালি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর কাজ করেছেন। অবশ্য উনি অনার্স গ্র্যাজুয়েশন করার আগেই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলেন। আর টেকনিক্যাল ডিটেইলসগুলো নিখুঁত হবার প্রধান কারণ হচ্ছে, মুভিটির পরামর্শদাতা ছিলো খোদ NASA.
এই মুভিটা যে শুধু ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছে তাই নয়, মঙ্গলে আমাদের অতীত যাত্রাগুলোকেও টান মেরে নিয়ে এসেছে। ট্রেলারে সবাই দেখেছেন যে মার্ক ওয়াটনি পৃথিবীতে নাসার সাথে যোগাযোগ করতে পারে শেষ পর্যন্ত, এবং সেজন্যেই তাকে উদ্ধারের জন্য মিশন পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু সে কিভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলো, জানেন? তার কমিউনিকেশন টাওয়ার তো ঝড়ে ভেঙ্গে গিয়েছিলো! এটুকু বলার লোভ সামলাতে পারছি না। তার হঠাৎ মনে পড়ে যে, অতীতে (১৯৯৭ সালে) নাসা একটা প্রোব পাঠিয়েছিলো মঙ্গলে; যেটার নাম ছিলো Pathfinder. আর সেটা এখন মঙ্গলের ধূলিবালির নিচে। সে গিয়ে সেটাকে উদ্ধার করে, এবং সেটার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে নিজের মেসেজ পাঠায় নাসাতে। মুভিতে দেখানো Pathfinder এর রেপ্লিকা বাস্তবের সাথে একদম হুবহু মিল!
এই Pathfinder টা দেখা মাত্র মনের ভেতরটা কেমন যে করে উঠলো। একসাথে কত রকম আবেগ যে মনের মধ্যে নাড়া দিয়ে গেলো। এটার মধ্যে একটা ল্যান্ডার ছিলো, যেটা মঙ্গলে গিয়ে নেমেছিলো, এরপর তিনদিক থেকে ঢাকনার মত খুলে গিয়ে ভেতরের rover টাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলো। এরপর rover টা ঘুরে ঘুরে বেশ কিছু গবেষণা করেছিলো। সেই ল্যান্ডিং এর জায়গাটাকে, মানে ল্যান্ডারটা যেখানে আছে, সেই জায়গার নাম রাখা হয়েছিলো আমার আদর্শের নামে – Carl Sagan Memorial Station. সেই pathfinder খোঁজার জন্য মার্ক ওয়াটনি গিয়েছিলো সেই মেমোরিয়াল স্টেশনে, বালির নিচ থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে বের করেছিলো জিনিসটাকে।
এই নিয়ে দুটো সিনেমাতে ভিনগ্রহে অভিনেতা Matt Damon কে রেখে আসা হলো ভিন্ন গ্রহে। আরেকটা নিশ্চয়ই দেখা আছে, Interstellar. বেশ মজার ব্যাপার! দুটো সিনেমার মধ্যে তুলনা করতে গেলে বলতে হয়, এটার সায়েন্স আরো কম জটিল, কিন্তু আরো বেশি পাকাপোক্ত, কারণ এটা এমন বিষয় নিয়ে কাজ করেছে যার ব্যাপারে আসলে আমরা অনেক কিছুই জানি। অভিনেত্রী Jessica Chastain, তিনিও ইন্টারস্টেলারে ছিলেন, কিন্তু বেচারিকে ওখানে স্পেসস্যুট পরতে দেয়া হয়নি, এখানে সে একদম মিশন Ares 3 এর লিডার।
আর গ্র্যাভিটিতে যে অতিরিক্ত নাটকীয়তা নিয়ে আসা হয়েছিলো, এবং বেশ কিছু ভুলভাল বিজ্ঞানও দেখানো হয়েছিলো; দ্যা মার্শানে এমন কিছু নেই। ক্লাইম্যাক্স অবশ্যই খুবই চমৎকার, এবং সেটা কাহিনীর সাথে এমন সুন্দর করে মানিয়ে গেছে যে বলার মত না। মানে, ক্লাইম্যাক্স অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয়ার মত, এবং এমনটা হবার সম্ভাবনা মোটেও শূন্যের কাছাকাছি না। গ্র্যাভিটির ক্লাইম্যাক্স বাস্তবসম্মত না, এই মুভিতে বাস্তবসম্মত, এটুকুই বলতে চাইছি। মানে, এমনও মনে হচ্ছিলো যে, এটার কাছাকাছি কোনো বাস্তব ঘটনা নিয়ে একসময় মুভি বানানো হতে পারে।
গ্রাফিক্স খুবই ভালো ছিলো। আর শ্যুটিং লোকেশনগুলোর নির্বাচন একদম পারফেক্ট, জর্ডানে গিয়ে শ্যুটিং করা হয়েছে অনেকটুকু। আমি একটা জিনিস বুঝতে পারলাম না – গ্রাভিটি আর ইন্টারস্টেলারের মত দ্যা মার্শানকে আইম্যাক্সে রিলিজ দেয়া হয়নি। এহেন ঘটনায় আমার বিশাল স্ক্রীনভক্ত মনে খুবই কষ্ট পেয়েছি। ভেবেছিলাম, সেরকম আইম্যাক্সের দানবীয় স্ক্রীনে মুখ হা করে মুভিটা দেখবো, হলো না। আর একটা কথা খুব বেশি বেজেছে মনে – আমি Hans Zimmer এর মিউজিক খুব মিস করেছি। তার মিউজিক থাকলে ভিন্ন একটা মাত্রা পেতো বলে হয়তো অনেকেরই মনে হবে।
এস্ট্রোফিজিসিস্ট নীল ডিগ্রাস টাইসন এই সিনেমাটা নিয়ে বেশ উত্তেজিত, উনি নিজেই একটা ট্রেলারে আসতে রাজি হয়েছেন যেখানে দেখানো হচ্ছে তিনি কিছুটা বুড়োটে (অর্থাৎ, ভবিষ্যতের কথা)। মানুষ মঙ্গলে গিয়েছে ইতোমধ্যে, এবং সামনে The Martian এর ঘটনাগুলো আসছে। চাঁদে গমনকারী দ্বিতীয় ব্যক্তি এডুইন অলড্রিন এই সিনেমা দেখে এসে টুইট করেছিলেন,
আর নীল টাইসন তো অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর টুইট দিয়েছেন,
Mars One মিশনের কথা প্রথম যখন জানতে পেরেছিলাম, তখনই এপ্লাই করার জন্য ওদের ওয়েবসাইটে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি, ওরা এখন এপ্লিকেশন নিচ্ছে না। আমার খুব ইচ্ছা, অন্য কোনো গ্রহে যদি পা রাখতে পারতাম! পৃথিবীর বাইরে আরো একটা গ্রহের অধিবাসী যদি হতে পারতাম! আমিও একজন Martian হতাম! হ্যাঁ, ওখানে অনেক কষ্ট হতো। অনেককে ছেড়ে দূরে থাকতে হতো, তবে ভবিষ্যত মানবপ্রজন্মের জন্য একটা আশা হয়ে রইতাম!
ইস, যদি যেতে পারতাম! Mark Watney এর মত মঙ্গলের এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতাম। ওর মত করে বলতাম, “যেখানেই পা ফেলি, সেখানে যাওয়া যে কোনো মানুষের মধ্যে আমিই প্রথম। কোনো পাহাড়ে চড়লে, আমিই সেই পাহাড়কে জয় করা প্রথম ব্যক্তি। যাই করি, তাতেই আমি প্রথম!”
কী যে অপেক্ষায় আছি এই মুভিটার জন্য! হলে গিয়ে দেখবো আর গা শিরশির করবে, এমনটাই আকাঙ্ক্ষা।
সুন্দর এই রিভিউ উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিলো।
আগামী সপ্তাহেই নাকি রিলিজ পাবে ব্লকবাস্টারে না জানি সিনেপ্লেক্সে। দেখিস।
চমৎকার রিভিউ । মুভিটা দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছি!
একদম প্রথম তিন লাইন পড়েই মনে হচ্ছিলো ব্লু ফর দ্য রেড প্ল্যানেট এর কথা। কত্তবার যে দেখেছি! পরে মনে পড়লো আপনিই তো কসমস সিরিজের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন 😀 (যদিও আমার বাংলা সাবটাইটেল দিয়ে দেখা হয়নি)
ট্রেইলার টা ভালোই লেগেছিলো। বেশ ভালো গ্রাফিক্স। বাট এতো ডিটেইল্ড ছিলো, মনে তো হলো পুরো কাহিনীই দেখিয়ে দিয়েছে :/ তাও দেখার জন্য ওয়েট করছি। বাংলাদেশে আসবে শুনে ভালো লাগলো 😀
মুভিটা আসলে অনেক ডিটেইল্ড। ট্রেলারে দেখানো হয়েছে, কী হয়েছিলো। আর সিনেমাতে দেখবেন, কিভাবে হয়েছিলো। শুনতে অন্যরকম লাগবে, কিন্তু এটা অনেকটা শিক্ষামূলক।
আমি মুভি দেখি খুবই কম। কিন্তু এইরকম একেকটা রিভিউ পড়ার পর মুভিটা না দেখে কি আর উপায় থাকে। বিজ্ঞানযাত্রার কল্যানে বেশ কিছু মুভি দেখা হয়।
মুভি দেখা তো ভালু। দেখেন না কেনু?