পিথাগোরাসের দর্শন ছিলো পুরোপুরি গণিত নির্ভর। তিনি মনে করতেন, প্রকৃতির মধ্যে এক চমৎকার গাণিতিক সুষমতা বিদ্যমান এবং বিজ্ঞানীদের কাজ প্রকৃতির এই গাণিতিক সুষমতাকে খুঁজে বের করা। পরবর্তী বহু বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের উপর পিথাগোরাসের এই প্রভাব ছিলো যথেষ্ট লক্ষ্য করার মতো। টিটিয়াস এবং বোড ছিলেন তেমনই দুজন ব্যক্তিত্ব এবং তাঁরা সৌরজগতে গাণিতিক সুষমতার যে চমৎকার উদাহরণটি পেশ করেন তার নাম টিটিয়াস-বোড এর নীতি। এটি মূলত সূর্য থেকে সৌরজগতের গ্রহগুলোর দূরত্বের এক গাণিতিক সুসামঞ্জস্যতাকে নির্দেশ করে।
জার্মান পদার্থবিদ টিটিয়াস ১৭৬৬ সালে বললেন, সৌরজগতের গ্রহগুলো সূর্য হতে দূরত্বের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ গাণিতিক নিয়ম মেনে চলে। ১৭৭২ সালে জার্মান জ্যোতির্বিদ ও বার্লিন মান মন্দিরের তৎকালীন পরিচালক ইলারট বোড টিটিয়াসের এই আবিষ্কারকে আরো বিস্তৃতরুপে প্রকাশ করেন। এরপর থেকে সূত্রটিকে অনেক সময় বোড এর সূত্রও বলা হয়ে থাকে। সূত্রটির গাণিতিক প্রকাশ অনেকটা এরকম
[(৩ × ২n-২) + ৪]/১০
এখানে n, সূর্য হতে গ্রহগুলোর ক্রমানুসারিক সংখ্যাকে নির্দেশ করছে, যেমন বুধের ক্ষেত্রে n = ১, শুক্রের ক্ষেত্রে n = ২, পৃথিবীর ক্ষেত্রে n = ৩ ইত্যাদি। উপরের গাণিতিক রাশিটি প্রয়োগ করে বুধ থেকে শনি পর্যন্ত গ্রহগুলোর যে দূরত্ব পাওয়া যায় (অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিটে; সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বকে ১ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিটে ধরা হয় এবং এর মান ১৪৯,৫৯৭,৮৭০,৭০০ মিটার ) সেগুলো নিচে দেয়া হলো। তুলনা করার সুবিধার্থে একেবারে ডান কলামে গ্রহগুলোর প্রকৃত দূরত্বও উল্লেখ করা হলো।
গ্রহ |
n |
টিটিয়াস বোড দূরত্ব (অ্যাঃ ইউনিট) |
প্রকৃত দূরত্ব (অ্যাঃ ইউনিট)
|
বুধ | ১ | ০.৪ | ০.৩৯ |
শুক্র | ২ | ০.৭ | ০.৭২ |
পৃথিবী | ৩ | ১ | ১ |
মঙ্গল | ৪ | ১.৬ | ১.৫২ |
সেরেস | ৫ | ২.৮ | ২.৭৭ |
বৃহ¯পতি | ৬ | ৫.২ | ৫.২ |
শনি | ৭ | ১০ | ৯.৫৪ |
ইংরেজ জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হারশেল ইউরেনাস আবিষ্কার করেন ১৭৮১ সালে এবং দেখা গেলো এটাও টিটিয়াস-বোড এর সূত্রকে সমর্থন করে। টিটিয়াস-বোড এর সূত্র অনুসারে শনির পরে একটি গ্রহ সূর্য হতে ১৯.৬ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট দূরত্বে অবস্থান করবে এবং সেটা পাওয়াও গেলো ১৯.১৯ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট দূরত্বে। এই আবিষ্কারে টিটিয়াস-বোড এর সূত্রের উপর বিজ্ঞানীদের আস্থা বহুগুণে বেড়ে গেলো। তাঁরা চিন্তা করলেন, যদি বোড এর নীতি (টিটিয়াস-বোড এর নীতিকে অনেকসময় শুধু বোড এর নীতি বলা হয়) সঠিক হয়ে থাকে তবে n = ৫ এর জন্য মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝামাঝি ২.৮ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট দূরত্বে অবশ্যই একটি গ্রহ থাকতে হবে। ২.৭৭ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট দূরত্বে ১৮০১ সালে আবিষ্কৃত হলো গ্রহাণু সেরেস। ফলে বোড এর নীতিটি আবারও সঠিক প্রমাণিত হলো।
কিন্তু বাধ সাধলো সেরেসের আকার; মাত্র ৯৪০ কিলোমিটার; চাঁদের চারভাগের একভাগ মাত্র। সুতরাং, সেরেসকে কোনোভাবেই গ্রহ বলা যাচ্ছিলো না। সেরেস আবিষ্কারের অল্প কিছুদিনের মধ্যে কাছাকাছি পাওয়া গেলো আরো দুটি গ্রহাণু জুনো এবং ভেস্তা। একই অঞ্চলে ধীরে ধীরে আরো বহু গ্রহাণুর সন্ধান পাওয়া গেলো। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন এই সকল গ্রহাণুগুলো একটি কক্ষপথকে দখল করে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে এবং সেই কক্ষপথটি বোডের সূত্র অনুযায়ী সূর্য থেকে সঠিক দূরত্বেই আছে। এখন মনে করা হয় এই গ্রহাণু বলয়টি তৈরি হয়েছিলো সৌরজগত সৃষ্টির সময়েই। বৃহস্পতির তীব্র মহাকর্ষীয় বলের কারণে যেটুকু পদার্থ একটি একক পূর্ণাঙ্গ গ্রহ সৃষ্টিতে অংশগ্রহণ করতে পারেনি, সেগুলো দিয়েই এই বলয় তৈরি। এই কক্ষপথটিও গ্রহের কক্ষপথের ন্যায় কাজ করে, তবে এখানে একক কোনো গ্রহের পরিবর্তে পাওয়া যায় অসংখ্য গ্রহাণু।
বোড সূত্রের সমালোচনা
সমস্যা দেখা দেয় নেপচুন আবিষ্কারের পর। দেখা গেলো সূর্য হতে নেপচুনের দূরত্ব ৩০.৭ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট যদিও বোড এর সূত্রানুসারে এটাকে পাওয়ার কথা ছিলো ৩৮.৮ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট দূরত্বে। আবার যখন প্লুটো (এখন বামন গ্রহ) আবিষ্কার হলো তখন এর দূরত্ব পাওয়া গেলো ৩৯.৪৬ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট, অথচ বোড এর সূত্রানুসারে এই দূরত্ব হওয়া উচিত ছিলো ৭৭.২ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট, যেটা এক বিশাল অসঙ্গতিকেই নির্দেশ করছে। এই দুটি বস্তু আবিষ্কারের পর বোড এর সূত্রের যথার্থতা নিতে প্রশ্ন উঠলো। অনেকে বললেন আগের গ্রহগুলোর দূরত্ব অনেকটা কাকতালীয়ভাবে বোড এর নীতির সাথে মিলে গিয়েছিলো, এর আসলে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
অনেকে আবার ইউরেনাসের পর বোড এর সূত্র কাজ না করার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিতে লাগলেন। এই সকল ব্যাখ্যার মধ্যে ছিলো সৌরজগত সৃষ্টির সময়কার কিছু অসামঞ্জস্যতা, গ্রহের উপর অন্য গ্রহগুলোর প্রভাব, গ্রহের ক্রমানুসারতায় অধিক ভরের দুই গ্রহ বৃহস্পতি ও শনির পর হঠাৎ করেই আবার দুটি অপেক্ষাকৃত ছোট গ্রহের আবির্ভাব ইত্যাদি। তবে মূল কারণ যা-ই হোক না কেন, বোড এর সূত্রটি প্রকৃতিতে গাণিতিক সুষমতার এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। টিটিয়াস বোড এর ভবিষ্যদ্বাণীকৃত দূরত্বের সাথে গ্রহগুলোর প্রকৃত দূরত্বের মধ্যেকার তুলনামূলক একটি লেখচিত্র নিম্নে প্রদত্ত হলো। চিত্রে দেখা যাচ্ছে, শেষের দুটি গ্রহ প্রকৃত দূরত্ব থেকে বিচ্যুতি প্রদর্শন করছে।