২০১৫ সালের ২ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম “ফেসবুক”-এর একটা গ্রুপ Journey to the Surface of the MARS, মঙ্গলের বুকে চলে বেড়ানো নাসার মহাকাশযান “কিউরিওসিটি” রোভারের তোলা একটা ছবি শেয়ার করে। ছবিটাকে জুম করলে কাঁকড়া সদৃশ একটা অবয়ব চোখে পড়ে। মনে হয়, যেন দানবাকার একটা কাঁকড়া গুহার ভেতরে ঢুকতে চাইছে। ছবিটি অন্যান্য মাধ্যমে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে যায়। এ থেকে অনেকেই মঙ্গল গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা পোষণ করতে শুরু করেন।
কিন্তু এই ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে ৩ আগস্ট টাইম ম্যাগাজিনে একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, কাঁকড়া টাঁকরা কিছু না। এটাকে বলে “Pareidolia”। এটি হল Apophenia-এর একটি রূপ। Apophenia-তে মানুষ মিল নাই, চেনাজানা নাই এমন সব তথ্য-উপাত্ত বা জিনিসের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা মিল বা যোগসূত্র বের করে (when people see patterns or connections in unconnected data)। আর আমাদের মস্তিষ্ক যখন এলোমেলো প্যাটার্ন থেকে পরিচিত আকার আকৃতি খুঁজে নেয়, বিশেষ করে চেহারা, তখন সেই অবস্থার গালভরা সাইকোলজিক্যাল টার্মই হল Pareidolia । এটি মানব মস্তিষ্কের খুবই স্বাভাবিক একটা প্রবণতা।
তবে এই ডিবাংকিং হয়তো মানুষের নজর তেমন একটা কাড়েনি। কারণ ৭, ৮ এবং ৯ আগস্ট দুনিয়া জুড়ে সব মিডিয়াতে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে পরিবেশন করা হয় আরেকটা খবর – মঙ্গল গ্রহে নারী সদৃশ অবয়ব! এই হেডলাইনের পর খবরের বডিতে চলেছে বিশেষ একটা ছবির ব্যবচ্ছেদ। ছবিটিতে নারীদেহের মতো একটা অবয়ব দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে সেটি কিউরিওসিটি নিয়ে তাকিয়ে আছে কিউরিওসিটি রোভারের দিকে।
এক ডিগ্রী সরেস হয়ে ভিনগ্রহের প্রাণী অনুসন্ধানী ওয়েবসাইট ‘ইউএফও সাইটিংস ডেইলি’ বলছে, তারা স্পষ্টতই নারী দেহ দেখেছে এবং এটি কোনো মূর্তিও নয় বরং জীবন্ত নারী। আর এটিকেই মঙ্গলে প্রাণের ‘প্রমাণ’ বলে দাবি করেছে তারা।
যারা একটু বেশি সন্দেহবাদী, তারা ‘ইউএফও সাইটিংস ডেইলি’-এর বয়ানে বিশ্বাস করেনি। তারা চিন্তা করেছে, দেহাকৃতির মতো দেখতে ওই বস্তুটি মঙ্গলেরই কোনো একটি কিছু বা প্রাচীন সভ্যতার কোনো মূর্তি, কিংবা কেবলই এক টুকরো পাথরও হতে পারে। তবে নিজেদের দাবি সমর্থন করে ‘ইউএফও সাইটিংস ডেইলি’ তাদের ওয়েবসাইট বলেছে, এটি প্রাচীন কোনো মূর্তি হলে এত ছোট আকৃতির এ মূর্তি এতদিনে সহজেই ক্ষয়ে যেত বা ধ্বংস হয়ে যেত। আর তাই এটি জীবন্ত কোনো মানুষ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাছাড়া, এটি দাঁড়িয়েও রয়েছে মহাকাশযানের দিকে মুখ করে, যেন কিছুটা দূর থেকে যানটিকে দেখছে সে।
কথা হল, আপনি কী ভাবছেন এসব নিয়ে? আপনি কি কিউরিওসিটি রোভারের পাঠানো ছবি দেখে বিশ্বাস করে বসেছেন, মঙ্গল গ্রহে এলিয়েনরা পিরামিড তৈরি করেছে? নাকি বিশ্বাস করছেন, সত্যিই সেখানে আছে পোকামাকড়ের ঘরবসতি আর রহস্যময় নারী?
I Fucking Love Science ওয়েবসাইটটিতে আগস্টের ১১ তারিখে বিস্তারিত পোস্ট দেয়া হয়েছে Pareidolia নিয়ে। কারণ এটাই সকল রহস্যের চাবিকাঠি। চলুন আমরাও দেখি কাহিনি আসলে কী!
যেখানে যে দৃশ্য বা ছবি দেখার কথা নয়, সেখানে সেটা দেখা মানুষের জন্য খুব কমন একটা ঘটনা। এ ধরণের উদাহরণ আশেপাশে প্রচুর দেখা যায়। যেমন, দুদিন পরপরই কেউ না কেউ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে শেয়ার করে সে মেঘের বুকে বা পাথরের গায়ে আল্লাহ্ লেখা দেখেছে। নিচে একটা গ্রিল্ড চীজের ছবি দেওয়া হল, যেখানে দেখা যাচ্ছে ভার্জিন মেরির মুখ!
এসব কেন হয়? হয় কারণ মানুষের মস্তিষ্কের একটা প্রবণতাই থাকে অগোছালো বা অস্বাভাবিক জিনিসপত্রের মধ্যে জানাশোনা জিনিসের অবয়ব খুঁজে বের করা। চীজের মধ্যে স্বাভাবিক একটা প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে, কিন্তু সেটাকেই মানুষ একটা নারীর মুখ বলে চিহ্নিত করেছে। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হতে পারে, ছোটবেলায় আমরা মেঘের বিভিন্ন আকৃতিকে যেভাবে হাতি, ঘোড়া মনে করতাম, সেটা। এটাই Pareidolia ।
নিচের ছবিটা দেখে আপনার কী মনে হচ্ছে বলুন তো?
সাধারণ একটা হ্যাঙ্গারকে আপনি অক্টোপাস মনে করছেন, তাই নয় কি? কিন্তু কেন আমরা Pareidolia-তে ভুগি, সেই কারণে যাওয়ার আগে চলুন Pareidolia শব্দটির উৎসের দিকে তাকাই। দুটো গ্রিক শব্দ para (যার অর্থ ‘ভুল’ বা ‘পরিবর্তে’) এবং eidōlon (অর্থ ‘ছবি’ বা ‘আকৃতি’) থেকে Pareidolia শব্দটি এসেছে। এই ঘটনাটি দর্শন এবং শ্রবণ – উভয় ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে।
Pareidolia ঘটে তখনই, যখন আমরা একটা শব্দ শোনার পর বা কিছু দেখার পর আমাদের মস্তিষ্ক সেই শব্দ বা কিছুমিছুর ভিতরে পরিচিত একটা প্যাটার্ন বা ফিগার খুঁজে বের করতে চেষ্টা করে। কিন্তু কেন? এই ‘কেন’-র উত্তর কার্ল সেগান তাঁর “The Demon-Haunted World – Science as a Candle in the Dark,” বইয়ে খুব সুন্দর করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রাচীনকালের মানুষরা অনেক দূর থেকে বা স্বল্প দৃষ্টিসীমার মধ্যে থেকেই তাদের জীবনের উপর হুমকিজনক পরিস্থিতি অনুমান করতে পারতো। বেঁচে থাকার জন্য এই ক্ষমতাটা তাদের দরকার ছিল। এই ক্ষমতাবলেই ঝোপের আড়ালে সিংহ আকৃতির কিছু দেখলে তারা খিঁচে দৌড় দিতো। যাদের এই ক্ষমতা ছিল, তারা দৌড়ে নিজের জীবন বাঁচাতে পারতো। কিন্তু যাদের এই ক্ষমতা ছিল না, বা যারা নিজেদের এই ক্ষমতা ব্যবহার করতো না, তারা মারা পড়তো।
ফলাফলস্বরূপ, এই উপকারী জীনটি আমাদের দেহে রয়ে যায়। সমস্যা হয় তখনই, যখন এই জীনের কারণে আমরা প্রয়োজন না থাকলেও বেজায়গায় পরিচিত দৃশ্য দেখা শুরু করি।
যা হোক, সেপ্টেম্বরের ১ তারিখে কিউরিওসিটি রোভার আবার মানবজাতির জন্য নিয়ে এলো মুখরোচক খাদ্য – “ভাসমান চামচ বা ফ্লোটিং স্পুন”-এর খবর। এবারও উৎসাহী মানব সম্প্রদায়ের কিছু অংশ ভেবে বসলো, মঙ্গল গ্রহের লুক্কায়িত অধিবাসীরা এসব চামচ ব্যবহার করতেন বা করেন।
UnmannedSpaceflight.com-এর সদস্যরা এই প্রতিকৃতি খুঁজে বের করার পর নাসা তাদের টুইটে বলেছে, এটা কোনো চামচ নয়। বাতাসের কারণে মঙ্গলের পাথর ক্ষয়ে এমন আকারে পরিণত হয়েছে। আর অবশ্যই এটা Pareidolia-র আরেকটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ!
আরও দুটো ছবি দেখুন, যেখানে মঙ্গলের একটা পাথরকে কীভাবে ইগুয়ানার ফসিল বানিয়ে গুজব ছড়ানো হয়েছে। গুজবটা ছড়িয়েছে ‘ইউএফও সাইটিংস ডেইলি’। এ থেকেই বুঝা যায়, মানুষকে ভুল পথে প্ররোচিত করতে ইন্টারনেট কতোটা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে!
এরপর পাওয়া গেলো চামচ আকৃতির আরেকটা বস্তু। ‘দা প্ল্যানেটারি সোসাইটি’-র Emily Lakdawalla ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, চামচের এই কারবার আসলে মঙ্গলের আবহাওয়ার কারণেই ঘটেছে। প্রচণ্ড শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে পাথর ক্ষয় হয়ে এমন আকৃতিতে আসা আশ্চর্যের কিছু নয়। আর কাছাকাছি আকৃতি দেখে মানুষের মস্তিষ্ক ভেবে বসেছে, এটা সত্যিকার অর্থেই একটা চামচ! অর্থাৎ এটাও কীসের উদাহরণ? হ্যাঁ পাঠক, Pareidolia ।
তো, গণহারে অদ্ভুত খবর বিশ্বাস করার আগে আমাদের উচিৎ ঘেঁটে দেখা, তথ্যের সত্যতা নিরূপণ করা। ইন্টারনেটে যেমন প্রচুর পরিমাণে পুরীষ পাওয়া যায়, তেমনি হীরে জহরতের ভাণ্ডারও কম নয়! পার্থক্য শুধু, কে কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন, সেটা।